হায়দার আলি ছিলেন মহীশূর রাজ্যের শাসক তাঁর জন্ম, বাল্যকাল, বুদ্ধিবল, অশ্বারোহী সৈনিক, প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি, মহীশূর রাজ্যে অসন্তোষ, হায়দার আলির ক্ষমতা দখল, রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি, রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি, ইংরেজদের সাথে হায়দারের বিরোধের কারণ, হায়দার বিরোধী মৈত্রী চুক্তি, হায়দার আলির কূটকৌশল, প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, মাদ্রাজের সন্ধি, ইংরেজদের কাছে সাহায্য লাভে ব্যর্থ, ইংরেজদের মাহে দখল, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, হায়দার আলির আর্কট দখল, হায়দার আলির পরাজয়, মৃত্যু ও তার কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।
মহীশূর রাজ্যের শাসক হায়দার আলি
ঐতিহাসিক চরিত্র | হায়দার আলি |
জন্ম | ১৭২১ খ্রিস্টাব্দ (মতান্তরে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দ) |
পিতা | ফতে মহম্মদ |
পরিচিতি | মহীশূর রাজ্যের শাসক |
রাজত্বকাল | ১৭৬১-১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ |
মৃত্যু | ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ |
উত্তরসূরি | টিপু সুলতান |
ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হায়দার আলির নেতৃত্বে মহীশূর রাজ্যের উত্থান সমকালীন ভারত ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
হায়দার আলি সম্পর্কে কালীকিঙ্কর দত্তের অভিমত
ডঃ কালীকিঙ্কর দত্ত -র মতে, “অষ্টাদশ শতকে ভারতের ইতিহাস হল ভাগ্যান্বেষী, দুঃসাহসিক ব্যক্তিদের ক্ষমতালাভের কাহিনী।” মহীশূরের হায়দার আলি ছিলেন এই সব দুঃসাহসিক ভাগ্যান্বেষীদের অন্যতম।
হায়দার আলির জন্ম
১৭২১ (মতান্তরে ১৭২২) খ্রিস্টাব্দে বুদিকোটে এক অতি সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ফতে মহম্মদ নানা স্থানে ভাড়াটিয়া সৈনিকের কাজ করে বেড়াতেন।
হায়দার আলির বাল্যকাল
তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল অতি দারিদ্রের মধ্যে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ভাগ্যান্বেষণে বের হন। শিক্ষালাভের কোনও সুযোগ তাঁর মেলে নি।
হায়দার আলির বুদ্ধিবল
নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বুদ্ধিবলে তিনি মহীশূর রাজ্যের অধিপতিতে পরিণত হন।
হায়দার আলি সম্পর্কে নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের অভিমত
ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেন যে “অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতো হায়দারের উত্থান ছিল তাঁর ব্যক্তি গত উদ্যম, সাহসিকতা, পরিশ্রম ও ভাগ্যের ফল।”
অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে হায়দার আলির দায়িত্ব
নিরক্ষর হায়দার আলি ২৭ বছর বয়সে মহীশূরের প্রধান সেনাপতি নঞ্জরাজের অধীনে একজন সামান্য অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
হায়দার আলির প্রভাব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি
নিজ কর্মদক্ষতার গুণে অচিরেই তিনি তাঁর প্রভুর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন এবং তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মহীশূরের রাজার বন্দীত্ব
১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিন্দিগুলের ফৌজদার নিযুক্ত হন। এই সময় মহীশূরের হিন্দু রাজা চিক্কা কৃষ্ণরাজ ওড়িয়ার এবং রাজপরিবার কার্যত নঞ্জরাজের হাতে বন্দি ছিল।
মহীশূর রাজ্যে অসন্তোষ
প্রধান সেনাপতি নঞ্জরাজ ও তাঁর ভ্রাতা দেবরাজই রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। তাঁদের অযোগ্য শাসনে মহীশূরের সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ দেখা দেয়।
হায়দার আলির ক্ষমতা দখল
এই বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে হায়দার আলি তাঁর প্রভু নঙ্গরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন (১৭৬১ খ্রিঃ)।
হায়দার আলির নিজ কর্মদক্ষতা ও প্রতিভা
এইভাবে এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কেবল নিজ কর্মদক্ষতা ও প্রতিভা বলে তিনি মহীশূর রাজ্যের শাসন ক্ষমতা দখল করেন।
হায়দার আলির নেতৃত্বে রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি
১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেদনুর, গুটি, সুন্দা,সেরা প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে তিনি মহীশূর রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন।
হায়দার আলির নেতৃত্বে শক্তিশালী মহীশূর রাজ্য
তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত -এর প্রবর্তন, জমি জরিপ ও শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে মহীশূর একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়।
ইংরেজদের সঙ্গে হায়দার আলির সম্পর্ক
রাজত্বের সূচনা-পর্বে হায়দার আলির সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের কোনও কারণ ঘটে নি—বরং হায়দার আলি ইংরেজদের পছন্দই করতেন।
ইংরেজদের সঙ্গে হায়দার আলির বিবাদের কারণ
পরবর্তীতে নানা কারণে হায়দার আলির সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। যেমন –
- (১) প্রশাসন ও সেনাবিভাগে নানা সংস্কার প্রবর্তন করে হায়দার আলি মহীশূরকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন যা ইংরেজদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
- (২) ফরাসিদের সঙ্গে হায়দার আলির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং তাঁর রাজসভায় ফরাসিদের আনা-গোনা ইংরেজদের মনঃপূত হয় নি।
- (৩) কর্ণাটকের তৃতীয় যুদ্ধ -এর (১৭৫৬ খ্রিঃ) সময় হায়দার আলি ফরাসি সেনাপতি কাউন্ট লালিকে ৪ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে সাহয্যে করলে ইংরেজরা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।
- (৪) হায়দারের অন্যতম প্রধান শত্রু ছিল ইংরেজ সমর্থন-পুষ্ট আর্কটের নবাব মহম্মদ আলি। তাঁকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের সঙ্গে হায়দারের বিরোধ বাধে।
- (৫) হায়দার মহম্মদ আলি-র জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং আর্কটের সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার মাহফুজ খাঁ-কে নিজ দরবারে আশ্রয় দেন।
- (৬) মহম্মদ আলির আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী চাঁদাসাহেবের পুত্র রাজাসাহেবকেও তিনি নিজ অধীনে চাকরি দেন। এতে ইংরেজরা ক্ষুব্ধ হয়।
- (৭) আবার মহম্মদ আলির সঙ্গে হায়দারের বিবাদের কালে হায়দারের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ইংরেজরা মহম্মদ আলির সমর্থনে ভেলোরে একদল সৈন্য মোতায়েন করে। এতে হায়দার ক্ষুব্ধ হন।
- (৮) হায়দার যখন নিজ রাজ্যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন, তখন ইংরেজরা তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।
- (৯) মহীশূরের ক্ষমতাচ্যুত ও নজরবন্দি রাজার সঙ্গে ইংরেজরা হায়দার-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে হায়দার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
ইংরেজদের সঙ্গে হায়দার আলির সম্পর্কের অবনতি
এই সব বিভিন্ন কারণে হায়দার আলি ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর এর পরিণাম হল চারটি ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ এবং চূড়ান্ত যুদ্ধে মহীশূরের পরাজয় ও পতন।
হায়দার আলির বিরোধী মৈত্রী চুক্তি
দাক্ষিণাত্যে হায়দার আলির উত্থানে আশঙ্কিত হয়ে মারাঠা,নিজাম ও ইংরেজরা ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে হায়দার বিরোধী মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে।
হায়দার আলির কূটকৌশল
সুচতুর হায়দার শীঘ্রই কুটকৌশল ও অর্থের বিনিময়ে মারাঠা ও নিজামকে ইংরেজ পক্ষ থেকে সরিয়ে আনেন।
হায়দার আলি ও ইংরেজদের মধ্যে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলি ইংরেজদের আশ্রিত কর্ণাটকের নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়।
মাদ্রাজের সন্ধি স্বাক্ষর
হায়দারের সেনাদল অতর্কিতে ইংরেজ ঘাঁটি মাদ্রাজের উপকণ্ঠে হাজির হলে (১৭৬৯ খ্রি.) ইংরেজরা হায়দার আলির সঙ্গে মাদ্রাজের সন্ধি (১৭৬৯ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
মাদ্রাজের সন্ধির শর্ত
এই দ্বারা স্থির হয় যে,
- (১) একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফিরিয়ে দেবে।
- (২) এক পক্ষ অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে অন্য পক্ষ তাকে সাহায্য করবে।
ইংরেজদের কাছে সাহায্যলাভে ব্যর্থ হায়দার আলি
মারাঠারা ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলির রাজ্য আক্রমণ করে। হায়দার মাদ্রাজ সন্ধির শর্তানুযায়ী ইংরেজদের সহায়তা চেয়েও ব্যর্থ হন।
ইংরেজদের মাহে দখল
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্র ধরে ভারতে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ শুরু হলে ইংরেজরা হায়দারের রাজ্যভুক্ত ফরাসি উপনিবেশ মাহে দখল করে নেয়।
হায়দার আলি ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
ইংরেজদের মাহে দখলের প্রতিবাদে হায়দার আলি নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে ত্রিশক্তি জোট গঠন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ফলে শুরু দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৮০-৮৪ খ্রিস্টাব্দ)
হায়দার আলির আর্কট দখল
হায়দার কর্ণাটকের ওপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী আর্কট দখল করে নেন।
হায়দার আলি ও ইংরেজদের মধ্যে সলবাইয়ের সন্ধি
এই পরিস্থিতিতে ইংরেজরা মারাঠাদের সঙ্গে সলবাইয়ের সন্ধি (১৭৮২ খ্রি.) স্বাক্ষর করে বিবাদ মিটিয়ে নেয় এবং নিজামকেও দলে টেনে নেয়।
হায়দার আলির পরাজয়
অবশেষে হায়দার আলি ইংরেজ সেনাপতি স্যার আয়ার কূটের কাছে ত্রিনোমালি ও পোর্টোনোভো-র যুদ্ধে পরাজিত হন।
হায়দার আলির মৃত্যু
কিছুদিনের মধ্যেই কর্কট রোগে হায়দারের মৃত্যু (১৭৮২ খ্রি.) হলে তাঁর পুত্র টিপু সুলতান যুদ্ধ চালিয়ে যান।
হায়দার আলির কৃতিত্ব
- (১) অষ্টাদশ শতকের ভারত ইতিহাসে হায়দার আলি এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।
- (২) একজন অতি সাধারণ সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করে কেবলমাত্র নিজ প্রতিভা, দক্ষতা,বুদ্ধিমত্তা ও অসমসাহসিকতার বলে তিনি মহীশূর রাজ্যের প্রধান শাসকে পরিণত হন এবং অষ্টাদশ শতকের ভারত ইতিহাসে স্থায়ী কীর্তির স্বাক্ষর রেখে যান।
- (৩) মারাঠা, নিজাম ও হায়দার আলির কৃতিত্ব ইংরেজ—তিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালিয়ে যাওয়া কম কথা নয়।
- (৪) ব্যক্তিগত জীবনে নিরক্ষর হলেও তিনি নানা গুণের অধিকারী ছিলেন এবং শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন সফল।
- (৫) মহীশূর রাজ্যের কৃষিকাজ -এর উন্নতি, পতিত জমি পুনরুদ্ধার, বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি, সামরিক ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- (৬) ঐতিহাসিক উইলস্ (Wilkes) তাঁর ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন। তাঁর অধিকাংশ মন্ত্রীই ছিলেন ব্রাহ্মণ ।
উপসংহার :- ঐতিহাসিক স্মিথ তাঁর সম্পর্কে নানা কটূক্তি করলেও হায়দার আলি যে ভারত ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল স্থানের অধিকারী ছিলেন, সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।
(FAQ) হায়দার আলি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সেনাপতি নঞ্জরাজ।
১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে।
টিপু সুলতান।
দ্বিতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের সময় ১৭৮২ সালে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে।