প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যিক উপাদান, দেশজ সাহিত্য, বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ, প্রত্নতাত্তিক উপাদান, মুদ্রা, লিপি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান
ঐতিহাসিক বিষয় | প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান |
অর্থশাস্ত্র | কৌটিল্য |
রাজতরঙ্গিনী | কলহন |
হাতিগুম্ফা লিপি | খারবেল |
জুনাগড় লিপি | রুদ্রদামন |
ভূমিকা :- ইতিহাস মনগড়া কাহিনি নয়। ইতিহাসের ভিত্তি হল তথ্যসূত্র। যে সকল তথ্যের সূত্রে ইতিহাস লেখা হয় তাকে বলে ইতিহাসের উপাদান।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদানের শ্রেণীবিভাগ
প্রাচীন ভারত-এর ইতিহাসের উপাদানগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- (i) সাহিত্যিক উপাদান
- (ii) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
(i) সাহিত্যিক উপাদান
ভারত-ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদানকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- (ক) দেশজ সাহিত্য
- (খ) বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ
(ক) দেশজ সাহিত্য
- (১) দেশজ সাহিত্যের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বেদ ও বৈদিক সাহিত্য। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, সূত্র-সাহিত্য, বেদাঙ্গ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
- (২) সাহিত্য-উপাদান হিসেবে দুটি প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত-এর গুরুত্ব কম নয়। এছাড়া পুরাণ গ্রন্থাদি, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থাদি, সিংহলের দীপবংশ ও মহাবংশ প্রভৃতি থেকেও রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায়। ‘বৌদ্ধ-জাতক এবং জৈন ভগবতী সূত্র ও ‘আচার্য-সূত্র’ ইত্যাদি গ্রন্থের ইতিহাস-মূল্য অপরিসীম।
- (৩) প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রগুলি যেমন – মনুস্মৃতি, নারদ-স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক-স্মৃতি ইত্যাদি থেকে সমকালীন ধর্মীয় সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার-বিষয়ক আইনকানুন ও বিধিনিষেধের কথা জানা যায়। প্রাচীনকালে লেখা পুঁথিগুলিও সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়।
- (৪) প্রাচীন রাজাদের সভাকবিদের বিবরণ ও জীবনচরিত থেকেও ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। এরূপ রাজকাহিনির মধ্যে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদের-চরিত’, বাকপতির ‘গৌড়বহো’ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
- (৫) খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ প্রাচীন ভারতের প্রথম ইতিহাসমূলক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে কাশ্মীর ছাড়াও গুজরাট, নেপাল, আসাম ও সিন্ধু দেশের ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়।
- (৬) কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল। মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থা, রাজার কর্তব্য, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, ধর্মীয় জীবন ইত্যাদি এই গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’, বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে সমকালীন সমাজ জীবনের ছবি পাওয়া যায়।
(খ) বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ
বৈদেশিক লেখক ও পর্যটকদের বিবরণী প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের অতি মূল্যবান উপাদান। যেমন –
- (১) গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস-এর লেখা থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমরা কার্টিয়াস, ডিওডোরাস, প্লুটার্ক প্রমুখ গ্রিক ও রোমান লেখকের ইতিহাস থেকে পাই।
- (২) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-এর সভায় আগত গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস-এর ‘ইন্ডিকা‘ গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্য-এর বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সী’ গ্রন্থে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের এবং টলেমীর ‘ভূগোল’ থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক তথ্য জানা যায়।
- (৩) ফা-হিয়েন ভারতে আসেন গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত-এর আমলে। তাঁর ‘ফো-কুয়ো-কি’ গ্রন্থ থেকে সেকালের বহু তথ্য জানা যায়। হিউয়েন সাঙ এদেশে আসেন হর্ষবর্ধন-এর রাজত্বকালে। তাঁর ‘সি-ইউ-কি’ গ্রন্থ থেকে সমকালীন ঘটনাবলি সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। একইভাবে প্যান-কু রচিত ‘সিয়েন-হান-শূ’, ফ্যান-ই রচিত ‘হৌ-হান-শু’ কুষাণদের ইতিহাস সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে।
- (৪) অষ্টম শতক থেকে আরবীয় পর্যটকরাও এদেশে আসেন। এঁদের মধ্যে আল বেরুণীর ‘তহকিক-ই-হিন্দ’ গ্রন্থে তৎকালীন ভারতের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা সম্পর্কে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। আরব পর্যটক অল-বিলাদুরী, অল-মাসুদি প্রমুখের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যথেষ্ট সাহায্য করে।
(ii) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- (ক) সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ
- (খ) লিপি
- (গ) মুদ্রা
- (ঘ) স্থাপত্য-ভাস্কর্য
(ক) সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ
ভারতের নানা স্থানে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। তাকে বিশ্লেষণ করে সমসাময়িক নানা তথ্য জানা যায়। যেমন, সিন্ধু নদের উপত্যকায় মহেন-জো-দারো ও হরপ্পায় খননকার্য চালিয়ে এক সুপ্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। প্রমাণিত হয়েছে যে, আর্যসভ্যতার আগেও ভারতবর্ষে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
(খ) লিপি
- (১) প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লিপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনকালে পাথরের ফলক, তামা বা ব্রোঞ্জ-এর ফলক, পোড়ামাটির ফলক, বাসগৃহ বা মন্দিরের গায়ে ‘লিপি’ খোদাই করা হত। এই সকল লিপি থেকে ঐতিহাসিক ঘটনার সন, তারিখ, রাজা ও রাজবংশের নাম, ব্যাবসাবাণিজ্যে প্রসার, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়।
- (২) ভূমিদান পত্রগুলি থেকে জানা যায়, ভূমি-সংক্রান্ত আইনকানুন ও ভূমিব্যবস্থার কথা। ঐতিহাসিক স্মিথ লিপিগুলিকে ‘প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য উপাদান’ বলে মন্তব্য করেছেন।
- (৩) সম্রাট অশোক-এর আমলের অসংখ্য ‘লিপি’ আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁর সাম্রাজ্য-এর সর্বত্র এগুলি প্রোথিত ছিল। অশোকের অধিকাংশ ফলকে ‘ব্রাহ্মী লিপি‘ ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রাকৃত ভাষায় বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। তবে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে যবন প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি ‘খরোষ্ঠী লিপি‘ ব্যবহার করেছেন। ‘ব্রাহ্মীলিপি’ বাম থেকে ডানদিকে লেখা হত। তবে ‘খরোষ্ঠীলিপি’ ডান থেকে বামদিকে লেখা হত।
- (৪) গুপ্তযুগ থেকে লিপির ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া তামিল, তেলেগু, পালি ইত্যাদি নানা ভাষার ব্যবহার ছিল। এই ধরনের লিপির মধ্যে সাতবাহন রাজাদের ‘নানঘাট’ ও ‘নাসিকলিপি’, কলিঙ্গরাজ খারবেল-এর ‘হাতিগুম্ফালিপি’, শকক্ষত্রপ রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় লিপি’, সমুদ্রগুপ্ত-এর ‘এলাহাবাদলিপি’ (প্রশস্তি) উল্লেখযোগ্য।
- (৫) হরিষেণ বিরচিত ‘এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি’ থেকে সমুদ্রগুপ্তের আমলের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া স্কন্দগুপ্ত-এর ‘ভিটারিলিপি’, হর্ষবর্ধনের ‘নালন্দালিপি’, চালুক্য দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহোল লিপি‘ ইতিহাসের উপাদান হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
- (৬) বহির্ভারতের আবিষ্কৃত ‘শিলালিপি’ যেমন, এশিয়া-মাইনরের ‘বোখাজকোই’ শিলালিপি থেকে ভারতে আর্যদের আগমনকাল সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। ইরানের বেহিস্তান, পার্সিপোলিস ও নক্ক্স-ই-রস্তম্ নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলি থেকে প্রাচীন ভারত ও ইরানের যোগাযোগ-সংক্রান্ত মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেছে।
(গ) মুদ্রা
প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মুদ্রা। ১৯২৪ সালে তক্ষশীলার ভীরমাউন্ড-এ প্রাপ্ত ছাপযুক্ত মুদ্রাগুলিকে ভারতের প্রাচীনতম মুদ্রা বলা হয়। এগুলি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নন্দ ও মৌর্যদের আমলে চালু ছিল বলে অনুমান করা হয়। মুদ্রার গুরুত্ব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ –
- (১) সাহিত্য বা লিপি থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলি যাচাই করে প্রকৃত সত্য নির্ণয়ে মুদ্রা বিশেষ সাহায্য করে।
- (২) মুদ্রাগুলিতে সাধারণত রাজা ও রাজবংশের নাম, সন-তারিখ, রাজার মূর্তি ও নানা দেবদেবীর মূর্তি খোদিত থাকে। তাই মুদ্রা থেকে আমরা রাজার নাম, সন, তারিখ রাজ্যের পরিধি, সেকালের লিপি, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি নানা বিষয় জানতে পারি।
- (৩) প্রাচীন ভারতে এমন অনেক শাসক ছিলেন, যাদের কথা কেবল মুদ্রা থেকেই পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে খোদিত রাজার মূর্তি বা অন্যান্য ছবি থেকে সমকালীন রাজার আকৃতি, ধর্মবিশ্বাস, রাজার চরিত্র ইত্যাদি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি বা ঘোড়ার ছবি থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি সংগীতবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এবং অশ্বমেধ-যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।
- (৪) ঘটনার কাল-নির্ণয়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা খুবই মূল্যবান। আবার মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু থেকে সে-যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা, মুদ্রানীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- (৫) ভারতের বিভিন্ন গণরাজ্য ও উপজাতি যেমন মালব, যৌধেয় প্রমুখের সম্বন্ধে জানার জন্য মুদ্রা বিশেষ সাহায্য করে। মুদ্রার মতো সিলমোহরও প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার মূল্যবান দলিল।
(ঘ) স্থাপত্য-ভাস্কর্য
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মন্দির, স্তূপ, বিহার, প্রাসাদ, মূর্তি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনকালে মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্য গড়ে তোলা এই সব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য থেকে শিল্প ও ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। পরোক্ষভাবে এগুলি তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও প্রতিফলিত করে।
উপসংহার :- প্রাচীন সাহিত্য থেকে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা অনুসরণ করা জরুরি। কারণ, সাহিত্যে কল্পনার আধিক্য থাকা অসম্ভব নয়। সাহিত্যকর্মে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য থাকায় সমাজ সম্পর্কে একপাক্ষিক আলোচনা থাকার সম্ভাবনা বেশি। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য লেখকদের রচনায় নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের অভাব থাকা অসম্ভব নয়। বিদেশি পর্যটকরা এদেশের ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। তাই তাঁদের রচনায় প্রকৃত তথ্য পাওয়া কিছুটা কষ্টকর।
ইতিহাসের উপাদান সম্পর্কে আলোচনা
(FAQ) প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কৌটিল্য বা চাণক্য।
রাজতরঙ্গিনী।
সমুদ্রগুপ্ত।
শক রাজা রুদ্রদামন।