ইন্দোচীন

ইন্দোচীন স্থানটি প্রসঙ্গে ইন্দোচিনে উপনিবেশিক শাসন হিসেবে ফরাসি আধিপত্য, জাপানের আধিপত্য, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা ঘোষণা, ফরাসি প্রতিরোধ, ইন্দোচিনের বিভাজন, আমেরিকার সক্রিয়তা, ও ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম সম্পর্কে জানবো।

ইন্দোচীন

ঐতিহাসিক স্থানইন্দোচিন
ইন্দোচায়না কমিউনিস্ট পার্টিহো চি মিন
জেনেভা সম্মেলন১৯৫৪ খ্রি
ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম১৯৭৬ খ্রি
রাজধানীহ্যানয়
ইন্দোচীন

ভূমিকা :- ভিয়েতনামে বিদেশি আধিপত্যের ইতিহাস বহু প্রাচীন। চীন এখানে দীর্ঘকাল আধিপত্য চালায় ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের পর এখানে কিছুদিনের জন্য চিনের আধিপত্য লুপ্ত হয়। ১৪০৭ খ্রিস্টাব্দে আবার দুই দশকের জন্য ভিয়েতনাম চিনাদের দখলে চলে যায়।

ভিয়েতনামের বিভাজন

সপ্তদশ শতকে ভিয়েতনাম রাজ্যটি প্রশাসনিকভাবে কার্যত দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে এখানে ইউরোপীয় শক্তির আধিপত্যের পথ সুগম হয়।

ইন্দোচিন

সপ্তদশ শতকে ভিয়েতনাম অঞ্চলের বেশ কিছু অংশে ফরাসিদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই অঞ্চল ইন্দোচিন নামে পরিচিত হয়।

ইন্দোচিনে উপনিবেশিক শাসন

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইন্দোচিনে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসার ঘটতে থাকে। এই ঔপনিবেশিক শাসন সম্পর্কে নীচে বিস্তৃত আলোচনা করা হল। –

(ক) ফরাসি শাসন

  • (১) সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইন্দোচিনে জেসুইট মিশনারিদের আগমনের মাধ্যমে ফরাসিদের সঙ্গে ইন্দোচিনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফরাসিরা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কোচিন চিন ও কম্বোডিয়া অধিকার করে। তারপর ফরাসিরা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনামে আসে এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সায়গন অধিকার করে।
  • (২) এভাবে টংকিং (উত্তরাঞ্চল), আন্নাম (মধ্যাঞ্চল) ও কোচিন চিন (দক্ষিণাঞ্চল) – এই তিনটি ভিয়েতনামি অঞ্চল এবং কম্বোডিয়া নিয়ে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোচিনে ফরাসি শাসনের অধীনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে লাওস অঞ্চল ইন্দোচিনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • (৩) ইন্দোচিনে ফরাসিদের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে কোচিন চিন। ইন্দোচিনের রাজধানী ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কোচিন চিনে অবস্থিত সায়গন থেকে টংকিং-এ অবস্থিত হ্যানয়-এ স্থানান্তরিত হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফরাসি ইন্দোচিনের প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়।

(খ) ভিয়েতনামিদের প্রতিরোধ

ভিয়েতনামে ফরাসি শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফরাসিরা সেখানকার মানুষের ওপর তীব্র শোষণ শুরু করে। তারা নির্বিচারে ইন্দোচিনের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ শোষণ করতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় থেকে ভিয়েতনামিদের মধ্যে ক্রমে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভিয়েতনামি সৈন্যদের একটি অংশও ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পূর্ব পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামিদের বিদ্রোহ সফল হয় নি।

(গ) ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

ঔপনিবেশিক ফরাসি শক্তি ভিয়েতনামের সবক্ষেত্রেই নিজেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। ভিয়েতনামে ফরাসি সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রসার ঘটে। শিক্ষাদান, সরকার পরিচালনা, বাণিজ্য প্রভৃতি সমস্তক্ষেত্রেই ফরাসি ভাষা হয়ে ওঠে ভিয়েতনামের প্রধান ভাষা। শহর ও আধা শহরের জনগণের মধ্যে ফরাসি ভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। অভিজাত ও শিক্ষিত ভিয়েতনামিদের প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে ফরাসি ভাষা।

(ঘ) কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা

ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ইন্দোচিনের ভিয়েতনামিরা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সংগঠিত হতে থাকে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেখানে বেশ কয়েকটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দল গড়ে ওঠে। ভিয়েতনামের অন্যতম নেতা হো-চি-মিন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এই দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘ইন্দোচায়না কমিউনিস্ট পার্টি’র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই দলটি তিনভাগে ভেঙে গিয়ে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে পৃথকভাবে কাজ করতে থাকে।

(ঙ) জাপানের আধিপত্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স দখল করে নেয় এবং জার্মানির মিত্র জাপান ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচিন দখল করে নেয়। ভিয়েতনামে জাপানিদের প্রতিরোধ করতে ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট পার্টি মিত্রশক্তিকে সহায়তা করে। এদিকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে হো-চি-মিন প্রতিষ্ঠিত ভিয়েতমিন দল জাপানের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম শুরু করে যা প্রথম ইন্দোচিন যুদ্ধ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের (১৯৪৫ খ্রি.) পর ভিয়েতমিন দল ভিয়েতনামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

(চ) স্বাধীনতা ঘোষণা

পটসডাম সম্মেলন-এ (জুলাই, ১৯৪৫ খ্রি.) স্থির হয় যে জাপানের পরাজয়ের পর ফ্রান্স ইন্দোচিনের দখল নেবে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের পর ফরাসিরা তাদের ইন্দোচিন সাম্রাজ্য-এ নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এই সময় ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা ভিয়েতনামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করে এবং ভিয়েতনামকে প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করে। ইন্দোচিনের নাম হয় ভিয়েতনাম এবং হো- চি-মিন এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।

(ছ) ফ্রান্সের প্রতিরোধের চেষ্টা

ফ্রান্সের পক্ষে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তারা আনামের গদিচ্যুত সম্রাট বাও দাইকে ভিয়েতনামের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে ভিয়েতমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভিয়েতমিন গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফরাসি সরকার ভিয়েতমিন সরকারের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করে (১৯৪৬ খ্রি.)। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্সের অবস্থার উন্নতি হলে ফ্রান্স ভিয়েতমিনদের ওপর আবার অভিযান চালায়। আমেরিকা ও ব্রিটেন বাও দাই সরকারকে এবং চিন ও রাশিয়া হো-চি-মিনের পক্ষকে সহায়তা করতে থাকে।

(জ) স্বাধীনতা লাভ

ফ্রান্স ইন্দোচিনে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ইন্দোচিনে কমিউনিস্টদের অগ্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা এখানে ফরাসি সরকারকে প্রভূত সামরিক সাহায্য দিয়ে এই সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স ইন্দোচিনের ক্ষমতা ফিরে পেতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ দিয়েন-বিয়েন-ফু-র যুদ্ধে ফ্রান্স শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে ইন্দোচিনে ফরাসিদের আধিপত্য লুপ্ত হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা সম্মেলনে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।

(ঝ) ইন্দোচিনের বিভাজন

  • (১) জেনেভা সম্মেলনে মার্কিন, ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও চিনা প্রতিনিধিদের সম্মতিতে স্থির হয় যে, ইন্দোচিন থেকে ফরাসি বাহিনী প্রত্যাহারের সময় ভিয়েতনাম সাময়িকভাবে উত্তর ও দক্ষিণ – এই দু-ভাগে বিভক্ত হবে এবং দুই অংশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত হবে। সেই অনুসারে ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ – এই দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়।
  • (২) উত্তর ভিয়েতনামে হো-চি-মিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে পূর্বতন সম্রাট বাও দাই-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট-বিরোধী সরকার ক্ষমতা লাভ করে। এর পরের ২০ বছর ধরে উত্তর ভিয়েতনামের নেতৃত্বে উভয় ভিয়েতনামের সংযুক্তিকরণের জন্য আন্দোলন চলতে থাকে।

(ঞ) আমেরিকার সক্রিয়তা

  • (১) দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদীদের নির্মূল করার জন্য আমেরিকা সেখানকার সরকারকে সব ধরনের সহায়তা দিতে থাকে। উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের ওপরও মার্কিন বোমারু বিমানের হামলা চলে।
  • (২) ১৯৬৪ খ্রি. জনসনের উদ্যোগে উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যে ‘Operation rolling thunder” শুরু হয়, তা তিন বছর চলেছিল। ফলে ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সায়গনে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার মার্কিন সেনা ঘাঁটি গেড়েছিল।
  • (৩) আমেরিকা ভিয়েতনামে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়। ভিয়েতনামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি বোমা বর্ষণ করা হয়। এমনকি আমেরিকা সেখানে পরীক্ষামূলকভাবে রাসায়নিক বোমাও ফেলে।
  • (৪) ভিয়েতনামে ১৫ বছরব্যাপী যুদ্ধে আমেরিকা ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এবং ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মার্কিন আগ্রাসনে ভিয়েতনামের সর্বত্র ধ্বংসলীলার ঘটনায় সারা বিশ্ব আমেরিকার বিরুদ্ধে নিন্দায় মুখর হয়।
  • (৫) দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল, সাহিত্যিক জাঁ পল সার্ত্রে, গায়িকা আর্থকিট, চিত্রাভিনেত্রী জেন ফন্ডা, অভিনেতা গ্রেগরি পেসহ বিশ্বের বহু বুদ্ধিজীবী ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন।

(ট) কমিউনিস্টদের দখলে ভিয়েতনা

ব্যাপক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত ভিয়েতনামের কাছে শক্তিশালী আমেরিকা পরাজিত হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা প্রত্যাহার করে। এর ২ বছর পর দক্ষিণ ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের দখলে আসে।

উপসংহার :- ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে উভয় ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম নামে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এর রাজধানী হয় হ্যানয়। সায়গনের নাম পালটে নতুন নাম রাখা হয় হো-চি-মিন সিটি।

(FAQ) ইন্দোচীন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন কোন অঞ্চল ইন্দোচিন নামে পরিচিত?

টংকিং (উত্তরাঞ্চল), আন্নাম (মধ্যাঞ্চল) ও কোচিন চিন (দক্ষিণাঞ্চল) – এই তিনটি ভিয়েতনামি অঞ্চল এবং কম্বোডিয়া।

২. ফরাসিরা কোচিন চিন ও কম্বোডিয়া অধিকার করে কখন?

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

৩. ইন্দোচিনে ফরাসিদের প্রধান কেন্দ্র ছিল কোনটি?

কোচিন চিন।

৪. কে কখন ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘ইন্দোচায়না কমিউনিস্ট পার্টি’র প্রতিষ্ঠা করেন ?

হো চি মিন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।

৫. জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কখন?

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে।

৬. ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয় কখন?

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment