ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম প্রসঙ্গে গুলবদন বেগমের জন্ম, গুলবদন বেগমের শৈশব, অন্দরমহলে গুলবদন বেগমের জীবন, হুমায়ুনের সাথে গুলবদন বেগমের সম্পর্ক ও গুলবদন বেগমের গ্রন্থ রচনা সম্পর্কে জানব।
মুঘল সম্রাট বাবর কন্যা গুলবদন বেগম
ঐতিহাসিক চরিত্র | গুলবদন বেগম |
পরিচিতি | মোঘল রাজকন্যা |
পিতা | বাবর |
মাতা | দিলদার অগাচহ বেগম |
ভাই | হুমায়ুন |
রচিত গ্রন্থ | হুমায়ুননামা |
ওমর সেখ মির্জার একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তার নামকরণ করা হয়েছিল জহীর-উদ-দীন মহম্মদ। বড় কঠিন লাগে উচ্চারণ করতে। তাই নামকরণ করা হয়েছিল চিতাবাঘের মতো তার বিক্রমকে স্মরণ করেই বুঝি – বাবর। পিতার মতই বড় হয়ে বাবর অনেকগুলি পত্নীকে হারেমে স্থান দেন। এঁদেরই একজন ছিলেন দিলদার অগাচহ বেগম। মোগল সাম্রাজোর প্রতিষ্ঠাতা দুর্ধর্ষ বীর সুলতান বাবরের পাঁচ সন্তানের গর্ভধারিণী। প্রথম সন্তান ছিলেন কন্যা – নামটি চমৎকার, গুলরঙ। জন্মেছিলেন ১৫১১ থেকে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তাই থেকে ধরে নিতে পারি ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দিলদার এসেছিলেন বাবরের হারেমে। দিলদারের গর্ভে এর পরে যে সন্তানটি জন্মগ্রহণ করে ভূমিষ্ঠ হল সেটিও কন্যা ৷ এর নামটিও বেশ মনোরম – গুলচিহরা। তৃতীয় সন্তানের পিতৃদত্ত নাম আবু নাসির হলেও ইতিহাসে তার পরিচিতি একটি দারুণ সুন্দর নামে – হিন্দাল নামেই ৷ হিন্দাল না হিন্দোল ! এমন একটি পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী যদি মোগল রাজবংশে একজনকেও পেতাম, বর্তে যেতো তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাস। পঞ্চম বা শেষ সন্তান আলওয়ার (অকাল মৃত্যু ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে) জন্মাবার আগেই দিলদারের গর্ভে জন্মেছিলেন মোগল রাজবংশের বিদূষীদের অন্যতম গুলবদন, সম্ভবত ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে কাবুলে, হিন্দুস্তানের বাইরে।
হিন্দাল জন্মেছিলেন ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেদিক থেকে এই প্রিয়তমা ভগিনীটি তার থেকে বছর চারেকের ছোটো। কি ভালোটাই না বাসতেন তার এই ছোট্ট বোনটিকে আর বোনটিও দাদা বলতে অজ্ঞান। হিন্দাল তো মায়ের পেটের ভাই, ভালোবাসারই কথা। বৈমাত্রেয় ভাই হুমায়ুনই কি কম ভালবাসতেন এই ছোট বোনটিকে ! হুমায়ুন ছিলেন বাবরের জ্যেষ্ঠপুত্ৰ তার প্রধানা মহিষী মাহম বেগমের প্রথম সন্তান। হুমায়ুন (জন্ম ৬ মার্চ ১৫০৮) গুলবদনের চেয়ে বয়সে প্রায় পনেরো বছরের বড়ো। তার ভালবাসা ছিলো অনেকটা বাবার মতোই।
বাবর তনয়া, হুমায়ুন ভগিনী গুলবদন ছিলেন অবশ্যই মহামতি আকবরের পিসিমাও। পিতা বাবর যখন মারা যান গুলবদনের তখন বয়স বছর সাতেক কি আটেক (বাবরের মৃত্যু ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ)। হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ২৬ জানুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। গুলবদন তখন তেত্রিশ বছরের মধ্যবয়স্কা রমণী, আকবর তখন মাত্র ১৪ বছরের বালক (জন্ম ২৩ নভেম্বের ১৫৪২)। আর গুলবদন যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন (১৬০৩ খ্রি) তখন তিনি নিজে আশী বছরের পূর্ণ পরিণত বয়স্ক মহিলা আর সম্রাট আকবর নিজে ৬১ বছরের পরিণত শাসক।
আকবরের মৃত্যু হয় পিসিমার মৃত্যুর দু বছর পরেই (১৭ অক্টোবর ১৬০৫ খ্রি)। ইতিহাসকারেরা লিখেছেন যুবরাজ সেলিমের (জাহাঙ্গীর) বিদ্রোহ আর প্রিয়বন্ধু আবুল ফজল-এর শোচনীয় মৃত্যু তাঁকে হেনেছিল মর্মান্তিক আঘাত। আর দুই পুত্র মুরাদ ও দানিয়েলের অকাল মৃত্যু তার স্বাস্থ্যের সুঠাম কাঠামোটিকে দিয়েছিল একেবারে চুরমার করে। তাতেই তার মৃত্যু ঘটল সহসা পীড়া এসে তাকে বিপর্যস্ত ক’রে। যদি একথাও বলি যে তার অভিজাত পিতৃস্বসার মৃত্যুর বেদনাও তার মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল, তবে কি তা ইতিহাসের তথ্যের বিরোধী হবে ?
পিতা বাবর, বৈমাত্রের ভাই হুমায়ুন, ভ্ৰাতুষ্পুত্ৰ আকবর – তিন সম্রাটের জীবনের সূচনা ও স্থিতি, প্রতিষ্ঠা ও বিপর্যয়, সুখ ও দুখের তিনপুরুবের ভাগী ও সাক্ষী গুলবদনের জীবনে তাই জন্মেছিল অজস্ৰ অভিজ্ঞতার স্তূপমণ্ডলী। তার শিক্ষিত মন সেই অভিজ্ঞতাকে উপহার দিয়েছে তার আনত্মস্মৃতির আকারে। এই আত্মস্মৃতিতে যেমন প্রকাশিত হয়েছে একটি ধর্মনিষ্ঠ রাজকীয় মহিলার ঈশ্বরানুরক্তি। যেমন মুদ্রিত হয়েছে অন্তপুরচারিণীর প্রবল কৰ্মোদ্যোগ, তেমনি সুরভিত হয়ে উঠেছে তার অন্তঃকরণের স্নেহ মিশ্রিত সৌরভ।
শুধু তাই নয় তার ‘হুমায়ুননামা’ আত্মস্মৃতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাবর-হুমায়ুন-আকবরের রাজ্যশাসনের, মোগল অন্তঃপুরের এবং সমসাময়িক ঘটনাও বিশ্বাসের দলিলচিত্র হয়ে উঠেছে। অন্দরমহলের
কেচ্ছাকাহিনী নয়। হুমায়ুননামা, সত্যনিষ্ঠ এক ইতিহাস, মোগল ইতিহাসের আদি পর্বের বিশ্বাসযোগ্য আকরগ্রন্থ। লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ‘হুমায়ুননামা’র পাণ্ডুলিপি (Or. 116) সযত্নে রক্ষিত হয়ে আজও তিনপুরুষের লিপি সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আবুল ফজল তো গুলবদনের কাছেই নানা কাহিনী শুনে তার সুখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের বহু উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন।
হুমায়ুন ছিলেন মাহম বেগমের একমাত্র জীবিত পুত্র ৷ শুধু পুত্র নন, একমাত্র সন্তানও। তার গৰ্ভজাত অন্য সব সন্তানই অকালে মারা যায়। স্বভাবতই হুমায়ুন সেজন্য ছিলেন বাবরের চোখের মণি। একবার পাটরাণী মাহমকে তিনি বলেই বসেছিলেন – কেন দুঃখ করছ রাণী, আমার আরও অনেক ছেলে আছে বটে, কিন্তু হুমায়ুনের চেয়ে কি আমি আর কাউকে বেশি ভালবাসি? সে যে আমার চোখের মনি ! হুমায়ুন যদি একরোখা হয়ে অন্য ভাইবোনদের হিংসে করতেন, খুব একটা অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু গুলবদন আর হিন্দাল সম্পর্কে তার একটা দুর্বল ক্ষেত্র ছিল। কামরান বা অস্করীও তো তার বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের কি এদের মতো এতোখানি ভালবাসতেন হুমায়ুন ? কখনোই না। বিশেষ করে কামরানকে তো কখনোই নয়। ভালবাসার কথাও নয়। কামরান কি তার কম বিরোধিতা করেছেন?
কিন্তু হিন্দাল বা গুলবদনকে ভালবাসার অন্য একটা কারণও ছিল। মৃতবৎসা মাহমের বুকে মাতৃস্নেহের অজস্ৰ উৎস। এক হুমায়ুনকে ভালবেসে তার পরিসমাপ্তি ঘটে না। সপত্নী দিলদারের সন্তানেরা তখন একের পর এক জন্মগ্রহণ করে চলেছে। না, কোনো ঈর্ষার জ্বালা মাহমকে ধরাশায়ী করে না। প্রবল মাতৃত্বে তিনি দিলদারের পুত্ৰ-কন্যাদের কাছে টেনে বুকের মধ্যে বেঁধে রাখেন ৷ সবচেয়ে ভাল লাগে তার হিন্দালকে আর গুলবদনকে। তবুও তার একটা পুত্রসন্তান আছে। কিন্ত মেয়ে না হলে কি বুকের স্নেহ পরিতৃপ্ত হয় ! মেয়ে তো নিজেরই প্রতিরূপ। তাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে, তাকে পরিয়ে-খাইয়ে, তাঁকে নাইয়ে-চুল বেঁধে তো নিজের হারানো জীবনটাকেই সাজিয়ে গুজিয়ে তোলা হয়। তার শৈশবেই গুলবদনকে কন্য়া রূপে গ্রহণ করেছিলেন। দিলদার আপত্তি করেছিলেন নিশ্চয়ই ৷ কিন্তু বাবরেরও যে সেই ইচ্ছে। তাই মায়ের পেটের ভাইবোনের মতোই হুমায়ুন আর গুলবদন বেড়ে উঠেছিলেন। হুমায়ুন তো তখন বড়োই হয়ে উঠেছেন। গুলবদন, শিশু গুলবদন মাহমের পীযূষ ধারায় স্নাত-পরিতৃপ্ত হতে থাকলেন।
কিন্তু পুত্রকন্যাদের ভালবেসে সাধারণ মানুষের মতো নিরাপদ-নিশ্চিন্তে দিন যাপনের অবকাশ কোথায় বাবরের ? দিগ্বিজয় তখন তার রক্তে ধরিয়েছে দারুণ নেশা। মাত্র পনের বছর বয়সে যিনি সমরখন্দ অধিকার করেন, চল্লিশ বছর বয়সে আক্রমণ করেন ভারত-এর সীমান্ত অঞ্চল আর তেতাল্লিশ বছরে পাঞ্জাব আক্রমণ করে দৌলত খাকে বশে আনেন, বিজয় গৌরবে দিল্লী আর আগ্রাকে অধিকার করেন চুয়াল্লিশ বছর বয়সে, পঁয়তাল্লিশ বছরে জয়লাভ করেন খানুয়ার যুদ্ধ-এ (১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দ), তার কি পুত্রকন্যাদের আদর করে ঘরের কোণে দিন কাটতে পারে?
তবুও অন্তরে তার পত্নীর জন্য যেমন ছিল ভালবাসা, তেমনি পুত্র কন্যাদের জন্যও স্নেহ ভালবাসা ছিল বইকি ! স্বামী বাবরের একের পর এক জয়ের সংবাদে মাহম আত্মহারা হয়ে কাবুল থেকে ছুটে এলেন আলিগড়ে, সঙ্গে বুকে করে এনেছেন ছয় বছরের ছোট আর ফুটফুটে গুলবদনকে। বাবর এগিয়ে গেছেন তখন আরও একটু দূরে আগ্রায়। ২৭ জুন ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দের রাত যখন নিষুতি হয়ে উঠেছে, মাহম-বাবরের মিলন হল তখন। বেশ রাত হয়ে গেছে আলিগড় থেকে আসতে। অতএব মাহম ইচ্ছে সত্বেও গুলবদনকে নিয়ে আসতে পারেন নি আলিগড় থেকে আগ্রায়। বাবরের পিতৃহৃদয়, বুভুক্ষু পিতৃহৃদয় যেন হতাশায় কেঁদে উঠল। পরের দিন ভোর না হতেই পিতার সঙ্গে কন্যার মিলনকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাবর লোক পাঠিয়ে দিলেন। ছোট্ট গুলবদন এসে বাবাকে দেখে বাবার পায়ে, পরম শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে লুটিয়ে পড়ল। গুলবদনের বাবা আর পাঁচটা মেয়ের বাবার মতো তো নন, তিনি দিগ্বিজয়ী বীর বাবর। পিতা বাবর তখন পরম স্নেহে গুলবদনকে বুকে তুলে নিয়ে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দিলেন গুলের বদন। ছোট্ট বেলার সেই স্মৃতি গুলবদনের অন্তরে চিরস্থায়ী মুদ্রিত হয়ে গেছিল। সেদিনের সেকথা স্মরণ করেই বড় হয়ে ‘হুমায়ুননামা’-তে গুলবদন উজ্জল করে, গৌরব করে লিখেছিলেন “বাবার বুকের মধ্যে আটকে থেকে আমি যে কি অপার নির্মল আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলাম, জীবনে তার চেয়ে বেশি আনন্দের অনুভূতি বুঝি কল্পনাতীত ৷”
ভিতরে ভিতরে বোধহয় বাবর বুঝতে পারছিলেন, তার দিন ফুরিয়ে আসছে। জীবনের আস্বাদকে তাই তিনি বুঝি চাইছিলেন পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে নিতে। তাই না চাইলেন মাহমকে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দিতে, না চাইলেন গুলবদনকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন সৌন্দর্যনগরী ঢোলপুর আর সিক্রিতে। সিক্রির বাগানে সকলে মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি চৌখণ্ডী – বাবর এটিকেই একটি তূর্খানা করে এর উপরে বসে তার আত্মজীবনী ‘বাবরনামা‘ রচনা করতেন (বাবরের আত্মজীবনী তুজুক-ই-
বাবরী এবং ওয়াকি-য়াৎ-ই-বাবরী নামেও পরিচিত)৷
এই সিক্রির বাগানের এক নির্জন কোণে বসে মা মাহম একনিষ্ঠ মনে নিরত হতেন আল্লাহ-এর উপাসনায়। বাবরের অপর এক পত্নী ছিলেন মুবারিকা ৷ নিঃসন্তান মুবারিকাও এসেছিলেন মাহমের সঙ্গে এই সিক্ৰির বাগানে। মাহম প্রায়ই ভগবৎ-উপাসনায় নিমগ্ন থাকতেন আর ছোট্ট গুলবদনকে সে সময়ে দেখাশোনা করতেন মুবারিকা। একদিন একটা ঘটনার কথা গুলবদন স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে তার ‘হুমায়ুননামা’য় উল্লেখ করে দিয়েছেন। মুবারিকা আর গুলবদন খেলা করছিলেন। গুল একটু অশান্ত। তাকে টেনে ধরে আনতে গিয়েছিলেন মুবারিকা। হতভাগিনীর টানটা একটু বেশি জোরেই হয়ে গিয়েছিল। একটা বড়ো মানুষের হাতের জোরে কি ছোট্ট মেয়ে পারে? টানাটানিতে ছোট্ট গুলের হাড় গেল সারে। খুব জোরে কেঁদে উঠেছিল গুলবদন। সঙ্গে সঙ্গে খবর
পাঠানো হল চিকিৎসককে ৷ তিনি এসে মশলা আর আরক দিয়ে বেঁধে দিলেন। ভাঙা হাড় জোড়া লাগল অনতিবিলম্বে। খবরটা বাবরের কানে গেল। অস্থির হয়ে ছুটে এলেন তিনি। কোলে তুলে নিলেন আদরের মেয়েটিকে ; মেয়েকে দেখে তবে স্বস্তি পেলেন।
কিন্তু গুলবদনের ভাগ্যে পিতার এমন নিঃসপত্ন আদর বুঝি বেশি দিনের জন্য লেখা ছিল না। হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সম্ভল জয় করতে গিয়ে নিদারুণ গ্রীষ্মের খরতাপে ৷ দিল্লীতে এসেই তার অবস্থা এতো সঙ্গীন হল যে আগ্রা পর্যন্ত তাকে আনা যাচ্ছিল না। শেষ অবধি তিনি আগ্রায় এলেন। গুলবদন, তার বোনেরা হুমায়ুনকে দেখে একেবারে কাতর হয়ে গেলেন। বাবরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হুমায়ুন যেন একেবারে প্রলাপ বকছেন। তারপর সেই বহু পরিচিত উপাখ্যান। ঈশ্বরের কাছে বাবরের প্রার্থনা – আমার আয়ু নিয়ে তুমি আমার পুত্রকে বাঁচিয়ে দিও। উপাখ্যান বলে হুমায়ুন বেঁচে উঠলেন, বাবর শুলেন মৃত্যুশয্যায়। শুনতে ভাল লাগে এই ঈশ্বর বিশ্বাসের মনোরম কাহিনী।
কিন্তু ঘটনা তা নয়। গুলবদন স্বয়ং তার সাক্ষী। তিনি লিখেছেন, সেদিনই বাবর অসুস্থ হয়ে শুলেন বটে, কিন্তু বাবর অনেক আগে থেকেই হতাশায় ভুগছিলেন। তাঁর মনের জোর তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই বাবরের মৃত্যু হয়নি। ভাল হয়ে হুমায়ুন আগ্রা ছেড়ে পুনশ্চ সম্ভলে যান বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আর উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই জেনেই। দু ‘তিন মাস ভোগার পর হঠাৎ তার অবনতি ঘটে এবং হুমায়ুনকে ডেকে পাঠানো হয় এবং তারপর বাবরের মৃত্যু ঘটে। বাবরের মৃত্যু স্বভাবতই গুলবদনের জীবনে শুন্যতা আনল। সাত বছরের মেয়ে নিশ্চয়ই সেই “ফিরদৌস মকানী’ দুঃখস্মৃতি ভুলে যান নি, যেতে পারেন নি।
দুঃসময় একা আসে না কখনও। গুলবদনের জীবনেও নিরবচ্ছিন্ন, সুখ প্রশ্রয় পায় নি। পিতার মৃত্যুর ক্ষত তখনও তার অন্তর থেকে শুকোয়নি। তার কাছে এসে পড়ল আরও একটি তীব্র অপ্রাৰ্থিত আঘাত। বীবনের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হুমায়ুন আগ্রায় এসে মা মাহমের কাছে আছেন ৷ ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্ৰিল-মে মাস তখন। মাহমের পেটে এক দারুণ পীড়া দেখা দিল – তিনি চলে গেলেন তার প্রিয় স্বামীর সন্নিধানে (১৫৩৩)। দশ বছরের গুলবদন, অনাথ গুলবদন কান্নায় ভেঙে পড়লেন একেবারে। ক্রমাগত কেঁদে চলেন, কিছুতেই পারেন না মনকে প্রবোধ মানাতে। নিজেকে ভাবেন এক আশ্রয়হীনা আতুর বালিকা বলে। তার প্রিয় আকাম্ও তাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন – মাত্র দশ বছরের বালিকা স্বপ্নেও ভাবে নি।
গুলবদনকে অতএব ফিরতে হল গর্ভধারিণী দিলদারের স্নেহবুভুক্ষু হৃদয়ের চিরবাঞ্ছিত আশ্রয়ের মধ্যেই। শুধু গুল একা নয়, অগ্রজ হিন্দালকেও তার বুকে তুলে নিলেন দিলদার। এতোদিনে দিলদার পূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি তো এতোদিন ওদের প্রসব করেই ছিলেন – পালন তো করতে পারেন নি। অভিমানে প্রথমে নিশ্চয়ই ফুলে উঠেছিল তাঁর শুষ্ক ওষ্ঠাধর। তিনি মা, কতক্ষণই বা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন। অচিরে টেনে নিয়েছিলেন পুত্র কন্যা দুটিকে শূন্য বুকের পিঞ্জরে। সেদিন ভরে উঠেছিল তার মাতৃহৃদয় কানায় কানায়। গুলবদনও কি প্রাপ্তির আনন্দে চোখ দুটিকে বন্ধ করে মায়ের উত্তপ্ত স্নেহ আস্বাদন করে নি? সে এক মনোরম মনোহর দৃশ্য। দীর্ঘদিন গুলবদন মায়ের কবোষ্ণ বুকটিকে আশ্রয় করে রইলেন।
ইতোমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে ৷ স্বয়ং সম্রাট হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধ-এ পরাস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ঘোড়াশুদ্ধ গঙ্গা পার হতে গিয়ে এক ভিস্তিওয়ালার বায়ুপূৰ্ণ মশকের কল্যাণে বেঁচে গেলেন ৷ আর একটা দুর্বল সেতু ভেঙে পড়ে বহুজনের ঘটেছে প্রাণহানি। হারেমের বহু ললনার হয় মৃত্যু ঘটেছে, না হলে তারা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে ৷ রাণী হাজী বেগম ধরা পড়েছেন আফগানদের কবলে ৷ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন আয়েশা সুলতান বেগম, চাঁদ বিবি এমন কি শিশু আকিকা বেগমও। ভাগ্য বিপর্যয়ের নানা দুখময় পর্যায় পার হয়ে হুমায়ুন ফিরে এসেছেন পুনশ্চ আগ্রায়। গুলবদনকে শেষ দেখেছিলেন বোধহয় তার দশ বছর বয়সে। বালিকা গুলবদন তখন মাথায় পরতেন কুমারীর আবরণ “তাক” এখন পরিবর্তে পরিধান করেছেন যৌবনবতী রাজকুমারীর মস্তকাবরণ ‘লচক’
(বিভারিজের অনুদিত হুমায়ুনামার ১৩৮ পৃষ্ঠায় এর বিবরণ আছে)। তিনকোণা ঐ মস্তকাবরণে ভারী সুন্দর দেখতে লেগেছিল স্নেহের বোন গুলবদনকে হুমায়ুনের। বোনকে ডেকে অনেক আদর করে দুজনে মিলে অনেক দুঃখ করেছিলেন মাতা মাহমের জন্য। গুলের দু চোখে জল এসেছিল – একদিকে আনন্দাশ্রু, অন্যদিকে শোকাশ্রু।
এরই মধ্যে গুলবদনের বিয়ে হয়ে গেছিল চঘতাই-মোগল বংশের খিজর্ খাওয়াজা খানের সঙ্গে তার পনেরো বছর বয়সে। কিন্ত বিবাহিত জীবনে সুখ কই? ভ্রাতৃবিরোধে মোগল রাজবংশের সিংহাসন টল-টলায়মান। হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বৈমাত্রের ভাই কামরান যৎপরোনাস্তি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কামরানের তঞ্চকতাও লক্ষ্য করার মতো। গুলবদনকে তিনি তার পক্ষভুক্ত করতে চান। তাই মিষ্টি কথায় বার বার হুমায়ুনকে লিখতে লাগলেন – “আমি নিদারুণ অসুস্থ, যদি গুলবদনকে পাঠাও, আমি খুবই বাধিত হবো”। হুমায়ুন, সরল হুমায়ুন গুলকে ডেকে বললেন – বোনটি,। কামরান অসুস্থ, তুমি এখনই তার কাছে যাও। হুমায়ুনের স্নেহে অভিসিঞ্চিত গুলের ঠোঁট দুটি ফুলে উঠল অভিমানে তুমি কি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ দাদা? তাড়িয়ে দিলেও আমি যাবো না।
হুমায়ুন পাগলী বোনের কাণ্ড দেখে অবাক। শেষে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তারপরেই হুমায়ুনের রাজ্যে শুরু হল অনিশ্চয়তার লঙ্কাকাণ্ড। শেরশাহ-এর উপর্যুপরি আক্রমণে হুমায়ুন বিধ্বস্ত। তার পাশে এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছেন গুলের সহোদর অগ্রজ হিন্দাল। কিন্তু গুল কোথায়? কামরান কি তাকে নজরবন্দী করে রেখেছিলেন? গুলবদন কি অভিমানবশতঃ দাদার বিপদের দিনেও কি মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন? ইতিহাসে সে কথার উল্লেখ কোথায়? গুলবদন তো আত্মকথা লিখতে বসেন নি, চেয়েছিলেন হুমায়ুনের রাজত্বের উত্থান-পতনের কাহিনী লিখতে ৷ নিজে চোখে দেখেন নি এই সময়ের ঘটনাগুলি বলেই কি গুলবদন এখনকার কথা লেখেন নি? কাবুল থেকে দিল্লী-আগ্রার কথা জানা সহজ ছিল না সেকালে।
হুমায়ুনের সঙ্গে আবার তার দেখা হল দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। হুমায়ুন তখন পারস্যের শাহ তাহমাস্প-এর আশ্রয় পেয়ে অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়েছেন l কান্দাহার পুনরুদ্ধারে তিনি এগিয়ে এসেছেন। দাদাকে কাছে পেয়ে গুলবদনের কি আনন্দ ! সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে একেবারে ছোট বোনটির মতো দাদাকে সাদরে নিলেন বরণ করে।
কামরানের আশ্রয়ের দিনও তার শেষ হয়ে এল কামরানেরই ঔদ্ধত্যে ৷ ক্ষমতালোভী কামরান একদিন বিমাতা দিলদারকে দারুণ অপমান করে বসলেন। গর্ভধারিণীর এই অপমানে গুলবদনের হৃদয়ের ভালবাসার স্নিগ্ধ প্রদীপ-শিখাটি বহ্নিশিখায় প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল। তীব্ৰ প্রতিবাদ করে প্রবল ঘৃণায় কামরানের আশ্রয়কে করলেন প্রত্যাখ্যান ৷ কামরান বুঝতে পারলেন ভুজঙ্গিনীকে দলন করা উচিত হয় নি। অমনি খোসামোদ করে সারা ৷ বললেন, এখনই তার প্রয়োজন গুলবদনের স্বামী খিজর খাঁর সাহায্য। দাও তো ভাই খাঁ সাহেবকে একখানা চিঠি লিখে।
পিত্তি জলে উঠেছিল গুলবদনের। কিন্তু কামরানের নৃশংস চরিত্র তার অজানা নয়। তাই মনে মনে ফেঁদে বসলেন একটা কৌশল। বললেন, দেখ ভাই – আমি তো স্বামীকে কোনদিন চিঠি লিখি নি। আমার হাতের লেখা তিনি চেনেনই না। জাল চিঠি ভেবে তিনি আসবেনই না হয়তো। মাঝখান থেকে তোমার অপমান হয়ে যাবে খামোকা। কাজ নেই ওঁর সাহায্য চেয়ে। আসলে কামরান চান সর্বদা হুমায়ুনের ক্ষতি ৷ সেকথা বুদ্ধিমতী গুলবদনের অজানা নয়।
গুলবদনের মতো হিন্দালও চাইতেন না হুমায়ুনের সর্বনাশ। তাই জীবনের বিনিময়ে সেই ভালবাসার শিলমোহর এঁকে দিয়েছিলেন হিন্দাল। ২৩ নভেম্বর ১৫৫১ (আবুল ফজল লিখেছেন ২০ নভেম্বর) তারিখের রাত্রির প্রথম প্রহর অতীত ৷ সুরখাব আর গণ্ডমকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিয়াহ অব নদীর তীরে মির্জা কামরানের আক্রমণে রাতের ঘন অন্ধকারে গোলমালের মধ্যে প্রাণ হারাতে হল বীর হিন্দালকে মর্মান্তিকভাবে। শহীদের মৃত্যু সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রিয়তমা ভগ্নী গুলবদনকে রেখে গেলেন এক নিদারুণ বেদনাভরা অবস্থার মধ্যে। গুলবদন লিখেছেন (ইংরাজি অনুবাদে) — If that slayer of a brother, that stranger’s friend, the monster, Mirza Kamran had not come that night, this calamity would not have descended from the heavens? আর অশ্রু দিয়ে বুঝি আরও লিখে গেলেন – “আয় দরেঘা, আয় দরেঘা, আয় দরেঘা/আফতাবম শুদ নিহান্ দর জের-ই-মেঘ !” – হায়রে হায়রে, হায়রে দুঃখ ! আমার সূর্য মেঘের আড়ালে গেল ঢেকে।
তারপর থেকেই গুলবদনের গোলাপের পাপড়িতে যেন শুষ্কতা দেখ দিল। গুল ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজেকে নিয়ে যেতে লাগলেন। শেরশাহের প্রবল তাড়নায় বিহ্বল হুমায়ুন গুলবদন আর সব মেয়েদের নিয়ে (১৫৫৬) পশ্চিম সিওয়ালিকের কাছে মানকোটের রাজশিবিরে উপস্থিত ৷ গুলবদনকে সেই শিবিরে আমরা যেন দেখি এক বিবাগী সন্ন্যাসিনী। এক পরম ঔদাসীন্য, জীবনের প্রতি একটা নির্মোহ ভাব তাকে যেন কোন সুদূরের সত্তায় পরিণত করেছে। শুধু বই পড়ায়, কবিতা রচনায় এই সন্ন্যাসিনীর সময় কাটে। পতিপরায়ণা এই নারীর সংসারজীবনেও এসে গিয়েছিল নিরাসক্তি। তাই সাদৎ-ইয়ার ছাড়া অন্য কোনো পুত্রকন্যার নাম পর্যন্ত তিনি উল্লেখ করেন নি।
জীবনের উপভোগের ক্ষণিকতা গুলবদনের বোধকে করেছিল গভীরভাবে আচ্ছন্ন। ঈশ্বরমুখিতাকেই তখন ভাবতে শুরু করেছিলেন জীবনের একমাত্র আচরিত বস্তু। পঞ্চাশ পার হয়ে গেছেন এখন গুল – এক পা পরপারের দিকে। এখনই তো প্রয়োজন আল্লাহ-এর উপাসনা করা, প্রয়োজন মক্কাতীৰ্থ ঘুরে আসা। বিধবার জীবনে, এর চেয়ে প্রার্থিত আর কি হতে পারে? হুমায়ুন নেই। মহাসন্মানে তাকে রেখেছেন আকবর ৷ ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছে হজ-গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন গুলবদন। সম্রাট নারাজ পিসিমাকে ছেড়ে দিতে। পরের বছর হজযাত্রার সময় এলে আকবরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ইচ্ছের কথা পুনরায় করে। রক্ষণশীল সম্রাট আর না করতে পারলেন না। পথের বিপদের ভয়ও গুলবদনকে পারল না তার ইচ্ছা থেকে অপসারিত করতে।
গুজরাটের সাম্রাজ্যভুক্তি এবং গোয়ার বিদেশী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় পরিস্থিতি অনুকুল বুঝে আকবর শেষে মক্কা যাত্রার ব্যবস্থা করলেন দুভাবে – একটি দল যাবে পুরুষদের, অন্যটি যাবে জেনানাদের নিয়ে। পুরুষদের জন্য তিনি তো দরবারে একটি পদই সৃষ্টি করে বসলেন – মীর হাজি, যিনি হবেন তীৰ্থযাত্রী দলের সরকার নিযুক্ত নেতা।
অক্টোবর ১৫৭৫ ৷ মেয়েদের দলটির সঙ্গে গুলবদন রওনা হলেন তার প্রার্থিত ভূমির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে গেলেন অন্তপুরের আরও নয়জন গণনীয় মহিলা। তাদের মধ্যে প্রধান নুর উদ দীন মহম্মদের কন্যা, বৈরাম খান-এর প্রাক্তন পত্নী এবং বর্তমানে আকবরের প্রধানা মহিষী সলীমা সুলতান বেগম। যাত্রাপথে যাতে কোনো বিঘ্ন উপস্থিত না হয় সেজন্য বিস্তৃত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গৃহীত হল। শুধু গুলবদন যাচ্ছেন না। স্বামীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্বামীকে ছেড়েই যাচ্ছেন স্বয়ং বেগম সাহেবা। আরও আছেন গুলবদনের বৈমাত্রের ভাই অস্করীর বিধবা স্ত্রী সুলতানাম্ বেগম, মৃত কামরানের দুই মেয়ে হাজী ও গুল-ইজার বেগম এবং গুলবদনের পৌত্রী উম্-ই-কুলসূম্ ৷ যাচ্ছেন সালীমা খানম্ ইনি খিজর্ খাজার মেয়ে, গুলবদনেরই আত্মজা কি? আগ্রা থেকে সবাই রওনা হলেন ৷ বেশ অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে এলেন আকবরের দুই বালক পুত্ৰ সেলীম ও মুরাদ। রওনা হলেন একটি তুর্কী জাহাজে, নাম – ‘সলীমী’। পুরুষদের নিয়ে রওনা হল আরও একটি জাহাজ ‘ইলাহী’। সব খরচ দিলেন সম্ৰাট।
কিন্তু পর্তুগীজরা অত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। হলই বা রাজকীয় তীৰ্থযাত্রা। তাঁদের দাপট সমানে চলতে লাগল সমগ্র জলপথে। এতএব আটকে পড়ে যেতে হল সুরাটে। সেও অল্প দিনের নয় – প্রায় একটা বছর। অবশেষে আশ্বাস পাওয়া গেল, পথিমধ্যে নারীদের ধর্ষিতা হবার আর ভয় রইল না। অতএব গ্যারন্টির কাগজপত্র নিয়ে জাহাজ পুনশ্চ পাড়ি দিল সুরাট বন্দর থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ল জাহাজ এডেনের কাছে। দীৰ্ঘকাল পড়ে থাকতে হল সেই নির্জন বন্দরে। শেষে অনেক ভুগে হজ সেরে ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের মাৰ্চ মাসে তীর্ঘযাত্রীরা এসে পৌঁছালেন ফতেপুর সিক্রিতে। আজমীর ঘুরে দেখলেন চিশতী ফকিরদের পবিত্র বাসস্থান। কিন্তু কই আমরা তো গুলের কাছ থেকে এই ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ পেলাম না। এও সেই
সন্ন্যাসিনীর আত্মগোপনের, আত্মবিস্মরণের অকথিত কাহিনী ৷ আকবর তো তাকে হুমায়ুনের কথা লিখতে বলেছেন, কেন গুলবদল আত্মজীবনী লিখতে যাবেন?
কিন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান রমণী গুলবদনের মধ্যে অন্য ধর্মের, বিশেষতঃ খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি একটা জুগুপ্সার ভাব ছিল। হজ থেকে ফিরে এসে বুঝি সেটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। দমন-এর কাছে বুংসর বলে একটা গ্রাম পোতুৰ্গীজদের দিয়ে হজ যাবার অনুমতি নিয়েছিলেন গুল বাধ্য হয়ে, খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি তার অনীহা হয়েছিল বুঝি ঐ পোতুৰ্গীজ দস্যুদের আচরিত ধর্ম বলেই। ফিরে আসার পর তাই তার মধ্যে বিরূপতা লক্ষ্য করা গেল ৷ সম্রাটের লোকজনদের বললেন, গ্রামটা কেড়ে নাও। তাই করতে গেলে পোতুৰ্গীজরা একটা মোগল জাহাজ আটকে রেখে দিল। মোগলরাও একদল তরুণ ভ্রমণকারীদলের নয়জনকে গ্রেপ্তার করে বসল। এদিকে উপস্থিত পোর্তুগীজ যাজক ফাদার রাইভোলফো আ্যাকোয়াভিভা (AQUAVIVA)। দৰ্শনশাস্ত্ৰের এই অধ্যাপক কুমার মুরাদকে মাঝে মাঝে খ্রিষ্টধর্মের উপদেশ দিতেন। গুলবদন ফিরে এসে এই ব্যাপার দেখে দারুণ দুঃখিত হয়ে এর প্রতিবাদ করেন।
এখন গুলবদন প্রায় ষাট বছরের বয়সকে ছু’ই-ছু’ই। বাস করছেন আগ্রার রাজপ্রাসাদে। এখানে বসেই রচনা করেন অনেক কবিতা ফার্সী ভাবায়। শিক্ষিতা মহিলা গুলবদনের অন্তরে বাস করত একটি কবিপ্রাণ। আর রচনা করেন এক মনে ‘হুমায়ুননামা’। আকবর আদেশ দিয়েছেন গুলবদনের জানা এবং স্মৃতিবাহিত যে সব ঘটনা বাবর এবং হুমায়ুনকে আশ্রয় করে আছে, সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে ৷ আবুল ফজল সেই উপকরণ দিয়ে লিখবে আকবরের ইতিহাস। বাবরকে দেখেছেন সেই ছোট বয়সে। বাবরের অনেক কথাই তার শোনা কথা মাত্র। তাই দেখি ‘হমায়ুননামা’য় বাবরের বর্ণনা কতো সংক্ষিপ্ত। হুমায়ূনের জীবন, তার বিজয়যাত্ৰা, তার পরাজয়, বিশ্বাসঘাতক কামরানের হাতে হুমায়ুনের ভাগ্যবিপর্যয়-এর নানা কাহিনীতেই হুমায়ুননামার অধিকাংশ পৃষ্ঠা আকীর্ণ। অনেক রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া তার সময়ের নানা সামাজিক আচার-ব্যবহারের কথাও এই উল্লেখযোগ্য
বইটিতে জুগিয়েছে মূল্যবান উপকরণ। মোগলদরবারের আদব-কায়দা, তৈমুর বংশীয়দের রীতিনীতি, হিন্দালের বিয়ের বিচিত্র আখ্যানে হুমায়ুননামা পরিপূর্ণ।
গুলবদনের আত্মসাক্ষী ও সততা, তথ্য সংগ্রহের প্রবল নিষ্ঠা বইটিকে করে তুলেছে বহুমূল্য ৷ মাহম বেগম, খানজাদাহ বেগম, হামিদাবানু বেগমের কাছ থেকেও সংগৃহীত হয়েছিল ইতিহাসের নানা ঘটনা ৷ মূলত
ফার্সী ভাষায় লিখিত এই বইয়ে তুর্কি ভাষারও মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। পাণ্ডিত্য তার পাতায় পাতায় ছড়ানো, কিন্তু কী গভীর বিনয়ে নিজেকে ঘোষণা করেছেন একজন ‘ইন হকীর’ বলে – যার অর্থ নগণ্য নারী ৷ তার পান্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে এই শব্দগুলি – আহওয়াল হুমায়ুন পাদশাহ্ জমহকরদহ গুলবদন বেগম বিনৎ বাবুর পাদশাহ্ অম্ম আকবর পাদশাহ ৷
গুলবদন নিশ্চয়ই শিক্ষিত নারী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন না ভুল-ত্রুটির উর্ধে। সব মূল্যবান ঘটনাই প্রচুর আলোকপাতে উজ্জল নয়। বানানের ভুলও কম নয় আবার অনেক বাক্যবন্ধ জড়ানো আর অস্পষ্ট। স্বামীকে চিঠিপত্র লিখতেন। কিন্তু হাতের লেখা খুব একটা ভাল ছিল না। থাকার কথাও নয়। বিবাহের (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাল্য-বিবাহ) সঙ্গে সঙ্গেই তো অন্দরমহলের শিক্ষার ইতি ঘটতো। তবুও হুমায়ুননামার গুরুত্ব এতটুকু কম করে দেখার কিছুমাত্র কারণ নেই। এই গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন বলেই তো আকবর গুরুভার অৰ্পণ করেছিলেন।
লিখতে লিখতে গুলবদনের হয়তো আরও দশটা বছর কেটে গিয়েছিল। স্বেচ্ছানির্বাসিতা এই মহিলার সেই দশ বছরের জীবনের কাহিনী আমরা জানি না। তারপর তার জীবনে নীরবতার আরও দশ, বারোটি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। গুলবদন তখন আশি বছরের এক পূৰ্ণবয়স্ক সম্ভ্রান্ত মহিলা। আকবর তাকে পূর্ণ মর্যাদায় পালন করে চলেছেন। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে গুলবদন একেবারে বিছানাগত হয়ে পড়লেন। শয্যাপার্শ্বে আকবর জননী হামিদাবানু বেগম। হামিদা যখন তাদের সংসারে এসেছিলেন তখন গুলের বয়সই বা কতো – বছর আঠারো। দুই তরুণী বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন ভালবাসার গাঢ় সুত্রে। হামিদা তো তার চেয়ে বয়সে চার বছরের ছোটই ছিলেন। সেই হামিদাও এখন পরিণত বৃদ্ধা। হামিদা এসে ননদিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ওষুধ খাইয়ে দেন। আর ভাঙা গলায় ফিসফিসিয়ে পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন।
কিন্তু ভালবাসা দিয়ে যদি সবাইকে আটকে রাখা যেত! যায় না, যায় না। হামিদা বানুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই, ঐ আটকে রাখার বাণী উচ্চারণ করতে করতেই ৮২ বছরের গুলবদনের উজ্জল চোখ দুটি বন্ধ হয়ে গেল (৭ ফেব্রুয়ারী ১৬০৩) ৷ হামিদার কানে তখনও গুঞ্জরণ করে চলেছে গুলবদনের শেষ কথা কটি – ‘আমি চলে যাচ্ছি হামিদা, তুমি চিরজীবিনী হও।’ “অহন্যানি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরং -‘ শেষে যারা রইলেন, অগ্রগামিনীরা এ কথা জেনেও তাদের আয়ুষ্কামনা করেন। এইতো জীবন, এইতো মাধুৰ্য, এইতো প্রেম।
(FAQ) গুলবদন বেগম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। গুলবদন বেগম কে ছিলেন?
ভারতের মোঘল সম্রাট বাবরের কন্যা হলেন গুলবদন বেগম।
২। গুলবদন বেগমের মায়ের নাম কী?
দিলদার বেগম।
৩। কখন, কোথায় গুলবদন বেগমের জন্ম হয়?
১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে।
৪। গুলবদন বেগম রচিত গ্রন্থের নাম কী?
হুমায়ুননামা
৫। হুমায়ুননামা গ্রন্থ থেকে কার কথা জানা যায়?
মোঘল সম্রাট হুমায়ুন