প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার

প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার প্রসঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্য, আমদানি দ্রব্য, দূরপাল্লার বাণিজ্য, বৈদিক সভ্যতার বাণিজ্য, মৌর্যযুগে বাণিজ্য, গুপ্তযুগে বাণিজ্য, নগর বাণিজ্য ও বণিক শ্রেণি সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার
হরপ্পা সভ্যতালোথাল
শতদাড় যুক্ত নৌকাঋগ্বেদ
মুদ্রার ব্যাপক প্রচলনমৌর্য সাম্রাজ্য
শান্তি ও সমৃদ্ধিগুপ্ত সাম্রাজ্য
প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার

ভূমিকা :- ভারত-এর অর্থনৈতিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে বাণিজ্য প্রাচীনকাল থেকেই জড়িত। প্রাচীন ভারতে কৃষিই প্রধান জীবিকা হলেও সেই সময় বাণিজ্যেরও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। প্রাচীন যুগে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় বাণিজ্যই চলত।

হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্য

হরপ্পা-সভ্যতার আমলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের আভাস পাওয়া যায়। হরপ্পীয়রা যেসব ধাতু ব্যবহার করতেন তা ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে কিংবা বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা হত।

হরপ্পা সভ্যতার আমদানি দ্রব্য

হরপ্পায় ব্যবহৃত সোনা আসত দাক্ষিণাত্য থেকে, রুপো আসত সম্ভবত আফগানিস্তান থেকে। তামার প্রাপ্তিস্থান ছিল রাজস্থানের ক্ষেত্রী অঞ্চল, দাক্ষিণাত্য ও বালুচিস্তান। লাপিস লাজুলী পাওয়া যেত আফগানিস্তানের বদখশান থেকে।

হরপ্পা সভ্যতার প্রান্তবর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র

আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সোটুগাই হরপ্পা-সভ্যতার প্রান্তবর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার দূরপাল্লার বাণিজ্য

  • (১) সেকালে দূরপাল্লার বাণিজ্যেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয়ার ‘উর’ অঞ্চলে হরপ্পীয়দের সিলের অনুরূপ চব্বিশটি সিলমোহর পাওয়া গেছে। এই ঘটনা সিন্ধু-উপত্যকা ও টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকার মধ্যে বাণিজ্য-সম্পর্কিত ইঙ্গিত দেয়।
  • (২) পশ্চিম-এশিয়া থেকে পাওয়া ‘কালকাকার’ হরফে লিখিত ফলকে আক্কাদের রাজা সারগণের আমলের দূরপাল্লার বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেলুহা, মগন ও তিলমুন – এই তিনটি অঞ্চলের সাথে আক্কাদের বাণিজ্য চলত। মাটিমার হুইলার মেলুহাকে নিম্ন সিন্ধু-উপত্যকার সাথে অভিন্ন বলে মনে করেন।

হরপ্পা সভ্যতার সামুদ্রিক বাণিজ্য

গুজরাটের লোথালে আবিষ্কৃত প্রাচীন পোতাশ্রয়ের ধ্বংসাবশেষ এবং হরপ্পীয়দের সিলমোহরে উৎকীর্ণ জলযানের প্রতিকৃতি থেকে প্রাচীনকালে ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।

বৈদিক সভ্যতার বাণিজ্য

বৈদিক সভ্যতায় ব্যাবসাবাণিজ্য সাধারণভাবে বৈশ্যের বৃত্তি বলে গণ্য হত। ঋগবেদে বাণিজ্য ও বণিকের উল্লেখ আছে। দূরদেশে বাণিজ্যকালে বিপদ থেকে মুক্তির প্রয়োজনে কিছু প্রার্থনামন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বাণি’ বলতে সম্ভবত বণিকদের বোঝানো হয়েছে। ঋগবেদে ‘সমুদ্র’ ও ‘শতদাড়যুক্ত নৌকা’র উল্লেখ থেকে তাদের বাণিজ্যকর্মের প্রমাণ মেলে।

নগরের উত্থান

  • (১) ড. রামশরণ শর্মার মতে, ভারতে নগরের উদ্ভব হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫০ অব্দে হরপ্পাতে। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ নাগাদ নগরগুলির পতন ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে মধ্যগাঙ্গেয় সমভূমিতে পুনরায় নগরের উত্থান ঘটে। হরপ্পা সভ্যতার যুগে উন্নত শহরগুলির অন্যতম ছিল হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, লোথাল, কালিবনগান ইত্যাদি।
  • (২) ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে ব্রোঞ্জ যুগেই সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে নগরের উদ্ভব সম্ভব হয়। কিন্তু মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় লৌহ যুগ-এর আগে নগরের উদ্ভব ঘটেনি। লৌহ হাতিয়ার আবিষ্কৃত হলে বনজঙ্গল পরিষ্কার সম্ভব হয়।
  • (৩) লোহার লাঙল দ্বারা পলি জমিতে উদ্‌বৃত্ত ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়। এই উদ্‌বৃত্ত নগরবাসীর জন্য সংগৃহীত হত কর হিসেবে বা গ্রাম ও নগরের মধ্যে বাণিজ্যের লভ্যাংশ হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুদ্রার প্রচলন হলে মধ্য গাঙ্গেয় নগরগুলিতে সচ্ছলতা আসে।
  • (৪) উদ্ভবকাল থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরের বিকাশ অব্যাহত ছিল। পরে অবনতি শুরু হয়। তবে সীমিত আকারে এই নগরগুলি দ্বাদশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল। ‘মহাপরিনির্বাণ সূত্র’ অনুসারে গৌতম বুদ্ধ-এর সমকালীন নগরের সংখ্যা যাট। এর মধ্যে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ নগর হল বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী ও কুশীনগর।
  • (৫) উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্জিখেড়া তে খননকার্যের ফলে ‘উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের স্তরে প্রাচীনতম নগর প্রাকার আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দে নির্মিত হয়েছিল। তবে ড. রামশরণ শর্মা প্রমুখ মনে করেন, কৌশাম্বী, রাজগৃহ প্রভৃতি নগর পত্তনের কিছু আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের কিছু আগে এর পত্তন হয়ে থাকতে পারে।
  • (৬) সম্ভবত পাটলিপুত্র নগরীর পত্তন হয়েছিল কিছু পরে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। উত্তর ভারতে নগরায়ণ ঘটলেও দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণাত্যে নগরের উদ্ভব বিলম্বিত হয়েছিল। কারণ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে দক্ষিণ ভারতে উদ্‌বৃত্ত আহরণ করার মতো রাজনৈতিক অবস্থা বা প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না। তাই বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে প্রাচীনকালে নগরের অস্তিত্ব দেখা যায় না।

প্রাক-মৌর্যযুগে বাণিজ্য

প্রাক্‌-মৌর্য যুগে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এর পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যেরও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়। মহাজনপদগুলির উত্থান, নগরের বিকাশ, মুদ্রার প্রচলন প্রভৃতি এই সময় বাণিজ্যের বিকাশে সহায়তা করেছিল। রাজগৃহ, চম্পা, বৈশালী, বারাণসী, উজ্জয়িনী, কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী প্রভৃতি এই সময় বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

মৌর্যযুগে বাণিজ্য

মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কালে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন, কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বাণিজ্যের সরকারি সহায়তা প্রভৃতির ফলে বাণিজ্যের অগ্রগতি সহজতর হয়েছিল। বণিকদের পণ্য চলাচলের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় পাহারার ব্যবস্থা ছিল।

গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগের বাণিজ্য

গুপ্তযুগে শান্তি ও সমৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত ছিল। এই সময় তাম্রলিপ্ত, ভূগুকচ্ছ, কল্যাণ, কাবেরীপত্তনম্ প্রভৃতি বন্দর থেকে পারস্য, বাইজানটাইন, ইথিওপিয়া, চীন, সিংহল, ব্রহ্মদেশ ও অন্যান্য দূরবর্তী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

নগর-বাণিজ্য ও বণিকশ্রেণি

  • (১) কৃষি অর্থনীতির সূচনা, নগরের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি পরবর্তী বৈদিক যুগ-এ বাণিজ্য বিকাশের সহায়ক ছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য-এ ‘শ্রেণি’ শব্দটি প্রথম দেখা যায়। এর অর্থ অত্যন্ত ধনীবণিক। যজুর্বেদে ‘বণিজ’ বা বণিকের পুত্র কথার ব্যবহার থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তখন বণিকের বৃত্তি বংশানুক্রমিক হয়েছিল।
  • (২) পালি সাহিত্যে জীবিকা হিসেবে ‘বণিচ্ছা’ বা বাণিজ্যকে কৃষির থেকেও সহজসাধ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাণিজ্য থেকে যে প্রচুর অর্থ লাভ হওয়া সম্ভব, এই সম্বন্ধে পালি সাহিত্য যথেষ্ট সচেতন ছিল।
  • (৩) আচ্ছাদিত গো-শকটে পণ্য নিয়ে এই ক্যারাভ্যান বণিকের দল দূর দেশে পাড়ি দিত। এই জাতীয় বণিকদলের প্রধানকে বলা হত ‘সার্থবাহ’। অসংখ্য গো-শকট বোঝাই করে সার্থবাহ পূর্বসীমা থেকে ‘অপারান্ত’ পাড়ি দিচ্ছেন, এমন বর্ণনা পালি সাহিত্যে পাওয়া যায়। সে যুগের শ্রেষ্ঠী’রা মিলিতভাবে ‘গণ’ বা ‘সংঘ’ স্থাপন করেছিলেন।
  • (৪) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে পার্বত্য কিরাতগণ গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিত। তারা ঔষধের বিনিময়ে চর্ম ও বস্ত্র গ্রহণ করত। উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজগির, গয়া, বৈশালী প্রভৃতি নগর অতিক্রম করে নেপাল-এর তরাই অঞ্চল পর্যন্ত বাণিজ্যপথ প্রসারিত ছিল।
  • (৫) পশ্চিমে বাণিজ্যের ধারা শ্রাবস্তী, দিল্লি-মথুরা হয়ে সুদূর তক্ষশীলায় পৌঁছেছিল। দাক্ষিণাত্যে ভিলসা ও মহীশূরের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য চালু ছিল আওরঙ্গাবাদ জেলার অন্তর্গত পৈঠান বা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত।

উপসংহার :- গুপ্ত-পরবর্তী যুগে ব্যাবসাবাণিজ্য যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছিল বলে ড. রামশরণ শর্মা আরো অনেকেই মনে করেন। এই সময় রােম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ভারত-রােম বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

(FAQ) প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হরপ্পা সভ্যতায় তামা আসতো কোথা থেকে?

রাজস্থানের ক্ষেত্রী।

২. বৈদিক সভ্যতায় কাদের বৃত্তি ছিল বাণিজ্য?

বৈশ্য।

৩. হরপ্পা সভ্যতার বন্দর কোথায় ছিল?

গুজরাটের লোথালে।

৪. প্রাক মৌর্য যুগের দুটি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম লেখ।

বারাণসী, উজ্জয়িনী।

Leave a Comment