জাহাঙ্গীর ও নুরজাহান প্রসঙ্গে নুরজাহানের জন্ম, শিক্ষা ও বিবাহ, শের আফগানের হত্যা, নূরজাহানের আগ্রা আগমন, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নুরজাহানের বিবাহ, মেহেরউন্নিসার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের পূর্ব সম্পর্ক, শের আফগান হত্যায় জাহাঙ্গীরের দায়িত্ব ও ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত সম্পর্কে জানবো।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর, নূরজাহানের পূর্ব নাম, নূরজাহানের প্রকৃত নাম, জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেম কাহিনী, নূরজাহান ও জাহাঙ্গীরের বিবাহ, নূরজাহান চক্র, জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব ও মুঘল রাজনীতিতে নূরজাহানের অবদান।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের সম্পর্ক
ঐতিহাসিক চরিত্র | জাহাঙ্গীর ও নুরজাহান |
বাদশাহ | জাহাঙ্গীর |
পাদশা বেগম | নূরজাহান |
বিবাহ | ১৬১১ খ্রি |
পূর্ব নাম | মেহেরুন্নেসা |
ভূমিকা :- মুঘল যুগের ইতিহাসে অন্তঃপুরিকাদের প্রভাব মুঘল রাজনীতির ওপর মাঝে মাঝে দেখা যায়। ধাত্রী মাতা মহম আনাগা আকবর -এর নাবালকত্বের সময় আধিপত্য স্থাপনের ক্ষীণ চেষ্টা করেন। কিন্তু আকবরের বাক্তিত্বের জন্য তা সফল হয় নি।
হাতের পুতুল জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে তার মহিষী নূরজাহান বেগম রাজকার্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। এই বেগম সম্রাটকে প্রায় হাতের পুতুলে পরিণত করেন বলে ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন।
মেহেরউন্নিসার জন্ম
নূরজাহানের পিতা মীর্জা গিয়াস বেগ আদিতে পারস্যের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দারিদ্র্য দশা থেকে মুক্তিলাভের আশায় ভারতে আসেন। পথিমধ্যে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহারে তার এক কন্যার জন্ম হয়। এই কন্যার নাম ছিল মেহেরউন্নিসা।
আকবরের অধীনে গিয়াস বেগের চাকরি
মীর্জা মিয়াস বেগ সম্রাট আকবরের অধীনে সাধারণ চাকুরী নেন। কিন্তু তার যোগ্যতা ও প্রতিভার বলে দ্রুত চাকুরীতে উন্নতি লাভ করেন। তিনি কাবুলের দেওয়ান এবং পরে সরকারি কারখানার দেওয়ান নিযুক্ত হন। জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসার পর গিয়াস বেগ সহকারি দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং ‘ইতিমাদ উদদৌলা’ উপাধি পান।
মেহেরউন্নিসার শিক্ষা ও বিবাহ
মীর্জা গিয়াস তার কন্যা মেহেরউন্নিসার সুশিক্ষার বন্দোবস্ত করেন। কন্যার ১৭ বছর বয়সে তাকে আলিকুলি ইস্তাজলু বা শের আফগান নামে এক পারসিক যুবকের সঙ্গে বিবাহ দেন। আলিকুলির সাহস ও বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আকবর তাঁকে ‘শের আফগান’ উপাধি দেন।
বর্ধমানের জায়গীরদার শের আফগান
জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসার পর শের আফগানকে বর্ধমান -এর জায়গীরদার নিযুক্ত করেন। এই সময় বাংলায় আফগান শক্তি পুনরায় মুঘলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টা চালায়। আগ্রায় সংবাদ আসে যে, শের আফগান বাংলার বিদ্রোহীদের পক্ষ নিচ্ছেন। জাহাঙ্গীর তার সম্পর্কিত ভ্রাতা কুতবউদ্দিনকে বাংলার সুবাদার পদে নিয়োগ করেন এবং শের আফগানকে আগ্রায় ফেরত পাঠাতে নির্দেশ দেন।
শের আফগানের হত্যা
- (১) কুতবউদ্দিন সৈন্যদলসহ বর্ধমানে চলে আসেন এবং শের আফগানকে তাঁর দরবারে হাজিরা দিতে আদেশ দেন। শের আফগান একাকী অনুচর নিয়ে কুতবউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন।
- (২) কিন্তু কুতব উদ্দিন অকস্মাৎ তাকে বন্দী করার আদেশ দিলে, শের আফগান অস্ত্রের আঘাতে কুতবউদ্দিনকে নিহত করেন। মুঘল রক্ষীরা শের আফগানকে তৎক্ষণাৎ নিহত করে। বর্ধমানে এখনও শের আফগান ও কুতবউদ্দিনের কবর পাশাপাশি দেখা যায়।
মেহেরউন্নিসার আগ্ৰা গমন
মুঘল কর্মচারীরা শের আফগানের পত্নী মেহেরউন্নিসা ও তাঁর শিশু কন্যা লাডলী বেগমকে আগ্রায় মুঘল দরবারে পাঠিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীরের আদেশে মেহেরউন্নিসাকে মুঘল হারেমে প্রবীণা সেলিমা বেগমের অভিভাবকত্বে রাখা হয়।
জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নুরজাহানের বিবাহ
- (১) শের আফগানের মৃত্যুর ৪ বছর পরে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর মীনা বাজারে মেহেরউন্নিসাকে দেখেন এবং তার সৌন্দর্য ও আভিজাত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করেন।
- (২) ক্রমে মেহেরউন্নিসা জাহাঙ্গীরের প্রধানা মহিষীর স্থান নেন এবং রাজকার্যে অংশ নেন। জাহাঙ্গীর তার নাম দেন নূরজাহান বা “জগতের জ্যোতি”। এই বিবাহের সময় মেহেরউন্নিসার বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য তখনও ছিল অম্লান।
মেহেরউন্নিসার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের পূর্ব সম্পর্ক
- (১) শের আফগানের মৃত্যু ও মেহেরউন্নিসাকে জাহাঙ্গীরের বিবাহ সম্পর্কে সমকালীন যুগে নানা প্রকার মত প্রচলিত আছে। ওলন্দাজ পর্যটক ডি লেট (De Lact) -এর মতে, মেহেরউন্নিসার বিবাহের আগেই জাহাঙ্গীর যুবরাজ অবস্থায় তাঁর প্রতি আসক্ত হন।
- (২) আকবর এই বিবাহ অনুমোদন না করায় জাহাঙ্গীর তখন মেহেরউন্নিসাকে বিবাহ করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি তার হৃদয়ে মেহেরউন্নিসার প্রতি প্রেম লালন করেন। পরে তাঁর অভিলাষ পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেন।
- (৩) অপর দিকে ডঃ বেণী প্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন যে, ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের আগে জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসাকে চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেন নি। শের আফগানের সঙ্গে বিবাহের আগে মেহেরউন্নিসার প্রতি জাহাঙ্গীরের ভালবাসা সম্পর্কে কোনো পারসিক বা ইউরোপীয় ঐতিহাসিক কোনো তথ্য দেন নি।
- (৪) ডি লেট হলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। তাছাড়া যদি জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসাকে আগে থেকেই ভালবাসতেন তবে শের আফগানের মৃত্যুর পর তিনি ৪ বছর বিবাহের জন্য অপেক্ষা করতেন না।
শের আফগান হত্যায় জাহাঙ্গীরের দায়িত্ব
- (১) ডঃ বেণীপ্রসাদ মনে করেন যে, শের আফগানের হত্যাকাণ্ডে জাহাঙ্গীরের কোনো হাত ছিল না। তিনি মেহেরউন্নিসাকে পাওয়ার জন্য এই হত্যার ব্যবস্থা করেন নি। জাহাঙ্গীর মানসিংহকে সরিয়ে কুতবউদ্দিনকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন এজন্য যে, মানসিংহের বিশ্বস্ততায় জাহাঙ্গীর সন্দেহ করতেন।
- (২) কুতবউদ্দিনের সাহায্যে শের আফগানকে হত্যার জন্য কুতবউদ্দিনকে বাংলায় নিয়োগ করা হয় নি। যদি জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটত তবে সমকালীন ফার্সী বা ইউরোপীয় রচনায় তার কথা উল্লেখ থাকত।
- (৩) যদি জাহাঙ্গীর তার স্বামীকে হত্যা করতেন তবে নূরজাহানের মত তেজস্বিনী মহিলা কখনও তাকে বিবাহ করতেন না। যদি জাহাঙ্গীর শের আফগানের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন তবে তিনি তাকে বর্ধমানে জায়গীরদারের পদে নিয়োগ করতেন না।
ঈশ্বরীপ্রসাদে অভিমত
ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ তার Short History of Muslim Rule in India গ্রন্থে ডঃ বেণীপ্রসাদের যুক্তিগুলি খণ্ডন করেছেন। তার যুক্তিগুলি হল –
- (১) ডঃ বেণীপ্রসাদের যুক্তিগুলি নেতিবাচক। মেহেরউন্নিসার সঙ্গে যুবরাজ অবস্থায় জাহাঙ্গীরের পূর্ব প্রণয়ের তত্ত্বকে পুরো অবিশ্বাস করা যায় না। সম্ভবত মেহেরউন্নিসা শের আফগানের বাকদত্তা ছিলেন বলে সম্রাট আকবর এই বিবাহে আপত্তি করেন।
- (২) শের আফগানকে জায়গীরদারের পদ থেকে বরখাস্ত করে জাহাঙ্গীর কেন আগ্ৰায় ডেকে পাঠান তার প্রকৃত কারণ জানা যায় নি। শের আফগান জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত ছিলেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কুতবউদ্দিন কিভাবে শের আফগানের বিদ্রোহ সম্পর্কে নিশ্চিত হন তা জানা যায় নি।
- (৩) শের আফগানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি জানিয়ে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় নি। তাকে অকস্মাৎ বন্দী করার চেষ্টা করা হয়। এই আচরণ সন্দেহের ঊর্ধে নয়।
- (৪) বিধবা মেহেরউন্নিসাকে আগ্রায় এনে তাঁর পিতা বা ভ্রাতার কাছে না রেখে জাহাঙ্গীর তাকে কেন মুঘল হারেমে রাখেন তার কারণ জানা যায় নি।
- (৫) ডঃ আর পি. ত্রিপাঠী বলেছেন যে, মেহেরউন্নিসার পিতা ও ভ্রাতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে খসরু শাহের পক্ষে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। এজন্য জাহাঙ্গীর তাদের উপর রুষ্ট ছিলেন। কিন্তু যদি তাই হয়, তবে জাহাঙ্গীর তাদের পদচ্যুত করতে পারতেন। তাদের পরিবারের কন্যাকে হারেমে আটক কেন করেন তার প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি।
- (৬) শের আফগানের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসাকে বিবাহ করতে ৪ বছর অপেক্ষা করেন একথা সত্য। তার কারণ হল যে, মেহেরউন্নিসার মন থেকে পূর্ব স্বামীর জন্য শোক ও কষ্ট ভুলতে সময় লেগেছিল। জাহাঙ্গীর এজন্য ত্বরা করতে দ্বিধা করেন।
উপসংহার :- মোট কথা, শের আফগানের হত্যার ব্যাপারে জাহাঙ্গীরের দায়িত্ব ছিল না একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু নেই।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “জাহাঙ্গীর ও নুরজাহান” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) জাহাঙ্গীর ও নুরজাহান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কান্দাহারে।
মেহেরউন্নিসা।
বর্ধমানের জায়গীরদার শের আফগানের সাথে।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দে।
নূরজাহান।