আজ রাণী দুর্গাবতী -র জন্ম, পরিচিতি, বিবাহ, শাসন ক্ষমতা দখল, রাজত্বকাল, দক্ষ নেতৃত্ব, মোগল আক্রমণ প্রতিরোধ, কৃতিত্ব, মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
ভারতের গণ্ডোয়ানা রাজ্যের রানী দুর্গাবতী প্রসঙ্গে গণ্ডোয়ানা রাজ্যের অবস্থান, গণ্ডোয়ানা রাজ্যের উপর বহিরাগতদের নজর, রানী দুর্গাবতীর পরিচয়, রানী দুর্গাবতীর বিবাহ, রানী দুর্গাবতীর সন্তান, রানী দুর্গাবতীর ক্ষমতা দখল, রানী দুর্গাবতীর রাজত্বকাল, রানী দুর্গাবতীর দক্ষতা, রানী দুর্গাবতীর নেতৃত্বে রাজ্যের অগ্ৰগতি, রানী দুর্গাবতীর দক্ষ নেতৃত্ব, গণ্ডোয়ানা রাজ্যের প্রতি আকবরের লুব্ধ দৃষ্টি, রানী দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে মোগলদের আক্রমণ, মোগলদের সাথে রানী দুর্গাবতীর নররাইয়ের যুদ্ধ, আহত রানী দুর্গাবতী, রানী দুর্গাবতীর পরিকল্পনা ব্যর্থ, রানী দুর্গাবতীর মৃত্যু, রানী দুর্গাবতীর কৃতিত্ব ও রানী দুর্গাবতীর স্মৃতিরক্ষা।
রাণী দুর্গাবতী
ঐতিহাসিক চরিত্র | দুর্গাবতী |
পরিচিতি | চান্দেল্ল বংশীয় রাজকন্যা ও গন্ডোয়ানা রাজ্যের রাণী |
পিতা | কিরাত রাই |
রাজত্বকাল | ১৫৫০-৬৪ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- প্রাচীন মিশর -এ নেফারতিতি এবং ক্লিওপেট্রা; ভারত -এর সুলতান রাজিয়া,রাণী দুর্গাবতী, নূরজাহান প্রমুখ নারীর কথা জানা যায়, যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
গণ্ডোয়ানা
দিল্লিতে মোগল শাসনকালে ভারতে যে সকল আঞ্চলিক শক্তির অস্তিত্ব ছিল সেগুলির মধ্যে গণ্ডোয়ানা ছিল অন্যতম।
অবস্থান
মধ্যপ্রদেশের সাগর, দামো, মাওলা ও নর্মদা উপত্যকার কিছু অঞ্চল নিয়ে গণ্ডোয়ানা রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর রাজধানী ছিল গড়-কাটাঙ্গা।
বহিরাগতদের নজর
গণ্ডোয়ানায় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের ফলে এর উপর বহিরাগতদের লোভাতুর দৃষ্টি ছিল।
রাণী দুর্গাবতী
এখানকার রাণী দুর্গাবতী শাসনদক্ষতা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় অসামান্য আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন।
রাণী দুর্গাবতীর পূর্বপরিচয়
মাহোবার চান্দেল্ল বংশীয় রাজপুত রাজা কিরাত রাই-এর কন্যা দুর্গাবতী ছিলেন বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, অশ্বারোহণে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় সুদক্ষ।
রাণী দুর্গাবতীর বিবাহে ইচ্ছা প্রকাশ
গণ্ডোয়ানার শাসক সংগ্রাম শাহের পুত্র দলপৎ শাহের বীরত্বপূর্ণ কিছু কাজে মুগ্ধ হয়ে দুর্গাবতী দলপৎ শাহকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিখ্যাত চান্দেল্ল বংশের রাজকন্যা দুর্গাবতীকে তাঁর পিতা দলপৎ শাহের মতো একজন নীচুবংশজাত রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
রাণী দুর্গাবতীর বিবাহ
অবশ্য শেষপর্যন্ত দলপৎ শাহের বীরত্বে দুর্গাবতীর পিতাও মুগ্ধ হন এবং বিবাহে সম্মত হন। বিবাহের (১৫৪২ খ্রি.) কিছুদিন পরেই সংগ্রাম শাহের মৃত্যু হলে দলপং শাহ গণ্ডোয়ানার সিংহাসনে বসেন এবং দুর্গাবতী গণ্ডোয়ানার রানি হন।
রাণী দুর্গাবতীর সন্তান
তাদের সুখী দাম্পত্যে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে (১৫৪৫ খ্রি.), যার নাম রাখা হয় বীরনারায়ণ।
রাণী দুর্গাবতীর শাসন ক্ষমতা দখল
বীরনারায়ণের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে দলপৎ শাহের মৃত্যু হয়। রাজা দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র বীরনারায়ণ গণ্ডোয়ানার সিংহাসনে বসেন। এই সময় নাবালক পুত্রের অভিভাবিকা হিসেবে তাঁর মা রানি দুর্গাবতী গন্ডোয়ানার শাসন ক্ষমতা দখল করেন (১৫৫০ খ্রি.)।
রাণী দুর্গাবতীর রাজত্ব কাল
১৫৫০-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বেই গণ্ডোয়ানার শাসন পরিচালিত হয়।
শাসনকার্যে রাণী দুর্গাবতীর দক্ষতা
গন্ডোয়ানার রাণী দুর্গাবতী ছিলেন মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য নারী যিনি রাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসন পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
রাণী দুর্গাবতীর নেতৃত্বে রাজ্যের অগ্ৰগতি
তিনি ছিলেন সাহসী ও সংস্কৃতিমনস্ক। স্বদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। রাণী দুর্গাবতীর শাসনকালে গণ্ডোয়ানায় সার্বিক অগ্রগতি ঘটেছিল।
রাণী দুর্গাবতীর দক্ষ নেতৃত্ব
রাণী দুর্গাবতী দ্রুত স্বামীর মৃত্যুশোক ভুলে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন। তিনি শীঘ্রই নিজের শাসন দক্ষতার প্রমাণ দেন।
(১) আক্রমণ প্রতিরোধ
এই সময় আফগান নেতা বাজ বাহাদুর গন্ডোয়ানা আক্রমণ করলে তিনি দক্ষতার সঙ্গে তা প্রতিরোধ করেন। বাজ বাহাদুর আরও কয়েকবার পণ্ডোয়ানা আক্রমণ করলেও রানি দুর্গাবতীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন।
(২) রাজকোশে সংকট
বাজ বাহাদুরের বিরুদ্ধে জয় সত্ত্বেও বারংবার যুদ্ধে গন্ডোয়ানার প্রচুর অর্থসম্পদ ব্যয়িত হয় এবং রাজকোশে সংকট দেখা দেয়।
(৩) আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি
রাজকোশ পূর্ণ করতে রানি দুর্গবির্তী ক্ষুদ্র জোতদারদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগ করে অর্থ আদায়ের নির্দেশ দেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই রাজকোশ পূর্ণ হয়ে যায়।
রাণী দুর্গাবতীর গণ্ডোয়ানার প্রতি আকবরের লুব্ধ দৃষ্টি
গণ্ডোয়ানার বিপুল অর্থ সম্পদ মোগল সম্রাট আকবরকে প্রলুব্ধ করে। তাই তিনি মোগল সুবাদার আসফ খাঁ -র নেতৃত্বে গণ্ডোয়ানা অভিযানে এক বিশাল বাহিনী পাঠান।
রাণী দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে মোগলদের আক্রমণ
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাহিনী গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করে। রানি দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ছিল মোগল বাহিনীর নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ ও চূড়ান্ত অর্থলিপ্সার সুস্পষ্ট উদাহরণ।
মোগলদের সাথে রাণী দুর্গাবতীর নররাইয়ের যুদ্ধ
বিশাল মোগল বাহিনীকে প্রতিহত করে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে গণ্ডোয়ানার রানি দুর্গাবতী তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়েই প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও প্রবল বৃষ্টির কারণে এবং অন্ধকার নেমে আসায় গণ্ডোয়ানার বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।
আহত বীরনারায়ণ
যুদ্ধক্ষেত্রে বীরনারায়ণ আহত হলে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে রানি যুদ্ধ চালিয়ে যান।
আহত রাণী দুর্গাবতী
কিছু সময় পর রানি নিজেও যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের তিরের আঘাতে দারুণভাবে আহত হন এবং সেখান থেকে পিছু হঠে তাঁর দুর্গ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রাণী দুর্গাবতীর পরিকল্পনা ব্যর্থ
দুর্গে পৌঁছোতে গেলে একটি নদী অতিক্রম করতে হত। দুর্গাবতী যুদ্ধক্ষেত্রে আসার সময় সেই নদীতে জল না থাকলেও দুর্গে ফেরার সময় বৃষ্টির জলে তা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে অতি অল্প সময়ে নদী অতিক্রম করা অসম্ভব ছিল।
রাণী দুর্গাবতীর মৃত্যুবরণ
শত্রু সৈন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে দেখে রানি দুর্গাবতী অপমানিত হয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুবরণকেই শ্রেয় বলে মনে করে নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগ করেন (১৫৬৪ খ্রি.)।
রাণী দুর্গাবতীর পরাজয়ের পর গন্ডোয়ানার পরিণতি
- (১) ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত নররাই (Narrai) -এর যুদ্ধে দুর্গাবতীর বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে মোগলরা গণ্ডোয়ানা দখল করে।
- (২) গণ্ডোয়ানার রাজপুত নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ‘জওহরব্রত’ পালন করে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করেন।
- (৩) গন্ডোয়ানার ভূখণ্ডের একাংশ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অপর অংশের শাসনক্ষমতা দুর্গাবতীর বংশধর চন্দ্র শাহকে দেওয়া হয়।
- (৪) চন্দ্র শাহ মোগলদের হাতের পুতুল হয়ে গণ্ডোয়ানার শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে গণ্ডোয়ানার গৌরবের দিন শেষ হয়ে যায়।
রাণী দুর্গাবতীর কৃতিত্ব
মধ্যযুগের ভারতের একজন শাসিকা হয়েও দুর্গাবতী যে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা এককথায় অতুলনীয়।
- (১) দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর গন্ডোয়ানার চরম দুর্দিনে তিনি নিজ দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে তার অগ্ৰগতি ঘটান।
- (২) বিভিন্ন বহিরাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
- (৩) বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি নিজ রাজকোশ সমৃদ্ধ করেন।
- (৪) মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় রানি দুর্গাবতী যে অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন নজির ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যায় না।
রাণী দুর্গাবতীর স্মৃতি রক্ষার্থে
- (১) ১৯৮৩ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার তার স্মৃতিতে জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাণী দুর্গাবতী বিশ্ববিদালয় নামে নামকরণ করে।
- (২) ভারত সরকার ২৪ জুন, ১৯৮৮ তারিখে তার মৃত্যু স্মরণে একটি ডাক-স্ট্যাম্প জারি করে।
- (৩) জব্বলপুর জংশন থেকে জম্মুগামী ট্রেন রানির নামে দুর্গাবতী এক্সপ্রেস (১১৪৪৯/১১৪৫০) নামে পরিচিত।
উপসংহার :- মোগলদের হাতে গণ্ডোয়ানার স্বাধীনতা লুপ্ত হলেও রানি দুর্গাবতীর বীরত্বের কাহিনি হারিয়ে যায়নি। বীরাঙ্গনা দুর্গাবতী আজও ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তাঁর আত্মাহুতির দিনটিকে (২৪ জুন) ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে ‘শহিদ দিবস‘ হিসেবে পালন করা হয়।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “দুর্গাবতী” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) রাণী দুর্গাবতী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চান্দেল্ল বংশীয় রাজপুত কিরাত রাই -এর কন্যা এবং ১৫৫০-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গণ্ডোয়ানার রানি।
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে নররাই-এর যুদ্ধে।
নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে।