চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধ বা ইয়ম কিপুর যুদ্ধ প্রসঙ্গে যুদ্ধের পটভূমি হিসেবে উভয় পক্ষের শক্তিবৃদ্ধি, আরবদের প্রতিশোধ মূলক মনোভাব ইজরায়েলি আগ্রাসন, দুই রাষ্ট্রপ্রধানের দ্বিচারিতা, প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ, আরব জঙ্গিবাদ, যুদ্ধের সূচনা, ইয়ম কিপুর যুদ্ধ বিরোধী শান্তি চুক্তি ও যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ, চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধের পটভূমি বা কারণ, চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধের সূচনা, চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধ
ঐতিহাসিক যুদ্ধ | চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ |
অন্য নাম | ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ |
সময়কাল | ১৯৭৩ খ্রি |
বিবাদমান পক্ষ | ইজরায়েল ও আরব রাষ্ট্র |
জেনেভা সম্মেলন | ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩ খ্রি |
আরব-ইজরায়েল শান্তিচুক্তি | ১৯৭৭ খ্রি |
ভূমিকা :- ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের পর ইজরায়েল তার দখল করা আরব ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেয় নি। ফলে এই সময় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দ্বারা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও তা ছিল একান্তই ক্ষণস্থায়ী। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধে তার প্রমাণ মেলে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
বিভিন্ন কারণে চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। যেমন –
(১) উভয় পক্ষের শক্তিবৃদ্ধি
আপাত শান্তির আড়ালে আমেরিকার কাছ থেকে ইজরায়েল এবং রাশিয়ার কাছ থেকে আরব দেশগুলি সামরিক সাহায্য নিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছিল এবং উভয় পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। পাশাপাশি উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলেছিল।
(২) আরবদের প্রতিশোধমূলক মনোভাব
আরবরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হতে উদ্গ্রীব ছিল। তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময়কার ইজরায়েল অধিকৃত অঞ্চলগুলি উদ্ধারের জন্য আরব রাষ্ট্রগুলি সচেষ্ট হয়ে উঠলে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়
(৩) ইজরায়েলি আগ্রাসন
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর ইজরায়েলের বোমারু বিমান মিশর-এর রাজধানী কায়রোর কাছে বোমাবর্ষণ করে এবং নীলনদের ওপর একটি সেতু ধ্বংস করে। পাশাপাশি ডিসেম্বর মাসে জর্ডন ও ইরাকের ওপর আক্রমণ চালায়। ইজরায়েল কিছুদিন পরে লেবাননের রাজধানী বেইরুটের বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করে ১৩টি বিমান ধ্বংস করে। জাতিপুঞ্জ ইজরায়েলের এই আগ্রাসী নীতির তীব্র নিন্দা করে।
(৪) দুই রাষ্ট্রপ্রধানের দ্বিচারিতা
মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের মৃত্যুর পর নতুন রাষ্ট্রপতি হন মহম্মদ আনোয়ার সাদাত। তিনি একদিকে ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মিশরীয় সেনাবাহিনীকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন। অপরদিকে অধিকৃত আরব ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার জন্য আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইজরায়েলের সঙ্গে এক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার উদ্যোগ নেন। আবার ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ার প্রথমে শান্তির কথা বলেও পরে শান্তির উদ্যোগ থেকে সরে আসেন।
(৫) প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ
প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ দিনের পর দিন তীব্র রূপ নিতে থাকে। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন নামক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি খুনজখম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কাজ শুরু করে। এ ছাড়াও ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামক উগ্রপন্থী সংস্থাটি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ অলিম্পিকে যোগদানকারী ১১ জন ইজরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যা করে।
(৬) আরব জঙ্গিবাদ
ইতিমধ্যে আরব জাতীয়তাবাদীদের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী বিদেশি ইহুদিদের হাত থেকে মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে তীব্র লড়াই শুধু করে। এই জঙ্গিদের হাতে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ইজরায়েলি কুস্তিগিররা নিহত হয়। এভাবে পরিস্থিতি প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ
ইজরায়েলের বিভিন্ন আগ্রাসনমূলক আচরণে আরব দুনিয়া ক্ষোভে বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। –
(১) ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইজরায়েল অধিকৃত অঞ্চলের ওপর বোমাবর্ষণ করে। ইহুদিদের বার্ষিক ইয়ম কিপুর উৎসবের দিনে আরবরা ইজরায়েলের কাছ থেকে তাদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ শুরু করেছিল বলে এই যুদ্ধ ‘ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
(২) ইজরায়েলের প্রাথমিক বিপর্যয়
মিশরের বিমান ও স্থলবাহিনীর আক্রমণে ইজরায়েল ক্রমে পিছু হটতে থাকে। মিশরীয় সেনা সুয়েজ খাল অতিক্রম করে সিনাই পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সিরিয়া চারদিক থেকে ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ইজরায়েলের দিকে এগোতে থাকে। সৌদি আরব, জর্ডন, ইরাক, টিউনিশিয়া প্রভৃতি দেশ মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে হাত মেলায়। রাশিয়াও আরব রাষ্ট্রগুলির পাশে দাঁড়ায়। এভাবে যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইজরায়েলি বাহিনী প্রচন্ড বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
(৩) ইজরায়েলের প্রতি-আক্রমণ
আমেরিকা ইজরায়েলকে সহায়তা করলে যুদ্ধ শুরুর ৯ দিন পর ইজরায়েল প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। তারা দু-দিনের মধ্যেই আরব বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তারা সিরিয়ার সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে গোলান হাইটস্ দখল করে এবং সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিশরীয় বাহিনীর একটি অংশকে চারদিক থেকে অবরোধ করে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। ২২ অক্টোবর জাতিপুঞ্জ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উভয়পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
জেনেভা সম্মেলন
শেষপর্যন্ত ২০ ডিসেম্বর জেনেভায় একটি সম্মেলনে মিশর, জর্ডন, ইজরায়েল, আমেরিকা, রাশিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়।
জেনেভা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত
এই সম্মেলনে উপস্থিত দেশের প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে,
- (১) দু-পক্ষের দ্বারা স্বীকৃত সীমানায় আরব ও ইজরায়েলের সৈন্য অপসারিত হবে।
- (২) বেসামরিকীকরণ করা স্থানগুলির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।
- (৩) প্যালেস্টিনীয়দের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
- (৪) খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলিমদের পবিত্রস্থান রক্ষা করা হবে।
- (৫) মিশরীয় ও ইজরায়েলি সেনাবাহিনী সুয়েজের পূর্বতীর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অপসারিত করা হবে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের ফলাফল
এই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল নিম্নরূপ –
- (১) প্যালেস্টাইনের অধিকৃত অঞ্চলগুলি ইজরায়েল নিজের দখলে রাখে।
- (২) জাতিপুঞ্জের প্রচেষ্টায় ইজরায়েল সুয়েজ খাল সংলগ্ন অঞ্চল হতে নিজের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিলে মিশর সুয়েজ খালের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ফিরে পায়। সুয়েজ খাল ধরে জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা হয়।
- (৩) মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের উদ্যোগে মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার এল সাদাত ও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়াজক রাবিন এর মধ্যে আরব-ইজরায়েল শান্তি চুক্তি (১৯৭৭ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।
উপসংহার :- এভাবে মার্কিন উদ্যোগ ও জেনেভা সম্মেলনের দ্বারা আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের বিরোধের মীমাংসার চেষ্টা করা হয়।
(FAQ) চতুর্থ আরব ইজরায়েল যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ।
মিশর ও সিরিয়া।
২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা সম্মেলন।
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে।