সীতা

রামায়ণের নায়িকা চরিত্র সীতা প্রসঙ্গে তার জন্ম সম্পর্কে প্রবাদ, নামকরণ, শিক্ষা লাভ, বিবাহের উদ্যোগ, সীতার বিবাহের শর্ত হরধনু ভঙ্গে ব্যর্থতা, বিশ্বামিত্র কর্তৃক রাম ও লক্ষ্মণের সীতার রাজ্যে আগমন, রামচন্দ্র কর্তৃক সীতার বিবাহের শর্ত হরধনু ভঙ্গ, রামচন্দ্র ও সীতার বনবাস, রামচন্দ্র ও সীতার কথোপকথন, রাম, লক্ষণ ও সীতার বনবাস, পঞ্চবটী বনে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার কুটির নির্মাণ, সীতাপতি রামের কাছে অপমানিত শূর্পণখা, সীতা হরণের কৌশল, অশোকবনে চেড়ীদের বন্দিনী সীতা, রাবন কর্তৃক সীতা হরণ, হনুমান ও সীতার সাক্ষাৎ, হনুমান কর্তৃক সীতাকে আহ্বান, হনুমানের সাথে যেতে সীতার অসম্মতি, রামচন্দ্র কর্তৃক সীতার উদ্ধার সীতার অগ্নিপরীক্ষা, সীতার পুনরায় বনবাস, বাল্মীকির আশ্রমে সীতার যমজ সন্তানের জন্ম, সীতার যমজ সন্তানের অযোধ্যা গমন, সীতা ও রামচন্দ্রের পুনরায় সাক্ষাৎ এবং সীতার অন্তর্ধান সম্পর্কে জানবো।

হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের কেন্দ্রীয় বা প্রধান নারী চরিত্র সীতা প্রসঙ্গে জনকপুরে (বর্তমানে মিথিলা) সীতার জন্ম, রামায়ণের অন্যতম মুখ্য চরিত্র সীতা, হিন্দু ধর্মমতে দেবী হিসেবে সীতাকে মান্যতা, কিংবদন্তীর নায়িকা সীতা, পঞ্চসতীর অন্যতম একজন সীতা, মিথিলার রাজা জনকের কন্যা সীতা এবং রামচন্দ্রের পত্নী সীতা সম্পর্কে জানব।

রামায়ণের নায়িকা চরিত্র সীতা

ঐতিহাসিক চরিত্রসীতা
পরিচিতিঅযোধ্যাপতি রামচন্দ্রের পত্নী
জন্মধরিত্রী থেকে
পিতাজনক রাজা
পুত্রলব ও কুশ
রামায়ণের নায়িকা চরিত্র সীতা

ভূমিকা :- যা কিছু শুভ, যা কিছু পবিত্র, তা সীতা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সর্বংসহা সীতার মত হওয়া সব স্ত্রীলোকের উদ্দেশ্য। এই সীতা মিথিলার রাজা রাজষি জনকের কন্যা।

সীতার জন্ম সম্পর্কে প্রবাদ

ক্ষেত্র কর্ষণ করতে গিয়ে জনক রাজা এক রূপলাবণ্যবতী কন্যা প্ৰাপ্ত হন। সেই কন্যাকে তিনি নিজের কন্যার রূপে লালনপালন করেন।

সীতার নামকরণ

লাঙ্গলের ফলা হতে উঠেছিলেন বলে সেই কন্যা সীতা নামে অভিহিত হন।

সীতার শিক্ষা লাভ

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সীতার রূপ উছলে পড়তে লাগল। তাঁর গুণেরও সীমা রইল না। পিতার কাছে সর্বশাস্ত্র ও সর্ববিদ্যা শিক্ষা করলেন, তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর।

সীতার বিবাহের উদ্যোগ

রাজর্ষি জনক কন্যার বিবাহকাল উপস্থিত হয়েছে মনে করে তাঁকে উপযুক্ত পাত্রের হস্তে দান করতে মনস্থ করলেন। তাঁর গৃহে বহু সাধনায় প্রাপ্ত হরধনু ছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে সেই ধনু ভঙ্গ করতে পারবেন, তাঁকেই তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন।

সীতার বিবাহের শর্ত হরধনু ভঙ্গে ব্যর্থতা

একে একে সকল দেশের রাজকুমারগণ এলেন, কিন্তু ধনু ভঙ্গ করা দূরে থাক, অনেকেই তা তুলতেই পারলেন না। লঙ্কার রাক্ষসরাজ রাবণও এসেছিলেন, তিনিও অসমর্থ হয়ে দুঃখিত অন্তঃকরণে লঙ্কায় ফিরলেন। জনক মহা চিন্তিত হলেন।

বিশ্বামিত্র কর্তৃক রাম ও লক্ষ্মণের সীতার রাজ্যে আগমন

তাড়কা রাক্ষসীর উৎপাতে বিশ্বামিত্র ঋষি, অযোধ্যার রাজা দশরথের নিকট হতে রাম ও লক্ষ্মণকে তাড়কা-বধের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তাড়কা বধের পর রামকে উপযুক্ত পাত্র মনে করে বিশ্বামিত্র দুই ভাইকে নিয়ে জনকের সভায় উপস্থিত হলেন।

রামচন্দ্র কর্তৃক সীতার বিবাহের শর্ত হরধনু ভঙ্গ

বিশ্বামিত্রের আদেশে রাম অবলীলাক্রমে সেই ধনু ভঙ্গ করলেন। রামের সাথে সীতার বিবাহ হল। দশরথ সংবাদ পেয়ে মিথিলায় এসেছিলেন। জনকের তিন ভ্রাতুষ্পুত্রীর সাথে রামের অপর তিন ভ্রাতার বিবাহ হল। সীতা অযোধ্যায় এলেন।

রামচন্দ্র ও সীতার বনবাস

অযোধ্যায় গিয়ে সকলের কয়েক বছর বেশ সুখে কাটল। দশরথ অত্যন্ত বৃদ্ধ হওয়ায় জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে মনস্থ করলেন। কিন্তু কৈকেয়ী নিজ পুত্র ভরতকে রাজা করবার উদ্দেশ্যে কৌশলে রামের চৌদ্দ বছর বনবাস ঘটালেন। রামের বনগমনই স্থির হল।

সকলের কাছে রামের বিদায়

রাম একে একে সকলের নিকট বিদায় নিয়ে শেষে জানকীর নিকট উপস্থিত হলেন।

সীতা ও রামচন্দ্রের কথোপকথন

রামচন্দ্র: “জানকি ! মনে করিয়াছিলাম বুঝি আমাদের চিরদিন এইরূপ সুখে কাটিবে, কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ। পিতৃসত্য পালন করিবার জন্য আমি বনবাসী হইতে চলিয়াছি। তুমি এই চতুর্দ্দশ বৎসর গুরুজন সেবায় নিযুক্ত থাকিও আমায় বিদায় দাও।”

সীতা: “তুমি যদি বনগমন কর তাহা হইলে আমি কি সুখে রাজপ্রাসাদে থাকিব ? তুমিই আমার একমাত্র দেবতা, তুমিই আমার একমাত্র গুরু; তুমি যখন যে ভাবে থাকিবে আমিও সেই ভাবে থাকিব। তোমার মুখেতে শুনিয়াছি, স্বামী ভিন্ন স্ত্রীলোকের অন্য গতি নাই। তুমিই তো বলিতে স্বামীর জীবনে স্ত্রী জীবিত থাকে, স্বামীর সুখে স্ত্রী সুখ ভোগ করে। তুমি যদি বনে যাও, আমি দাসী হইয়া সঙ্গে যাইব। দাসীর সেবায় তোমার অনেক কষ্টের লাঘব হইবে।”

রাম: অশেষ প্রকারে বুঝালেন, বনবাসের ক্লেশের কথা বিস্তৃতরূপে বুঝালেন।

সীতা: “তোমার সঙ্গে তরুতলে বাস করিলেও আমি তাহা স্বর্গ বলিয়া মনে করিব; তোমার সঙ্গে থাকিয়া ধূলি ধূসসরিত হইলে তাহা চন্দনশোভিত বলিয়া মনে করিব, কুশকণ্টকে শরীর বিদ্ধ হইলে আমি তাহা তোমার স্নেহ-চুম্বন বলিয়া মনে করিব। তুমি আমাকে সঙ্গে না লইয়া গেলে আমি নিশ্চয়ই প্রাণ ত্যাগ করিব।”

রাম, লক্ষ্মণ সীতার বনবাস

সীতার এরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখে রাম তাঁকে সঙ্গে নিলেন। রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ অযোধ্যা অন্ধকার করে বনে চললেন। পুত্রশোকে দশরথের দেহত্যাগ হল।

পঞ্চবটী বনে রাম, লক্ষ্মণ সীতার কুটির নির্মাণ

অনেক বন ভ্রমণ করে তাঁরা অবশেষে পঞ্চবটী বনে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে কুটীর নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। সেখানে রাক্ষসদের বড়ই উৎপাত।

সীতাপতি রামের কাছে অপমানিত শূর্পণখা

লঙ্কার রাজা রাবণের ভগ্নী শূর্পণখা একদিন রাম-লক্ষণকে দেখতে পেয়ে তাদেকে বিবাহ করতে অনুরোধ করে। এতে তাদের নিকট যথেষ্ট অপমানিত হয়ে ভ্রাতার নিকট গিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলে।

সীতা হরণের কৌশল

রাবণ শূর্পণখার মুখে সীতার সংবাদ পেয়ে তাঁকে হরণ করবার জন্য মারীচ নামে এক রাক্ষসকে পাঠিয়ে দেন, নিজেও সঙ্গে আসেন। মারীচ স্বর্ণমৃগচ্ছলে রামকে কুটিরের অনেক দূরে নিয়ে যায়। মারীচের কৌশলে লক্ষ্মণকেও কুটির ত্যাগ করতে হল।

রাবণ কর্তৃক সীতা হরণ

সীতাকে অসহায় পেয়ে রাবণ ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করে তাকে হরণ করেন। সীতা এইরূপে রামের থেকে পৃথক হলেন। সীতা লঙ্কায় রাবণের বন্দিনী রূপে থাকতে বাধ্য হলেন। রামের বিরহে সীতা মৃতপ্রায় হলেন ।

অশোকবনে চেড়ীদের বন্দিনী সীতা

রাম ও লক্ষ্মণ বহু কষ্টে সীতার সন্ধান পেয়ে সুগ্রীব ও হনুমান প্রমুখ বানরগণের সাথে বন্ধুত্ব করলেন। হনুমান সাগর পার হয়ে লঙ্কায় উপনীত হয়ে সন্ধান করে জানলেন সীতা অশোকবনে চেড়ীগণবেষ্টিত হয়ে আছেন।

হনুমান ও সীতার সাক্ষাৎ

সেই চেড়ীগণ অন্য কাজে গেলে হনুমান্ সীতার কাছে গিয়ে বললেন “দেবি! আপনার স্বামী বহু কষ্টে আপনার সন্ধান পাইয়া আমাকে এখানে পাঠাইয়াছেন এবং আপনি এখানে আছেন নিশ্চয় জানিলে তিনি সসৈন্যে লঙ্কা আক্রমণ করে আপনার উদ্ধার করবেন।

হনুমান কর্তৃক সীতাকে আহ্বান

সীতার মলিন বেশ ও স্নান মুখ দেখে হনুন বললেন “মা যদি কষ্ট একেবারে অসহ্য হইয়া থাকে তাহা হইলে আমার পৃষ্ঠে আরোহণ করুন, আমি এক লাফে সাগর পার হইয়া আপনাকে শ্রীরামের নিকট লইয়া যাইব।”

হনুমানের সাথে যেতে সীতার অসম্মতি

সীতা যদিও হনুমানের নিকট নিদর্শন পেয়েছিলেন যে হনুমান রামের শিষ্য ও চর, তথাপি পরপুরুষের হাতে রক্ষা পাওয়া এবং চোরের মত বীরশ্রেষ্ঠ হরধনুভঙ্গকারী রামভার্য্যাকে নিয়ে গেলে তার স্বামীর অগৌরব হবে ভেবে যেতে অস্বীকার করলেন।

রামচন্দ্র কর্তৃক সীতার উদ্ধার

বাধ্য হয়ে হনুমান ফিরে এসে শ্রীরামকে সমস্ত নিবেদন করলেন। শ্রীরামচন্দ্র বানরগণের সাহায্যে সাগরে সেতু বেঁধে লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণ ও তাঁর সৈন্যগণকে বধ করে সীতা উদ্ধার করলেন ।

সীতার অগ্নিপরীক্ষা

এতকাল পরগৃহে বাস করেছেন বলে পাছে প্রজারা কোনো কলঙ্ক আরোপ করে এই ভেবে রাম সীতার অগ্নি-পরীক্ষা করালেন। সাধ্বী সীতা নীরবে তার অনুমোদন করলেন। তারপর সকলে অযোধ্যায় ফিরে এলেন।

সীতাপতি রামের সিংহাসনে আরোহণ

কৈকেয়ীর পুত্র ভরত বহু অনুরোধেও রাজসিংহাসনে বসেন নি। রামের আজ্ঞা নিয়ে তার পাদুকা সিংহাসনে রেখে নিজে প্রজাপালন করছিলেন। এখন রামকে পেয়ে তাকে সিংহাসনে বসালেন।

সীতার পুনরায় বনবাস

অযোধ্যাপুর আনন্দ-সাগরে মগ্ন হল। কিন্তু তখনও সীতার দুঃখের অবসান হল না। অগ্নিপরীক্ষা প্রজারা কেউ চোখে দেখে নি, সুতরাং তা বিশ্বাস না করে অনেকে সীতার উপর মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করতে লাগল। অনন্যোপায় হয়ে রাম সীতার পুনরায় বনবাসের ব্যবস্থা করলেন। লক্ষ্মণ সীতাকে নিয়ে কৌশলে বাল্মীকির তপোবনে রেখে এলেন।

বাল্মীকির আশ্রমে সীতার যমজ সন্তানের জন্ম

সীতার দুঃখের সীমা রইল না। সীতা তখন পূর্ণগর্ভা। রাজরাণী মুনির কুটিরে যমজপুত্র প্রসব করলেন। রাজকুমারদের জন্ম কেউই জানল না। বাল্মীকি যথাকালে তাদের জাতকর্মাদি সমস্ত সংস্কার করিয়ে সর্বশাস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিলেন। এই সময় বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করে লব-কুশকে শিক্ষা দিলেন। লব-কুশের মুখে বাল্মীকির রচিত রামায়ণ গান শুনে সীতা অনেক দুঃখ কষ্ট ভুলতেন।

সীতার যমজ সন্তানের অযোধ্যা গমন

মহা সমারোহে রাম অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। হিন্দুশাস্ত্রে আছে কোনো কাজই স্ত্রী ভিন্ন সম্পন্ন হয় না, তাই সীতার স্বর্ণমূর্তি যজ্ঞের জন্য গড়াতে হয়েছিল। সমস্ত রাজা ও মুনিদের নিমন্ত্রণ হয়েছিল। বাল্মীকি লব-কুশকে সঙ্গে নিয়ে সেই যজ্ঞে এসে লব-কুশকে দিয়ে রামায়ণ গান করালেন। সকলেই লব-কুশের গানে মুগ্ধ হলেন।

সীতা ও রামচন্দ্রের পুনরায় সাক্ষাৎ

রামের সীতা-স্মৃতি জাগরূক হওয়ায় তিনি অস্থির হলেন। শেষ পর্যন্ত বাল্মীকি সীতাকে রামের কাছে নিয়ে এলেন। সীতার মনে স্বামীর প্রতি কোনো বিদ্বেষ ভাব ছিল না। কেবলমাত্র প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্যই যে তার স্বামী এরূপ কার্য্য করেছেন তা তিনি বিশেষরূপে জানতেন। স্বামীর প্রতি ভক্তি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয় নি।

সীতার অন্তর্ধান

বাল্মীকি সীতাকে গ্রহণ করবার জন্য রামকে অনুরোধ করলেন। পুনরায় পরীক্ষার কথা উঠিল। পরীক্ষার কথা শুনে সীতার নিজের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা জন্মাল। তিনি “ভগবতি বসুন্ধরে দ্বিধা হও” বলে মূর্চ্ছিতা হলেন। সহসা সভাস্থল দ্বিখণ্ড হল। পাতাল হতে এক দেবীমূৰ্ত্তি উঠে সীতাকে নিয়ে অন্তর্হিতা হলেন।

উপসংহার :- সীতার অন্তর্ধানে সকলে হাহাকার করে উঠলেন। সীতা পৃথিবী হতে উঠেছিলেন, আবার পৃথিবীতেই লীন হলেন।

(FAQ) রামায়ণের নায়িকা চরিত্র সীতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সীতার অন্য নাম কি ছিল?

জানকী।

২. সীতার পিতা কে ছিলেন?

জনক রাজা।

৩. জনক রাজার রাজ্যের নাম কি?

মিথিলা।

৪. সীতার বিবাহ হয় কার সাথে?

অযোধ্যার রাজকুমার রামচন্দ্রের সাথে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment