বৈদিক সাহিত্য

বৈদিক সাহিত্য প্রসঙ্গে বেদের উৎপত্তি, শ্রুতি ও স্মৃতি, বেদের লিখিত রূপ, বেদের চারটি অংশ, বেদাঙ্গ ও সূত্র সাহিত্য, ছয়টি সূত্র, ষড়দর্শন, ষড়দর্শনের রচয়িতা, পাণিনি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জানবো।

বৈদিক সাহিত্য

বিষয়বৈদিক সাহিত্য
সভ্যতাবৈদিক সভ্যতা
প্রধান গ্ৰন্থবেদ
চারটি বেদঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ
প্রাচীন বেদঋগ্বেদ
বৈদিক সাহিত্য

ভূমিকা :- বৈদিক সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা হল আর্যরা। হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ভারত -এ বৈদিক গ্ৰামী সভ্যতা গড়ে তোলে আর্যরা। বেদ ও বেদাঙ্গ নিয়ে বৈদিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়।

বেদের উৎপত্তি

বেদ শব্দটি বিদ অর্থাৎ জ্ঞান শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য হল বেদ। বেদ সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। তবে ঋক বৈদিক যুগ-এ সংস্কৃত লোকের কথ্য ভাষা ছিল বলে মনে করা হয়। পরবর্তী বৈদিক যুগ-এ সংস্কৃত উচ্চশ্রেণীর ভাষায় পরিণত হয়।

বৈদিক সাহিত্য শ্রুতি ও স্মৃতি

বেদকে অপৌরুষের বা ঈশ্বরের বাণী বলে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা মনে করে। ঈশ্বরের কাছ থেকে বেদের বাণী শুনে ঋষিরা সে বাণী মনে ধরে রাখত। ঈশ্বরের কাছে শুনে এবং বংশ-পরম্পরার কাছে শুনে মুখস্থ করে বেদের বাণীগুলি বলে বলে এর নাম হয় ‘শ্রুতি’। এই যুগে বেদ লিখিত আকারে ছিল না। বংশ-পরম্পরায় মুখস্থ করে বেদকে স্মরণে রাখা হত, এজন্য এর নাম হল “স্মৃতি”।

বৈদিক সাহিত্য বেদের লিখিত রূপ

পরবর্তীকালে লিপি বর্ণমালার উদ্ভাবন হলে বেদকে লিখিত রূপ দেওয়া হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বেদকে হিন্দুধর্মের আকর গ্রন্থ বলে মনে করে। হিন্দুদের সকল ধর্মচিন্তা, সমাজ সংস্কার বেদে পাওয়া যায় বলে তারা বিশ্বাস করে।

বৈদিক সাহিত্য বেদ

বেদের সংখ্যা হল চারটি। চারটি বেদ হল ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব।

(১) ঋকবেদ

চার বেদের মধ্যে ঋক বেদ হল সর্বপ্রাচীন। ম্যাক্সমুলারের মতে, ঋকবেদের রচনাকাল ছিল সম্ভবত ১২০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্ব। ঋকবেদের কোনো কোনো স্তোত্র ১২০০ খ্রিস্টপূর্বতে রচিত হয় এবং এর সর্বশেষ স্তোত্র ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত হয়। এই মত অনেকে অগ্রাহ্য করেন। তবে বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ দৃষ্টে পণ্ডিতেরা ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্ব ঋকবেদের রচনাকাল বলেছেন।

(২) সাম, যজু ও অথর্ববেদ ঋকবেদের অনেক পরে রচিত হয়।

বেদের চারটি অংশ

প্রতিটি বেদের চারটি অংশ দেখা যায়। যথা, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ।

(১) সংহিতা

সংহিতা অংশ পদ্যে রচিত এবং এটি ছিল প্রধানত স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতি। ঋক্‌ সংহিতার বহু স্তোত্র সাম, যজু ও অথর্ব বেদের সংহিতায় পুনরায় গ্রহণ করা হয়েছে। সামবেদের স্তোত্রগুলি যজ্ঞের সময় সুর করে গানের মত গাওয়া হত, এর নাম সাম গান।

(২) ব্রাহ্মণ

ব্রাহ্মণ অংশগুলি গদ্যে রচিত। এতে যাগ-যজ্ঞের বিধি, প্রকরণ ও মন্ত্রগুলির টীকা দেওয়া আছে।

(৩) আরণ্যক

আরণ্যক অনেক পরে রচিত হয়। কারণ সংহিতা ও ব্রাহ্মণে যেরূপ যজ্ঞ প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে, আরণ্যকে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। যে সকল লোক যাগ-যজ্ঞে বিশ্বাস না করে অরণ্য অর্থাৎ বনে বসবাস করত এবং আত্মার মুক্তির উপায় চিন্তা করত তাদের কথাই আরণ্যকে স্থান পেয়েছে। এজন্য আরণ্যকে উচ্চ দার্শনিক চিন্তার পরিচয় দেখা যায়। আরণ্যকে ভক্তিধর্ম এবং জন্মান্তরবাদের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়।

(৪) উপনিষদ

  • (ক) উপনিষদে যজ্ঞ বা পুজো বাদ দিয়ে মানুষের মুক্তির কথা ভাবা হয়েছে। কর্মফল অর্থাৎ কর্ম অনুযায়ী জীবনে সুখ বা দুঃখ ভোগের তত্ত্ব উপনিষদে পাওয়া যায়। মৃত্যুর পরও মানুষ কর্মফলের কারণে পরজন্মে ফল ভোগ করে।
  • (খ) মৃত্যুর পর সব কিছু শেষ না হয়ে, আত্মা পুনর্বার নতুন দেহে জন্মগ্রহণ করে বলে উপনষিদে বলা হয়। জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যায় বলে উপনিষদে মত প্রকাশ করা হয়েছে। বেদের অন্তে উপনিষদ আছে বলে এর নাম হল বেদান্ত।
  • (গ) বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশের ধর্মবিশ্বাস থেকে উপনিষদের ধর্মবিশ্বাস অনেক পরিণত। কর্মফলের হাত থেকে মুক্তির জন্য ধ্যান, সন্ন্যাস, পরিশুদ্ধ নীতিবোধের কথা উপনিষদে পাওয়া যায়।

বেদাঙ্গ ও সূত্র সাহিত্য

বেদ যাতে ঠিকভাবে পাঠ করা যায় তা শিক্ষার জন্যে এবং যাগ-যজ্ঞের নিয়ম শিক্ষার জন্য বেদাঙ্গ রচিত হয়। বেদাঙ্গকে সূত্র সাহিত্য বলা হয়। বেদাঙ্গও হল বৈদিক সাহিত্যের অংশ। এতে ছয়টি সূত্র ও ছয়টি দর্শন আছে।

ছয়টি সূত্র

  • (১) শিক্ষা, যার সাহায্যে বিশুদ্ধ উচ্চারণে বেদ পাঠ করা যায়।
  • (২) ছন্দ, যাতে বেদের স্তোত্রগুলির ছন্দ আলোচনা করা হয়েছে। যেমন অনুষ্টুপ ছন্দ।
  • (৩) ব্যাকরণ, যার সাহায্যে ভাষাকে শুদ্ধভাবে প্রয়োগ করা যায়।
  • (৪) নিরুক্ত, যাতে বৈদিক ভাষাতত্ত্ব জানা যায়।
  • (৫) জ্যোতিষ, যাতে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও প্রভাব জানা যায়।
  • (৬) কল্প, যাতে সমাজ পরিচালনার নিয়ম, যাগ-যজ্ঞের প্রণালী প্রভৃতি জানা যায়।

বৈদিক সাহিত্য কল্পসূত্র

কল্প সূত্র বেদাঙ্গের খুব প্রয়োজনীয় অংশ। কারণ এতে আর্যদের সমাজ, গার্হস্থ্য, ধর্মীয় জীবন-যাপনের অনুশাসন দেওয়া আছে। কল্প সূত্র কয়েকটি সূত্রে বা অংশে বিভক্ত, যথা শ্রৌত, গৃহ্য, শূল্ব ও ধর্ম। এর মধ্যে গৃহ্য সূত্রে আছে গৃহীর জীবন-যাপনের নিয়ম ও তার দশকর্মবিধি।

বৈদিক সাহিত্য ধর্মসূত্র

ধর্মসূত্রে আছে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে অনুশাসন। এর ওপর নির্ভর করে পরে মনুর বিধান বা মনুসংহিতা, বৃহস্পতি স্মৃতি, নারদ স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।

বৈদিক সাহিত্য ষড়দর্শন

ছয়টি দর্শনকে (ষড়দর্শন) বেদাঙ্গের অপর অংশ বলে ধরা হয়। এই ছয় দর্শন হল- (১) সাংখ্য, (২) যোগ, (৩) ন্যায়, (৪) বৈশেষিক, (৫) পূর্ব মীমাংসা ও (৬) উত্তর মীমাংসা।

ষড়দর্শন রচয়িতা

যে ছয় ঋষি  ষড়দর্শন তত্ত্বের উদগাতা ছিলেন তাদের নাম হল যথাক্রমে কপিল (সাংখা), পতঞ্জলি (যোগ), গৌতম (ন্যায়), কনাদ (বৈশেষিক), জৈমিনী (পূর্ব মীমাংসা), বেদব্যাস (উত্তর মীমাংসা)।

পাণিনি

  • (১) পাণিনির ব্যাকরণ একটি প্রাচীন রচনা। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তার গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ী রচিত হয়। পাণিনির ভাষা ছিল মার্জিত ও উন্নত। এজন্য এর নাম ছিল সংস্কৃত। আর্যদের কথ্য ভাষা ছিল প্রাকৃত।
  • (২) পাণিনির ব্যাকরণে যে সকল স্থানের নাম আছে তার সাহায্যে ভারতে আর্য সভ্যতার বিস্তার সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তিনি বিন্ধ্যের দক্ষিণের কোনো স্থানের নাম দেন নি। পাণিনির আমলে প্রজাতন্ত্রগুলিব নাম ছিল সঙ্ঘ। জনপদ ছিল জেলা প্রশাসনের বিভাগীয় নাম।
  • (৩) তাঁর আমলে লোকে সুদে টাকা খাটাত। গরীব লোকেরা মজুর খাটত এবং নগদ মজুরী বা খাদ্যশস্য পেত। কার্যাপণ, নিস্ক, মাষ প্রভৃতি মুদ্রার প্রচলন ছিল।

জ্ঞান-বিজ্ঞান

  • (১) এই প্রসঙ্গে আর্যদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা কিছু উল্লেখ্য। আর্যরা গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, বছরকে সৌর নিয়মে ভাগ করতে জানত। তারা বারোমাসে বছরকে ভাগ করত এবং প্রতি মাসকে ত্রিশ দিনে ভাগ করত।
  • (২) শূল্ব সূত্রে আর্যদের জ্যামিতির জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। যজ্ঞবেদী তৈরির সময় চতুর্ভুজ ও ত্রিভুজ ক্ষেত্র তৈরির প্রণালী তারা আবিষ্কার করেছিল।
  • (৩) চিকিৎসাবিদ্যাও আর্যদের অধিগত ছিল। বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ তারা জানত। অথর্ববেদে ভেষজ ও চিকিৎসার কথা আলোচনা করা হয়েছে।

উপসংহার :- বিভিন্ন সাহিত্য, সূত্রের পাশাপাশি শারীরবিদ্যা সম্পর্কেও আর্যরা জ্ঞান রাখত। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তারা পরীক্ষা করেছিল।

(FAQ) বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বৈদিক সাহিত্য বলতে কি বুঝায়?

বেদ ও বেদাঙ্গ একত্রে বৈদিক সাহিত্য সৃষ্টি করে।

২. বেদ কয়টি ও কি কি?

চারটি- ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ।

৩. সর্বপ্রাচীন বেদ কোনটি?

ঋকবেদ।

৪. অষ্টাধ্যায়ী কার রচনা?

পাণিনি।

৫. প্রতিটি বেদের কয়টি ভাগ ও কি কি?

চারটি- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্।

Leave a Comment