জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা

জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রসঙ্গে গ্রন্থ রচনা, সার্বভৌম ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সার্বভৌমিকতা, রাষ্ট্র ও সরকারের শ্রেণীবিভাগ, নাগরিকত্ব, বিপ্লব, তার রাষ্ট্রচিন্তার ত্রুটি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের আধুনিক সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের প্রবক্তা জাঁ বোঁদা, জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার দুটি দিক, বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার ত্রুটি ও বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা

ঐতিহাসিক ঘটনাজাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা
পরিচিতিফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ
দেশফ্রান্স
গ্ৰন্থগ্ৰন্থ ‘Six Books of the Commonwealth’
চরম সার্বভৌমত্বজাঁ বোঁদা
মিশ্র রাষ্ট্রনৈরাজ্য
জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা

ভূমিকা :- আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জা বোঁদা (১৫০০-১৫১৬ খ্রি.)। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব, নাগরিকতা তত্ত্ব, বিপ্লব তত্ত্ব প্রভৃতি ধারণাগুলি সমকালে ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রচিন্তার জগৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

গ্ৰন্থ রচনা

তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘Method for the Easy Comprehension of History’ এবং ‘Six Books of the Commonwealth’।

সার্বভৌম ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

তিনি রাষ্ট্রের হাতে ধর্মযুক্ত ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ কেন্দ্রীভূত হওয়ার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সুদৃঢ় করেন।

বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা

জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি নীচে দেওয়া হল –

(ক) রাষ্ট্র

জাঁ বোঁদার রাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

বোঁদার মতে, “রাষ্ট্র হল বিষয়সম্পত্তি-সহ বিভিন্ন পরিবারের সমষ্টি যা সার্বভৌম শক্তি ও যুক্তির দ্বারা শাসিত এবং শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।” অর্থাৎ তাঁর মতে, রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিসমূহের সমষ্টি নয়। পরিবারের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকলে সম্পত্তির দখলকে কেন্দ্র করে লড়াই শুরু হয়। এই লড়াইয়ে বিজয়ী শ্রেণি পরাজিত শ্রেণিকে ক্রীতদাসে পরিণত করে নিজেদের সার্বভৌম শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে।

(২) ন্যায়বিচার ও প্রজাকল্যাণ

বোঁদার মতে, সুসংহত কোনো রাষ্ট্র প্রথমেই ন্যায়বিচার ও প্রতিরক্ষার বিষয়ে নজর দেবে। এরপর রাষ্ট্র তার বাসিন্দাদের কল্যাণসাধনে কাজ করবে।

(খ) সার্বভৌমিকতা

রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে বোঁদা-ই সর্বপ্রথম চরম সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করেন। সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা হিসেবে তিনি বলেছেন “সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের আদেশ জারির চরম ও চিরস্থায়ী ক্ষমতা। এটি হল নাগরিক ও প্রজাদের ওপর রাষ্ট্রের এমন চরম ক্ষমতা, যা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।” তাঁর মতে, একমাত্র রাষ্ট্রই চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাই অন্যান্য সংগঠন থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করেছে।

(গ) রাষ্ট্র ও সরকারের শ্রেণিবিভাগ

অ্যারিস্টটল-এর অনুসরণে বোঁদা রাষ্ট্র ও সরকারকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন – রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। সার্বভৌম ক্ষমতা একক ব্যক্তির হাতে থাকলে তা রাজতান্ত্রিক, কয়েকজনের হাতে থাকলে তা অভিজাততান্ত্রিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে থাকলে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হয়। বোঁদার মতে, একাধিক শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত মিশ্র রাষ্ট্র কখনোই রাষ্ট্র নয়, তা হল নৈরাজ্য।

(ঘ) নাগরিকতা

বোঁদা নাগরিকতাকে অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে দেখেছেন। তিনি সকল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের নাগরিক বলে মনে করেন না। তাঁর মতে পরিবারের প্রধান ব্যক্তি নাগরিক বলে গণ্য হবে। বোঁদার মতে, ‘নাগরিক হল সেই সকল স্বাধীন মানুষ যারা একটি সার্বভৌম ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণাধীন’। তিনি ক্রীতদাসদের নাগরিক বলে স্বীকার করেন নি।

(ঙ) বিপ্লব

রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে বোঁদা বলেছেন যে, জীবদেহের মতো রাষ্ট্রেরও জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু হয়। রাষ্ট্রের মৃত্যু অর্থাৎ অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পরিবর্তন ঘটে এবং সার্বভৌম ক্ষমতা এক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে অন্য কর্তৃপক্ষের হাতে চলে যায়। সার্বভৌম ক্ষমতার এই স্থানান্তরকে বোঁদা ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।

বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার ত্রুটি

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার সমালোচনা করা হয়। যেমন –

(১) মধ্যযুগীয় চিন্তা

বোঁদা নিজেকে যেমন মধ্যযুগীয় পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে পারেন নি, তেমনি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক প্রভাবকেও সম্পূর্ণ দূর করার চেষ্টা করেন নি।

(২) কম গুরুত্বপূর্ণ

বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তাকে অধ্যাপক স্যাবাইন কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। বোঁদার কার্যাবলিকে তিনি প্রথম শ্রেণির দার্শনিক উদ্ভাবন বলে মনে করেন নি।

(৩) স্ববিরোধিতা

বোঁদা একদিকে বলেছেন যে, আইনের উৎস হল সার্বভৌম ক্ষমতা। আবার অন্যদিকে তিনি বলেছেন যে, এমন কিছু আইন আছে যা রাজা রচনা বা পরিবর্তন করতে পারেন না।

(৪) সম্পত্তির অধিকার ও সার্বভৌম ক্ষমতার বিরোধ

বোঁদা একদিকে সার্বভৌম ক্ষমতাকে চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করলেও অন্যদিকে আবার বলেছেন যে, সম্পত্তির অধিকার হল এমন পবিত্র অধিকার যা সার্বভৌম ক্ষমতাও স্পর্শ করতে পারে না।

বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব

জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁর মতবাদের বিভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে। যেমন –

(১) আধুনিক ভাবধারা

বোঁদা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ভাবধারায় আচ্ছন্ন হলেও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় বহু আধুনিক ভাবধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিজ্ঞানকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।

(২) সার্বভৌমিকতার আদর্শ

রাষ্ট্রের চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে বোঁদা আধুনিক সার্বভৌমিকতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এজন্য ড. মুরে তাঁকে সার্বভৌমত্বের ধারণার জনক বলে অভিহিত করেছেন।

(৩) ধর্মনিরপেক্ষতা

মধ্যযুগীয় ভাবধারায় আচ্ছন্ন হলেও বোঁদার মতবাদে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।

উপসংহার :- রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ষোড়শ শতকের এই চিন্তাবিদের অবদান স্মরণ করে ইতিহাসবিদ অ্যালেন লিখেছেন যে, “বোঁদা ছিলেন এই শতকের ফরাসি এবং সম্ভবত সকল রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।”

(FAQ) জাঁ বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জাঁ বোঁদা কোন দেশের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ?

ফ্রান্স।

২. সর্বপ্রথম চরম সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করেন কে?

জাঁ বোঁদা।

৩. মিশ্র রাষ্ট্রকে নৈরাজ্য বলেছেন কে?

জাঁ বোঁদা।

৪. জাঁ বোঁদা রচিত বিখ্যাত গ্ৰন্থ কোনটি?

‘Method for the Easy Comprehension of History’ এবং ‘Six Books of the Commonwealth’

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment