দেবী সতী প্রসঙ্গে পাগল ভোলার সেবায় ধন্য সতী, আপন ভোলা সতী পতি মহাদেব, সতীর পিতা কর্তৃক মহাদেবের অপমান, মহাদেবের অপমানে সতীর পিতার বিপদ, দক্ষযজ্ঞের আয়োজন, দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর পিতৃগৃহে যাবার মনোবাসনা, নিরাভরণা সতীর উপহাস, পিতার নিকট সতীর অপমান ও সতীর দেহ ত্যাগ সম্পর্কে জানবো।
দক্ষরাজের কন্যা দেবী সতী প্রসঙ্গে সতী দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া, দাক্ষায়ণী বা সতী, হিন্দুধর্মে বৈবাহিক সুখ ও দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের দেবী সতী, স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় হিন্দু নারীদের সতীর পূজা, শিব পত্নী সতী ও সতীর দেহ ত্যাগ সম্পর্কে জানব।
দেবী সতী
ঐতিহাসিক চরিত্র | সতী |
পরিচিতি | শিব পত্নী |
পিতা | দক্ষরাজ |
দেহত্যাগ | যজ্ঞের আগুন |
ভূমিকা :- সতীত্বের পূর্ণাবতার ‘সতী’ ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি দক্ষের কনিষ্ঠা কন্যা। শৈশব থেকে অত্যন্ত সংযমী হয়ে সাধনা করে দেবাদিদেব মহাদেবকে পতিরূপে লাভ করেন।
পাগল ভোলার সেবায় ধন্য সতী
পাগলভোলা শ্মশানে-মশানে ফেরেন, ছাইভস্ম মাখেন, আপনার ধ্যানে সদাই বিভোর। রাজার নন্দিনী সতী তারই মত পাগলিনী সেজে, সেই পাগল ভোলার সেবা করে ধন্য হন। জগতের ঐশ্বর্য্য উভয়ের নিকট সমানই তুচ্ছ।
মহাযজ্ঞের আয়োজন
কিছুদিন পরে দেবতাদের এক যজ্ঞ হল, তাতে সমস্ত দেবতাই উপস্থিত হলেন। বড় বড় দেবতার মধ্যে অনেকেই দক্ষের জামাতা। দক্ষ যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হওয়া মাত্রই সকলে তাকে প্রণাম করলেন পিতা ব্রহ্মা ও বিষ্ণু ছাড়া।
আপন ভোলা সতী পতি মহাদেব
সতীর প্রেমে ভোলা পরমযোগী মহাদেব ছাইভস্ম মেখে, সিদ্ধিপানে বিভোর হয়ে সভার একপার্শ্বে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসেছিলেন। সম্মান পাবার আশায় দক্ষ তাঁর নিকট উপস্থিত হলে তিনি কেবলমাত্র দক্ষের দিকে চেয়ে দেখলেন। অন্য দেবতার মত, জামাতার মত, কোনরূপ সম্মান দেখালেন না।
মহাদেবের প্রতি সতীর পিতা দক্ষের তিরস্কার
এতে দাম্ভিক দক্ষ নিজেকে অপমানিত মনে করে মহাদেবের উপর ক্রুদ্ধ হলেন ও এইরূপ ব্যবহারের জন্য তাঁকে অজস্র গালি দিলেন। আশুতোষের কোনদিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই, দক্ষের এই তিরস্কারে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
সতীর পিতা কর্তৃক মহাদেবের অপমান
দক্ষ এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। তিনি স্বয়ং এক যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। তাতে সমস্ত দেবতাদের নিমন্ত্রণ করলেন তার অপমানকারী কনিষ্ঠ জামাতা দেবাদিদেব মহাদেবকে ছাড়া। মনে ভাবলেন এতে তাঁকে বিলক্ষণ অপমান করা হল।
মহাদেবের অপমানে সতীর পিতার বিপদ
পিতা ব্রহ্মার নিত্য-পূজ্য, জগতের সংহার কৰ্ত্তা মহাদেবের প্রতিহিংসায় আজ তিনি অন্ধ। তিনি প্রকৃতই অন্ধ, তিনি না বুঝিয়া নিজের বিপদ ডাকিয়া আনিলেন।
সতীর দক্ষযজ্ঞে নিমন্ত্রণ নেই
দক্ষযজ্ঞে একে একে সমস্ত দেবতাই এলেন। দক্ষের অন্যান্য কন্যারা সকলেই এলেন। বাকি রইলেন কেবল সতী। সতীর নিমন্ত্রণ হয় নি, কেননা তিনি মহাদেবের পত্নী।
দক্ষযজ্ঞের নিমন্ত্রণের ভার
নিমন্ত্রণের ভার নারদের উপর পড়েছিল। তিনি সকলকেই নিমন্ত্রণ করে শেষে কৈলাসে উপস্থিত হলেন। সতীর সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, “তোমার পিতা যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন, সকলেরই নিমন্ত্রণ হইয়াছে, কেবল তোমাদেরই হইবে না”।
মহাসমস্যায় সতী
সতী মহাসমস্যায় পড়লেন। একদিকে জন্মদাতা পিতা, অন্যদিকে তাঁর একমাত্র আরাধ্যদেবতা স্বামী। যদিও সতী স্বামীর আজ্ঞা ভিন্ন কোনো কৰ্ম্মই করবেন না, তথাপি তিনি স্থির জানেন ‘শিব’ তার স্বামী, আশুতোষ কখনই তাঁর পিতার এই অপমান গ্রহণ করবেন না।
সতী কর্তৃক পিতাকে বুঝানোর তাগিদ
তাঁর পিতা শিবনিন্দা করে আপনার সর্ব্বনাশ ডেকে আনছেন, এখন যদি তাকে বুঝিয়ে শিবের প্রতি বিদ্বেষভাব ত্যাগ করাতে পারেন তাহলে নিশ্চয় কন্যার উপযুক্ত কাৰ্য্য করা হবে।
দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর পিতৃগৃহে যাবার মনোবাসনা
এই ভেবে তিনি অপমান সত্ত্বেও পিতৃগৃহে যাবার জন্য স্বামীর আদেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। অন্যান্য ভগ্নীরা সকলে এসেছেন শুনে তিনি একান্ত অস্থির হয়ে পড়লেন এবং করজোড়ে ভোলানাথের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রেমের সাগর ভোলানাথ সতীর মনোবাসনা বুঝতে পেরে, তাকে নিবারণ করলেন না।
পিতৃগৃহে সতীর আগমন
নন্দী মাতাকে নিয়ে দক্ষালয়ে এল। সতীর মাতা সতীকে পেয়ে আহ্লাদসাগরে মগ্ন হলেন, সতীও অনেক দিন পরে মাকে দেখে আনন্দিতা হলেন। সতীর অন্যান্য ভগ্নীদের বড় বড় দেবতাদের সাথে বিবাহ হয়েছে, তাদের বেশভূষার সীমা নেই।
নিরাভরণা সতীর উপহাস
সতীকে নিরাভরণা দেখে সকলে উপহাস করে বলতে লাগলেন, “সতীর মত হতভাগিনী আর নাই, এক ভিখারীর হাতে পড়িয়া সতীর কোনো সাধই মিটিল না।”
সমস্ত ঐশ্বর্য্যের সৃষ্টিকর্তা মহাদেব ও সতী
কিন্তু তাঁরা জানতেন না যে জগতের সমস্ত ঐশ্বর্য্য সেই সতীর ও তাঁর ভিখারী স্বামীরই সৃষ্ট। যারা ঐশ্বর্য্য সকলকে দেন, তাদের ঐশ্বর্য্যে স্পৃহা হবে কেন?
পিতার নিকট সতীর অপমান
সতী যজ্ঞসভা দেখতে চললেন। পিতাকে যথারীতি সম্মান দেখিয়ে তিনি তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। দক্ষ সতীকে দেখামাত্র ক্রোধে জ্বলে উঠলেন ও মহাদেবের উদ্দেশ্যে যথেষ্ট কটুক্তি করলেন। বিনা নিমন্ত্রণে আসবার জন্য সতীকেও বিলক্ষণ অপমানিত হতে হল।
দক্ষের অপমানে সতীর উত্তর
পিতার এই দুর্ব্বদ্ধি দেখে সতী পিতাকে যথেষ্ট বুঝালেন। বললেন “আমার স্বামী আপনার কোনো অনিষ্টই করেন নাই। বিনা নিমন্ত্রণে আসিয়াছি আমি, আপনি আমাকেই তিরস্কার করুন। স্বামী স্ত্রীলোকের একমাত্র দেবতা, আমার সম্মুখে আপনি তাহার নিন্দা করিবেন না”।
সতীর দেহত্যাগ
সতীর কথায় আরও অধিক রাগান্বিত হলেন এবং শিবকে আরও অধিক দুর্বাক্য বলতে লাগলেন। সতী অস্থির হলেন, দক্ষের দুর্বাক্যের স্রোত অধিকতর বেগে চলতে লাগল। সতী কেঁপে উঠলেন, স্বামীনিন্দা আর সহ্য করতে পারলেন না, ভোলানাথের অভয়পদ ভাবতে ভাবতে সতী দেহত্যাগ করলেন, দক্ষ তিলমাত্র বিচলিত হলেন না।
নন্দী কর্তৃক সতীর দেহত্যাগের খবর প্রদান
নন্দী নিকটেই ছিল। মায়ের দেহত্যাগে আর স্থির থাকতে না পেরে উন্মত্তের মত কৈলাসে ছুটে গিয়ে মহাদেবের নিকট সব বলল।
সতীর দেহত্যাগে শিবের সংহার মূর্তি
সর্বদর্শী মহাদেবের কিছুই অগোচর ছিল না, সতীশোকে তিনি অধীর হলেন। উন্মত্তের মত হা সতি! হা সতি! বলে চীৎকার করতে লাগলেন। মুহূর্তে সংহারমূর্তি ধরলেন। সমস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠল, দেবতারা প্রমাদ গণলেন।
বীরভদ্র কর্তৃক সতীর পিতার যজ্ঞ ভণ্ড
মহাদেব মস্তকের একগাছি জটা ছিঁড়ে মাটিতে আঘাত করলেন। সহসা সংহারমূর্তি বীরভদ্রের সৃষ্টি হল। বীরভদ্র তৎক্ষণাৎ যজ্ঞের দিকে ছুটলেন, অনুচরেরাও সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। মুহূর্তে যজ্ঞসভা লণ্ডভণ্ড হল, যে যেদিকে পারল পালাল, অনেকের দুর্দ্দশার সীমা থাকল না। শিবহীন যজ্ঞ এইরূপে শেষ হল।
সতীশোকে উন্মাদ মহাদেব
মহাদেব উন্মাদের মত যজ্ঞস্থলে এসে দেখলেন তাঁরই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করে ছিন্ন লতার মত ভূতলে পড়ে আছেন। তিনি সেই শবদেহ স্কন্ধে তুলে নিলেন এবং উন্মাদের মত শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, জগতের কোনো চিন্তাই আর তাঁতে স্থান পেল না।
সতীর দেহের ৫২ অংশ
মহাদেব সতীর শব স্কন্ধে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগলেন। সংহারকর্তা সংহারকার্য ভুলে, জগতের চিন্তা ভুলে আজ সতীশোকে উন্মাদ। দেবতারা বড় চিন্তিত হলেন। সকলে মিলে ভগবান বিষ্ণুর নিকটে গিয়ে সমস্ত নিবেদন করলেন। বিষ্ণু দেখলেন সতীর শব তাঁর নিকট হতে পৃথক করতে না পারলে আর কোনও উপায় নেই, সুতরাং অলক্ষ্যে সুদর্শনচক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন। ৫২ অংশে বিভক্ত হয়ে সতীর দেহখানি ৫২ স্থানে পড়ল। প্রত্যেক স্থান মহাপীঠস্থানে পরিণত হয়েই আজ পর্যন্ত সকলের পূজিত হয়ে আসছে।
সতীর দেহ নিশ্চিহ্ন
মহাদেব যখন বুঝিতে পারিষলেন যে সতীর দেহ আর স্কন্ধের উপর নেই, তখন তিনি আরও অধীর হলেন, তাঁর আরও অধিক বৈরাগ্যভাব এল। শ্মশানে শ্মশানে আর ভ্রমণ না করে, তিনি হিমালয়ের এক প্রদেশে মহা তপস্যায় নিমগ্ন হলেন।
উপসংহার :- স্বয়ং তপস্যার ফলদাতা, নিজেরই অগ্নিমূর্তি বাইরে প্রকাশ করে তাতে আহুতি দিতে লাগলেন। তিনি সৰ্ব্বসিদ্ধিযুক্ত, কে জানে আজ তার কিসের কামনা! বুঝি পুনরার সতীলাভের জন্যই এই তপস্যা।
(FAQ) দেবী সতী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রাজা দক্ষের।
মহাদেব।
যজ্ঞের আগুনে দেহত্যাগের মাধ্যমে।
মহাদেব।