ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ হিসেবে স্বার্থের সংঘাত, ভারতীয়দের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার, নবজাগরণের প্রভাব, নতুন সাহিত্য, সংবাদপত্র, বেকারত্ব ও চাকরিতে বঞ্চনা, ভারতীয় স্বার্থের প্রতি উদাসীনতা, অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা সম্পর্কে জানবো।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ প্রসঙ্গে ভারতে জাতীয়তাবাদের উত্থান ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রধান প্রধান কারণ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে স্বার্থের সংঘাত, ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ইংরেজি শিক্ষা, ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরাবিস্কার, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে নবজাগরণের প্রভাব, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সংবাদপত্রের ভূমিকা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার প্রভাব সম্পর্কে জানব।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ (Growth of Nationalist Consciousness in India)
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ |
আধুনিক ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক | স্বামী বিবেকানন্দ |
এশিয়াটিক সোসাইটি | স্যার উইলিয়াম জোনস |
আনন্দমঠ | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
ব্রাহ্ম সমাজ | রাজা রামমোহন রায় |
আর্য সমাজ | স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী |
ভূমিকা :- উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ। ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র, তাদের শোষণের পদ্ধতি এবং কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের সমন্বয়ে ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের কারণ
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে নিম্নলিখিত কারণ গুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেমন –
(ক) স্বার্থের সংঘাত
- (১) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, ভারতীয় ও ব্রিটিশ-স্বার্থের সংঘাতই ছিল জাতীয়তাবাদ উন্মেষের মূল কারণ। নিজ স্বার্থ-সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ভারত জয় করেছিল এবং এ দেশে তারা এমন এক শাসন-ব্যবস্থা স্থাপন করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বজায় রাখা।
- (২) ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, স্বার্থের সংঘাতের ফলেই জন্ম নেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। ব্রিটেনের স্বার্থ হল ভারতকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তার অধীনস্থ করে রাখা, আর ভারতীয় জনগণের স্বার্থহল ভারতীয় সমাজের অবাধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে নির্বিঘ্নে রাখা।
- (৩) ভারতের সর্বস্তরের মানুষ ধীরে ধীরে এই পরম সত্যটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, ইংরেজ সরকার ও তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে পরস্পর-বিরোধী। এর ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের সঞ্চার হয়।
- (৩) দরিদ্র কৃষক উপলব্ধি করতে পারে যে, তার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে উৎপন্ন ফসলের অধিকাংশই সরকারি রাজস্ব দিতে চলে যায় এবং সরকারি পুলিশ ও প্রশাসনের লক্ষ্য হল জমিদার শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করা।
- (৪) ব্রিটিশ পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে ভারতীয় কারিগর ও শিল্পীদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। ব্রিটিশ মালিকানাধীন কল-কারখানা, খনি এবং চা ও কফি বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা স্পষ্টই বুঝেছিল যে, মালিকের স্বার্থরক্ষা করাই সরকারের লক্ষ্য।
- (৫) কেবলমাত্র কৃষক, কারিগর ও শ্রমিকরাই নয়—ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও দেশীয় শিল্পপতিরাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংরেজ শাসনাধীনে তাঁদের স্বার্থও নিরাপদ নয় এবং তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার থেকে তাঁরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।
- (৬) সুতরাং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক ব্রিটিশ-বিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়।
(খ) ভারতীয়দের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ
- (১) ডঃ নিমাই সাধন বসু বলেন যে, উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গঠনে বর্ণবৈষম্যএবং জাতিগত বিদ্বেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত।”
- (২) বিজেতা ইংরেজরা জাতিগত দিক থেকে নিজেদের ভারতীয়দের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত এবং ভারতীয়দের প্রতি তাদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ভারতীয়দের প্রতি সর্বদাই তাদের তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশিত হত। তাদের কাছে ভারতীয়রা ছিল ঘৃণ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অর্ধ-বর্বর। চার্লস গ্রান্ট-এর মতে ভারতীয়রা হল“একটি ঘৃণিত ও শোচনীয়ভাবে অধঃপতিত এক জাতি।”
- (৩) রেলগাড়ির কামরা, স্টেশনের প্রতীক্ষাশালা, হোটেল, পার্ক, ক্লাব, সাঁতার কাটার জায়গা, খেলার মাঠ প্রভৃতি সর্বসাধারণের ব্যবহারের স্থানগুলি ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত থাকত। কোনও ইউরোপীয় যাত্রী থাকলে টিকিট থাকা সত্ত্বেও কোনও ভারতীয় যাত্রী রেলের সেই কামরায় ভ্রমণ করতে পারত না।
- (৪) পদস্থ ভারতীয়দের প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করতেও তারা দ্বিধা করত না এবং ভারতীয়দের অন্যায়ভাবে হত্যা করলেও নামমাত্র জরিমানা দিয়েই তারা মুক্তি পেত। ইংরেজ মনিব ভারতীয় চাকরকে বা চা-বাগানের সাহেব কুলিকে সবুট লাথি মেরে হত্যা করেছে এবং আদালতে নামমাত্র জরিমানা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে—এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে।
- (৫) ১৮৭৬ সালে আগ্রাতে ফুলার নামে এক ইংরেজ তার সহিসকে এভাবে হত্যা করে মাত্র ত্রিশ টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পায়। কোনও ভারতীয়—তিনি যত সম্মানিতই হোন না কেন, কোনও ইংরেজের সামনে ঘোড়া, হাতি বা পালকি চড়ে যেতে পারতেন না বা দেশি চটি পরে কোনও পদস্থ ইংরেজের সামনে যেতে পারতেন না।
- (৬) ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে এক সাহেবের সামনে পালকি চড়ে রাজা রামমোহন রায়-এর মতো মানুষ অপমানিত হয়েছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর পালকি চড়ে যাওয়ার সময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্নেল ডাফিনের হাতে প্রহৃত হন।
- (৭) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর মতো প্রতিষ্ঠিত মানুষকে তাঁর চটির জন্য কলকাতা মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নি। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কার্জন যখন বড়লাট হয়ে ভারতে আসেন, তখন তাঁকে অভিনন্দন জানাবার উদ্দেশ্যে ‘ভারত সভা‘-র পক্ষ থেকে যে প্রতিনিধি দল লাটভবনে যায় তার মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর জামাতা যোগেশচন্দ্র চৌধুরী চটি পরে গিয়েছিলেন বলে লাটভবনে প্রবেশাধিকার পান নি।
- (৮) শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সর্বদাই এই জাতি-বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হত। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জি. ও. ট্রিভেলিয়ান লিখছেন যে, “আমাদের একজনমাত্র দেশবাসীর (ইংরেজ) প্রদত্ত সাক্ষ্যকেই আদালতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বহু হিন্দু সাক্ষী বিপরীত সাক্ষ্য দিলেও তা আদালত কোনও গুরুত্ব দেয় না। একজন বিবেচনাহীন লোভী ইংরেজের পক্ষে কতদূর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার সুযোগই না এই বিচারব্যবস্থা করে দিয়েছে।”
- (৯) ব্রিটিশ শাসকবর্গ এই জাতিবিদ্বেষের কথা খোলাখুলি প্রচার করত। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বড়লাট লর্ড মেয়ো পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে লিখছেন—“আপনার অধীনস্থ কর্মচারীদের এই শিক্ষা দেবেন যে আমরা সবাই ব্রিটিশ ভদ্রলোক এবং একটি নিকৃষ্টতর জাতিকে শাসন করার মতো মহৎ কাজে আমরা সবাই নিযুক্ত।”
- (১০) বলা বাহুল্য, বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের এমন নির্লজ্জ ও স্পর্ধিত প্রকাশ, ভারতীয়দের ওপর এই লাঞ্ছনা এবং ইংরেজদের এই সীমাহীন ঔদ্ধত্য শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কোনও ভারতীয়র পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এই অপমানবোধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করে।
- (১১) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, ভারতে জাতীয় চেতনা উন্মেষের অন্যতম কারণ ছিল ভারতবাসীর প্রতি বহু ইংরেজের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
(গ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ
- (১) ইংরেজ শাসনাধীনে উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল এক শাসনাধীনে আসে এবং সমগ্র ভারতে একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) সারা দেশে একই ধরনের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা, অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতে একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য গড়েওঠে।
- (৩) এইভাবে বিদেশি শাসনের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে একটি ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। তারা বুঝতে পারে যে, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বাস করলেও তারা একই শত্রুর দ্বারা নিপীড়িত—এবং এই সময় শত্রু হল ব্রিটিশ-রাজ।
- (৪) এই ঐক্যবোধ থেকেই জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। তাই বলা হয় যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হল ব্রিটিশ শাসনের পরোক্ষ সুফল।
(ঘ) ইংরেজি শিক্ষা
- (১) ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে পাশ্চাত্য শিক্ষার পালিত পুত্র। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ভারতবাসী মিল, লক, বার্ক, মেকলে, বেন্থাম, স্পেনসার, টম পেইন, মিল্টন, রুশো, ভলতেয়ার, কার্ল মার্কস প্রমুখ দার্শনিকদের রচনার মাধ্যমে ইউরোপীয় রাষ্ট্রনীতি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে সুপরিচিত হয়।
- (২) ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, সাম্য, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাংবিধানিক আদর্শ তাদের মনে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ড-এর গৌরবময় বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব-এর সাফল্য, বিদেশি শাসনের বন্ধন থেকে আমেরিকা, গ্রিস ও ইতালির বন্ধনমুক্তি, আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ম্যাৎসিনী ও গ্যারিবল্ডি আদর্শ ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে।
- (৩) এইভাবে ভারতবাসীর চিন্তা ও চেতনায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। তাছাড়া ইংরেজি ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয়দের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের বাহক হয়ে ওঠে এবং নেতৃমণ্ডলী এই ভাষার মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে ব্রিটিশ-বিরোধী আলাপ-আলোচনা চালান। এইভাবে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সমগ্র ভারতে এক ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়।
(ঙ) উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা
- (১) ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে একটি রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। দেশের এক বিরাট অঞ্চলের ওপর ইংরেজ আধিপত্য স্থাপন এবং একই ধরনের কেন্দ্রীভূত আইন-কানুন ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সারা দেশে একই রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে ওঠে।
- (২) রাস্তাঘাট ও রেলপথ নির্মাণ এবং ডাক ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণে সক্ষম হন।
- (৩) এইভাবে সারা দেশে এক অখণ্ড ভারতবোধ জেগে ওঠে। ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ভারতীয়দের একটি জাতিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। ডঃ তারা চাঁদ বলেন যে, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিভিন্ন অঞ্চলের নতুন সামাজিক শ্রেণীগুলির যোগাযোগে সাহায্য করে তাদের একটি সংঘবদ্ধ এককে পরিণত করে।
(চ) ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার
- (১) পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রথম সংঘাতে ভারতে প্রথমে অন্ধ পাশ্চাত্যানুকরণ শুরু হয়। এই সময় সরকারি উদ্যোগে প্রচার করা হতে থাকে যে, ভারতবাসী চিরদিনই বর্বর এবং অতীত সম্পর্কে গর্ব করার মতো কিছু ভারতবাসীর নেই।
- (২) ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র প্রতিষ্ঠা এবং স্যার উইলিয়ম জোন্স, ম্যাক্সমুলার, মনিয়র উইলিয়মস, প্রিন্সেপ, কানিংহাম, মার্শাল, উইলসন, ফার্গুসন, কীথ, জেকোবি, রাণাডে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভাণ্ডারকর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ পণ্ডিতদের প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণার ফলে ভারত ও বিশ্ববাসীভারতের সুপ্রাচীন ও মহত্তর সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারে।
- (৩) ভারতীয়রা উপলব্ধি করেন যে, তাঁরা এক সুপ্রাচীন কৃষ্টি ও মহত্তর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী এবং ভারতীয় সভ্যতা, কৃষ্টি, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, স্থাপত্য ও চারুকলা প্রাচীন গ্রিক বা রোমান সভ্যতা অপেক্ষা কোনও অংশেই কম নয়।
- (৪) এর ফলে ভারতে এক সাংস্কৃতিক নবজাগরণ দেখা দেয়, ভারতবাসী নিজ দেশের অতীত ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান ও দেশপ্রেম জেগে ওঠে এবং তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গঠনে প্রভূত সাহায্য করে।
- (৫) ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কারের ভিত্তির ওপর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে।
(ছ) নবজাগরণের প্রভাব
- (১) ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ-এর অবদান নেহাৎ কম নয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে রামমোহন রায়, ডিরোজিওর নব্যবঙ্গ সম্প্রদায়, ব্রাহ্ম সমাজ, আর্য সমাজ, থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রভৃতির নেতৃত্বে ভারতে যে ধর্মীয় ও সামাজিক পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে দেশবাসী প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।
- (২) ভারতীয় নবজাগরণ দেশবাসীকে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বলবর্তী করে তোলে। শ্রীমতী অ্যানি বেশান্ত বলেন যে, রামমোহন বাংলাকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি সৃষ্ট জড়ত্ব থেকে মুক্ত করেন।
- (৩) কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ জাতীয়তাবাদের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল জাতির স্বাধীনতা লাভ। তিনিই সর্বপ্রথম ‘স্বরাজ’ কথাটি ব্যবহার করেন।
- (৪) দয়ানন্দ সরস্বতী বলেন যে, “ভারত ভারতীয়দের জন্য”। ঐতিহাসিক হ্যানস কন (Hans Kohn) বলেন যে, “আর্য সমাজের আন্দোলন একই সঙ্গে ধর্মীয় ও জাতীয় আন্দোলন।
- (৫) ভারতীয় জাতীয়তার বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তাঁকে ‘আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও চেতনার মূর্ত প্রতীক। এইভাবে ভারতীয় নবজাগরণ নানাভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সঞ্জীবিত করেছে।
(জ) নতুন সাহিত্য
- (১) জাতীয়তার বিকাশে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশিত সাহিত্যগুলির অবদানও কম নয়। কবি, সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকারগণ তাঁদের রচনার মাধ্যমে দেশবাসীর অন্তরে স্বাজাত্যবোধ জাগ্রত করতে সক্ষম হন।
- (২) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দেশবাসীকে জানান যে, ভারতভূমি ‘ইন্দ্রের অমরাবতী’ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, নবীনচন্দ্র সেন দেশবাসীকে স্বাজাত্যবোধের নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করেন।
- (৩) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদের নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে। তিনি ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেন যে, “সকল ধর্মের উপর স্বদেশ প্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না।” স্বামী বিবেকানন্দের রচনা দেশবাসীকে আত্মদান, আত্মত্যাগ, আত্মবিশ্বাস ও জাতীয়তার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে ভারতে এক নবযুগের সৃষ্টি করে।
- (৪) হিন্দি, মারাঠি, তামিল, তেলেগু, গুজরাটি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, ফারসি, উর্দু সাহিত্যেও যুগান্তর আসে। মারাঠি চিন্তাবিদ রাণাডে বলেন যে, শিবাজি সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রচনাগুলি মারাঠিদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেয়। জ্যোতিবা ফুলে শুদ্র শিবাজির অভ্যুত্থানের মধ্যে এক সমাজ বিপ্লবের সন্ধান পান।
(ঝ) সংবাদ পত্র
- (১) জাতীয়তার বিকাশে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ভূমিকাও কম নয়। ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- (২) কেবল সমাজ ও ধর্মসংস্কার নয়—এই সব পত্রিকায় সরকারি অনাচার, অত্যাচার ও নানা রাজনৈতিক বিষয় প্রকাশিত হত। এই ব্যাপারে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ পত্রিকা‘, ‘বঙ্গদর্শন পত্রিকা‘, ‘সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা‘ এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা‘, অমৃতবাজার পত্রিকা‘, ‘বেঙ্গলি পত্রিকা‘ প্রভৃতি পত্রিকার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- (৩) ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিও অনুরূপ ভূমিকা পালন করে। এই সব পত্রিকাগুলির মধ্যে মাদ্রাজের ‘হিন্দু’, ‘স্বদেশ মিত্রম’, মহারাষ্ট্রের ‘কেশরী পত্রিকা‘, ‘মারাঠা’, ইদুপ্রকাশ’, পাঞ্জাবের ‘কোহিনুর’, ‘লাহোর ট্রিবিউন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ছিল।
- (৪) এই পত্রিকাগুলির ভাষা এবং তিক্ত মতামত সরকারের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। এই কারণে সরকার পত্রিকাগুলির বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ভারতের লাট লর্ড ডাফরিন মন্তব্য করেন যে, ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি পাঠ করলে মনে হয় যে ইংরেজরা যেন “মানব জাতির শত্রু—বিশেষ করে ভারতীয়দের।”
(ঞ) বেকারত্ব ও চাকরিতে বঞ্চনা
- (১) পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা ইংরেজ সরকারের অধীনে উপযুক্ত চাকরি আশা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এদিক থেকেও তাঁরা হতাশ হন। তাঁদের প্রবল বেকারত্বের সম্মুখীন হতে হয়।
- (২) যাঁরা চাকরি পেতেন তাঁরাও কিন্তু কখনোই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পেতেন না—সকল উচ্চপদ ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত থাকত, ভালো বেতনের চাকরি ছিল তাদের নাগালের বাইরে।
- (৩) ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী দেখিয়েছেন যে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাসিক পঁচাত্তর টাকা বেতনের ওপর পদের সংখ্যা ছিল ১৩,৪৩১টি।আর এর অধিকাংশই সংরক্ষিত ছিল উচ্চবিত্ত ইংরেজ বা মধ্যবিত্ত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের জন্য।
- (৪) লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড কর্ণওয়ালিস প্রমুখ বড়লাটেরা ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগের বিরোধী ছিলেন কারণ তাঁরা ভারতীয়দের অসৎ বলে মনে করতেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন-এ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতীয়কে উপযুক্ত পদে নিয়োগের নীতি ঘোষিত হলেও, তা কখনও বাস্তবায়িত হয় নি।
- (৫) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ-এর পর মহারানির ঘোষণাপত্র-এও নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু ইংরেজ শাসকরা সেগুলি বাস্তবায়িত করার পথে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে।
- (৬) ভারতীয়রা যাতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে না পারে সে জন্যও তারা সচেষ্ট হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন পাশ করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স একুশ থেকে কমিয়ে উনিশ করা হয়। বলা বাহুল্য, উনিশ বছরের একজন ভারতীয় যুবকের পক্ষে লন্ডনে গিয়ে এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া একরকম অসম্ভব ছিল।
- (৭) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সার্ভিসে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ১০০টি পদের মধ্যে ভারতীয় ছিল মাত্র ১৬ জন।
- (৮) এই সব নানা কারণে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(ট) ভারতীয় স্বার্থের প্রতি উদাসীনতা
- (১) পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দর্শনের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা উপলব্ধি করেন যে, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, ধীরে ধীরে তাঁদের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু শীঘ্রইতাঁদের আশা অলীক বলে প্রমাণিত হয়।
- (২) মহাবিদ্রোহের পর থেকে যে প্রশাসনিক পরিবর্তন করা হয়, তাতেও ভারতীয়রা খুশি হননি। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সেই সব ভারতীয়দের মনোনীত করা হয়, যাঁরা ইংরেজদের অনুগত ছিলেন। প্রাদেশিক আইন পরিষদ-গুলিতেও ভারতীয়দের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ ছিল না।
- (৩) ভারত শাসন পরিচালনার জন্য অত্যধিক ব্যয়, ভারত সরকারের নামে গৃহীত ঋণের সুদ, ইংরেজ স্বার্থে পরিচালিত বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ব্যয়ভার, সেনাবাহিনীর জন্য বিপুল ব্যয় এবং অপরদিকে ভারতীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ, শিল্পোন্নয়ন প্রভৃতির প্রতি চরম অবহেলা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
(ঠ) অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা
- (১) ইংল্যাণ্ডের স্বৈরাচারী অর্থনৈতিক শোষণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গঠনে যথেষ্ট সাহায্য করে। পূর্বে কৃষি ও কুটির শিল্প ছিল ভারতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি। সুতি, রেশম, পশম বস্ত্র, ধাতু ও মূল্যবান প্রস্তর শিল্পের জন্য ভারত বিখ্যাত ছিল।
- (২) পলাশীর যুদ্ধ-এর পর অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং ভারতের বুকে শুরু হয় কোম্পানির স্বৈরাচারী অপশাসন। ভারতের প্রচুর সোনা-রূপা ইংল্যাণ্ডে চলে যায় এবং কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য শুরু করে।
- (৩) ইংল্যাণ্ডের শিল্প বিপ্লব-এর ফলে ভারত ব্রিটিশ কারখানাগুলির কাঁচামাল সরবরাহের উৎস ও ভোগ্যপণ্যের খোলাবাজারে পরিণত হয়। ইংল্যাণ্ড-জাত দ্রব্য বিনা শুল্কে ভারতে বিক্রি হতে থাকে এবং ভারতীয় পণ্যের ওপর চাপানো হয় বিশাল করের বোঝা।
- (৪) শুল্কের অসম প্রতিযোগিতার ফলে ভারতীয় বস্ত্র, লৌহ, কাগজ, তৈল, লবণ প্রভৃতি শিল্প ও অন্যান্য ভারতীয় কুটির শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একদিকে ভারতীয় কুটির শিল্পের ধ্বংসসাধন এবং অপরদিকে আধুনিক শিল্প স্থাপনে সরকারের অনীহা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্রতর করে তোলে।
- (৫) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে জমির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং বহু বেকার শিল্পী, কারিগর ও বণিকেরা জমিতে ভিড় করতে থাকে।কিন্তু সরকারের স্বৈরাচারী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
- (৬) নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং চা ও কফির বাগানে ভারতীয় শ্রমিকদের ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্যাতন দেশে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
- (৭) ১৮৬৫ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ প্রায় ২ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ৩৬০ লক্ষ মানুষকে পীড়িত করে।
- (৮) এই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত তখন আফগান যুদ্ধের ব্যয়নির্বাহের জন্য লর্ড লিটন ভারতীয়দের ওপর নতুন কর চাপান এবং ভারতীয় রাজস্ব থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মহারানি ভিক্টোরিয়ার সম্মানার্থে মহাসমারোহে দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত করেন।
- (৯) ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে, ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে তাঁরা নিজ গৃহে পরবাসী মাত্র—এ দেশে তাঁদের কোনও অধিকার নেই। দাদাভাই নওরোজি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পভার্টি অ্যান্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া, রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর ‘ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’ এবং মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে ‘ইণ্ডিয়ান ইকনমি’ গ্রন্থ মারফৎ ইংরেজদের স্বৈরাচারী শোষণের স্বরূপ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন।
(ড) লর্ড লিটনের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকাল
- (১) ভারতীয় জাতীয়তার বিকাশে লর্ড লিটনের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকাল (১৮৭৬-৮০ খ্রিঃ) খুবই সহায়ক হয়েছিল।
- (২) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন যে, “লর্ড লিটনের প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ভারতের জনসাধারণকে তাদের অভ্যস্ত জড়তা থেকে মুক্ত করে দিয়েছিল। এই আঘাতে জনগণ তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল। …..বহুকাল ব্যাপী আন্দোলন যে ঈপ্সিত লক্ষ্যসাধন করতে অপারগ হয়, সেখানে অত্যাচারী শাসকের অত্যাচার জনজাগরণের কাজটি দ্রুত ফলপ্রসূ করে দিয়ে থাকে।”
- (৩) ব্রিটেনের বস্ত্র ব্যবসায়ীদের খুশি করার জন্য লর্ড লিটন ভারতে আমদানিকৃত বিলিতি বস্ত্রের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে দেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা এই ব্যাপারটি ভালোভাবে মেনে নেননি। তাঁরা এর মধ্যে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত লক্ষ্য করেন। এর ফলে সারা দেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
- (৪) লিটন দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে (১৮৭৮-৭৯ খ্রিঃ) জড়িয়ে পড়েন এবং অনুৎপাদক যুদ্ধখাতে ভারতীয় রাজস্ব ব্যয় করতে শুরু করলে জনমনে প্রবল ক্ষোভ দেখা দেয়।
- (৫) সিভিল সার্ভিসের চাকরি থেকে ভারতীয়দের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই পরীক্ষার বয়স একুশ থেকে কমিয়ে উনিশ করা হয়।
- (৬) ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করার জন্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ (Vernacular Press Act) বা ‘মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন’ পাশ করা হয়।
- (৭) ভারতীয়দের নিরস্ত্র করার জন্য পাশ করা হয় ‘অস্ত্র আইন’ বা ‘আর্মস অ্যাক্ট’ (Arms Act, ১৮৭৮ খ্রিঃ)।
- (৮) ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সারা দক্ষিণ ভারত-ব্যাপী ব্যাপক দুর্ভিক্ষের কালে তিনি মহাসমারোহের সঙ্গে দিল্লি দরবারের আয়োজন করেন। এই সব ঘটনা ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং ইংরেজ শাসন সম্পর্কে দেশবাসীর মোহভঙ্গ হয়।
উপসংহার :- ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে লিটনের পদত্যাগকালে সুরেন্দ্রনাথ ‘বেঙ্গলী’-তে লেখেন যে, “লর্ড লিটন তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপের দ্বারা ভারতে জনমত গঠনে সহায়তা করেছেন এবং তাঁর এই অবদানের জন্য আমাদের দেশ তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।” পরবর্তী শাসক লর্ড রিপনের আমলে ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে দেশময় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং এই ঘটনা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে তোলে।
(FAQ) ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
স্বামী বিবেকানন্দকে।
স্যার উইলিয়াম জোনস।
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।