আজ আমরা হর্ষবর্ধন -এর জন্ম, সিংহাসনে আরোহণ, সাম্রাজ্যের বিস্তার, হর্ষবর্ধনের চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে জানবো ।
হর্ষবর্ধন
জন্ম | ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ |
পিতা | প্রভাকর বর্ধন |
মাতা | যশোমতী |
রাজত্বকাল | ৬০৬ – ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ |
বংশ | পুষ্যভূতি বংশ |
ভূমিকা :- হর্ষবর্ধন বা হর্ষ উত্তর ভারত -এর এক খ্যাতনামা সম্রাট যিনি ৬০৬ থেকে ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা প্রভাকর বর্ধনের সন্তান ছিলেন।
হর্ষবর্ধন সম্পর্কে জানার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
হর্ষবর্ধন সম্পর্কে জানতে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে তার সভাকবি বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত এবং তার রাজসভায় আগত চীনা দূত হিউয়েন সাঙ -এর সি-ইউ-কি গ্ৰন্থ দুটি।
লিপি
হর্ষের রাজত্বকালে খােদিত বাঁশখেরা তাম্রপট্ট, নালন্দা শীল সােনাপৎ তাম্রপট্ট মধুবনী তাম্রপট্ট প্রভৃতি লিপি এবং চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহােল শিলালিপি হর্ষবর্ধন (Harshavardhana) সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধারণ করে আছে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন
ষষ্ঠ শতকের মাঝের দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্য -এর পতন ঘটলে উত্তর ভারত ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র ও রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
হর্ষবর্ধনের সিংহাসনে আরোহণ
থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধন (হর্ষবর্ধনের দাদা) গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্ক -এর হাতে নিহত হলে ৬০৬ সালে হর্ষকে রাজা ঘোষণা করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
হর্ষ সম্বৎ প্রচলন
কনৌজ দখল করেই হর্ষবর্ধন ‘হর্ষ সম্বৎ’ (৬০৬খ্রি:) প্রচলন করেন।
প্রজাতন্ত্র একত্রিকরণ
শ্রীহর্ষ পাঞ্জাব থেকে মধ্য ভারত পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রগুলিকে একত্রিত করেন।
হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তার
পশ্চিমে পাঞ্জাব থেকে শুরু করে পূর্ব বঙ্গ ও ওড়িশা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নর্মদা নদীর উত্তরে অবস্থিত সমস্ত সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকাতে হর্ষবর্ধনের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল।
চালুক্য প্রতিরোধে ব্যর্থ
নর্মদার দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার করার চেষ্টা করার সময় দক্ষিণে চালুক্য বংশ -এর রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী-র কাছে হর্ষবর্ধন পরাজিত হন (৬১৮-৬১৯)।
সুশাসন ও শান্তির রাজত্ব
হর্ষের রাজত্বে সুশাসন এবং শান্তি বজায় থাকার কারণে বহুদূর দেশ থেকেও বহু শিল্পী, বিদ্বান ব্যক্তি ও ধর্ম প্রচারক তার রাজসভায় সমাদৃত হন।
হিউয়েন সাঙ ও হর্ষবর্ধন
চীন -এর পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ রাজা হর্ষের রাজসভায় উপনীত হন এবং তার রাজসভার সুবিচার এবং রাজার দানশীলতার সম্বন্ধে নিজের ভ্রমণকাহিনীতে প্রশস্তি বাক্য লেখেন।
সাহিত্যানুরাগ
হর্ষবর্ধন কবিতা ও নাটক লিখতেন। তিনি নাগানন্দ, প্রিয়দর্শিকা এবং রত্নাবলী নামের তিনটি সংস্কৃত নাটক রচনা করেন।
কনৌজ শহর ছিল হর্ষবর্ধনের রাজধানী এবং এখানে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা হত। বিখ্যাত বাণভট্ট হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন। তিনি হর্ষবর্ধনের জীবনীমূলক গ্রন্থ হর্ষচরিত রচনা করেন; এটি ছিল সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রথম ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ।
ধর্মানুরাগী
তিনি প্রথম জীবনে এক জন শৈব হলেও পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম -এর অনুসারী হন। তিনি ভারতে বহু বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় -এ অনেক দান করেন।
চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন
হর্ষবর্ধনই প্রথম ভারতীয় রাজা যিনি চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযান
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজশ্রীকে উদ্ধার ও শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন।
- (১) এই অভিযানে হর্ষবর্ধনের সাথে যোগ দেন কামরূপ রাজ্য -এর রাজা ভাস্করবর্মন।
- (২) বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত সূত্রে জানা যায়, হর্ষবর্ধন বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন।
- (৩) এরপর শশাঙ্ক ভাস্করবর্মণ ও হর্ষবর্ধনের সেনাবহিনী দ্বারা আক্রমণ এড়িয়ে, কৌশলের সাথে তিনি কনৌজ ত্যাগ করেন। ফলে হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে না পেরে রাজধানীতে ফিরে আসেন
গৌড় দখল
গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধন এবং ভাস্করবর্মন গৌড়রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দখল করে নেন।
উড়িষ্যা আক্রমণ
এরপর তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করে গঞ্জাম পর্যন্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন। গঞ্জাম অধিকারের পর সেখানকার মহাযান বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি সভা আহ্বান করেন। সম্মেলনের পর তিনি জয় সেন নামক জনৈক বৌদ্ধ-আচার্যকে উড়িষ্যার ৮০টি নগরীর রাজস্ব অর্পণ করেছিলেন।
কাশ্মীর অভিযান
হর্ষবর্ধন একাধিক বার কাশ্মীরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। কাশ্মীর অভিযানের ফলাফল জানা যায় না। তবে সিন্ধুদেশে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
বলভী রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান
তিনি পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্রের বলভী রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে দ্বিতীয় ধ্রুব সেনকে পরাজিত করেছিলেন। হিউসেন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি তাঁর নিজ কন্যাকে ধ্রুব সেনের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন।
পঞ্চভারত জয়
চৈনিক সূত্রে বলা হয়েছে যে, হর্ষ পূর্বদিকে অভিযানে রওনা হয়ে যে-সকল রাজ্য তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে সম্মত হয়নি তাদের বিরুদ্ধে ছয় বৎসর অবিরাম যুদ্ধ করে ‘পঞ্চভারত’ নিজ আনুগত্যাধীনে আনেন।
হর্ষবর্ধনের উপাধি
চালুক্য লিপিতে তাঁকে ‘সকলােত্তরপথনাথ’ বা সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি বলা হয়েছে। তাছাড়া তিনি নিজে শিলাদিত্য উপাধি গ্ৰহণ করেন।
হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা
হর্ষের শাসনব্যবস্থাকে একটি উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্র বলা যেতে পারে। এই শাসনব্যবস্থার সাফল্য হর্ষের ব্যক্তিত্ব ও যােগ্যতার ওপরই বেশিরভাগ নির্ভরশীল ছিল।
মৃত্যু
৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কোনো উত্তরাধিকার না থাকায়, তাঁর অবর্তমানে অর্জুন নামক এক মন্ত্রী রাজত্ব লাভ করেন।
উপসংহার :- অনেক ঐতিহাসিক হর্ষবর্ধনকে ‘প্রাচীন ভারতের শেষ গুরুত্বপূর্ণ শাসক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ঐতিহাসিক আর.কে. মুখার্জী বলেন,
“হর্ষের চরিত্রে সমুদ্রগুপ্তের সমরকুশলতা ও সম্রাট অশােক -এর প্রজাহিতৈষণার সমন্বয় ঘটেছিল”।
আর.কে. মুখার্জী
(FAQ) হর্ষবর্ধন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।
শিলাদিত্য।
প্রিয়দর্শিকা, রত্নাবলী, নাগানন্দ।