বারাণসী

আজ ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থান কাশী বা বারাণসী -র অবস্থান, ইতিহাস, ধর্মীয় অর্থনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল । খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে কোনাে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি ছিল না। ভারতে কোনাে অখণ্ড সর্বভারতীয় রাষ্ট্র এই সময় ছিল না। একটা অখণ্ড রাষ্ট্রের পরিবর্তে ছিল যােলটি রাজ্য বা যােড়শ মহাজনপদ।

ষোড়শ মহাজনপদ:- যেমন – কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বৃজি, মল্ল, চেদি, বৎস্য, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, শূরসেন, অশ্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ

কাশী বা বারাণসী

প্রাচীন পরিচিতিউল্লেখযোগ্য ষোড়শ মহাজনপদ
বর্তমান পরিচিতিমহানগর
অবস্থানউত্তর প্রদেশের বারাণসী জেলা
আয়তন১১২.১০ বর্গকিমি
কাশী বা বারাণসী

ভূমিকা :- বারাণসী হল ভারত -এর উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসী জেলার একটি শহর। শহরটি স্থানীয়ভাবে বেনারস নামে এবং বাঙালিদের কাছে কাশী নামে অধিক পরিচিত। শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।

কাশী বা বারাণসীর অবস্থান

উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউ শহরের থেকে কাশী বা বারাণসী শহরের দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার (২০০ মা)।

প্রাচীন যুগে কাশী বা বারাণসী

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের ষোড়শ মহাজনপদ গুলির মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী মহাজনপদ ছিল কাশী।

সপ্তপুরীর অন্যতম হল কাশী বা বারাণসী

হিন্দুধর্ম ও জৈন ধর্ম -এর সাতটি পবিত্রতম শহরের (“সপ্তপুরী”) একটি হল বারাণসী। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্ম -এর বিকাশেও বারাণসী শহরের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

হিন্দুদের বিশ্বাস

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বারাণসীতে মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করেন। বারাণসী ভারত তথা বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির অন্যতম।

ভারতের আধ্যাত্মিক রাজ্য কাশী বা বারাণসী

কাশী বা বারাণসী ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী নামেও পরিচিত।

মহম্মদ ঘোরির আক্রমণ

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মহম্মদ ঘোরি বারাণসীর অনেক মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেছিলেন। এই শহরের মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্তমান রূপ পেয়েছে।

কাশী নরেশ

কাশীর মহারাজা, যিনি “কাশী নরেশ” নামে পরিচিত বারাণসীর প্রধান সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বারাণসীর সব ধর্মীয় উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তিনি।

গঙ্গা নদী

গঙ্গা নদীর সঙ্গে বারাণসীর সংস্কৃতির বিশেষ যোগ আছে। বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে বারাণসী উত্তর ভারতের এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

প্রাচীনতম ইতিহাস

বারাণসীর ইতিহাস বিশ্বের অনেক প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন।

বারাণসী ঘরাণা

হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের বারাণসী ঘরানার উৎপত্তি এই শহরে। বারাণসী শহরে অনেক বিশিষ্ট ভারতীয় দার্শনিক, কবি, লেখক ও সংগীতজ্ঞ বাস করেছেন।

প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার

বারাণসীর কাছে সারনাথে গৌতম বুদ্ধ প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন।

তুলসীদাস

তুলসীদাসের রামচরিতমানস সহ একাধিক বিখ্যাত গ্রন্থ এই শহরে রচিত হয়েছিল। বারাণসীর সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দিরটিকে কবি তুলসীদাসের স্মরণে “তুলসীমানস মন্দির” বলা হয়।

আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়

বারাণসীর কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার প্রাচীনতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি।

বারাণসী শহরের অভিধা

বারাণসীকে “মন্দিরনগরী”, “ভারতের পবিত্র নগরী”, “ভারতের ধর্মীয় রাজধানী”, “আলোকনগরী”, “শিক্ষানগরী” ও “বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত নগরী”ও বলা হয়।

বারাণসী নামের ব্যুৎপত্তি

বারাণসী নামটি বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

  • (১) “বারাণসী” নামটি সম্ভবত দুটি নদীর নাম থেকে এসেছে – বরুণা (বারাণসীতে এখনও প্রবহমান) ও অসি (অসি ঘাটের কাছে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী) নদী। গঙ্গার উত্তর কূলে অবস্থিত বারাণসী শহরের সীমানা নির্দেশ করছে গঙ্গার এই দুটি উপনদী।
  • (২) অন্যমতে বারাণসী নামটি বরুণা নদীর নাম থেকেই এসেছে। কারণ, কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে এই নদীকেই বারাণসী নদী বলা হত। তবে এই মতটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
  • (৩) যুগে যুগে বারাণসী নানা নামে অভিহিত হয়েছে। যেমন  “কাশী” (বৌদ্ধযুগের তীর্থযাত্রীরা বারাণসীকে এই নামে অভিহিত করতেন, এখনও করেন), “কাশিকা” (উজ্জ্বল), “অবিমুক্ত” (শিব যে স্থান “কখনও ছাড়েন না”), “আনন্দবন” ও “রূদ্রবাস” (রূদ্রের নিবাস)।
  • (৪) ঋগ্বেদ-এ এই শহরকে “কাশী” নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই গ্রন্থে কাশীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে।
  • (৫) কাশী নামটির উল্লেখ স্কন্দ পুরাণেও পাওয়া যায়। এই পুরাণের একটি শ্লোকে শিবের উক্তি রয়েছে, “তিন ভুবন আমার কাছে একটি মাত্র শহর, আর কাশী হল সেই শহরে আমার রাজপ্রাসাদ।”

প্রাচীন শহর বারাণসী শহরের প্রতিষ্ঠাতা

কিংবদন্তি অনুসারে, শিব বারাণসী শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পান্ডব ভ্রাতার বারাণসী আগমন

হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের নায়ক পাণ্ডব ভ্রাতারা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ -এ ভ্রাতৃহত্যা ও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ থেকে উদ্ধার পেতে শিবের খোঁজ করতে করতে এই শহরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।

মোক্ষ প্রদানকারী বারাণসী

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, যে সাতটি শহর মোক্ষ প্রদান করতে পারে, সেগুলির একটি হল বারাণসী।

পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ

বারাণসীতে যে সবচেয়ে পুরনো পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তার থেকে অনুমিত হয় যে,

  • (১) গাঙ্গেয় উপত্যকায় বারাণসী শহরে জনবসতি, বৈদিক ধর্ম ও দর্শন শিক্ষাকেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই জন্য বারাণসীকে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির একটি মনে করা হয়।
  • (২) এই পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায় যে, বৈদিক ধর্মাবলম্বী আর্যরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। যদিও প্রায় সমসাময়িককালে রচিত অথর্ববেদ থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলে আগে স্থানীয় উপজাতির মানুষেরা বসবাস করত।
  • (৩) সেই জাতির বসতির প্রমাণ কোনো পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

জৈন সংযোগ

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে বিদ্যমান ২৩তম জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ (প্রথম ইতিহাস-স্বীকৃত তীর্থঙ্কর) বারাণসীর অধিবাসী ছিলেন। পার্শ্বনাথের পর মহাবীর তীর্থঙ্কর হয়েছিলেন।

গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র

বারাণসী একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে ওঠে। মসলিন ও রেশমের বস্ত্র, সুগন্ধি দ্রব্য, হাতির দাঁতের কাজ ও ভাস্কর্য শিল্পের জন্য এই শহর  বিখ্যাত ছিল।

কাশী রাজ্যের রাজধানী

গৌতম বুদ্ধের সময় বারাণসী ছিল কাশী রাজ্যের রাজধানী। ৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বারাণসীর কাছে সারনাথে বুদ্ধদেব প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেন। এই ঘটনা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস “ধর্মচক্রপ্রবর্তন” নামে পরিচিত।

ফা হিয়েন

৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে চীন -এর পর্যটক ফা হিয়েন কাশী বা বারাণসী শহরে এসেছিলেন। তার রচনা থেকে এই শহরের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন গঙ্গার পশ্চিম তীরে ৫ কিলোমিটার (৩.১ মা) দীর্ঘ অঞ্চলে বারাণসী অবস্থিত ছিল।

হিউয়েন সাঙ

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাঙ বারাণসীতে এসেছিলেন। তিনি এই শহরকে “পোলোনিসি” নামে উল্লেখ করেন এবং লেখেন এই শহরে ৩০টি মন্দির ছিল ও প্রায় ৩০ জন সন্ন্যাসী ছিলেন।

ধর্মীয় গুরুত্ব বৃদ্ধি

অষ্টম শতাব্দীতে বারাণসীর ধর্মীয় গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই সময় আদি শঙ্কর শিব উপাসকদের বারাণসীর প্রধান সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

মৌর্য অবদান

মৌর্য সাম্রাজ্য -এর যুগে তক্ষশীলা থেকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত প্রসারিত একটি রাস্তা বারাণসীকে দুই শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।

কুতুবউদ্দিন আইবকের আক্রমণ

১১৯৪ সালে তুর্কি মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক বারাণসী জয় করেন। তিনি এই শহরের প্রায় এক হাজার মন্দির ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন। মুসলমান রাজত্বে এই শহরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়েছিল।

নতুন মন্দির নির্মাণ

আফগান অনুপ্রবেশের পর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কিছু নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

ফিরোজ শাহর নিষ্ঠুর আচরণ

১৩৭৬ সালে ফিরোজ শাহ বারাণসী অঞ্চলের কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন।

সিকান্দার লোদি

১৪৯৬ সালে আফগান শাসক সিকন্দর লোদি বারাণসী শহরের হিন্দুদের প্রতি দমনপীড়ন নীতি বজায় রেখে অবশিষ্ট মন্দিরগুলির অধিকাংশই ধ্বংস করে দেন।

সংস্কৃতির কেন্দ্র

মুসলমান শাসনের অবদমনের পরেও মধ্যযুগে বারাণসী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে তার খ্যাতি হারায়নি। এর ফলে ধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে এই শহরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

ভক্তিবাদী সন্তগণ

ভক্তিবাদী আন্দোলনের বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

  • (১) ভক্তিবাদী সন্তদের অন্যতম কবীর ১৩৯৮ সালে  বারাণসী শহরেজন্মগ্রহণ করেছিলেন। কবীরকে “পঞ্চদশ শতাব্দীর ভারতের শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী সন্ত কবি ও অতিন্দ্রীয়বাদী” বলা হয়।
  • (২) রবিদাস ছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীরই এক ভক্তিবাদী ধর্মসংস্কারক, অতিন্দ্রীয়বাদী, কবি, পর্যটক ও ধর্মগুরু। তিনি বারাণসীতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই শহরের এক চামড়ার কারখানায় তিনি কাজ করতেন।

গুরু নানকের বারাণসী সফর

ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার বহু বিশিষ্ট পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক বারাণসীতে এসেছিলেন। ১৫০৭ সালের শিবরাত্রি উৎসবের সময় গুরু নানক এই শহরে আসেন। তার এই বারাণসী সফর শিখধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

আকবরের অবদান

ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘম সম্রাট আকবরের সময়কাল ছিল বারাণসীর সাংস্কৃতিক নবজাগরণ -এর যুগ।

  • (১) আকবর শহরটি সাজিয়ে তোলেন। তিনি এই শহরে শিব ও বিষ্ণুর দুটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন।
  • (২) এই যুগেই ২০০ মিটার (৬৬০ ফু) দীর্ঘ আকবরি সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হয়।

শেরশাহের অবদান

শেরশাহ -এর আমলে কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত রাস্তা নির্মিত হলে বারাণসী অঞ্চলের পরিবহন পরিকাঠামোরও উন্নতি ঘটেছিল। এই রাস্তাটিই ব্রিটিশ যুগে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত হয়।

আধুনিক বারাণসী

আধুনিক বারাণসীর বেশিরভাগটাই রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের হাতে তৈরি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলির বেশিরভাগই বর্তমান রূপ পায়।

ব্রিটিশ যুগে কাশী বা বারাণসী

ব্রিটিশ যুগে (১৭৭৫-১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) কাশীর রাজাই এখানকার মুখ্য শাসক হয়ে ওঠেন। ১৭৩৭ সালে মুঘল সম্রাট কাশী রাজ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাশীর রাজবংশ বারাণসী শাসন করেছিল।

সংস্কৃত কলেজ স্থাপন

১৭৯১ সালে ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ও জোনাথান ডানকান কাশী বা বারাণসী শহরে একটি সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।

ভারত প্রেমিক টোয়েইন

১৮৯৭ সালে বিশিষ্ট ভারতপ্রেমিক সাহিত্যিক মার্ক টোয়েইন বারাণসী দেখে লেখেন, “বারাণসী ইতিহাসের চেয়েও পুরনো, ঐতিহ্যের চেয়েও পুরনো, এমনকি কিংবদন্তির চেয়েও পুরনো। সব কিছুকে একত্রিক করলে যা দাঁড়ায় তার চেয়েও দ্বিগুণ পুরনো।”

কাশী বিশ্ববিদ্যালয়

থিওসফিক্যাল সোসাইটির প্রচারে অ্যানি বেসান্ত কাশী শহরে এসেছিলেন। তিনি এখানে সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৯১৬ সালে এই কলেজটি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

ভারত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত কাশী

১৯৪৮ সালের ১৫ অক্টোবর কাশী ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বারাণসীর ১৯টি স্থাপনাকে জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা বলে চিহ্নিত করেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে সারনাথ, লাল খানের সমাধি, ধারাহরা মসজিদ, মানসিংহের মানমন্দির, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ইত্যাদি। বারাণসীর আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরগুলি হল যন্তরমন্তর, সারনাথ সংগ্রহালয়, ভারত কলা ভবন ও রামনগর দূর্গ।

চলচ্চিত্র শুটিং

রামনগর দুর্গ থেকে গঙ্গার সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় বলে, এখানে চলচ্চিত্রের শ্যুটিং-ও হয়ে থাকে। বানারস সহ অনেক জনপ্রিয় ছবির শ্যুটিং এখানে হয়েছিল।

গঙ্গার ঘাট

বারাণসীর গঙ্গার ঘাটগুলি হিন্দুদের ধর্মীয় জীবন ও ধর্মচর্চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। প্রতিটি ঘাটকেই পবিত্র মনে করা হয়। বারাণসীতে প্রায় ৮৪টি ঘাট আছে। এই ঘাটগুলির মধ্যে দশাশ্বমেধ ঘাট, মনিকর্ণিকা ঘাট, পঞ্চাঙ্গ ঘাট ও হরিশ্চন্দ্র ঘাট (শ্মশান) বিখ্যাত।

কাশীর মন্দির

বারাণসীতে প্রায় ২৩০০০ মন্দির আছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির ও দুর্গামন্দির।  দুর্গামন্দিরটি নিকটবর্তী গাছের বাঁদরগুলির জন্য বিখ্যাত।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দির

গঙ্গার তীরে অবস্থিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কাশীর প্রধান দেবতা শিবের মন্দির। মন্দিরটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অন্যতম। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, অন্য এগারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনে যে ফল, সেই সম্মিলিত ফলের চেয়েও বেশি পুণ্যার্জন করা যায় শুধুমাত্র কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করলে।

অহল্যাবাই নির্মিত মন্দির

বর্তমান কাশী মন্দিরটিকে বলা হয় স্বর্ণমন্দির। ১৭৮০ সালে ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকর এই মন্দিরটি নির্মাণ করান।

বারাণসীতে মহাত্মা গান্ধী

১৯৩৬ সালে বারাণসীতে মহাত্মা গান্ধী ভারতমাতা মন্দিরের উদ্বোধন করেন। এই মন্দিরে শ্বেতপাথরের উপর ভারতের মানচিত্র খোদাই করা আছে।

কাশীর মসজিদ

বারাণসীর বিখ্যাত মসজিদগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জ্ঞানবাপি মসজিদ, আলমগিরি মসজিদ, গঞ্জ-এ-শহিদান মসজিদ ও চৌখাম্বা মসজিদ।

শিল্পকেন্দ্র কাশী

বারাণসী একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র। এখানকার রেশম ও সোনা-রুপোর কাজ করা ব্রোকেড, কার্পেট বুননশিল্প, কাঠের খেলনা, কাচের চুড়ি, হাতির দাঁতের কাজ, সুগন্ধি দ্রব্য, শিল্পগুণসম্মত পিতল ও তামার বাসনপত্র বিখ্যাত।

হিন্দুধর্ম

বারাণসী হিন্দুদের সব সম্প্রদায়ের কাছেই একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এই শহর হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। হিন্দুদের যে সাতটি শহর মোক্ষ প্রদানে সক্ষম (“সপ্তপুরী”), তার একটি হল বারাণসী।

কাশীর বিশালাক্ষী মন্দির

বারাণসী শহরের বিশালাক্ষী মন্দিরে সতীর কানের দুল পড়েছিল বলে মনে করা হয়। শাক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ তাই এই শহরে তীর্থযাত্রায় আসেন।

হিন্দু ধর্মের নবজাগরণ

আদি শঙ্কর এখানে বসেই তার বিখ্যাত টীকাগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন। ফলে হিন্দুধর্মে নবজাগরণ আসে।

ইসলাম ধর্ম

এক লক্ষ হিন্দুর পাশাপাশি আড়াই হাজার মুসলমানেরও বাসস্থান বারাণসী। মুসলমান সম্প্রদায় বারাণসীতে প্রায় এক হাজার বছর ধরে বাস করছে।

বৌদ্ধস্তূপ

বারাণসীর ধামেক স্তুপ মৌর্য সম্রাট অশোক -এর পূর্ব যুগের স্তুপ। তবে এই স্তুপের ভিত্তি অংশটিই এখন অবশিষ্ট আছে।

জৈনধর্ম

হিন্দু ও বৌদ্ধদের পাশাপাশি বারাণসী জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছেও একটি তীর্থ। জৈন বিশ্বাস অনুসারে, সুপার্শ্বনাথ, শ্রেয়াংশনাথ ও পার্শ্বনাথ এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বারাণসীর ভেলপুরে শ্রীপার্শ্বনাথ দিগম্বর জৈন তীর্থক্ষেত্র (মন্দির) অবস্থিত। এটি জৈনদের একটি প্রধান মন্দির।

রামলীলা অনুষ্ঠান

কাশীর রাজা উদিতনারায়ণ সিংহ ১৯৩০ সাল নাগাদ রামলীলা অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে রামলীলা নামে লোকনাট্যের আয়োজন করা হয়। ৩১ দিন ধরে সন্ধ্যায় এই নাটক হয়।

সংগীত

বারাণসীর সংগীতের সঙ্গে পৌরাণিক কিংবদন্তিগুলির যোগ পাওয়া যায়।

  • (১) কথিত আছে কাশীর প্রতিষ্ঠাতা শিব সংগীত ও নৃত্যের জনক।
  • (২) মধ্যযুগে বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের যুগে কাশীতে ভক্তিবাদী সংগীতের উদ্ভব ঘটে। সুরদাস, কবীর, রাইদাস, মীরা ও তুলসীদাস প্রমুখ ভক্তিবাদী কবিরা বারাণসীতে বাস করেছেন।
  • (৩) ষোড়শ শতাব্দীতে গোবিন্দ চন্দ্রের রাজত্বকালে শাস্ত্রীয় সংগীতের দ্রুপদ ধারাটি রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। এই সময় বারাণসীতে ধামার, হোরি ও চতুরঙ্গ ধারার উদ্ভব হয়েছিল।
  • (৪) বর্তমানকালের বিশিষ্ট ঠুমরি গায়িকা গিরিজা দেবী বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন।

বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী

কণ্ঠসংগীত ছাড়াও বিশিষ্ট সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ও বিশিষ্ট সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শংকর বারাণসীর বাসিন্দা ছিলেন। এঁরা দুজনেই ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন পেয়েছিলেন।

উপসংহার :- প্রাচীন যুগের বিখ্যাত ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম কাশী রাজ্য বর্তমানে বিখ্যাত হিন্দু তীর্থক্ষেত্র বারাণসী রূপে বিরাজ করছে।

(FAQ) ‘বারাণসী’ হতে জিজ্ঞাস্য ?

১. বারাণসী কোথায় অবস্থিত ?

উত্তর প্রদেশে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।

২. কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কোথায় অবস্থিত ?

উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত।

৩. কাশীর বিখ্যাত শ্মশানঘাট কোনটি ?

মণিকর্ণিকা শ্মশানঘাট।

Leave a Reply

Translate »