তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ -এর সময়কাল, বিবাদমান পক্ষ, যুদ্ধের কারণ হিসেবে ফরাসিদের সাথে টিপুর যোগাযোগ, ইংরেজদের গুন্টুর লাভ, নিজামকে সামরিক সাহায্য প্রদান, নিজাম ও ইংরেজদের চুক্তি, ইংরেজদের মিত্র রাজ্যের তালিকায় মহীশূর রাজ্যের নাম অনুপস্থিত, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা, টিপুর পরাজয়, শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি, শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধির শর্ত, টিপুর পতন সুনিশ্চিত, কর্ণওয়ালিসের সমালোচনা, কর্ণওয়ালিসের সমর্থনে বক্তব্য ও তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

বিখ্যাত তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ প্রসঙ্গে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময়কাল, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের কারণ, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতানের পরাজয়, শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি দ্বারা তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের ফলাফল।

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০-৯২ খ্রিঃ)

সময়কাল১৭৯০-৯২ খ্রিস্টাব্দ
বিবাদমান পক্ষইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মহীশূর রাজ্যের টিপু সুলতান
ফলাফলটিপু সুলতানের ব্যর্থতা
শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ

ভূমিকা :- দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ -এর পর স্বাক্ষরিত ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি ছিল একটি শূন্যগর্ভ চুক্তি। এর দ্বারা দু’পক্ষের বিবাদের কোনও অবসান হয় নি। এই সন্ধি একটি সাময়িক যুদ্ধ-বিরতি ছিল মাত্র।

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের কারণ

উভয় পক্ষই জানত যে, অচিরেই আবার যুদ্ধ শুরু হবে। তাই দুই পক্ষই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।

(১) টিপুর ফরাসিদের সাথে যোগাযোগ

যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে টিপু সুলতান ইংরেজদের শত্রু ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন এবং কনস্টান্টিনোপল, কাবুল, মরিশাস প্রভৃতি স্থানে দূত পাঠান।

(২) ইংরেজদের গুন্টুর লাভ

ইংরেজ-পক্ষও নিশ্চেষ্ট ছিল না। মাঙ্গালোরের সন্ধির পরেই তারা টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট কর্নওয়ালিস নিজামের কাছ থেকে গুন্টুর নামক স্থানটি পান।

(৩) নিজামকে সামরিক সাহায্য প্রদান

গুন্টুর লাভের বিনিময়ে টিপুর দ্বারা অধিকৃত নিজামের কিছু রাজ্য নিজাম-কর্তৃক পুনরাধিকারের জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নিজামকে সামরিক সাহায্য দেবেন—যদিও ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি দ্বারা ঐ স্থানগুলির ওপর টিপুর অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল।

(৪) নিজাম ও ইংরেজদের চুক্তি

বড়লাট কর্ণওয়ালিস নিজামের সঙ্গে এক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং বলা হয় যে, ইংরেজদের প্রেরিত সেনাদল কোনও ইংরেজ মিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না।

(৫) ইংরেজদের মিত্র রাজ্যের তালিকায় মহীশূর অনুপস্থিত

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে কর্ণওয়ালিস নিজামের কাছে ইংরেজদের মিত্র রাজ্যগুলির এক তালিকা দেন—তাতে মহীশূরের নাম ছিল না।

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা

স্বভাবতই টিপু সুলতান রুষ্ট হন এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন।ফলে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়।

টিপুর পরাজয়

নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যোগদান করে। দু’বছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ত্রি-শক্তি জোটের আক্রমণে টিপু কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি

ইংরেজ ও তাদের মিত্রপক্ষ রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অবরোধ করলে টিপু সুলতান শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি (১৭৯২ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধির শর্ত

এই সন্ধির শর্ত অনুসারে,

  • (১) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা এবং ইংরেজ, নিজাম ও মারাঠাদের নিজ রাজ্যের অর্ধাংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
  • (২) কৃষ্ণা থেকে পেনার নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা পায় নিজাম।
  • (৩) তুঙ্গভদ্রা নদীর সন্নিহিত অঞ্চল পায় মারাঠারা।
  • (৪) কুর্গ, মালাবার, মাদুরাই ও সালেম, দিন্দিগুল, বরামহল প্রভৃতি অঞ্চলকোম্পানির অধীনে থাকে।
  • (৫) ক্ষতিপূরণের টাকারজামিন হিসেবে টিপু তাঁর দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন।

টিপুর পতন সুনিশ্চিত

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ও শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধির ফলে ‘মহীশুর শার্দুল’ টিপুর শক্তি প্রবলভাবে খর্ব হয় এবং তাঁর পতন সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে।

কর্ণওয়ালিসের সমালোচনা

  • (১) কোনও কোনও ঐতিহাসিক এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য কর্ণওয়ালিসের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, এই যুদ্ধের পর সমগ্র মহীশূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত না করে কর্ণওয়ালিস প্রচণ্ড ভুল করেন এবং এই কারণে লর্ড ওয়েলেসলিকে মহীশূরের বিরুদ্ধে আরেকটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।
  • (২) বোর্ডঅব কন্ট্রোলের সভাপতি ডাণ্ডাস, সেনাপতি মনরো, থর্নটন কেউই এই সন্ধি মানতে পারেন নি। তাঁদের মতে অনেক সহজ শর্তে টিপুর সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

কর্ণওয়ালিসের সমর্থনে বক্তব্য

বলা বাহুলা, এই সব সমালোচনা বহুলাংশে অমূলক। কর্ণওয়ালিসের সমর্থনে বলার মতো অনেক কিছু আছে। যেমন –

  • (১) তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের দুশবছর পর কর্ণওয়ালিসের সমালোচনা করা যতটা সহজ, দুশবছর আগে তা বাস্তবায়িত করা ততটা সহজ ছিল না। কর্ণওয়ালিস শ্রীরঙ্গম অবরোধ করেছিলেন—দখল করতে পারেন নি।
  • (২) টিপু যদি আর কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, তাহলে ইংরেজ-পক্ষ অসুবিধায় পড়ত। তখন গ্রীষ্মকাল আসন্ন প্রায় এবং এই কারণে বহু ইংরেজ সেনা তখন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। মনে হয় এই বাস্তব কারণে কর্ণওয়ালিস এই চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য হন।
  • (৩) এই সময় কোম্পানি সমগ্র মহীশূর দখল করলে কোম্পানির মিত্র মারাঠা ও নিজাম ঈর্ষান্বিত হয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধাচারণ করতে পারত। তাতে হিতে বিপরীত হত।
  • (৪) কর্ণওয়ালিস অনুধাবন করেছিলেন যে, মহীশূর দখল করার পর সেখানে সুষ্ঠু প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং মহীশূর রক্ষা করার মতো সেনাবল কোম্পানির নেই।
  • (৫) সেই সময় ইউরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সে রকম হলে ভারত -এ টিপু সুলতান ফরাসি সাহায্য পেতেন, যা কোম্পানির পক্ষে ক্ষতিকর হত।
  • (৬) ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের পিটের ভারত শাসন আইন -এ (Pitt’s India Act) কোম্পানিকে রাজ্য বিস্তার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের ফলাফল

এই যুদ্ধ টিপু সুলতানকে খুবই দুর্বল করে দেয়। যেমন –

  • (১) তাঁর রাজ্য চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে। উত্তর-পূর্বে নিজাম, উত্তর-পশ্চিমে মারাঠা এবং অন্যান্য দিকে ইংরেজরা থাকায় তাঁর পক্ষে নানা অসুবিধা দেখা দেয়।
  • (২) দিন্দিগুল ও দোয়াব ছিল মহীশূরের শস্যাগার। এই অঞ্চল দু’টি এবং প্রভুত অর্থ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ফলে মহীশূরের অর্থনীতি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।

উপসংহার :- টিপু সুলতানের পক্ষে শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ছিল অপমানজনক। তিনি রাজ্যের আভ্যন্তরীণ সংস্কার ও সেনাবাহিনী সুসংহত করে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময়কাল কত?

১৭৯০-৯২ খ্রিস্টাব্দ।

২. কোন সন্ধির মাধ্যমে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটে?

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ।

৩. তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময়কাল গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

লর্ড কর্ণওয়ালিস।

৪. শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি কবে, কাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়?

১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও টিপু সুলতানের মধ্যে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলি

Leave a Comment