ব্রাহ্মী লিপি

ভারতের প্রাচীনতম ব্রাহ্মী লিপি -র নামকরণ, সময়কাল ও প্রচলিত স্থান, সমসাময়িক লিপি, পরিচিতি লাভ, আবিষ্কার, উৎপত্তি, সাদৃশ্য, প্রাচীনতম নিদর্শন, বর্ণ, লিপির উৎস, লিখিত নমুনা, বৌদ্ধধর্মের বিকাশে ভূমিকা সম্পর্কে জানবো।

ভারতের প্রাচীনতম ব্রাহ্মী লিপি প্রসঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির নাম, ব্রাহ্মী লিপির সময়কাল ও স্থান, ব্রাহ্মী লিপির সমসাময়িক লিপি, ব্রাহ্মী লিপির আবিষ্কার, ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি, হরপ্পা সভ্যতারই কোনো লিপি ব্রাহ্মী লিপি, ব্রাহ্মী লিপি থেকে অন্যান্য লিপির উদ্ভব, ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন, ব্রাহ্মী লিপির উৎস ও ভারতে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব কাল।

ভারতের প্রাচীনতম ব্রাহ্মী লিপি

ধরণশব্দীয় বর্ণমালা লিপি
সময়কালআনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ‌ শতক থেকে আনুমানিক পঞ্চম শতক
লেখার দিকবাম দিক থেকে ডান দিকে
ভাষাসমূহশক, তুকারিয়ান, মধ্য ইন্দো-আর্য‌ (প্রাকৃত) ভাষাসমূহ, দ্রাবিড়ীয় ভাষাসমূহ
ব্রাহ্মী লিপি

ভূমিকা :- এক প্রাচীন লিখন পদ্ধতির নাম হল ব্রাহ্মী লিপি। এই লিপিকে ভারত -এর প্রাচীনতম মৌলিক লিপি বলে অভিহিত করা হয়।

ব্রাহ্মী লিপির সময়কাল ও স্থান

এই লিপি খ্রিস্টপূর্ব শেষ শতকগুলিতে এবং খ্রিস্টের জন্মের পর প্রথম শতকগুলিতে ভারত উপমহাদেশ ও মধ্য এশিয়ায় ব্যবহৃত হত।

ব্রাহ্মী লিপির নাম

এই লিপির নাম নিয়ে মতভেদ আছে।

  • (১) অনেকে মনে করেন যে, প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্টির সাথে ধ্বনির বাহক হিসাবে এই লিপি প্রদান করেছিলেন। ব্রহ্মার দ্বারা এই লিপি উদ্ভাবিত ও প্রকাশিত হওয়ায় এর নাম রাখা হয়েছিল ব্রাহ্মী।
  • (২) আবার অন্যমতে বলা হয় যে, বৈদিক সভ্যতায় ব্রাহ্মণরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মী।

পরবর্তী ব্রাহ্মী

ব্রাহ্মী লিপি একসময় ইংরেজিতে “পিন-ম্যান” নামে পরিচিত ছিল। পঞ্চম শতকের গুপ্তলিপিকে মাঝে মাঝে ‘পরবর্তী ব্রাহ্মী’ বলা হয়।

ব্রাহ্মী লিপির সমসাময়িক লিপি

ব্রাহ্মী লিপির সমসাময়িক লিপি হল খরোষ্ঠী লিপি, যা আফগানিস্তানপাকিস্তান -এ ব্যবহৃত হত।

বর্ণমালার লিপি ব্রাহ্মী লিপি

এই লিপি শব্দীয় বর্ণমালা লিপি, যেখানে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মী লিপির পরিচিতি লাভ

ব্রাহ্মী লিপি বেশি পরিচিতি লাভ করেছে সম্রাট অশোক -এর পাথরে খোদাই করা বাণী থেকে। সম্রাটের এই লিপিটি উত্তর-মধ্য ভারতে স্থাপিত হয় ২৫০-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

ব্রাহ্মী লিপির আবিষ্কার

সম্রাট অশোকের খোদাই করা ব্রাহ্মী লিপিটি ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদ জেমস প্রিন্সেপ আবিষ্কার করেন।

ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি

পশ্চিমা ভাষা একাডেমির মতে ব্রাহ্মী লিপি সেমিটিক লিপি থেকে উৎপন্ন হয়েছে, নয়তো প্রভাবিত হয়েছে।

ব্রাহ্মী লিপি সম্পর্কে ভারতে প্রচলিত মত

বর্তমানে ভারতে একটি মতামত প্রচলিত আছে, যেখানে বলা হয় ব্রাহ্মী লিপি পুরনো সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতারই কোনো লিপি, যা এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে উৎপন্ন লিপি

এই লিপি থেকে অসংখ্য লিপি উৎপন্ন হয়েছিল। বর্তমানে অনেক আধুনিক লিপি ভারতসহ পূর্ব এশিয়ায় সগৌরবে চলছে। তাই ব্রাহ্মী বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবক লিপি হিসেবে সমাদৃত। সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৮ টি লিপি ব্রাহ্মী থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

ব্রাহ্মী লিপির সাদৃশ্য

জনপ্রিয় মতামত অনুসারে ব্রাহ্মীর সাথে সেমেটিক লিপির সম্পর্ক আছে বলে অনেক বিদ্বান মেনে নিয়েছেন। ব্রাহ্মীর সাথে আরামাইক লিপিরও কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন

ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে নেপাল -এর তরাই অঞ্চলের পিপ্রাবা থেকে। মনে করা হয় যে, এই লিপিটির সময়কাল গৌতম বুদ্ধ -এর নির্বাণকালের কিছু পরে।

ব্রাহ্মী লিপির অপর নাম অশোক লিপি

ব্রাহ্মীলিপির আদি পাঠগুলি সম্রাট অশোকের নির্দেশে স্থাপিত হয়েছিল বলে, অনেকে এই লিপিকে অশোক লিপি নামে অভিহিত করেছেন।

ব্রাহ্মী লিপির অন্য নাম মৌর্য লিপি

মৌর্য সাম্রাজ্য -এর রাজাদের সময়ে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপিকে মৌর্যলিপি বলা হয়। ভাষা বিজ্ঞানীরা খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীকে মৌর্যলিপির সময়কাল ধরে থাকেন।

ব্রাহ্মী লিপির বর্ণ

  • (১) প্রাপ্ত নিদর্শন গুলির বিচারে ব্রাহ্মীলিপিতে মাত্র ৪৪টি বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভিতরে স্বরবর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি।
  • (২) বাংলা বর্ণমালার বিচারে ঋ এবং ঔ বর্ণের নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তবে ব্যঞ্জনবর্ণের ঔ বর্ণের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাতে মনে হয় এই বর্ণ দুটির অস্তিত্ব ছিল।
  • (৩) ব্যঞ্জন বর্ণের ভিতরে ৩৫ বর্গীয় বর্ণ পাওয়া যায়।

বংভী লিপি

মহাবীর -এর অনুগামী জৈনদের ‘পবন্নবণাসূত্র’ এবং ‘সমবায়াঙ্গসূত্র’ নামক গ্রন্থদ্বয়ে যে ১৮টি লিপির উল্লেখ পাওয়া যায়, তার ভিতরে এই লিপির নাম পাওয়া যায় ‘বংভী’ হিসাবে।

ললিতবিস্তারে ব্রাহ্মী লিপির উল্লেখ

বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বীদের সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘ললিতবিস্তার’ -এ ৬৪টি লিপির নাম পাওয়া যায়। এই লিপিগুলির প্রথম লিপিটি হল ব্রাহ্মী।

ব্রাহ্মী লিপির লিপির উৎস

ইউরোপ -এর পণ্ডিতরা এই লিপির উৎস সম্পর্কে এক প্রকার জোর করে বলার চেষ্টা করেছেন যে, এই লিপির উদ্ভব ঘটেছিল ভারতবর্ষের বাইরে। এক্ষেত্রে তাদের মতামত হল –

  • (১) ড. আফ্রড মুলর, প্রিন্সেস, সেনার্ট, উলসন প্রমুখের মতে গ্রীকরা আমাদের দেশ ভারতবর্ষ -এ আসার পর ভারতবর্ষে ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি হয়েছিল।
  • (২) উলসন, ক্লিষ্ট, স্টিবেনসন, পল গোল্ডস্মিথ বার্নেল, লেনোর্মট প্রমুখের মতে ফিনিশীয় লিপি থেকে ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব ঘটেছিল।
  • (৩) জোন্স, কাপ্প, লেপ্সিয়স, ওয়েবার, আইজাক টেলর, ওয়েবার প্রমুখের মতে সেমেটিক লিপি থেকে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব ঘটেছিল।
  • (৪) বার্নেল ও অন্যান্যদের মতে আরামাইক লিপি থেকে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব ঘটেছিল।

ভারতে ব্রাহ্মী লিপির উৎস

ব্রাহ্মী লিপি মূলত ভারতবর্ষেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই লিপির ক্রমবিকাশের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সহজ নয়।

ভারতে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব কাল

মনে করা হয় যে, ষআনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে এই লিপির উদ্ভব হয়েছিল। কালক্রমে এই লিপি ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির নিদর্শন

বহু বছর আগে থেকেই ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা অজস্র নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে এদেশের প্রাচীন মুদ্রায়, ধাতু নির্মিত পাত্রে, পাহাড়ে, পাথরের ফলকে এবং স্তম্ভের গায়ে। 

ব্রাহ্মী লিপির প্রকৃষ্ট নিদর্শন

অশোক স্তম্ভ -এর লেখমালাগুলিতে ব্রাহ্মী লিপির প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উদাহরণটি হল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লিখিত একটি স্তম্ভলিপি।

ব্রাহ্মী লিপিতে লিখিত নমুনা

এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত যে সকল নমুনা পাওয়া গেছে সেগুলি হল –

  • (১) ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে নেপালের তরাই অঞ্চলের পিপ্রাবা থেকে। ধারণা করা হয়, এই লিপিটি গৌতম বুদ্ধ -এর নির্বাণকালের (৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কিছু পরে।
  • (২) সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে গুজরাটের জুনাগড় জেলার গিরনার পর্বতের গায়ে।                                            
  • (৩) খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে আবিষ্কৃত রামগঢ়, ঘোসুণ্ডী, বেসনগর, নাগার্জুনীগুম্ফা, নানাঘাট, ভরহুত, সাঁচী হাথিগুম্ফা লিপি ও ভট্টীপ্রোলুস্তূপের শিলালিপি।
  • (৪) খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে পভোসা ও মথুরায় প্রাপ্ত লিপি।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে বর্ণমালার উৎপত্তি

মনে করা হয় যে, বর্তমান ভারতবর্ষ এবং তৎসংলগ্ন এলাকার প্রচলিত বহু বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে আদি ব্রাহ্মীলিপি থেকে।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে অন্যান্য লিপির উদ্ভব

উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য -এ ‘গুপ্ত লিপি’ র উদ্ভব হয়েছিল। এটি মধ্যযুগে আরও নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সিদ্ধং, শারদা ও নাগরী লিপি।

বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে ব্রাহ্মী লিপির ভূমিকা

‘সিদ্ধং’ লিপি বৌদ্ধধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, প্রচুর বৌদ্ধ ‘সূত্র’ এর মাধ্যমেই লিখিত হয়। সিদ্ধং হস্তলিপি বর্তমানে  নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রেখেছে জাপানে।

দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মী লিপি

দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মীর লিপির মধ্যে প্রাচীন কন্নড়, পল্লব ও ভাট্টেলুত্তু লিপিই অধিক প্রসিদ্ধ।

উপসংহার :- ভারতের প্রাচীনতম লিপিমালার দুটি রূপ হল ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী। ব্রাহ্মী লিপি সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে ব্যবহারের ফলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ব্রাহ্মী লিপি” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ব্রাহ্মী লিপি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ব্রাহ্মী লিপির সময়কাল কত?

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ‌ শতক থেকে আনুমানিক পঞ্চম শতক।

২. কোন লিপি থেকে বাংলা লিপির উদ্ভব হয়?

ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের মাধ্যমে।

৩. ভারতীয় লিপিমালার প্রাচীনতম রূপ কয়টি ও কি কি?

দুটি, ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী।

৪. কোন লিপিকে ভারতের মৌলিক লিপি বলা হয়?

ব্রাহ্মী লিপি।

Leave a Comment