নূরজাহান

আজ নূরজাহান -এর জন্ম, পরিচিতি, ভারতে আগমণ, আলিকুলি বেগ ও পরে জাহাঙ্গীরের সাথে বিবাহ, মুদ্রায় তাঁর নামাঙ্কন, রাজনৈতিক ক্ষমতা, নূরজাহান চক্র, কৃতিত্ব, তাঁর শেষ জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহান প্রসঙ্গে নূরজাহানের প্রকৃত নাম মেহেরুন্নেসা, নূরজাহানের জন্ম, নুরজাহানের দিল্লি আগমন, জাহাঙ্গীরের সাথে নূরজাহানের প্রণয়, আলি কুলি বেগ বা শের আফগানের সাথে নূরজাহানের বিবাহ, জাহাঙ্গীরের সাথে নূরজাহানের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ, জাহাঙ্গীরের সাথে নূরজাহানের বিবাহ, মুদ্রায় নূরজাহানের নাম অঙ্কন, নুরজাহানের রাজনৈতিক দক্ষতা, প্রশাসনের প্রধান নূরজাহান, নূরজাহানের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম, নূরজাহান চক্র, নূরজাহান চক্রের আধিপত্য, সিংহাসনের চালিকাশক্তি নূরজাহান, নূরজাহানের শেষ জীবন, নূরজাহানের মৃত্যু ও কৃতিত্ব।

জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহান

ঐতিহাসিক চরিত্রনূরজাহান
প্রকৃত নামমেহেরুন্নিসা
পরিচিতিজাহাঙ্গীর -এর পত্নী
জন্ম১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ
নূরজাহান

ভূমিকা :- প্রাচীন মিশর -এ নেফারতিতি এবং ক্লিওপেট্রা; ভারত -এর সুলতান রাজিয়া, রাণী দুর্গাবতী, নূরজাহান প্রমুখ নারীর কথা জানা যায়, যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

মেহের উন্নিসার জন্ম

মেহেরউন্নিসা ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে (৩১ মে) কান্দাহারে জন্মগ্রহণ করেন।

মেহের উন্নিসার পিতা মাতা

পারস্যের বাসিন্দা মীর্জা গিয়াস বেগ ও আসমা বেগমের কন্যা নূরজাহানের প্রকৃত নাম ছিল মেহেরউন্নিসা।

মেহের উন্নিসার দিল্লি আগমণ

মীর্জা গিয়াস বেগ সপরিবারে ভারতে চলে আসেন এবং শেখ মামুদ নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সহায়তায় আকবরের রাজপ্রাসাদে চাকুরি গ্রহণ করেন। আকবর তাঁকে ইতিমাদ উদদৌলা’ উপাধি দেন। তার সূত্র ধরে কন্যা মেহেরউন্নিসাও আকবরের রাজপ্রাসাদে আসেন।

সেলিমের সাথে নূরজাহানের প্রণয়

আকবরের পুত্র সেলিম (জাহাঙ্গীর) মোগল প্রাসাদে মেহেরউন্নিসাকে দেখে তাঁর অসামান্য রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে পড়েন। সেলিম শীঘ্রই অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী মেহেরউন্নিসার প্রেমে আকুল হয়ে তাঁকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

আলিকুলি বেগের সঙ্গে বিবাহ

সেলিমের পিতা সম্রাট আকবর এই বিবাহে অসম্মত হয়ে ১৭ বছরের মেহের উন্নিসাকে বর্ধমানের জায়গিরদার আলিকুলি বেগের সঙ্গে বিবাহ দেন (১৫৯৪ খ্রি.)।

আকবরের বৃথা চেষ্টা

সম্রাট আকবর মেহের উন্নিসাকে দিল্লি থেকে বহু দূরে বিবাহ দিয়ে তাঁকে সেলিমের চোখের আড়াল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল নয়, সেলিম অপরূপা মেহেরউন্নিসাকে মন থেকে কখনোই ভুলতে পারেননি।

জাহাঙ্গীরের রাজত্ব লাভ

সম্রাট আকবরের মৃত্যুর (১৬০৫ খ্রি.) পর তাঁর পুত্র সেলিম সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গীর নাম গ্রহণ করেন।

আলিকুলি বেগকে হত্যা

রাজত্ব লাভের পর ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেহের উন্নিসার স্বামী বর্ধমানের জায়গিরদার আলিকুলি বেগকে হত্যা করেন।

জাহাঙ্গীরের সাথে মেহের উন্নিসার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ

১৬১১ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে নববর্ষের উৎসবে মীনা বাজারের মোগল প্রাসাদে জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসার আবার সাক্ষাৎ হয় এবং তার রূপের মোহে আকৃষ্ট হয়ে জাহাঙ্গীর অতি দ্রুত তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন।

জাহাঙ্গীরের সাথে মেহের উন্নিসার বিবাহ

ইতিমধ্যে মেহেরউন্নিসার পরিবার অর্থনৈতিক দিক থেকেও তীব্র সংকটে পড়েছিল। তাই ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে মেহেরউন্নিসাকে বিবাহ করে জাহাঙ্গীর তাকে প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন।

মেহের উন্নিসার নতুন নামকরণ নূরজাহান

সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর নতুন নাম রাখেন ‘নূরজাহান’, যার অর্থ ‘জগতের আলো’।

মুদ্রায় নূরজাহানের নাম অঙ্কন

নূরজাহানের রূপের আলোয় জাহাঙ্গীর নিজেকে আরও উজ্জ্বল করেন। তিনি মোগল মুদ্রায় নিজের নামের সঙ্গে নূরজাহানের নামও খোদাই করার নির্দেশ দেন।

নূরজাহানের রাজনৈতিক দক্ষতা

তিনি ছিলেন প্রজাদরদি এবং বহুমুখী গুণের অধিকারী। রাজনৈতিক কৌশলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধুরন্ধর ও সাবলীল। জটিল রাজনৈতিক আবর্তে অবাধে সাঁতার কেটে তিনি অনায়াসেই সেই আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন।

প্রশাসনেরর প্রধান শক্তি নূরজাহান

জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহের (১৬১১ খ্রি.) পর থেকে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু (১৬২৭ খ্রি.) পর্যন্ত স্বামীর অসুস্থতা ও দুর্বলতার সুযোগে নূরজাহান দরবারে এবং মোগল প্রশাসনে সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

প্রধান নিয়ন্তা নূরজাহান

প্রকৃতপক্ষে তিনিই এই সময় প্রশাসনের প্রধান নিয়ন্তায় পরিণত হন এবং তার নির্দেশেই মোগল প্রশাসন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।

নূরজাহানের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম

এই সময়ে নুরজাহান দরবারে দর্শনার্থীদের দর্শন দিতেন এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন।

নূরজাহান চক্র

এই সময় তিনি নিজ প্রভাবাধীন একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন।

(১) নূরজাহান চক্রের গঠন

জাহাঙ্গীরের অসুস্থতা ও অন্ধ পত্নীপ্রেমের সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান নিকটজনদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন, যা ‘নূরজাহান চক্র’ নামে পরিচিত।

(২) নূরজাহান চক্রের সদস্যবৃন্দ

নূরজাহানের নেতৃত্বাধীন এই চক্রের অন্যান্য সদস্য ছিলেন তাঁর পিতা মীর্জা গিয়াস বেগ, ভ্রাতা আসফ খাঁ ও ইদমৎ খাঁ, যুবরাজ খুররম (শাহজাহান) প্রমুখ।

(৩) নূরজাহান চক্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব

জাহাঙ্গীর ক্রমে আমোদ-প্রমোদ, মদ্যপান ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে অশক্ত হয়ে পড়লে মোগল প্রশাসন ও রাজনীতিতে নূরজাহান চক্রের কর্তৃত্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়।

রক্ষক নূরজাহান

ইতিহাসবিদ ড. আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন যে, “জাহাঙ্গীরের জীবনে কোনো অশুভ শক্তি নয়, তিনি ছিলেন তাঁর রক্ষাকারী দেবদূত। “

নূরজাহান চক্রের আধিপত্য

ক্রমে নূরজাহান চক্রের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।

(১) বিভিন্ন উচ্চপদ লাভ

নূরজাহান চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন উচ্চ রাজপদ গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মীর্জা গিয়াস বেগ এবং দুই ভ্রাতা আসফ খাঁ ও ইদমৎ খাঁ মোগল দরবারে উচ্চ রাজপদ লাভ করে। আসফ খাঁ সম্রাটের ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন।

(২) জাহাঙ্গীরের কর্তৃত্ব হ্রাস

অসুস্থ, সুরাসক্ত ও পত্নীপ্রেমী জাহাঙ্গীর নূরজাহানের হাতের পুতুলে পরিণত হন। জাহাঙ্গীর নিজেই একদা মন্তব্য করেন যে, “এক পেয়ালা সুরার বিনিময়ে আমি আমার রাজ্য আমার প্রিয়তমা রাণীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।”

সিংহাসনের চালিকা শক্তি নূরজাহান

এই সময়কালে নূরজাহান ‘Power behind the throne‘ অর্থাৎ ‘সিংহাসনের চালিকা শক্তি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

নূরজাহান চক্র নিয়ে সন্দেহ

নূরজাহান চক্রের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার চক্র অধিকাংশ ইতিহাসবিদ স্বীকার করে নিলেও ড. নুরুল হাসান -এর মতো কেউ কেউ ‘নূরজাহান চক্র’-এর বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

খুররমের নূরজাহান চক্র ত্যাগ

শেষপর্যন্ত নূরজাহান চক্রে ভাঙন ধরে। তিনি তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমকে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে শাহরিয়ারকে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা করেন। ফলে ক্ষুব্ধ খুররম এই চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যান।

খুররমের সিংহাসন লাভ

শেষ পর্যন্ত তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত ও পিতা জাহাঙ্গীরকে বন্দি করে খুররম দিল্লির সিংহাসনে বসেন। এর ফলে নূরজাহানের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

নূরজাহানের শেষজীবন

খুররমের অধীনে গৃহবন্দি হয়ে তিনি বাকি জীবন কাটাতে বাধ্য হন। বন্দি অবস্থায় তাঁর পিতার স্মৃতিতে নির্মীয়মাণ সমাধির কাজকর্ম দেখাশোনা এবং কখনো কখনো পারসি ভাষায় কবিতা লিখে তাঁর দিন কাটত।

নূরজাহানের মৃত্যু

১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে (১৭ ডিসেম্বর) নূরজাহানের মৃত্যু হলে লাহোরের শাহদারা বাগে জাহাঙ্গীরের কবরের পাশেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

নূরজাহানের কৃতিত্ব

নূরজাহানের প্রধান কৃতিত্বগুলি হল –

(১) নূরজাহানের শাসন ক্ষমতা দখল

তিনি অতি সাধারণ অবস্থা থেকে মোগল রাজক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছোতে সক্ষম হন।

(২) নূরজাহানের বিচক্ষণতা

মধ্যযুগের একজন নারী হয়েও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে তিনি বহু পুরুষকেও হার মানান।

(৩) সুশাসন প্রবর্তনে নূরজাহানের ভূমিকা

জাহাঙ্গীরের আমলে সাম্রাজ্যে অপশাসনের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা নূরজাহান নিজের যোগ্যতায় দূর করে দেশে সুশাসন প্রবর্তন করেন।

উপসংহার :- নূরজাহান শুধু ঐতিহাসিকভাবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণীই ছিলেন না সেই সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি, দাতব্য কাজ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও লৌহমানবীর ন্যায় ক্ষমতা পালনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “নূরজাহান” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে  তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) নূরজাহান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নূরজাহানের প্রকৃত নাম কি?

মেহেরউন্নিসা।

২. নূরজাহান নামের অর্থ কি?

পৃথিবীর আলো।

৩. নূরজাহান চক্র কি?

জাহাঙ্গীরের অসুস্থতা ও অন্ধ পত্নীপ্রেমের সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান নিকটজনদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী বা চক্র গড়ে তোলেন, যা ‘নূরজাহান চক্র’ নামে পরিচিত।

Leave a Comment