প্রথম আফিম যুদ্ধ

চীনে প্রথম আফিম যুদ্ধ প্রসঙ্গে আফিম যুদ্ধ নামকরণের কারণ, ভিনাকের মন্তব্য, ফেয়ারব্যাঙ্কের মন্তব্য, প্রথম আফিম যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ, প্রথম আফিম যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব, প্রথম আফিম যুদ্ধে চিনের পরাজয়, প্রথম আফিম যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত নানকিং সন্ধি ও তার শর্ত, প্রথম আফিম যুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত বোগের সন্ধি, প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তীতে আমেরিকার আগ্ৰাসী নীতি, প্রথম আফিম যুদ্ধের পরে ফ্রান্সের সুবিধা আদায় ও প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

প্রথম আফিম যুদ্ধ বা অ্যাংলো-চীনা যুদ্ধ প্রসঙ্গে প্রথম আফিম যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ, প্রথম আফিম যুদ্ধের সময়কাল, প্রথম আফিম যুদ্ধের নামকরণ, প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয়, প্রথম আফিম যুদ্ধ শেষে নানকিং সন্ধি স্বাক্ষর ও প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানব।

চীনে প্রথম আফিম যুদ্ধ

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রথম আফিম যুদ্ধ
অন্য নামপ্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ
বিবাদমান পক্ষইংল্যান্ডচীন
সময়কাল১৮৩৯-৪২ খ্রি
নানকিং সন্ধি১৮৪২ খ্রি
চীনে প্রথম আফিম যুদ্ধ

ভূমিকা :- ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে অ্যাডমিরাল এলিয়টের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রচুর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চীন আক্রমণ করেন। চীনারা এই আক্রমণ প্রতিহত করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে বদ্ধপরিকর হন। প্রথম ইঙ্গ- চীন যুদ্ধের সূচনা ঘটে।

আফিম যুদ্ধ নামকরণের কারণ

ইম্যানুয়েল সু বলেছেন, “এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চীনারা বেআইনি আফিম ব্যবসার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন” (For the Chinese, the war was primarily a crusade against opium.)। তাই ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধকে প্রথম আফিম যুদ্ধ (First Opium War) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রথম আফিম যুদ্ধ সম্পর্কে ভিনাকের মন্তব্য

ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক বলেছেন, আফিম কখনোই এই যুদ্ধের কারণ ছিল না, উপলক্ষ্য ছিল মাত্র (Opium, however, was the occasion, and not the cause of the war between the British and the Chinese.)। যুদ্ধের মূল কারণ নিহিত ছিল ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির মধ্যে এবং বিদেশিদের কাছে অপমানজনক ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার শর্তাবলীর মধ্যে।

প্রথম আফিম যুদ্ধ সম্পর্কে ফেয়ারব্যাঙ্কের মন্তব্য

ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক বলেছেন, আফিম ব্যবসার বিরুদ্ধে চীনের জেহাদ এবং নজরানা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সক্রিয় বিরোধিতা এই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল (The Chinese struggle against the opium trade went forward in the context of the equally determined British struggle against the tribute system.)।

প্রথম আফিম যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ

গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন থেকে প্রকাশিত “History of Modern China Series”-এর চীনা ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে চীনা জনগণের প্রথম পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

প্রথম আফিম যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব

চীনারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সঙ্গে বীরবিক্রমে লড়াই করেছিলেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন এলিয়ট, তারপর যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন কর্নেল স্যার হেনরি পটিংগার।

প্রথম আফিম যুদ্ধে চিনের পরাজয়

বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করা সত্ত্বেও, চীনারা ব্রিটিশদের উন্নতমানের সমরকৌশল এবং অস্ত্রশস্ত্রের সাথে পেরে ওঠেন নি। এই যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ চীনা এবং মাত্র ৫০০ জন ইংরেজ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। যুদ্ধে চীন পরাস্ত হয়। পরাজিত হয়ে মাঞ্চু সরকার ইংরেজদের সাথে শান্তিস্থাপনের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে, প্রথমেই দেশপ্রেমিক লিন-সে-সু-কে পদচ্যুত এবং নির্বাসিত করা হয়। বলা হয় যে, তাঁর “হঠকারী পদক্ষেপ” এই যুদ্ধের জন্য দায়ী।

প্রথম আফিম যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত নানকিং সন্ধি

চীনের সামন্ততান্ত্রিক শাসকশ্রেণী কতকগুলি অপমানজনক শর্ত মেনে নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে একটি “অসম চুক্তি” স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তি নানকিং-এর সন্ধি-চুক্তি নামে বিখ্যাত। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট নানকিং-এর সন্ধি-চুক্তির মাধ্যমে প্রথম আফিম যুদ্ধের অবসান ঘটে।

প্রথম আফিম যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত নানকিং সন্ধির শর্ত

এই সন্ধির শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ –

  • (১) ইংরেজরা চীনের কাছ থেকে মোট ২১ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার ক্ষতিপূরণ হিসাবে লাভ করে। এই ২১ মিলিয়নের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সামরিক ক্ষতিপূরণ ছিল ১২ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার, লিন কর্তৃক বিনষ্ট আফিমের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ছিল ৬ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার এবং ক্যান্টনের হং বণিকদের বকেয়া ঋণ শোধের জন্য দিতে হয়েছিল ৩ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার।
  • (২) ক্যান্টনে কো-হং-এর একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।
  • (৩) ক্যান্টন, অ্যাময়, ফু-চাও, নিংপো, সাংহাই – এই পাঁচটি বন্দর ইংরেজদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, ব্রিটিশ কনসাল, বণিকেরা এবং তাদের পরিবারবর্গ এই অঞ্চলগুলিতে বসবাস করতে পারবে।
  • (৪) হংকং ইংরেজদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
  • (৫) দুই তরফের মধ্যে সরকারি চিঠিপত্রের ব্যাপারে সমতা স্বীকৃত হয়।
  • (৬) বিদেশি পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করা হবে এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই পরিমাণ নির্ধারিত হবে।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত বোগের সন্ধি

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর নানকিং সন্ধি-চুক্তি সম্পূরক একটি সন্ধি চুক্তি চীন ও ইংরেজদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি-চুক্তি বোগের সন্ধি-চুক্তি নামে পরিচিত।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত বোগের সন্ধির শর্ত

এই চুক্তির মাধ্যমে স্থির হয় যে,

  • (১) আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হবে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্যের ওপর নির্ধারিত শুল্কের পরিমাণ হবে ১.৫ শতাংশ থেকে ১০.৭৫ শতাংশ।
  • (২) ব্রিটিশরা চীনে “অতি আঞ্চলিক অধিকার” লাভ করে। অর্থাৎ ব্রিটিশ কনসালরা চীনে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করার অধিকার লাভ করে।
  • (৩) ইংল্যান্ডকে চীনে সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশের মর্যাদা দেওয়া হয়। বোগের সন্ধি-চুক্তিকে হুমেনের সন্ধি-চুক্তি নামেও অভিহিত করা হয়।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তীতে আমেরিকার আগ্ৰাসী নীতি

  • (১) নানকিং-এর সন্ধি-চুক্তির পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বণিকরা চীনে কিছু সুবিধা আদায় করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কালেব কাশিং নামে বৈদেশিক দপ্তরের এক পদস্থ কর্মচারীকে চিনে পাঠায়।
  • (২) তাঁর সঙ্গী ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব ড্যানিয়েল ওয়েবস্টারের পুত্র এস. ওয়েবস্টার। কালেব কাশিং মাঞ্চু সরকারের কাছে আর্জি রাখেন যে, চীন ব্রিটিশ বণিকদের যে সুবিধাগুলি দিয়েছে সেগুলি আমেরিকান বণিকদেরও দিতে হবে। এর অন্যথা হলে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তীতে স্বাক্ষরিত ওয়াংশিয়ার চুক্তি

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ চীন অভিমুখে আসতে আরম্ভ করে। সন্ত্রস্ত চীনা কর্তৃপক্ষ আমেরিকার সাথে একটি অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই চীন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ওয়াংশিয়ার সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তীতে স্বাক্ষরিত ওয়াংশিয়ার সন্ধির শর্ত

এই সন্ধির শর্তে বলা হয় যে,

  • (১) চীনে বসবাসকারী কোনো মার্কিন নাগরিক যদি কোনো চীনার সাথে কোনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তার বিচার করবেন আমেরিকান কনসাল। একজন আমেরিকান অপরাধীকে বিচার করার কোনো এক্তিয়ার চীনা আদালতের থাকবে না।
  • (২) আমদানিকৃত বা রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার সময় বা এই শুল্কের হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চীনা সরকারকে আমেরিকান কনসালের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। অর্থাৎ শুল্ক ধার্য করার স্বাধিকার চীন সরকার হারাতে বাধ্য হল।
  • (৩) বিদেশি বাণিজ্য-জাহাজ যখন তখন চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়াই চীন ছাড়তে পারবে। তাছাড়া, আমেরিকানরা পাঁচটি উন্মুক্ত বন্দরে তাদের গির্জা বানাবার অধিকার লাভ করে। ১২ বছর পর এই সন্ধি-চুক্তির পুনর্বিন্যাস করা হবে।

প্রথম আফিম যুদ্ধের পরে ফ্রান্সের সুবিধা আদায়

  • (১) এরপর ফরাসিরাও চীনে সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ফরাসি সরকার লাগ্ৰিন নামে জনৈক প্রতিনিধিকে চিনে পাঠায়। লাগ্রিনের উদ্যোগে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর চীন ও ফ্রান্স-এর মধ্যে একটি সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি-চুক্তি হোয়াম্পোয়ার সন্ধি-চুক্তি নামে বিখ্যাত।
  • (২) ইংরেজরা নানকিং-এর সন্ধির মাধ্যমে এবং আমেরিকানরা ওয়াংশিয়া সন্ধির মাধ্যমে যে-সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছিল, ফরাসিরা হোয়াম্পোয়ার সন্ধির মাধ্যমে সে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। উপরন্তু তারা একটি বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেয়।
  • (৩) পাঁচটি উন্মুক্ত বন্দরে তারা ক্যাথলিক গির্জা তৈরির অনুমতি লাভ করে (আমেরিকানরাও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা তৈরির অনুমতি পেয়েছিল) এবং চুক্তির এই ধারায় বলা হয় যে, কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এই ‘পবিত্র’ স্থানগুলিকে কলুষিত করার চেষ্টা করলে চিং শাসকের স্থানীয় প্রতিনিধি তাদের কঠোর হাতে শাস্তি দেবে।
  • (৪) এই শর্তের ফলে চিং সরকার ফরাসি গির্জা ও ক্যাথলিক মিশনারিদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য ছিল। পরবর্তীকালে এই বিশেষ শর্তটি চীনা জনস্বার্থের পরিপন্থী হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিল। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা ধর্মের নামাবলী গায়ে দিয়ে চীনে তাদের আগ্রাসী নীতি কার্যকরী করতে চেয়েছিল।

প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল

এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –

(ক) প্রথম আফিম যুদ্ধের পরাজয়ের ফল হিসাবে চিনকে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সাথে কতকগুলি অপমানজনক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়েছিল। চিনের ইতিহাসে এই ব্যবস্থা চুক্তি ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এই চুক্তি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে চিন একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগে পদার্পণ করে। চীন একটি “আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক” রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

(খ) চিনের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট

  • (১) প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয় এবং তারপর চুক্তি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের ফলে চিনের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়। হংকং ব্রিটিশদের হাতে চলে যাওয়ার ফলে চীনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাছাড়া, চুক্তি ব্যবস্থার ফলে চীন বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার অধিকার হারিয়েছিল।
  • (২) চিনে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে “অতি আঞ্চলিক অধিকার” স্বীকার করে নিতে এবং বিভিন্ন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রকে “সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশ”-এর মর্যাদা দিতে চিন বাধ্য হয়েছিল। এ সবই ছিল চীনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।

(গ) নজরানা প্রথার অবসান

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চিনের দুর্বলতার সুযোগে কতকগুলি সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল ৪টি অসম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। চুক্তি ব্যবস্থার সূচনার ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিনের নজরানা প্রথার অবসান ঘটেছিল।

(ঘ) চিনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্ৰস্ত

  • (১) প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চীনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আফিমের চোরাই চালান বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রিটিশ অধিকৃত হংকং আফিম চোরাকারবারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
  • (২) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় কার্ল মার্কস “The Opium Trade” নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন যে, প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের পর আফিম ব্যবসা দক্ষিণ চীনেও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
  • (৩) ১৮৪০-এর দশকে চীনে আফিমের বাৎসরিক আমদানির গড় পরিমাণ ছিল ৩৭,০০০ পেটি। ১৮৫০-এর দশকে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭০,০০০ পেটি। চিনের অভ্যন্তরে আফিমের পাচার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চিনা জনগণের নৈতিক অধঃপতন এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি একই সাথে হতে থাকে।

(ঙ) চিনের হস্তশিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন

বিদেশি বণিকদের কাছে চিনের পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত হওয়ার ফলে এবং বিদেশি পণ্যের উপর অত্যল্প বাণিজ্যশুল্ক ধার্য করতে বাধ্য থাকার ফলে বিদেশি পণ্য চিনের বাজার ছেয়ে ফেলে। বিশেষত, বিদেশি বস্ত্র এবং সুতো চিনের বাজার দখল করে নেয়, ফলে চিনের হস্তশিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।

প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে মাও সে তুং এর মন্তব্য

আধুনিক চিনের রূপকার মাও সে-তুং তাঁর The Chinese Revolution and the Chinese Communist Party প্রবন্ধে বলেছেন, “চীনের সামাজিক অর্থনীতি ভেঙে ফেলার ব্যাপারে বিদেশি পুঁজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একদিকে বিদেশি পুঁজি চীনের স্বনির্ভর স্বাভাবিক অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল, অন্যদিকে তা চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলের হস্তশিল্পের ধ্বংসসাধন করেছিল।” সমগ্র চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলে পণ্যনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

উপসংহার :- প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চীনের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও লুপ্ত হয়েছিল। প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তী চুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত হওয়ার ফলে চীনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিদেশি পুঁজিপতিদের লেজুড় বৃত্তি করার জন্য চিনে এক নতুন সামাজিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল। এই শ্রেণী মুৎসুদ্দি শ্রেণী নামে পরিচিত।

(FAQ) চীনে প্রথম আফিম যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রথম আফিম যুদ্ধ অন্য কি নামে পরিচিত ছিল?

প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ।

২. প্রথম আফিম যুদ্ধের সময়কাল কত?

১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দ।

৩. কোন সন্ধির মাধ্যমে প্রথম আফিম যুদ্ধের অবসান ঘটে?

নানকিং সন্ধি।

৪. প্রথম আফিম যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল?

ইংল্যান্ড ও চিন।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment