মহম্মদ ঘুরী

সুলতান মহম্মদ ঘুরী প্রসঙ্গে জন্ম, রাজত্বকাল, গজনির শাসক, খোরাসানের আধিপত্য, গুজরাট আক্রমণ, তরাইনের প্রথম যুদ্ধ, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ, কনৌজ জয়, মৃত্যু ও ঘুর সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জানবো।

আফগানিস্তানের ঘুর সাম্রাজ্যের মহান শাসক মহম্মদ ঘুরী প্রসঙ্গে মহম্মদ ঘুরীর জন্ম, মহম্মদ ঘুরীর পরিচয়, মহম্মদ ঘুরীর আসল নাম, মহম্মদ ঘুরীর প্রকৃত নাম, মহম্মদ ঘুরীর অনুচর, মহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি, মহম্মদ ঘুরীর রাজত্বকাল, গজনির শাসক মহম্মদ ঘুরী, মহম্মদ ঘুরীর গুজরাট আক্রমণ, তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীর পরাজয়, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীর জয়লাভ, মহম্মদ ঘুরীর কনৌজ জয়, ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান মহম্মদ ঘুরী, মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যু ও তার স্মৃতি।

সুলতান মহম্মদ ঘুরী

ঐতিহাসিক চরিত্রমুইজুদ্দিন মহম্মদ ঘুরী
বংশঘুর বংশ
জন্ম১১৪৯ খ্রিস্টাব্দ
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ১১৯১ খ্রিস্টাব্দ
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ
চন্দওয়ারের যুদ্ধ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু১২০৬ খ্রিস্টাব্দ
সুলতান মহম্মদ ঘুরী

ভূমিকা :- ঘুর সাম্রাজ্য -এর অন্যতম মহান শাসক ছিলেন মুইজউদ্দিন মহম্মদ ঘুরি। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শাসনের ভিত্তি তিনিই স্থাপন করেছেন।

মহম্মদ ঘুরীর জন্ম

১১৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তান -এর ঘুর অঞ্চলে মুইজউদ্দিন মহম্মদ ঘুরি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রথম বাহাউদ্দিন ছিলেন ঘুরের একজন স্থানীয় শাসক। তার বড় ভাই ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ।

মহম্মদ ঘুরীর রাজত্বকাল

তিনি ভাই গিয়াসউদ্দিন মহম্মদের সাথে ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি ১২০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন শাসক হিসেবে শাসন করেন।

গজনির শাসক মহম্মদ ঘুরী

মহম্মদ ঘুরি ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনি আক্রমণ করে অগুজ তুর্কিদের বিতাড়িত করেন। অগুজ তুর্কিরা গজনভিদের কাছ থেকে শহরটি দখল করে নিয়েছিল। এরপর মুইজউদ্দিনকে গজনির শাসক নিযুক্ত করা হয়।

মহম্মদ ঘুরীর খোরাসানে আধিপত্য

পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তর খোরাসানের আধিপত্য নিয়ে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি তার ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সহায়তা করেন।

মহম্মদ ঘুরীর মুলতান ও উচ দখল

সুলতান মহম্মদ ঘুরি ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে হামিদ লুদি রাজবংশের কাছ থেকে মুলতান জয় করেন। ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ অধিকার করেন।

মহম্মদ ঘুরীর গুজরাট আক্রমণ

সোলাঙ্কি বংশের দ্বিতীয় ভীমদেব -এর রাজত্বকালে মহম্মদ ঘুরী গুজরাট আক্রমণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। এই যুদ্ধে সোলাঙ্কি রাজমাতা নাইকিদেবী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।

তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীর পরাজয়

  • (১) পূর্ব পাঞ্জাব তখন ছিল আজমীর ও দিল্লীর অধিপতি চৌহান বংশীয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজের অধীনে। তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহান বা রায়পিথোরা ছিলেন বিখ্যাত যোদ্ধা। মহম্মদ ঘুরী পশ্চিম পাঞ্জাব অধিকার করলে তিনি বিপদ বুঝে তার সীমান্ত দুর্গ তবরহিন্দ বা ভাতিণ্ডাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন।
  • (২) মহম্মদ ঘুরী তাঁকে পাশ কাটিয়ে পূর্ব পাঞ্জাবে ঢুকে পড়ার উপক্রম করলে পৃথ্বীরাজ পিছিয়ে এসে দিল্লী থেকে ৮০ মাইল দূরে তরাইনের প্রান্তরে তাঁকে বাধা দেন। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে (১১৯১ খ্রীঃ) পৃথ্বীরাজের সেনাপতি গোবিন্দ রাওয়ের আক্রমণে মহম্মদ আহত হন। তাঁর সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
  • (৩) এক খলজি সেনাপতি আহত মহম্মদকে নিজ ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে তাকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন। মহম্মদ তরাইনের প্রথম যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে ঘুর রাজ্যে ফিরে আসেন।

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীর জয়লাভ

  • (১) এর পর মহম্মদ এক বছর ধরে পরবর্তী আক্রমণ হানার জন্য প্রাণপণে প্রস্তুতি করেন। যে সকল সেনা ও সেনাপতি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে দুর্বলতা দেখায় তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দেন। প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার বাছাই সেনা এবং তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি – কুতুবউদ্দিন আইবক, নাসিরুদ্দিন কুবাচা ও তাজউদ্দিন ইলদুজের সাহায্য নিয়ে তিনি পুনরায় দিল্লীর দিকে এগিয়ে আসেন।
  • (২) পৃথ্বীরাজ এবারও তরাইনের প্রান্তরে (১১৯২ খ্রি) তার গতিরোধ করেন। কিন্তু মহম্মদের তীরন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে তাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পৃথ্বীরাজ নিজে তুর্কী সেনাদের হাতে বন্দী হন।
  • (৩) হাসান নিজামীর মতে বিজয়ী মহম্মদ, পৃথ্বীরাজকে তার সামন্ত রাজা হিসাবে আজমীরে রাজত্ব করার অনুমতি দেন। সংস্কৃত গ্রন্থ বিরুদ্ধবিধি, বিদ্ববংশ ও পৃথ্বীরাজের মুদ্রা থেকে একথা সমর্থিত হয়। পরে পৃথ্বীরাজ মহম্মদের বিরোধিতা করার চেষ্টা করলে তাঁকে নিহত করা হয়।
  • (৪) আজমীরের সিংহাসনে মহম্মদের অনুগত সামন্ত হিসাবে কিছুকাল পৃথ্বীরাজের পুত্র রাজত্ব করেন। এরপর মহম্মদ ঘুরীর নির্দেশে তার সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবক দিল্লী দখল করেন। আজমেরও তুর্কীদের অধিকারে চলে যায়।

মহম্মদ ঘুরীর কনৌজ জয়

১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে চন্দওয়ারের যুদ্ধে কনৌজ -এর রাজা জয়চাঁদকে পরাজিত করে মহম্মদ ঘুরী দিল্লি দখল করেন। এরপর তিনি উত্তর রাজস্থান ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের উত্তর অংশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন।

ভাইয়ের সাথে মহম্মদ ঘুরীর ঝগড়া

১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গিয়াসউদ্দিন ও মহম্মদ ঘুরী তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে খোরাসানের দিকে অগ্রসর হন। নিশাপুর জয় করার পর ঘুরীকে রাইয়ের দিকে অভিযানে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেন নি। এর ফলে তিনি গিয়াসউদ্দিনের সমালোচনার সম্মুখীন হন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়ার ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়

ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান মহম্মদ ঘুরী

১২০২ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন মারা যান। মহম্মদ ঘুরী ভারত থেকে ফিরে আসেন এবং অভিজাত ব্যক্তিদের সমর্থন লাভ করে ফিরোজকোহে ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান হন।

শৃঙ্খলা স্থাপনে মহম্মদ ঘুরীর মনোনিবেশ

খোয়ারিজমীয় ও কারা-খিতানদের কাছে পরাজিত হয়ে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এই সময় পাঞ্জাব ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ফলে পাল্টা আক্রমণের পরিবর্তে তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মনোনিবেশ করেন।

মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যু

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় মহম্মদ ঘুরি নিহত হন। তার হত্যাকারীর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো কারো মতে এই হত্যাকারী স্থানীয় গাখার জাতি। আবার কারো মতে তিনি খোখার বা ইসমাইলিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।

মহম্মদ ঘুরীর সাম্রাজ্যের বিভাজন

মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তার অনুচররা ভাগ করে নেয়। যথা –

  • (১) কুতুবউদ্দিন আইবক ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির শাসক হন এবং দিল্লী সুলতানী প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ভারতে মামলুক রাজবংশের সূচনা হয়।
  • (২) নাসিরউদ্দিন কুবাচা ১২১০ খ্রিস্টাব্দে মুলতানের শাসক হন।
  • (৩) তাজউদ্দিন ইলদুজ গজনির শাসক হন।
  • (৪) ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার শাসক হন।

ঘুরী সাম্রাজ্যের পতন

মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর ঘুরি নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে খোয়ারিজমীয়রা ঘুরিদের উপর জয়ী হয়। এরপর ঘুরি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লেও তৈমুরীয়দের আগমনের আগে পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ঘুরি রাজ্য টিকে ছিল।

মহম্মদ ঘুরীর স্মৃতি

সুলতান মহম্মদ ঘুরীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের তিনটি মধ্য-পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘুরির নামে নামকরণ করেছে – ঘুরি-১, ঘুরি-২ ও ঘুরি-৩।

উপসংহার :- মুইজউদ্দিন মহম্মদ ঘুরীর বিজয় অভিযান ভারত -এ মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। মহম্মদ ঘুরীর একজন বিশ্বস্ত দাস কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লির প্রথম সুলতান ছিলেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “মহম্মদ ঘুরী” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) মহম্মদ ঘুরী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মুইজুদ্দিন মহম্মদ ঘুরীর জন্ম কখন হয়?

১১৪৯ খ্রিস্টাব্দে।

২. মুইজুদ্দিন মহম্মদ ঘুরী কখন ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান হয়েছিলেন?

১২০২ খ্রিস্টাব্দে।

৩. তরাইনের প্রথম যুদ্ধ কখন হয়?

১১৯১ খ্রিস্টাব্দে।

৪. চন্দওয়ারের যুদ্ধ কখন হয়?

১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে।

৫. মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যু কখন হয়?

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment