পটসডাম সম্মেলন

১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির পোটসডামে অনুষ্ঠিত পটসডাম সম্মেলন প্রসঙ্গে সময়কাল, যুদ্ধকালীন শেষ সম্মেলন, নেতৃবৃন্দ, নেতাদের পরিবর্তন, বোঝাপড়ার অভাব, নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিল, জার্মানি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত, পোল্যান্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্ত, জাপানের বিরুদ্ধে রাশিয়া, আমেরিকার আণবিক বোমা আবিষ্কার, জাপানে বোমা নিক্ষেপ সম্পর্কে জানবো।

পটসডাম সম্মেলন

ঐতিহাসিক ঘটনাপটসডাম সম্মেলন
সময়কালজুলাই-আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
স্থান    পোটসডাম, জার্মানি
প্রধান ব্যক্তিত্বস্ট্যালিন, হ্যারি ট্রুম্যান, ক্লিমেন্ট এটলি
প্রেক্ষাপটদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
পটসডাম সম্মেলন

ভূমিকা:- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জার্মানির আত্মসমর্পণের পর বার্লিনের উপকণ্ঠে পোটসডাম শহরে মিত্রপক্ষীয় নেতৃমণ্ডলীর এক সম্মেলন বসে। এই সম্মেলন পোটসডাম সম্মেলন নামে অভিহিত।

পটসডাম সম্মেলনের সময়কাল

১৭ জুলাই ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২রা আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

যুদ্ধকালীন শেষ সম্মেলন পটসডাম সম্মেলন

পোটসডাম সম্মেলন হল মিত্রপক্ষীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের যুদ্ধকালীন শেষ সম্মেলন।

পটসডাম সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ

রাশিয়ার স্ট্যালিন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

পটসডাম সম্মেলনে নেতাদের পরিবর্তন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মৃত্যুর ফলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। অপরদিকে, ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের পরাজয়ের ফলে জয়ী শ্রমিক দলের নেতা এটলি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সুতরাং পূর্বতন যুদ্ধকালীন শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একমাত্র স্ট্যালিনই এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

পটসডাম সম্মেলনে নেতাদের বোঝাপড়ার অভাব

পূর্ববর্তী নেতৃবৃন্দ একে অন্যকে বুঝতেন এবং যুদ্ধকালে তাঁদের মধ্যে একটি সুন্দর পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এর যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়।

পটসডাম সম্মেলনে নেতাদের পারস্পরিক সন্দেহ

  • (১) পোটসডাম সম্মেলনে আসার আগে স্ট্যালিন সম্পর্কে ট্রুম্যান যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, ইয়াল্টা সম্মেলনের সময় রুজভেল্ট অসুস্থ ছিলেন এবং স্ট্যালিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি ইয়াল্টা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি পোটসডাম সম্মেলনে যোগ দেন।
  • (২) এছাড়া, পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কেও তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন না। এই কারণে এই ব্যাপারে তিনি তাঁর পরামর্শদাতাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।

পটসডাম সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাউন্সিল গঠন

এই সম্মেলনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন –

  • (১) এই সম্মেলনে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কাউন্সিল বা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
  • (২) স্থির হয় যে, লন্ডনে এই কাউন্সিলের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হবে, তবে প্রয়োজনে অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজধানীতেও এর অধিবেশন বসতে পারে।
  • (৩) এই পরিষদ ইতালি, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড ও জার্মানির সঙ্গে পৃথক পৃথক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করবে।
  • (৪) তেহরান থেকে মিত্রপক্ষীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে।
  • (৫) অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে না।

পটসডাম সম্মেলনে জার্মানির সম্পর্কে সিদ্ধান্ত

এই সম্মেলনে জার্মানি সম্পর্কেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন –

  • (১) ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া ও ফ্রান্স জার্মানির যে সব অংশ দখল করেছে, সেই অংশের দায়িত্বভার থাকবে স্ব-স্ব সরকারের সেনাপতির উপর।
  • (২) সমগ্র জার্মানির স্বার্থ-সংক্রান্ত বিষয়গুলি যুগ্মভাবে স্থিরীকৃত হবে এবং এজন্য ওই চারটি দেশের সেনাপতিদের নিয়ে গঠিত হবে একটি Control Council’ বা জার্মানি সম্বন্ধে নিয়ন্ত্রণ পরিষদ’।
  • (৩) জার্মানি থেকে নাৎসি দল, নাৎসি আইন-কানুন, বিচারালয়, শিক্ষাব্যবস্থা সব কিছু বিলুপ্ত করে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে জার্মানিকে পুনর্গঠিত করা হবে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে জার্মানির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে।
  • (৪) জার্মান জনগণের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে জার্মানিতে সার্বজনীন নির্বাচন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে।
  • (৫) জার্মানির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে এবং সমগ্র জার্মানি একটি অর্থনৈতিক একক হিসেবে বিবেচিত হবে।
  • (৬) জার্মানির আমদানি-রপ্তানি, কৃষি, শিল্প-উৎপাদন, মজুরি, ব্যাঙ্ক, মুদ্রাব্যবস্থা, রেশনিং, পরিবহণ প্রভৃতি সব বিষয়ে যুগ্মভাবে একই নীতি অনুসৃত হবে।
  • (৭) জার্মানির কাছ থেকে উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে এবং এই উদ্দেশ্যে একটি ‘মিত্রপক্ষীয় কমিশন’ গঠিত হবে।
  • (৮) জার্মানির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ক্ষতিপুরণ আদায় করা হবে এবং ক্ষতিপুরণ মেটাতে গিয়ে জার্মানিকে যাতে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হতে না হয়ে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হবে।
  • (৯) মিত্ররাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ অধিকৃত অঞ্চল থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। যেহেতু জার্মান আক্রমণে রাশিয়া সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাই জার্মানির কাছ থেকে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অর্ধাংশ রাশিয়াকে দেওয়া হবে।
  • (১০) জার্মানিকে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র করা হবে এবং তার সমস্ত সামরিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলি ভেঙে দেওয়া হবে। জার্মানির যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতির কারখানাগুলিকে মিত্রপক্ষের অধীনে আনা হবে।
  • (১১) জার্মানির যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যপোতগুলি রাশিয়া, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে এবং তার সমস্ত ডুবোজাহাজ ধ্বংস করে ফেলা হবে।

পটসডাম সম্মেলনে পোল্যান্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্ত

  • (১) ইয়াল্টা সম্মেলন -এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পোল্যান্ড-এ একটি অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থির হয়েছিল যে, এই সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সরকার গঠন করবে। পোটসডাম সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
  • (২) জার্মানির কিছু এলাকা পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও চেকোশ্লোভাকিয়ার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। পোল্যান্ডকে দেওয়া হয় পূর্ব প্রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল, ডানজিগ বন্দর, সাইলেশিয়ার কিছু অংশ এবং অন্যান্য কিছু অঞ্চল।

জাপানের বিরুদ্ধে রাশিয়া

ইয়াল্টা সম্মেলনে স্থির হয় যে, জার্মানির আত্মসমর্পণের পর দূরপ্রাচ্যে রাশিয়া আমেরিকার পক্ষে জাপান-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করবে।

পটসডাম সম্মেলন কালে আমেরিকার আণবিক বোমা আবিষ্কার

পোটসডাম সম্মেলন চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে সংবাদ আসে যে, আমেরিকার আণবিক বোমার পরীক্ষা সফল হয়েছে। এই বোমা সে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং আমেরিকার আর রুশ সাহায্যের কোনও প্রয়োজন নেই।

জাপানে বোমা নিক্ষেপ

আমেরিকা হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। আমেরিকার আণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে গোপনীয়তা এবং জাপানের উপর বোমা নিক্ষেপ মিত্রশক্তিবর্গ বিশেষত রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

উপসংহার:- মিত্রশক্তিগুলির মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, বিদ্বেষ ও ভীতি দেখা দেয়। এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মিত্রশক্তিবর্গের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই-এর সূত্রপাত হয়।

(FAQ) পটসডাম সম্মেলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কবে কোথায় পোটসডাম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?

জুলাই-আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ জার্মানির পোটসডামে।

২. পোটসডাম সম্মেলনে প্রধান ব্যক্তিত্ব কারা ছিলেন?

মার্শাল স্ট্যালিন, হ্যারি ট্রুম্যান, ক্লিমেন্ট এটলি।

৩. কোন পরিস্থিতিতে পোটসডাম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে।

Leave a Comment