অম্বপালী

প্রাচীন ভারতের পতিতা নারী অম্বপালি প্রসঙ্গে প্রকৃত নামে অম্বপালী, তার নিবাস, অম্বপালীর আম্রকাননে বুদ্ধদেবের উপস্থিতি, বুদ্ধদেব ও অম্বপালীর সাক্ষাৎ, অম্বপালী সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মানসচিন্তা, অম্বপালীর মন সত্যধর্মের প্রতি ধাবিত, অম্বপালী কর্তৃক বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ, গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক অম্বপালীর আমন্ত্রণ গ্ৰহণ, অম্বপালীর নিকট রাজার লোকেদের প্রস্তাব, অম্বপালীর প্রতি বৈশালীর লিচ্ছবিদের গ্লানি, বুদ্ধ ও তার সংঙ্ঘে অম্বপালীর দান, বুদ্ধদেবের দান গ্ৰহণ ও ভিক্ষুণী অম্বপালী সম্পর্কে জানবো।

ভারতের শ্রেষ্ঠ নর্তকীর নাম ছিল আম্রপালি বা অম্বপালি প্রসঙ্গে অনিন্দ্য সুন্দরী অম্বপালি, নগরবধূ বা পতিতা অম্বপালি, বৈশালী শহরে বাসকারী অম্বপালি, গৌতম বুদ্ধের শিষ্যা অম্বপালি সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন ভারতের পতিতা নারী অম্বপালী

ঐতিহাসিক চরিত্রঅম্বপালী
পরিচিতিপ্রাচীন ভারতের পতিতা নারী
নিবাসবৈশালীর নিকট কোটিগ্ৰাম
ধর্মবৌদ্ধ ধর্ম
শিষ্যত্ব গ্রহণগৌতম বুদ্ধ
অম্বপালি

ভূমিকা :- সেকালের অনেক বিদুষী পতিতা রমণীও মহাপ্রাণ বুদ্ধদেবের কৃপালাভ করে পবিত্র ধর্মপথ অবলম্বন করে যশস্বিনী হয়েছেন। সেই সকল নারীদের মধ্যে আম্রপালি বা অম্বপালীর নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

প্রকৃত নামে অম্বপালী

অম্বপালীর প্রকৃত নাম কি তা জানা যায় না। তবে এই রূপসী পতিতা রমণীর একটি সুবৃহৎ আম্রকানন ছিল বলিয়া তিনি অম্বপালী নামে খ্যাতা হয়েছিলেন।

অম্বপালীর নিবাস

সুবিখ্যাত বৈশালী নগরের অনতিদূরে কোটিগ্রাম নামে এক পল্লীতে তার সুবৃহৎ প্রাসাদ, উপবন এবং আম্রকাননাদি ছিল।

অম্বপালীর আম্রকাননে বুদ্ধদেবের উপস্থিতি

ভগবান বুদ্ধদেব তার মহাপরিনির্বাণের চার-পাঁচ মাস পূর্বে বর্ষার প্রাক্কালে একদিন শিষ্যগণ সহ অম্বপালীর আম্রকাননে এসে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধদেব বিশ্রাম লাভের পর শিষ্যগণকে উপদেশ দিচ্ছেলেন।

বুদ্ধদেব ও অম্বপালীর সাক্ষাৎ

সেই সময়ে অম্বপালী বুদ্ধদেবের আগমনবার্তা শুনে তাকে দেখার জন্য আগমন করলেন। অম্বপালীর সহজ শোভন সুন্দর বেশভূষা ও মোহিনী মূর্তি দেখে বুদ্ধদেবও ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধ হলেন।

অম্বপালী সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মানসচিন্তা

তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন “এই স্ত্রীলোকটি কি পরমাসুন্দরী! রাজপুরুষেরাও ইহার রূপলাবণ্যে মোহিত ও বশীকৃত। অথচ এ কেমন সুধীর শান্ত, সাধারণ স্ত্রীলোকের ন্যায় যৌবনমদমত্তা চপলস্বভাবা নহে। জগতে এইরূপ রমণী দুর্লভ।”

বুদ্ধদেবের নিকট অম্বপালীর আগমন

অম্বপালী বুদ্ধদেবের সৌম্যশান্ত সুগভীর মূর্তি দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বুদ্ধদেবের পাশে বসলেন। বুদ্ধদেব তখন উপদেশ দিচ্ছেলেন। তাঁর বদন হতে অমৃতের বাণী নিঃসৃত হচ্ছিল। সেই ধর্ম-উপদেশ শুনে পতিতানারী মুগ্ধা হলেন।

অম্বপালীর মন সত্যধর্মের প্রতি ধাবিত

বুদ্ধদেব তাকে ধর্মোপদেশ দিয়ে বাসনার মূলোচ্ছেদ করলেন। অম্বপালীর চিত্ত দ্রব হয়ে সত্যধর্মের প্রতি তাঁর মন ধাবিত হল।

অম্বপালী কর্তৃক বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ

অম্বপালী গৃহে প্রত্যাগমন করবার পূর্বে ভক্তিভাবে বুদ্ধদেবের শরণপ্রার্থী হয়ে বিনীতভাবে বললেন, “প্রভু! কল্য আপনার শিষ্যমণ্ডলী সহ আমার গৃহে পদার্পণ করিয়া মধ্যাহ্নভোজন করিলে আমি অনুগৃহীত হইব।”

গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক অম্বপালীর আমন্ত্রণ গ্ৰহণ

বুদ্ধদেব বিনা দ্বিধায় এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ভগবান একজন পতিতা রমণীর গৃহে ভোজন করতে স্বীকৃত হয়েছেন, এই সংবাদে সকলেই বিস্মিত হলেন।

গৌতম বুদ্ধের নিকট লিচ্ছবি বংশীয় রাজার আগমন

এর অব্যবহিত পরেই বৈশালীর লিচ্ছবি বংশীয় রাজা তার রাজধানীর অনতিদূরে বুদ্ধদেব অবস্থান করছেন জানতে পেরে স্বয়ং বহুসংখ্যক নাগরিকের সাথে যানাদি সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধদেবকে নিমন্ত্রণ পূর্বক রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবার জন্য উপস্থিত হলেন। রাজার সঙ্গিরা অপূর্ব সাজসজ্জা করে এসেছিলেন। তাঁদের কেউ শুভ্র, কেউ বা রঙিন বেশে বিবিধ অলঙ্কারে ভূষিত।

বৈশালীর রাজা ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মন্তব্য

বুদ্ধদেব রাজা ও তার সঙ্গীদেরকে লক্ষ্য করে শিষ্যগণকে বললেন, “দেখ, ইহাদের কেমন সাজ, ঠিক যেন দেবতারা ভূতলের ক্রীড়াকাননে উপস্থিত হইয়াছেন।”

বৈশালীর রাজা কর্তৃক বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ

রাজা তার অনুচরবর্গের সঙ্গে এসে বুদ্ধদেবকে ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করলে তিনি বললেন, “আমি অম্বপালীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছি।”

অম্বপালীর নিকট রাজার লোকেদের প্রস্তাব

এরপর বৈশালীর নৃপতির সঙ্গিগণ আশ্চর্যান্বিত হয়ে অম্বপালীর নিকট গিয়ে বললেন, “তুমি নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার কর। বুদ্ধদেবকে রাজভবনে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। যদি তুমি রাজার এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হও, তাহলে তোমাকে তিনি তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দান করিবেন।”

নিমন্ত্রণ প্রত্যাহারে অম্বপালীর অসম্মতি

অম্বপালী পতিতা নারী। বৈশালীর একজন সামান্যা প্ৰজা। তবু সে বিচলিতা না হয়ে দৃঢ়তার সাথে বলল, “তোমরা যদি রাজকোষের সমস্ত অর্থ, সমস্ত বৈশালীনগর – উপনগর সমস্তই আমাকে দান কর, তাহা হইলেও আমি ভগবান বুদ্ধদেবের নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করিব না।”

অম্বপালীর প্রতি বৈশালীর লিচ্ছবিদের গ্লানি

লিচ্ছবিগণ অম্বপালীকে নানারূপে গ্লাণি করতে করতে অধোবদনে ফিরে গেলেন।

বুদ্ধদেব কর্তৃক অম্বপালীর আমন্ত্রণ রক্ষা

পরদিন প্রভাতে বুদ্ধদেব সশিষ্য অম্বপালীর ভবনে গমন করলে, অম্বপালী নানাবিধ অন্নব্যঞ্জনাদি দ্বারা তাঁর পরিতোষ সাধন করলেন।

বুদ্ধ ও তার সংঙ্ঘে অম্বপালীর দান

আহারান্তে অম্বপালী ভগবান বুদ্ধদেবকে করজোড়ে নিবেদন করলেন, “আমার উদ্যান, এই গৃহ ভগবান বুদ্ধ ও তাঁহার সঙ্ঘে সমর্পণ করিতেছি। আমার এই সামান্য উপহার গ্রহণ করিয়া আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন।”

বুদ্ধদেব কর্তৃক অম্বপালীর দান গ্ৰহণ

ভগবান বুদ্ধদের এই পতিতা রমণীর প্রদত্ত প্রীতি-উপহার গ্রহণ করলেন এবং তাঁকে বহুতর ধর্মোপদেশ দানে শিষ্যত্বে বরণ করে সেই স্থান হতে প্রস্থান করলেন।

ভিক্ষুণী অম্বপালী

অম্বপালী এইভাবে যৌবনেই সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ভিক্ষুণী হয়েছিলেন। এই ঘটনার অল্পকাল পরেই কার্তিকের শুক্লাষ্টমী তিথিতে ভগবান সুগত মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।

অম্বপালীর সুন্দর দেহে জরার প্রভাব বিস্তার

ভগবান বুদ্ধদেব বলতেন যে মানবজীবনে জরা একদিন আসবেই। যেদিন সত্যি সত্যিই জরা এসে অম্বপালীর সুন্দর দেহের উপর আপনার প্রভাব বিস্তার করল তখন সেই জরাকে অগ্রাহ্য করে তুচ্ছ রূপগৌরবের কথা অম্বপালী তাঁর বিরচিত গাথায় উল্লেখ করে গেছেন।

অম্বপালী রচিত গাথা

আমরা এখানে অম্বপালী রচিত সেই গাথাটির অনুবাদ প্রদান করলাম –

ভ্রমরের মত কাল ছিল কেশ বর্ণে,

কুঞ্চিত ছিল বেণী-পর্ণে;

আজি যে জরায় মারা শণের মতন সাদা;

প্রভুর বচন জাগে মৰ্মে।

সত্য বচনে তাঁর অন্যথা কোথা বা?

সুগন্ধি চূর্ণকে ছিল কেশ সুরভি,

গুঁজিতাম সদা তায় চম্পক করবী।

শশকের লোমপ্রায়, গন্ধ এখন তায় ;

যাবে সব; সারহীন গরবই –

নীল রঙ্গে তুলি দিয়া যেন পটে লিখিত

ভ্রূযুগল সুন্দর ললিত।

জরায় এখন তথা, পেশীগুলি অবনতা;

সুন্দরী আমি আজ নহি ত।

মণিসম সুরুচির ভাস্কর আলোকে।

সুনীল আয়ত আঁখি, পলকে

করিল মলিন যে হে! জরা প্রবেশিয়া দেহ!

আকরিবে হেন ধন বল কে?

উপবনে কোকিলার মত আমি নিতি গো

গাহিতাম সুস্বরে গীতি গো।

গেছে সে মধুর স্বর। তবু কেন করে নর

এ দেহের পরে এত প্রীতি গো?

এমনি ত জর্জর – দেহদুখগেহটি

তার পানে ফিরে চাহে কেহ কি?

দেয়াল হইতে ঝ’রে রূপের প্রলেপ পড়ে!

গরবের ধন এই দেহ কি?

সত্য বচনে তাঁর অন্যথা কোথা বা?

উপসংহার :- বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের পরেও যুবতী অম্বপালী বহুদিন জীবিতা ছিলেন। বৃদ্ধবয়সে অম্বপালী একটি অতি সুন্দর গান রচনা করেছিলেন। এই গানের রচনা হতে বুঝতে পারা যায় যে প্রাচীনযুগে একজন পতিতা নারী কতদূর সুশিক্ষিত হয়েছিলেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “অম্বপালী” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) প্রাচীন ভারতের পতিতা নারী অম্বপালী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. অম্বপালী কে ছিলেন?

প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ যুগের একজন পতিতা নারী, যিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব লাভ করেছিলেন।

২. কোন নগরের কাছে অম্বপালীর নিবাস ছিল?

বৈশালী।

৩. কোন গ্ৰামে অম্বপালীর বাড়ি ছিল?

কোটিগ্ৰামে।

৪. অম্বপালী কার শিষ্যা ছিলেন?

গৌতম বুদ্ধ।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment