ভক্তি আন্দোলন প্রসঙ্গে ভক্তিবাদের উৎপত্তি, ইসলামের প্রভাব, জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা, সুফীবাদের প্রভাব, ইসলামের শিক্ষা, হিন্দুশাস্ত্রে ভক্তিতত্ত্বের কথা, হিন্দুধর্মে ভক্তিযোগের কথা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ এবং ভক্তি গুরুদের মূল কথা সম্পর্কে জানবো।
ভক্তি আন্দোলন
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভক্তি আন্দোলন |
মোক্ষ লাভ | নিষ্কাম কর্ম |
ভক্তিবাদের বীজ | বৈদিক সাহিত্য |
দেবতা | কৃষ্ণ বা রাম |
ভূমিকা :- সুলতানি যুগে ভক্তিধর্মের প্রসার ছিল এক বিরাট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর ভক্তি আন্দোলনের মত এত ব্যাপক ও গভীর ধর্ম আন্দোলন আর ভারত -এ হয়নি।
ভক্তিবাদের উৎপত্তি
ভক্তিধর্মের উদ্ভব সম্পর্কে পণ্ডিতেরা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেন। ডঃ তারাচাঁদ, ইউসুফ হুসেন, ডঃ আই এইচ কুরেশির মতে, মধ্যযুগে ভারতীয় ভক্তিধর্মের উদ্ভবে ইসলামের প্রভাব বিশেষভাবে দেখা যায়। ইসলামের একেশ্বরবাদ, আল্লাহের প্রতি আত্মসমর্পণকে মুক্তির একমাত্র পথ রূপে বিশ্বাস ভক্তিধর্মের প্রচারকাজের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে।
ভক্তি আন্দোলনে ইসলামের প্রভাব
ইসলামের প্রভাবে তারা বহু দেবতার পুজো, জটিল আচার-অনুষ্ঠান ত্যাগ করে একমাত্র দেবতা হিসেবে কৃষ্ণ বা রামের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনকেই মুক্তির পথ বলে প্রচার করেন। ইসলামের মানবতাবাদ ও সামাজিক গণতন্ত্রের প্রভাবে তারা প্রভাবিত হন। সকল মুসলিম আল্লাহের চক্ষে সমান এবং সকল মুসলিম ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ। এই চিন্তাধারা ভক্তি গুরুদের প্রভাবিত করে।
জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতায় ভক্তিবাদ
- (১) ভক্তি গুরুরা হিন্দু সমাজের জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করেন। সকল ভক্তই ভগবানের কাছে সমান এই তত্ত্ব তাঁরা প্রচার করেন। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুধর্মের চিন্তাধারায় ভক্তিধর্মের কথা ছিল কিন্তু ব্রাহ্মণ্য মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানের চাপে তা ছিল উপেক্ষিত, প্রাণহীন।
- (২) ভারতে ইসলামের আগমনের পর, ইসলামের একেশ্বরবাদ ও আল্লাহের প্রতি ভক্তি হিন্দু ধর্মগুরুদের একাংশকে এই চাপাপড়া ভক্তিবাদকে নূতন করে প্রাণ শক্তি দানে অনুপ্রাণিত করে।
ভক্তি আন্দোলনের উপর সুফীবাদের প্রভাব
- (১) সুফীবাদও ভক্তিধর্মের উদ্ভবে বিশেষ ভূমিকা নেয়। সুফী সন্তরা সুন্নীদের মত ইসলামের বাইরের অনুশাসন ও আচারে জোর দিতেন না। তাঁরা আল্লাহের প্রতি ভক্তিকেই মুক্তির পথ বলতেন।
- (২) যেক্ষেত্রে উলেমারা ধর্ম সমন্বয়ের বিরোধিতা করেন, আপোষ বিরোধী গোঁড়া কোরাণীয় মত প্রচার করেন, সেক্ষেত্রে সুফী সন্তরা অতীন্দ্রীয়, দিব্য উপলব্ধি, ভক্তিতত্ত্ব ও নৈতিক আদর্শের ওপর জোর দেন।
- (৩) তাঁরা হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলেন। সুফী সন্তরা কোরাণের পণ্ডিতী ব্যাখ্যা অপেক্ষা আল্লাহের প্রতি ভক্তিকেই মুক্তির পথ বলতেন। সূফী সন্তদের এই উদার মত হিন্দু ভক্তি আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে।
ভক্তি প্রচারকদের ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ
ইসলামের উদারনৈতিক মত থেকে হিন্দু ভক্তিধর্মের প্রচারকরা এই বাস্তব শিক্ষা নেন যে, জাতিভেদ জর্জর, বহু দেবতার পূজায় আসক্ত, শতধা বিভক্ত হিন্দু সমাজকে বলীয়ান করতে হলে ভক্তিধর্ম প্রবর্তন করা দরকার। এই ধর্ম ইসলামকে যেমন শক্তিশালী করেছে, হিন্দু সমাজকেও সেরূপ শক্তিশালী করবে।
হিন্দুশাস্ত্রে ভক্তিতত্ত্বের কথা
- (১) ভক্তিধৰ্ম কেবলমাত্র ইসলামের প্রভাবে হিন্দু সমাজে বিস্তার লাভ করে একথা বলা যায় না। ভক্তিধর্মের মূল নীতিগুলি দীর্ঘকাল হিন্দু শাস্ত্রে নিহিত ছিল। বিভিন্ন ধর্মগুরু সেই তত্ত্বগুলি নূতন আবেগ ও প্রেরণায় তা প্রচার করলে সমাজে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- (২) হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে মুক্তির তিনটি পথের কথা বলা হয়েছে। যথা – জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি। শঙ্কারাচার্য জ্ঞানযোগ বা দার্শনিক যুক্তি এবং ভক্তিযোগের কথা বলেন। মধ্য যুগের হিন্দু ধর্মগুরুগণ ভক্তিবাদ বা ভক্তিযোগের কথা বলেন। এজন্য তাদের ইসলামের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হয় নি।
- (৩) হিন্দুধর্মের মধ্যেই ভক্তিযোগের কথা প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। ভক্তি ধর্মের মূলকথা হল জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। বৈদিক সাহিত্যে ভক্তিবাদের বীজ নিহিত ছিল। উপনিষদে নিরাকার পরম ব্রহ্মের কথা বলা হয়।
- (৪) যাগযজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠান ত্যাগ করে মুক্তিদানের জন্য সাধনার কথা বলা হয়। বেদান্তে বলা হয় যে আত্মা হল ঈশ্বরের অংশ, যেমন বৃষ্টি কণা সমুদ্রের অংশ। আত্মা পরমাত্মায় লীন হলে আসে মুক্তি বা মোক্ষ। জ্ঞান যোগ, অথবা কর্মযোগ দ্বারা মানুষ মোক্ষলাভ করতে পারে।
- (৫) কিন্তু নিস্কাম কর্মের সাধনা ছাড়া মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। কাজেই কর্মযোগ ছিল অতি কঠিন পথ। কাজেই, ভক্তি মার্গকেই মুক্তির প্রকৃত ও সহজ পথ বলে মনে করা হত। ভগবদ গীতায় ভগবান কৃষ্ণ নিস্কাম কর্মের সাধনা অথবা ভগবানে ভক্তের আত্ম সমর্পণকেই মুক্তির পথ বলেন। কাজেই ভক্তিবাদের মূলকথা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের মধ্যেই ছিল।
হিন্দুধর্মে ভক্তিযোগের কথা
- (১) হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে ভক্তিধর্মের কথা আগে বলা হলেও, সুলতানি যুগে তা নতুন উদ্যমে কেন প্রচার করা হয়, সেই প্রশ্ন আসতে পারে। সুলতানি যুগে ভক্তিধর্মের প্রবলতার কারণ ইসলামের প্রভাব।
- (২) ইসলামের সাম্য ও সৌভাত্র এবং একেশ্বরবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দু ধর্মগুরুরা ভক্তিবাদ প্রচার করেন। তারাও একেশ্বরবাদ ও ভক্তি এবং মানবতার তত্ত্ব প্রচার করেন।
ভক্তি আন্দোলনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ
- (১) ভক্তিধর্ম প্রচারের একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল। হিন্দু উচ্চবর্ণের লোকেরা ছিল খুৎ, মুকাদ্দম বা সামন্তশ্রেণীর লোক। মুসলিম শাসকশ্রেণীও ছিল সামন্ততান্ত্রিক। দরিদ্র কৃষক, নিম্নবর্ণের মানুষ, শহরের কারিগর শ্রেণী ছিল সমাজে নিপীড়িত ও শোষিত।
- (২) এই নিপীড়িত শ্রেণীর মধ্যেই ছিল ভক্তিধর্মের প্রধান আসন। ভক্তিধর্ম সকল মানুষ সমান এই তত্ত্ব প্রচার করলে এই শ্রেণী মুক্তির আলোক দেখতে পায়। রুশ গবেষিকা কোকা আন্তোনোভা বলেছেন যে, “ঈশ্বরের সমীপে সকলে সমান – ভক্তিবাদের এই সামাজিক সাম্য, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মুসলমানদের আধিপত্য ও হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।”
ভক্তি গুরুদের মূল কথা
এই ভক্তিগুরুরা যে মূলকথা গুলি প্রচার করেন তা ছিল –
- (১) ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। সকল ধর্মে একই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে, সকল ধর্মই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে চায়। কাজেই বিভিন্ন ধর্মে কোনো বিরোধ নেই।
- (২) মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি। তার কাছে সকল মানুষই সমান। কাজেই জাতি ও বর্ণভেদ বলে কিছু নেই। মানুষের পরিচয় তার কর্মের দ্বারা অর্থের দ্বারা মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় না।
- (৩) ভক্ত ও ভগবানের কাছে পুরোহিত, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি নেই। আচার অনুষ্ঠান পালন দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। একমাত্র ভক্তি ও আত্মনিবেদন দ্বারা তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়।
- (৪) কাজেই মুক্তিলাভের একমাত্র পথ হল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি। সকল কর্মের ফল তাকে সমর্পণ করে কাজ করা।
উপসংহার :- কবীর ও নানক কোনো দেবতার নাম করেন নি। তারা কোনো সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেন নি। তারা নিরাকার ঈশ্বর -এর কথাই বলেন। অপরদিকে রামানন্দ, চৈতন্য প্রমুখ রাম বা কৃষ্ণের নাম প্রচার করেন।
(FAQ) ভক্তি আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ইসলামের প্রভাব।
বৈদিক সাহিত্য।
নিষ্কাম কর্মের সাধনা।
জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন।