আজ আমরা ফা-হিয়েন -এর জন্ম পরিচয়, বিভিন্ন নাম, ভারতে আসার কারণ, ভারতে অবস্থান কাল, সংস্কৃত শিক্ষা ও সাহিত্য সংগ্রহ, উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ, শেষ জীবন সম্পর্কে জানবো ।
চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন
জন্ম | ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ |
দেশ | চীন |
ধর্ম | বৌদ্ধ ধর্ম |
উল্লেখ্যযোগ্য কাজ | ফো-কুয়ো-কি |
মৃত্যু | ৪২২ খ্রিস্টাব্দ |
ভ্রমণ | ভারত |
ভূমিকা :- ফা-হিয়েন প্রথম চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী, যিনি মধ্য এশিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে তাদের সম্পর্কে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
ফা-হিয়েন নামের সঠিক উচ্চারণ
এই যাজকের নামের সঠিক উচ্চারণ সম্ভবত ফাজিয়ান এবং তা ফা-সিয়েন ফা হিয়েন হিসেবেও লেখা হয়।
ফা-হিয়েনের জন্ম পরিচয়
পূর্ব জিন রাজবংশের শাসনামলে চতুর্থ শতাব্দীতে শানসি প্রদেশে ফা হিয়েন জন্মগ্রহণ করেন।
ফা-হিয়েনের বিভিন্ন নাম
তাঁর জন্মের পর নাম ছিল সেহি। পরে তিনি ফাসিয়ান বা ফা হিয়েন নামটি গ্রহণ করেন, যার আক্ষরিক অর্থ “ধর্মের জাঁকজমক”।
ফা-হিয়েনের ভারতে আসার কারণ
বৌদ্ধধর্মে ব্রতিত্ব লাভ করার পর ফা হিয়েনের মনে বৌদ্ধ ধর্মের মঠতান্ত্রিক নীতি সংবলিত গ্রন্থ ‘বিনয় পিটক’-এর সন্ধানে ভারতে আসার ইচ্ছা জাগ্রত হয়।
ফা-হিয়েনের ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা
৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফা হিয়েন যখন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তখন তার বয়স সম্ভবত ৬৪ বছর।
ফা-হিয়েনের যাত্রাপথ
পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে ফা হিয়েন ভারত সফর করেন। তিনি চীন থেকে বরফের মরুভূমি এবং এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি গিরিপথ ধরে হেঁটেছেন বলে জানা যায়।
ফা-হিয়েনের ভারতে প্রবেশ
ফা হিয়েন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করেন এবং পাটলিপুত্র নগরীতে পৌঁছান।
ফা-হিয়েনের ভারতে সফরকাল
ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য -এর রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত -এর রাজত্বকালে ফা-হিয়েন ভারত সফরে এসেছিলেন।
ফা-হিয়েনের ভারতে অবস্থান কাল
ফা হিয়েন উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর স্মৃতিকথা ভারতে তাঁর ১০ বছরের অবস্থান বর্ণনা করে।
ফা-হিয়েনের পরিদর্শন স্থান
ফা হিয়েন গৌতম বুদ্ধ -এর সাথে সম্পর্কিত প্রধান স্থানগুলি, সেইসঙ্গে শিক্ষার বিখ্যাত কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ বিহারগুলি পরিদর্শন করেছিলেন।
নগর পরিদর্শক ফা-হিয়েন
ফা হিয়েন কপিলবস্তু (লুম্বিনি), বোধগয়া, বেনারস (বারাণসী), শ্রাবস্তী এবং কুশিনগর পরিদর্শন করেছিলেন, যা সবই বুদ্ধের জীবনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।
ফা-হিয়েনের সংস্কৃত শিক্ষা ও সাহিত্য সংগ্রহ
ফা হিয়েন সংস্কৃত শিখেছিলেন এবং গান্ধার, পাটলিপুত্র (পাটনা), তক্ষশীলা থেকে ভারতীয় সাহিত্য সংগ্রহ করেছিলেন।
বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে ফা-হিয়েন
ফা হিয়েনের স্মৃতিকথা হীনযান (থেরাবাদ) এবং উদীয়মান মহাযান ঐতিহ্যের পাশাপাশি পঞ্চম শতাব্দীর ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন বিভাগ ও ভিন্নমত থেরবাদ উপ-ঐতিহ্যের উল্লেখ করে।
প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সংস্কৃত গ্ৰন্থ সংগ্ৰহ
চীনে ফিরে যাওয়ার আগে ফা-হিয়েন ভারতের প্রচুর সংস্কৃত গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
ফা-হিয়েনের ভ্রমণবৃত্তান্ত
ফা হিয়েন তার ভ্রমণের উপর একটি বই লিখেছিলেন। এই বিবরণে তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন তিনি।
- (১) প্রাথমিক ভাবে ফা-হিয়েন তার ভ্রমণ কাহিনীতে বৌদ্ধধর্মের বিবরণ সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেন।
- (২) সিল্ক রুটের ধারে থাকা অসংখ্য দেশের ভূগোল ও ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ফা হিয়েন তার বিবরণে তুলে ধরেছেন।
- (৩) ফা হিয়েন মধ্যদেশের তক্ষশীলা, পাটলিপুত্র, মথুরা এবং কনৌজ -এর মতো শহরগুলির কথা লিখেছেন। তিনি আরও লিখেছেন যে মধ্যদেশের বাসিন্দারা চীনাদের মতো খায় এবং পোশাক পরে। তিনি পাটলিপুত্রকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ শহর হিসেবে ঘোষণা করেন।
ফা-হিয়েনের বিবরণীতে পাটলিপুত্র নগর
পাটলিপুত্র নগর এবং সেখানকার নাগরিক সভ্যতা ফা হিয়েনের বিবরণীতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছে। আর প্রশংসা পেয়েছে সরকারি ব্যয়ে সরাইখানা, চিকিৎসালয় ও অনাথ আশ্রমগুলি পরিচালনার উদ্যোগ। মৌর্যদের ধ্বংসপ্রায় কাঠের রাজপ্রাসাদের গঠন নৈপুণ্য ও শিল্পরীতি তাঁকে বিস্মিত করেছিল।
ফা-হিয়েনের বর্ণনায় গুপ্ত শাসনব্যবস্থা
ফা হিয়েনের মতে, দায়িত্বশীল কর্মচারীদের হাতে ছিল দেশের শাসন ভার, তারা অকারণে প্রজাপীড়ন করত না । দণ্ডবিধি লঘু হওয়া সত্ত্বেও দেশে চোর ডাকাতের উৎপাত ছিল না। এ ছাড়া করভার বেশি না হওয়ায় প্রজারাও ছিল সুখী ও সচ্ছল
গুপ্ত বাণিজ্য সম্পর্কে ফা-হিয়েনের অভিমত
‘ফো কুয়ো কি’ গ্রন্থে গুপ্ত নৌবহর ও বাণিজ্য সংক্রান্ত তথ্যও রয়েছে। পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সোপারা ও পূর্ব উপকূলে তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে ভারতীয় বাণিজ্যতরী সিংহল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেত।
ভারতীয় জনজীবন সম্পর্কে ফা হিয়েনের ভাষ্য
- (১) ভারতীয়দের নীতিবোধ, সংযত চরিত্র ও উচ্চ নৈতিকতা নিয়ে ফা-হিয়েন প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত।
- (২) পাশাপাশি জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার কড়াকড়িতে ভারতীয় সমাজ যে জর্জরিত ছিল ফা হিয়েন তার উল্লেখ করতে ভোলেননি। অধিকাংশ ভারতীয়ই ছিল নিরামিষভোজী ও অহিংসায় বিশ্বাসী ।
- (৩) মধ্যদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রবল হলেও পাঞ্জাব ও বাংলাদেশ -এ বৌদ্ধধর্ম ছিল জনপ্রিয়। দেশের সর্বত্র হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক বিরাজ করত।
ফা-হিয়েনের চীনে প্রত্যাবর্তন
ফা হিয়েন ৪১২ খ্রিস্টাব্দে চীনে ফিরে আসার যাত্রা শুরু করেন এবং বর্তমানে নানজিং বা নানকিং -এ বসতি স্থাপন করেন।
প্রত্যাবর্তন কালে ফা-হিয়েনের সাথে ছিল
ফা হিয়েন তার সাথে বিপুল সংখ্যক সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থ এবং বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র মূর্তি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
ফা-হিয়েনের উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ
সম্ভবত ৪১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ফো-কুয়ো-কি’ বা বৌদ্ধ রাজ্যের গ্ৰন্থটি লিখেছেন।
চীনে ফা-হিয়েনের শেষ জীবন
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ফা হিয়েন পরবর্তী দশক কাটিয়েছেন ভারত থেকে তার সাথে আনা বৌদ্ধ সূত্রগুলি চীনা ভাষায় অনুবাদ করতে।
ফা-হিয়েনের ভারতে অধিকাংশ সময়
ফা হিয়েন তার ভ্রমণের অধিকাংশ সময়ই মধ্য ভারত বা মগধ পরিভ্রমণ ও তার বর্ণনায় অতিবাহিত করেন। ফা-হিয়েন দক্ষিণ ভারতের অঞ্চলসমূহ ভ্রমণ করেন নি।
ফা-হিয়েনের ভারত সফরের শেষ পর্যায়
ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে ফা হিয়েন সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার গন্তব্যস্থল ছিল সে সময়ের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দর তাম্রলিপ্তি (তমলুক)।
ফা-হিয়েনের তমলুকে অবস্থান
শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পূর্বে ফা হিয়েন দীর্ঘ দুবছর তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অনুলিপি তৈরি ও বৌদ্ধ মূর্তির ছবি আঁকেন। তার বিবরণী থেকে জানা যায়, এ সময় তাম্রলিপ্তিতে চব্বিশটি বৌদ্ধ মঠ ও অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন।
ফা-হিয়েনের শ্রীলঙ্কা সফর
ফা হিয়েন সমুদ্রপথেই ভারত ত্যাগ করে শ্রীলঙ্কা পরিভ্রমণের পর চীনে প্রত্যাবর্তন করেন। সমুদ্রে অনেক কষ্টকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে ফা-হিয়েন চীনে প্রত্যাবর্তন করেন।
পরবর্তী যাজকদের অনুপ্রেরণা
ফা-হিয়েনের তীর্থযাত্রা চীনের পরবর্তী প্রজন্মের যাজকদের অনুপ্রাণিত করেছে। চরমসত্য (ধম্ম) অনুসন্ধানে বুদ্ধের পবিত্র ভূমি পরিভ্রমণে জলপথ অথবা স্থলপথের সমস্ত কষ্টই তারা অগ্রাহ্য করেছেন।
উপসংহার :- ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করা চৈনিক পর্যটকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইৎ-সিং প্রমুখ। সুপ্রসিদ্ধ চৈনিক পর্যটকদের লিখিত বিবরণাদির মধ্যে ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।
(FAQ) মেগাস্থিনিস হতে জিজ্ঞাস্য ?
ফা-হিয়েন ছিলেন প্রথম চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী, যিনি মধ্য এশিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে সেগুলি সম্পর্কে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে যান ।
চীন।
ফো-কুয়ো-কি ।
আনুমানিক ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ ।
আনুমানিক ৪২২ খ্রিস্টাব্দে।
গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতে আসেন ।