আজ আমরা তক্ষশীলা -র সূচনাকাল, অবস্থান, পূর্বের অবস্থান, নামকরণ, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তক্ষশিলা, পবিত্র এলাকা হিসেবে তক্ষশিলা, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে তক্ষশীলা সম্পর্কে জানবো ।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান তক্ষশীলা
তক্ষশীলার সূচনা | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ |
পরিচিতি | প্রাচীন ভারত -এর শিক্ষানগরী ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান |
অবস্থান | পাকিস্তান -এর পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলা |
পতন | বৈদেশিক আক্রমণ (৪৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীতে) |
ভূমিকা :- তক্ষশীলা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলা ছিল প্রাচীন ভারতের উচ্চশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
তক্ষশীলার সূচনাকাল
পরবর্তী সময়কার বিভিন্ন লেখায় ছড়ানো ছিটানো সূত্র থেকে জানা যায় যে, তক্ষশিলার সূচনা সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে হয়েছিল।
তক্ষশীলার অবস্থান
প্রাচীন নগরী তক্ষশিলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে, গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে।
তক্ষশীলার পূর্বের অবস্থান
ভারত বিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগে পর্যন্ত তক্ষশীলা আমাদের দেশ ভারতবর্ষ -এর অর্ন্তগত ছিল।
তক্ষশীলার নামকরণ
তক্ষশিলার নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।
- (১) বলা হয়ে থাকে যে, তক্ষশিলার নামকরণ হয়েছে রামায়ণ মহাকাব্যের রামের ভাই ভরত ও তার স্ত্রী মাণ্ডবীর পুত্র তক্ষের নামানুসারে।
- (২) কিংবদন্তি আছে যে, তক্ষ একটি রাজ্য শাসন করতেন যার নাম ছিল তক্ষ খন্ড এবং তিনিই তক্ষশিলা নগরের প্রতিষ্ঠা করেন।
- (৩) দামোদর ধর্মানন্দ কৌশাম্বী প্রবর্তিত তত্ত্ব অনুযায়ী, তক্ষশিলা নামটি তক্ষক শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা ছুতার বা সূত্রধর শব্দের সংস্কৃতরূপ এবং এই শব্দটি প্রাচীন ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর অপর একটি নাম।
রাজধানী ও শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশীলা
তক্ষশিলা নগরটি কখনো কখনো পুষ্কলাবতীর সঙ্গে গান্ধার -এর রাজধানীর দায়িত্ব পালন করেছে আবার কখনো বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র রূপে খ্যাতি অর্জন করেছে।
হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র তক্ষশীলা
প্রাচীন তক্ষশিলা নগরী ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং বর্তমান সময়েও উক্ত ধর্মদুটির ঐতিহ্যে এ স্থানটির একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান তক্ষশীলা
১৯৮০ সালে বেশকিছু এলাকাসহ তক্ষশিলাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্র তক্ষশীলা
গার্ডিয়ান পত্রিকা ২০০৬ সালে তক্ষশিলাকে পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন স্থান হিসেবে নির্বাচিত করে।
কৌটিল্য ও তক্ষশিলা
কথিত আছে যে, কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র এই তক্ষশিলা নগরেই রচনা করেছিলেন।
মহাভারত ও তক্ষশিলা
হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত -এ আছে যে, কুরুর উত্তরাধিকার পরীক্ষিতকে তক্ষশিলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় এর সর্পসত্র যোজনায় ব্যাস কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার শিষ্য বৈশম্পায়ন সর্বপ্রথম তক্ষশিলাতেই মহাভারত পাঠ করেন।
জাতক কাহিনীতে তক্ষশীলা
পরবর্তীতে পঞ্চম শতাব্দীর দিকে শ্রীলঙ্কায় লিখিত জাতক কাহিনীতেও তক্ষশিলার বর্ণনা কিছুটা বিস্তারিত ভাবে করা হয়েছে।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে তক্ষশীলা
দশরথের পৌত্র এবং ভরত গান্ধার দেশ জয় করে নিজের পুত্র তক্ষের নামানুসারে তক্ষশিলা ও পুষ্কলের নামানুসারে পুষ্কলাবতী নগর স্থাপন করেন।
পবিত্র এলাকা তক্ষশিলা
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দে চীন -এর পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন।
ফা হিয়েন ও তক্ষশিলা
চৈনিক ভিক্ষু ফা-হিয়েন ৪০৫ খ্রিষ্টাব্দের তার তক্ষশীলা ভ্রমণকাহিনীতে তক্ষশিলা রাজ্যের অর্থ ‘ছিন্ন মস্তক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই নামটির উৎপত্তি হয়েছে বুদ্ধের জীবনের একটি ঘটনা থেকে, কেননা এটিই সেই জায়গা ‘যেখানে বুদ্ধ তার মাথা একটি লোককে দিয়েছিলেন’।
হিউয়েন সাঙ ও তক্ষশিলা
চৈনিক ভিক্ষু জুয়ানজ্যাং, যিনি হিউয়েন সাং নামেও পরিচিত ৬৩০ এবং ৬৪৩ সালে তক্ষশীলায় ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি শহরটির নাম বলেছিলেন তা-চা-শি-লো (Ta-Cha-Shi-Lo)। ধারণা করা হয় যে, সেই সময়েই শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল।
টলেমি ও তক্ষশিলা
ভূগোলবিদ টলেমি তার ভূগোল গ্ৰন্থে তক্ষশীলাকে বর্ণনা করেছেন ‘তক্ষিয়ালা’ (Taxiala) হিসেবে।
আলেকজান্ডার ও তক্ষশিলা
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এই সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তক্ষশিলা
মৌর্য সাম্রাজ্য -এর রাজা চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য) পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন।
বিন্দুসার ও তক্ষশিলা
চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসার -এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশিলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসারের নির্দেশে যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন।
অশোক ও তক্ষশিলা
সম্রাট অশোক পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলার ভিতরে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেন। ক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
পুষ্যমিত্র ও তক্ষশিলা
সম্রাট পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বৌদ্ধ ধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন। ফলে তাঁর সময় তক্ষশীলা গুরুত্ব হারাতে থাকে। অনেকে মনে করেন এই সময় তক্ষশিলার বৌদ্ধ-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছিল।
প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশীলা
তক্ষশিলা কখনো কখনো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাঠদান করা হতো না।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়নস্থল তক্ষশিলা
রাজা বিম্বিসার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবক এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন। এই স্থান তৎকালীন বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়নস্থল।
কুষাণ বংশ ও তক্ষশিলা
কুষাণদের রাজ্য বিস্তারের সময় তক্ষশিলা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে কুষাণ সাম্রাজ্য -এর শাসন কালেই তক্ষশীলা আবার তার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে থাকে। কালক্রমে তক্ষশিলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে।
তক্ষশীলার পতন
বিভিন্ন ভাবে তক্ষশিলা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
- (১) বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী রাজাদের দ্বারা তক্ষশিলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- (২) পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র হীন কাঠামোতে পরিণত হয়। ফলে তক্ষশিলা জন-পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়।
- (৩) ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে তক্ষশিলায় সর্বশেষ আক্রমণটি আসে হুনদের পক্ষ থেকে। এরপর পুরো তক্ষশিলা ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
উপসংহার :- সাম্রাজ্যবাদী পারস্য, গ্রীক, রোমান, শক, কুষান, আক্রমণ প্রভৃতি বিদেশী আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক আগ্রাসনে স্তব্ধ হয়ে যায় তক্ষশিলার পথ চলা।
(FAQ) তক্ষশীলা হতে জিজ্ঞাস্য?
প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী।
গান্ধার মহাজনপদের।