গৌতম বুদ্ধের পত্নী যশোধরা প্রসঙ্গে পুণ্যবতী যশোধরার পরিচয়, যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের বিবাহ প্রস্তাব, যশোধরা কর্তৃক বুদ্ধদেবকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ, যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের বিবাহ, যশোধরা কর্তৃক প্রোষিতভর্তৃকা ধর্ম পালন, পতিগতপ্রাণা যশোধরা, বুদ্ধদেবের অভ্যর্থনায় অনুপস্থিত যশোধরা, যশোধরার কক্ষে বুদ্ধদেবের প্রবেশ, বোধি লাভের পর যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ, যশোধরা কর্তৃক পুত্র রাহুলের রাজসাজ, সমুদায় ধন সম্পদের অধিকারী যশোধরা, যশোধরার ভিক্ষুণী হবার ইচ্ছা প্রকাশ, মহাপ্রজাপতীর নিকট যশোধরার প্রব্রজ্যা গ্রহণ, যশোধরার অর্হত্ব লাভ ও নির্বাণ লাভ সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী যশোধরা প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থে সমর্পিত প্রিয়া, পত্নী যশোধরা, কোলিয় প্রধান সুপ্পবুদ্ধ ও অমিতার কন্যা যশোধরা, যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের বিবাহ, যশোধরার ভিক্ষুণী হবার ইচ্ছা প্রকাশ ও যশোধরার নির্বাণ লাভ সম্পর্কে জানব।
গৌতম বুদ্ধের পত্নী যশোধরা
ঐতিহাসিক চরিত্র | যশোধরা |
পরিচিতি | গৌতম বুদ্ধ-এর স্ত্রী |
পিতা | কেলিরাজ সুপ্রবুদ্ধ |
প্রব্রজ্যা গ্রহণ | মহাপ্রজাপতী |
নির্বাণ লাভ | ৭৮ বছর বয়সে |
ভূমিকা :- পুণ্যবতী যশোধরা বুদ্ধদেবের সহধর্মিণী ছিলেন। তাঁর পাতিব্রত্য, নিষ্ঠা এবং ত্যাগের মহিমা বুদ্ধদেবের সিদ্ধিলাভের পক্ষে মহা সুযোগ দান করেছিল। বুদ্ধদেবের নামের সাথে যশোধরার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
পুণ্যবতী যশোধরার পরিচয়
যশোধরা কেলিরাজ সুপ্রবুদ্ধের কন্যা। যশোধরার সৌন্দর্য, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও জ্ঞানের কথা সেই সময়ে সর্বত্র সুপ্রচারিত ছিল।
যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের বিবাহ প্রস্তাব
রাজা শুদ্ধোদন যশোধরার রূপ ও গুণের কথা জানতে পেরে তাঁর সাথে সিদ্ধার্থের বিবাহ দেবার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সুপ্রবুদ্ধ প্রথমে স্বীকৃত হন নি। কারণ, সিদ্ধার্থ সংসারত্যাগী প্রব্রাজক হবেন এরূপ দৈববাণী প্রচারিত ছিল এবং সে কথা অনেকেই জানতেন। এজন্যই যশোধরার সাথে সিদ্ধার্থের বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সুপ্রবুদ্ধ অস্বীকৃত হয়েছিলেন।
যশোধরা কর্তৃক বুদ্ধদেবকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ
পুণ্যবতী যশোধরা পিতার এরূপ কথা শুনতে পেয়ে দৃঢ়তার সাথে পিতাকে বলেছিলেন “সিদ্ধার্থ প্রব্রাজক হন বা না হন, আমি তাঁকে ভিন্ন অন্য কাকেও পতিত্বে বরণ করব না।”
যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের বিবাহ
- (১) কেলিরাজ সুপ্রবুদ্ধ ছিলেন গুদ্ধোদনের সামন্ত নৃপতি, কাজেই শুদ্ধোদন নিজে যখন অগ্রণী হয়ে কেলিতে গমন করে যশোধরাকে সিদ্ধার্থের সাথে বিবাহ প্রদানের জন্য গ্রহণ করলেন তখন সুপ্রবুদ্ধ আর তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারলেন না।
- (২) পরে সেকালের বিবাহের রীতি অনুযায়ী যশোধরার জন্য পাঁচশত রাজকন্যার প্রয়োজন হল, তখন শাক্যনৃপতিরা বললেন “সিদ্ধার্থ বালক, তার কিরূপ বিদ্যালাভ হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা কোন পরিচয় পাই নি, তারপর তিনি নিজের পরিবার রক্ষা করবার মত শক্তিশালী কি না তাও জানি না।
- (৩) সিদ্ধার্থ এই কথা শুনে তাঁর নিজের বাহুবলের পরিচয় দেবার জন্য উৎসুক হলেন এবং সমুদয় শাক্যরাজ পুত্রদেরকে তার সাথে শক্তিপরীক্ষার নিমিত্ত প্রতিযোগিতায় আহ্বান করলেন। নির্দিষ্ট দিনে দেবদত্ত প্রমুখ শত শত শাক্য রাজপুত্রের সাথে সিদ্ধার্থ প্রতিযোগিতা করতে অগ্রসর হলেন।
- (৪) কিন্তু তাঁর অসাধারণ, অস্ত্রনৈপুণ্য, বলবীর্য এবং সর্বশাস্ত্রপারদর্শিতার নিকট সকলেই পরাজয় স্বীকার করলেন। অতঃপর আর সিদ্ধার্থের বিদ্যাবত্তা ও অস্ত্রনৈপুণ্য সম্বন্ধে কোনো কথাই হল না। শুভদিনে বিশেষ উৎসব আনন্দের সাথে যশোধরার সাথে সিদ্ধার্থের বিবাহ হয়ে গেল৷
সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগে শোভাহীন যশোধরা
কিছুকাল পরে সিদ্ধার্থ যখন গভীর রাত্রে সংসারত্যাগ করলেন, নিদ্রিতা যশোধরা তাঁর মহানিষ্ক্রমণের কথা জানতেও পারলেন না! যখন জানলেন তখন সাধ্বী সতী যশোধরার মনপ্রাণ ভেঙে গেল। তার হৃদয় পতির বিরহ ক্লেশে ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িল। তাহার মনে হইল যেন সমস্ত পৃথিবী শোভাহীন হয়ে পড়েছে, পৃথিবী অন্ধকার হয়ে পড়েছে। যশোধরা এই আঘাতের বেদনা নীরবে সহ্য করলেন, কেননা তাঁর স্বামী বিশ্বমানবের কল্যাণব্রতে দীক্ষিত হয়েছেন, তিনি মানবজাতিব জরামরণভীতি দূর করবেন। যশোধরা জগতের এই কল্যাণ মন্ত্রের নিকট আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ, ব্যক্তিগত সুখবিলাসকে অতি তুচ্ছ বলে মনে করলেন।
যশোধরা কর্তৃক প্রোষিতভর্তৃকা ধর্ম পালন
- (১) যে দিন সিদ্ধার্থ সংসার ত্যাগ করলেন, সে দিন হতে পতিব্রতা যশোধরা প্রোষিতভর্তৃকা ধর্ম পালন করেছিলেন। যখন ছন্দকের মুখে শুনলেন যে, সিদ্ধার্থ মস্তক মুণ্ডন করেছেন, তখন তিনিও ভ্রমর কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশদাম ছেদন করিয়া মুণ্ডিত মস্তক হলেন। যখন শুনলেন সিদ্ধার্থ রাজোচিত বসনভূষণ পরিত্যাগ করে চীরবসন পরিধান করেছেন, তখন যশোধরা একে একে রত্নখচিত ভূষণ ও বসন পরিত্যাগ করে চীরধারিণী হলেন।
- (২) যখন আরও শুনলেন যে, সিদ্ধার্থ আর কোনো বিলাসদ্রব্য ব্যবহার করেন না, সিদ্ধার্থ গন্ধাদি ব্যবহার করেন না, তখন যশোধরা নিজেও ঐ সকল বিলাসের দ্রব্য ত্যাগ করলেন। সিদ্ধার্থের ন্যায় তিনিও একাহারী হলেন। যশোধরা রাজপ্রাসাদে বাস করে ও ভূমিশয্যায় শয়ন করতেন এবং মৃৎপাত্র ভিন্ন অন্য কোনো ভোজনপাত্র ব্যবহার করতেন না।
পতিগতপ্রাণা যশোধরা
সিদ্ধার্থের মহানিষ্ক্রমণের পর সেকালের রীতি অনুযায়ী অনেক রাজকুমার তাহার পাণিগ্রহণার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সতীসাধ্বী পতিগতপ্রাণা যশোধরা সিদ্ধার্থ ভিন্ন অন্য পুরুষের কথা হৃদয়ে স্থান দেন নি।
বুদ্ধদেবের অভ্যর্থনায় অনুপস্থিত যশোধরা
বুদ্ধদেব সিদ্ধিলাভ করার কিছু কাল পর কপিলবাস্তু গিয়ে তার বৃদ্ধ পিতার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বুদ্ধদেব রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলে রাজপরিবারস্থ সমুদয় স্ত্রীপুরুষই তাঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্য উপস্থিত। এলেন না কেবল যশোধরা।
যশোধরার কক্ষে বুদ্ধদেবের প্রবেশ
- (১) বুদ্ধদেব যশোধরার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সকলে বলল তিনি আসবেন না। তখন গৌতম শুদ্ধোদনের সাথে স্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলেন। গিয়ে দেখলেন যশোধরা মলিনবেশে রুক্ষ আলুলায়িতকেশে বসে আছেন। নয়নসমক্ষে পতিদেবতাকে দেখতে পেয়ে তার প্রেমাশ্রু উথলে উঠল।
- (২) যে দীর্ঘ সংযম ও সহিষ্ণুতা দ্বারা আপনার মনকে সংযত রেখেছিলেন, আজ প্রত্যক্ষ দেবতা স্বামীকে সম্মুখে দেখতে পেয়ে সে সংযম রক্ষা করতে পারলেন না। গৌতমের পদযুগল ধারণ করে তিনি অজস্র ধারে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
বোধি লাভের পর যশোধরা ও গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ
- (১) এতদিন অভাগিনী যশোধরা, দীনবেশে, অনাহারে, অনিদ্রায় কিরূপ ক্লেশে কালযাপন করেছিলেন রাজা শুদ্ধোদন একে একে পুত্রের নিকট সে কথা বললেন। যশোধরাও গৌতমের সাথে রাজাকে দেখতে পেয়ে একপার্শ্বে সরে দাঁড়ালেন। বুদ্ধদেব পত্নীর এরূপ অবস্থা দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
- (২) প্রশান্ত স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিদ্বারা স্নেহময়ী পত্নীকে আনন্দে অভিষিক্ত করতে লাগলেন। যশোধরার অসাধারণ পতিভক্তি দেখে গৌতমেরও মন গলে গিয়েছিল। যশোধরা পূর্বজন্মেও কিরূপ গুণবতী ছিলেন ‘জাতকের’ একটি গল্প বলে তিনি সকলকে সেই কথা বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন তিনি কপিলাবস্তু ছেড়ে চলে গেলেন। বুদ্ধদেবের উপদেশ শ্রবণ করে যশোধরার মনে এক নূতন আশা ও আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হল ।
যশোধরা কর্তৃক পুত্র রাহুলের রাজসাজ
- (১) কিছুকাল পরে যশোধরা তার পুত্র রাহুলকে রাজপুত্রের ন্যায় বেশভূষায় সুসজ্জিত করে বুদ্ধদেবের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। রাহুল তখন সাত বছরের বালক মাত্র। যশোধরা পুত্রকে বলে দিলেন, “ঐ যে সাধুকে দেখছ, ঐ সাধুই তোমার পিতা। এই সাধুর কাছে অনেক ধনরত্ন, অনেক ঐশ্বর্য আছে, তুমি তার কাছে গিয়ে পিতৃধন চেয়ে আন। রাহুল বলল, “রাজাই ত আমার পিতা, আমার আবার পিতা কে ? যশোধরা বুদ্ধদেবকে দেখিয়ে দিলেন।
- (২) রাহুল বুদ্ধের নিকট গিয়ে তাকে পিতৃসম্বোধনে সম্বোধিত করে বলল, “পিতা, আমাকে আমার প্রাপ্য পৈতৃক সম্পত্তি প্রদান করুন।” বুদ্ধ স্নেহের সাথে পুত্রকে আশীর্বাদ করে বললেন, “বৎস! পৃথিবীর ধন, রত্ন, টাকা কড়ি এই সকল কিছুই আমার নই।
- (৩) আমার কাছে সত্যরত্ন আছে। যদি তুমি তা গ্রহণ করতে সম্মত হও, তাহলে আমি তোমাকে দিতে পারি। যদি তুমি তা যত্নপূর্বক রক্ষা করতে পার তাহলেই আমি তোমাকে সেই সত্যরত্ন প্রদান করব।” এইরূপ বলে বুদ্ধদেব পুত্রকে বিবিধ ধর্মোপদেশ প্রদান করলেন। বালক সেই পিতৃ উপদেশ গ্রহণ করে বৌদ্ধ ধর্ম-এ দীক্ষিত হল।
সমুদয় ধনসম্পত্তির অধিকারিণী যশোধরা
কালক্রমে শুদ্ধোদন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। নন্দ, রাহুল, দেবদত্ত, মহাপ্রজাপতী প্রমূখ সকলে একে একে সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করলেন। এই সময়ে পতিকূলের ও পিতৃকুলের সমুদয় ধনসম্পত্তিরই অধিকারিণী হলেন যশোধরা।
যশোধরার ভিক্ষুণী হবার ইচ্ছা প্রকাশ
- (১) কিন্তু সংসারের সুখবিলাস, ধনসম্পত্তি তার আর ভাল লাগছিল না, তিনি মহাপ্রজাপতীর ন্যায় ভিক্ষুণী ব্রত গ্রহণ করার জন্য মনস্থির করলেন। একদিন সহস্র শাক্য রাজকন্যা পরিবৃতা হয়ে তিনি কপিলাবস্তু পরিত্যাগ করলেন।
- (২) কোপি ও কপিলাবস্তু এই দুই জনপদবাসী নরনারী তাকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধর্মের ও ত্যাগের প্রবল আহ্বানের কাছে সব চেষ্টা পরাজিত হল। যখন কিছুতেই যশোধরাকে তাঁরা নিরস্ত করতে পারলেন না, তখন তার যাতায়াতের জন্য রথ ইত্যাদি দিতে চাইলেন। তিনি তাও নিলেন না ।
মহাপ্রজাপতীর নিকট যশোধরার প্রব্রজ্যা গ্রহণ
প্রায় পঁয়তাল্লিশ যোজন পথ চলে তিনি বৈশালীতে উপস্থিত হয়ে মহাপ্রজাপতীর সঙ্গে দেখা করলেন এবং তাঁর নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ পূর্বক শ্রাবস্তীতে গিয়ে বুদ্ধদেবকে প্রণাম করলেন। বুদ্ধদেব যশোধরাকে পরম প্রশান্ত চিত্তে উপসম্পদা দিয়েছিলেন ।
যশোধরার রাজগৃহে বসবাস
এর পর যশোধরা অর্হত্ব লাভ করলেন এবং শ্রাবস্তীতেই কিছুদিন বাস করেছিলেন। কিন্তু এই স্থানে অবস্থানকালে ভারতবর্ষ-এর নানাস্থান থেকে লোকে তাকে বিবিধরূপ উপহার প্রচুর পরিমাণে পাঠাতে লাগল, যশোধরা ঐরূপ উপহারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পুনরায় বৈশালীতে চলে গেলেন। সেখানেও নানাস্থান হতে উপহার আসতে আরম্ভ করল, তখন তিনি রাজগৃহে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।
যশোধরার নির্বাণ লাভ
পুণ্যবতী যশোধরা ৭৮ বছর বয়সে নির্বাণ লাভ করেন।
উপসংহার :- যশোধরার পতির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা, প্রব্রজ্যা গ্রহণ ও ত্যাগ, এবং নিষ্ঠা প্রাচীন বৌদ্ধযুগের বৌদ্ধসন্ন্যাসিনীদের মধ্যে তাকে শ্রেষ্ঠস্থান দিয়েছিল। সীতার পাতিব্রতাধর্মের ন্যায় যশোধরার ত্যাগ ও সতীত্ব গৌরব বৌদ্ধযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে সন্দেহ নেই।
(FAQ) যশোধরা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গৌতম বুদ্ধের পত্নী।
কেলিরাজ সুপ্রবুদ্ধ।
মহাপ্রজাপতী।
৭৮ বছর।