ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি -র প্রতিষ্ঠা, রাজকীয় সনদ অর্জন, সমসাময়িক মোগল সম্রাট, একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার, প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন, বাংলায় আগমন, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারে অনুমতি, নবাবের কলকাতা দখল, ইংরেজদের কলকাতা পুনর্দখল, আলিনগরের সন্ধি, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পলাশীর যুদ্ধ, নবাব মীরজাফর, বক্সারের যুদ্ধ, দেওয়ানি লাভ, দ্বৈত শাসন, লুণ্ঠন, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বোম্বাইয়ে কোম্পানির শাসন, মাদ্রাজে কোম্পানির শাসন, পাঞ্জাব দখল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, কোম্পানির সুবিধা, কোম্পানির শাসনের বিলুপ্তি ও ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তন সম্পর্কে জানবো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

বিষয়ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
প্রতিষ্ঠা৩১ ডিসেম্বর, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ
দেশইংল্যান্ড
সদর দপ্তরলণ্ডন
উদ্দেশ্যআন্তর্জাতিক বাণিজ্য
অবলুপ্ত১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ভূমিকা:- ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত একটি জয়েন্ট‌-স্টক কোম্পানি হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের সরকারি নাম “ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজকীয় সনদ অর্জন

১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ততকালীন রাণী প্রথম এলিজাবেথ কর্তৃক এই কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ অর্জন করেছিল। এই সনদ কোম্পানিটিকে ২১ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারত-এ একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার অর্পণ করেছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের সময় মোগল সম্রাট

রাণী এলিজাবেথ যখন লন্ডনের বণিকদের দেওয়া অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করেন, তখন ভারতের শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল

পরবর্তীকালে এই কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। এরপর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।

বাণিজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার

১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাণী প্রথম এলিজাবেথের সনদ বলে এই কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন

তারা ১৬০৮সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর -এর শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। পরে অন্যান্য স্থানসহ হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় আগমন

সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফরমান লাভ

১৬৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট শাহজাহান -এর থেকে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি সম্বলিত একটি ফরমান লাভ করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারে অনুমতি

১৭১৫ সালে মোগল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। মোগল সাম্রাজ্যেও ঐ মুদ্রা চালু হয়।

নবাবের কলকাতা দখল

১৭৫৬ সালের ২০ জুন নবাব সিরাজউদৌলা ইংরেজদের কাছ থেকে কলকাতা দখল করে আলিবর্দি খাঁ -র নামে কলকাতার নাম রাখেন আলিনগর।

ইংরেজদের কলকাতা দখল

২ জানুয়ারি, ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজ যোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতা পুনরায় দখল করেন। 

আলিনগরের সন্ধি

কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে পরাজিত হয়ে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

নবাবের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ষড়যন্ত্র

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চন্দননগর দখল করার পর সিরাজউদৌলাকে উৎখাত করার জন্য তার পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন।

পলাশীর যুদ্ধ

নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পর নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদৌলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেকি যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। সিরাজউদৌলা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন।

নবাব মীরজাফর

মীরজাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হত। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ক্লাইভ দেশে ফিরে যান।

বক্সারের যুদ্ধ

১৭৬৪ সালে বাংলার ক্ষমতাচ্যুত নবাব মিরকাশিম -এর বিরুদ্ধে বিহারে বক্সারের যুদ্ধ -এ জয়লাভ করার পর কোম্পানির ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ

রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে আবার ফিরে আসেন এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন।

দ্বৈত শাসন

দেওয়ানি লাভের পর বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে কোম্পানি, নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন

নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এর ফলে বাংলার নবাব ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬) অনাবৃষ্টি হয়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এই দুর্ভিক্ষ ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।

বোম্বাইয়ে কোম্পানির শাসন

বোম্বাই কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও কোম্পানি রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করে। প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধতৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ -এর মাধ্যমে কোম্পানি মারাঠা সাম্রাজ্য দখল করেন।

মাদ্রাজে কোম্পানির শাসন

কোম্পানি হায়দার আলি -র বিরুদ্ধে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ এবং টিপু সুলতান -এর বিরুদ্ধে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধচতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ -এ জয়লাভ করে মাদ্রাজ দখল করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাঞ্জাব দখল

১৮৪৫-৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ এবং ১৮৪৮-১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ -এর পর পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর অধিগৃহীত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত -এর মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলছিল মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও রীতিপদ্ধতিতেই।

কোম্পানির সুবিধা

কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন করা হয়।

ইংরেজ অধিকারে বাংলা

বাংলা নামের এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ব হয় ১৮১৩ সালে। এই বছর ব্রিটিশ সরকার এক চার্টার অ্যাক্ট বলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং দেশের শাসনভার কোম্পানির উপর ন্যস্ত করে।

কোম্পানির শাসনের বিলুপ্তি

১৮৫৮ সালে কোম্পানির শাসন বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।

ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তন

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ -এর পর ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব স্বহস্তে তুলে নেয় এবং দেশে নতুন ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তিত হয়।

উপসংহার:- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু অবস্থা বুঝে তারা ব্রিটিশ রাজের আনুকূল্যে শাসনকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এই জন্য কবি লিখেছেন,

“বণিকের মানদণ্ড, পোহালে শর্বরী, দেখা দিলরাজদণ্ড রূপে”।

(FAQ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

৩১ ডিসেম্বর ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ।

২. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কার কাছ থেকে রাজকীয় সনদ লাভ করে?

ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ।

৩. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের কোথায় প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে?

সুরাটে।

৪. ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে কখন?

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment