ফরাসি বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লব -এর পূর্বে ফ্রান্সের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, কর ব্যাবস্থা, গীর্জার দুর্নীতি ও বিপ্লবের প্রভাব সম্পর্কে দেওয়া হল।

আধুনিক সভ্যতার যাত্রাপথের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ের পাখি, ফরাসি বিপ্লবের জনক রুশো, ফরাসি বিপ্লবের জননী প্যারিস নগরী, ফরাসি বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ রাজবংশের রাজা ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুদণ্ড, ফরাসি বিপ্লব কালে ফ্রান্সে দৈব রাজতন্ত্র, ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক কারণ, ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ, ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণ, ফরাসি বিপ্লব কালে টেনিস কোর্টের শপথ, ফরাসি বিপ্লব কালে বাস্তিল দুর্গের পতন, ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের কর ব্যবস্থা, ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের ধর্ম কর টাইথ, ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল, ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা মিরাবো, প্রজাপতি রাজা পঞ্চদশ লুই, ফরাসি বিপ্লবের সময় জাতীয় সভা, ফরাসি বিপ্লবের মূল আদর্শ ও ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
টেনিস কোর্টের শপথ ২০ শে জুন, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
বাস্তিল দুর্গের পতন১৪ ই জুন, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
রাজা ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ড২১ শে জানুয়ারী, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ
ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব পুরাতন তন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের সমাজ, রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের সূচনা করে ।

ভূমিকা :- আধুনিক সভ্যতার যাত্রাপথের গুরুত্বপূর্ণ মোড় হল ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রিঃ)। এই বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং একই সাথে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ সকল গোঁড়ামী ত্যাগ করে নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসি বিপ্লবকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজনীতি এবং অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে পদার্পণ করে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রচারিত হয়। আর এই আদর্শ ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করে।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজ ব্যবস্থা

বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্স ছিল দুর্দশার শিকার । যাজক শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর চাপে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছিল। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে যাজকদের সাথে রাজার পৌইসির চুক্তি হওয়ার ফলে রাজা তাঁদের উপর কর বসাতে পারতেন না । অভিজাতরা কর দিলেও তাদের অনেক ছাড় ছিল। রাজা নিজেও ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্গত । রাজার এ হেন স্বৈরাচারী মনোভাব, অভিজাত শ্রেণীর অহংবোধ ও যাজক শ্রেণীর ঔদ্ধত্য ফ্রান্সের অর্থনীতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখেছিল। বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের সমাজে শ্রেণীবিভক্তি দেখা যায়। প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল- যাজক শ্রেণী, অভিজাত শ্রেণী ও তৃতীয় শ্রেণী।

(i) যাজক শ্রেণী

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় যাজকেরা ছিলেন প্রথম শ্রেণীভুক্ত । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষ কুড়ি হাজার। তাদের মধ্যেও ভেদাভেদ ছিল। তারা উচ্চ যাজক ও নিম্ন যাজক এই দুই ভাগে সুবিন্যস্ত ছিল। ফরাসী মন্ত্রী নেকারের মতে, ফ্রান্সের গীর্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি লিভর। খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গীর্জার জমির ফসল চড়া মূল্যে বিক্রয় করে অনেক লাভ হত। গীর্জার এই বিপুল অর্থ উচ্চ যাজক বা বিশপ শ্রেণীই ভোগ করত। যাজক বা গীর্জার বৃহৎ সম্পত্তি ভোগ করা সত্ত্বেও যাজকদের কোনো কর দিতে হত না।

(ii) অভিজাত শ্রেণী

সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল অভিজাত শ্রেণী । ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের সংখ্যা ছিল তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। দেশের মোট জনসংখ্যার ১.৩ ভাগ ছিল অভিজাতরা। এরা ছিল বংশ মর্যাদার দাবিদার। স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায়ের। সুতরাং অভিজাতরাই সবসময় privilege ভোগ করত। অভিজাতরা প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। জন্মসূত্রে অভিজাত বা সাবেকি অভিজাত বা দরবারি অভিজাত বা অসিধারি অভিজাত (Nobility of the Sword)। রাজার মন্ত্রিপরিষদ, আইন পরিষদ, রাষ্ট্রদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলি ছিল এদের একচেটিয়া অধিকারে। দ্বিতীয় ভাগ হল কর্মসূত্রে বা পোশাকি অভিজাত। এরা টাকার বিনিময়ে প্রশাসনিক পদগুলি ক্রয় করে নিত। এদের হাতে প্রচুর সম্পত্তি থাকলেও ইচ্ছা মতো কর দিত।

(iii) তৃতীয় শ্রেণী

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী ব্যতীত ফ্রান্সের বাকি লোকেরা তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর প্রভৃতি সকলেই ছিল তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। তৃতীয় শ্রেণীকে Unprivileged বা সুবিধাহীন শ্রেণী বলা হয় । ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যার শতকরা ৯৩ ভাগই ছিল তৃতীয় শ্রেণী তথা Third state এর অন্তর্ভূক্ত । এরা সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও সবরকম কর দিতে তারা বাধ্য হত।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে অঁসিয়া রেজিম

আঁসিয়া রেজিম-এর অর্থ হল পূর্বতন সমাজ। ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তীকালে ফ্রান্স তথা ইউরোপের অধিকাংশ দেশে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তাকে ‘অঁসিয়া রেজিম’ বা পুরাতনতন্ত্র বা old regime বলা হয়।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর ফ্রান্স

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের অর্থনীতি ছিল ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ। বুরবোঁ রাজাদের দ্বারা পরিচালিত ফরাসি সরকার অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলে। বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা, রাজপরিবারের বিলাসিতা, ভ্রান্ত যুদ্ধ নীতি, প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি রাজকোশকে একেবারে শূন্য করে ফেলে। বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা দেখে পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তাঁর “ওয়েলথ অব নেশনস” গ্ৰন্থে তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলে অভিহিত করেছেন।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের করব্যবস্থা

বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের সমাজ অধিকারভোগী ও অধিকারহীন এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। দেশের ভূ-সম্পত্তির শতকরা ৪০ ভাগ সুবিধাভোগী দুই শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে বহাল ছিল। তাঁদেরকে কোনো কর দিতে হত না। যাজকরা ও অভিজাতরা কর দিত না বললেই চলে।

ফলে করের বোঝা গিয়ে পড়ে অধিকারহীন শ্রেণী অর্থাৎ কৃষক, কারিগর এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর। ফ্রান্সে তিনটি প্রধান কর ছিল — টেইলে বা ভূমি কর, ক্যাপিটেশন বা আয়কর এবং ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর।

কিন্তু ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী যথাক্রমে এক-দশমাংশ ও এক-পঞ্চমাংশ ভূ-সম্পত্তির মালিক। তাছাড়া ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজার সাথে যাজক শ্রেণীর পোইসির চুক্তি হওয়ায় রাজা তাদের উপর কর আরোপ করতে পারতেন না। অভিজাতরাও ক্যাপিটেশন বা আয়কর এবং ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর সুকৌশলে এড়িয়ে যেত। ইন্টেন্ডেন্ট নামক রাজকর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিবাজ।

তিনটি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ বেশ কিছু পরোক্ষ কর আদায় করত। রাজার কর আদায়ের একমাত্র উৎস ছিল তৃতীয় শ্রেণী ।

ফলে তৃতীয় শ্রেণী করের জোগান দিতে গিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। ফসলের এক-দশমাংশ টাইদ বা ধর্ম কর হিসেবে যাজকদেরকে দিতে হত। সামন্ত প্রভুদের জন্য করভি বা বিনা মজুরিতে কাজ করা, গম, যব ভাঙানো বা মদ তৈরির জন্য বানালিতে, পথ, সেতু ও খেয়াঘাট ব্যবহারের জন্য পেয়াজ, লবণ কর হিসেবে গ্যাবেলা প্রভৃতি কর ছিল বাধ্যতামূলক।

এভাবে তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর কতৃত্ব করতে থাকে ফরাসী বুরবোঁ রাজবংশ। কর বৃদ্ধির সাথে সাথে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি যেন প্রকট হয়ে ওঠে। চতুর্দিকে কর দিতে গিয়ে যখন নাজেহাল অবস্থা তখন বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন জনজীবনের নাভিশ্বাস আরো বাড়িয়ে তোলে ।

ফ্রান্সের রাজা ও রাজন্যবর্গের অমিতব্যয়ীতা

ফ্রান্সের অর্থনীতির ঘোর অন্ধকারময় দিক হল রাজকোষের যথেচ্ছ ব্যবহার। ঐতিহাসিক গুডউইনের মতে ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ; যাদের মধ্যে ১৬ হাজার কর্মচারী কেবল রাজপ্রাসাদের কাজের জন্যই বহাল ছিল। রাণী মারি আঁতোয়ানেতের খাস চাকরের সংখ্যা ছিল ৫০০। এইভাবে রাজপরিবারের অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য রাজাকে বহু অর্থ ঋণ করতে হয়।

ফরাসি বিপ্লবের যুদ্ধনীতি

স্পেন -এর উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭০২-১৩ খ্রিঃ), অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০-৪৮ খ্রিঃ), সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩ খ্রিঃ) ও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ফ্রান্সের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। ফ্রান্সের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার এটাও একটি কারণ হতে পারে । শুধু আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থমন্ত্রী নেকার ১০০ কোটি লিভর ঋণ নিয়েছিলেন। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজাকে ঋণের সুদের দরুণ ৩১ কোটি ৮০ লাখ লিভর ব্যয় করতে হত। এর সঙ্গে সরকারের অন্যান্য খরচ যুক্ত হলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ কোটি লিভর।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে রাজন্যবর্গের দূর্বলতা

রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রিঃ) বিলাসব্যসনে মগ্ন থেকে স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তিনি দম্ভের সাথে ঘোষণা করেছিলেন, “আমিই রাষ্ট্র” (I am the state.)।

তাঁর উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ছিলেন বিলাসী, অলস ও পরিশ্রমবিমুখ । “প্রজাপতি রাজা” বলে পরিচিত এই রাজা তাঁর রানীর প্রভাবাধীন ছিলেন । পঞ্চদশ লুইয়ের দূর্বলতার সুযোগে রানী প্রতিনিয়ত রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন।

এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রী ও অভিজাতদের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন। ঐতিহাসিক শেভিলের মতে, রাজার নামে অভিজাতরাই প্রশাসন চালাতে থাকেন।

এইভাবে ফরাসী রাজসভা স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতিতে রাজা পঞ্চদশ লুই বলেছিলেন, “আমার পরেই মহাপ্লাবন”।

ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন দুর্বল চিত্ত শাসক। তাঁর সময়ে রাজতন্ত্রে অবক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তিনি ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ। তিনি ছিলেন রাণী মারি আঁতোয়ানেতের প্রভাবাধীন। সেকারণে তিনি পত্নী, অভিজাত, সভাসদ ও মন্ত্রী কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। তাছাড়া তিনি নিজের ইচ্ছাকেই আইন বলে ঘোষণা করেন।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে দৈব রাজতন্ত্রের ধারণা

মধ্য যুগে খ্রিস্টান ধর্ম জগতের গুরু পোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বিরোধিতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা স্বর্গীয় অধিকার তত্ত্ব প্রচার করেন। ফ্রান্সের রাজার এই দৈব রাজতন্ত্রের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা স্বর্গীয় অধিকার নীতি মেনে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

রাজা বলতেন যে, তাঁর নিজের কাজের জন্য তিনি শুধু মাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়ী। ঐতিহাসিকদের ধারণায় ফরাসি রাজতন্ত্র ঐশ্বরিক অধিকার বলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফরাসি রাজারা নিজেদেরকে দেবতার প্রতিনিধি বলে প্রচার করতেন।

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য। সে সময় দার্শনিকরা মনে করতেন যে রাষ্ট্র ও সমাজের পশ্চাতে যে নিয়মগুলি কাজ করে তা শুধু আবিষ্কার করলেই চলবে না, তাকে প্রয়োজনমতো সংস্কারও করতে হবে। তাঁরা প্রাকৃতিক আইন ও যুক্তিবাদকেই গুরুত্ব দিতেন। ফরাসি জনগণের ভাবজগতে বিপ্লবের সঞ্চার করেছিলেন মূলত তিন জন ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু, ভলতেয়ার এবং রুশো।

মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫)

ফ্রান্সের প্রাক-বিপ্লব যে সমস্ত দার্শনিক মতবাদ প্রবর্তন করেছেন তাঁদের মধ্যে মন্তেস্কু ছিলেন অন্যতম। তাঁর মতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজ-বংশ ও অভিজাত শাসনব্যবস্থা ছিল যুক্তি বহির্ভূত। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বিমুখ এবং রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।

গণতন্ত্রে তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক। তিনি তার যুক্তিবাদী মনন দ্বারা ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ও শাসনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন।

তিনি ছিলেন ক্যাথলিক গির্জার ও রাজার সীমাহীন ক্ষমতার ঘোরবিরোধী। স্বর্গীয় ‘অধিকারপ্রাপ্ত রাজতন্ত্র’ তত্ত্বকে অস্বীকার করে তিনি এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরেন।

তিনি ‘Persian Letters’ নামক ব্যঙ্গাত্মক লেখার মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজের অন্যায় শ্রেণিবৈষম্যের প্রতি কটাক্ষপাত করেন। ‘The spirit of laws’ গ্রন্থে তিনি শাসনব্যবস্থার মধ্যে আইন বিভাগ, কার্যনির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেছেন।

তাঁর মতে, এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার একত্রীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও লোপ পায়। সুতরাং মন্তেস্কুর রচনা জনগণকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল।

তিনি স্বৈরতন্ত্রের যে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেন এবং বিকল্প হিসেবে ক্ষমতা বিভাজনের যে প্রস্তাব দেন তা সমকালীন যুগে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

মন্তেস্কু ফরাসি বিপ্লব দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তার লেখনী ফরাসি জনতার মননে ব্যাপক প্রতিঘাত সৃষ্টি করেছিল। এজন্য ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব-পরবর্তী সংবিধানে তার ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হয়।

ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)

ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান ছিলেন ভলতেয়ার। তার প্রকৃত নাম ফ্রাঁসোয়া ম্যারি অ্যারুয়েঁ। তিনি নাটক, কাব্য, ইতিহাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর লেখা গ্ৰন্থের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘কাঁদিদ’ ও ‘ফিলোসফিক্যাল ডিকশনারি’।

তাঁর লেখার লক্ষ্য ছিল চার্চের দোষ-ত্রুটি এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা। তিনি আপসহীনভাবে সামন্তপ্রথা ও খ্রিষ্টানধর্মের গৌড়ামিবিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী।

তাকে মানবজাতির ‘বিবেক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মনীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেন। তিনি ব্যঙ্গাত্মক লেখনীর মাধ্যমে গির্জার দুর্নীতি প্রকাশ করলে গির্জার প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও ভীতি কমে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি —

 “ঈশ্বর না থাকলে তাকে বানাতে হত। কেননা, প্রকৃতি বলছে ঈশ্বর আছে।”

জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ)

ফরাসি বিপ্লবের জনক, ঝড়ের পাখি ছিলেন রুশো। তিনি ফ্রান্সে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেন। সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল তার আদর্শ।

তিনি বিখ্যাত সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (Social Contract 1762) গ্রন্থে বলেন যে, শাসনক্ষেত্রে জনমত তথা জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু পরে সে সর্বত্রই শৃঙ্খলবদ্ধ’- রুশোর এই মতবাদ বিপ্লবীদের কল্পনার আগুনে ফুলকি ধরিয়ে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে রুশো ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত রুশো তার বিখ্যাত রচনায় এ সত্য প্রচার করেন যে, ঈশ্বর রাজা বা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেননি। আদিতে সব মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ও সুখী ছিল। জনসাধারণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস।

সুতরাং রাজা জনসাধারণের মতানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তার এ তত্ত্ব ইউরোপীয় চিন্তাজগতে এক বৈপ্লবিক চেতনার জন্ম দেয়। এ কারণে রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রগুরু বলা হয়ে থাকে।

ডেনিস দিদারো (Denis Diderot) 

ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন ডেনিস দিদারো। | তিনি বিশ্বকোষ রচনা করে ফ্রান্সে যুক্তিবাদী দৃষ্টি গঠনে সহায়তা করেছিলেন। এই গ্রন্থে মানুষের জ্ঞাতব্য সবকিছুই সন্নিবেশিত করা হয়েছিল এবং তদানীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনাও লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

মানুষের জন্মগত অধিকার, মানবধর্ম, শিক্ষা বিষয়ে তথ্যপূর্ণ লেখা ছিল এ গ্রন্থে, যা বঞ্চিত মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে উজ্জীবিত করে।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে অর্থনীতির সংস্কার

এই ফরাসি বিপ্লবের গতি যেমন ছিল বৈচিত্র্যময়, তেমনই ছিল ব্যাপকব্যাপক। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ লুইয়ের পর ষোড়শ লুই ফ্রান্সের রাজা হন। ষোড়শ লুই ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ রাজা।

পিতা ও পিতামহের ন্যায় তিনি স্বেচ্ছাচারী পথ অবলম্বন করেন। ক্রমাগত বহিঃশত্রুর মোকাবিলা ও সীমাহীন বিলাসিতার ফলে ফ্রান্সের রাজকোষ অচিরেই শূন্য হয়ে পড়ে ।

এসময় জনসাধারণের উপর করবৃদ্ধি করে ফ্রান্সের অচলাবস্থা মোচন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই টুর্গোকে নির্দেশ দেওয়া হয় আর্থিক সংস্কারের জন্য।

তিনি ফ্রান্সে অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন, গিল্ড উচ্ছেদ ও কৃষকদের উপর থেকে বিশেষ কর উচ্ছেদের ঘোষণা দিলে অভিজাতবর্গ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাঁদের চাপে রাজা টুর্গোকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন।

অতঃপর ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে নেকারকে টুর্গোর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি ফ্রান্সের ব্যয় সংকোচন নীতি প্রবর্তন ও ভূমি সংস্কারের চেষ্টা করেন । কিন্তু অভিজাতদের চাপের মুখে তিনিও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

নেকারের পদত্যাগের পর অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ক্যালোন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি সরকারের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর উপর কর ধার্যের প্রস্তাব করেন।

এছাড়া তিনি ‘করভি’ নামক বাধ্যতামূলক শ্রমদান নিষিদ্ধকরণ ও লবণ কর সকল শ্রেণীর উপর আরোপের প্রস্তাব দেন। তাঁর এ প্রস্তাব জনসাধারণের নিকট প্রশংসিত হলেও অভিজাতরা এর বিরোধিতা করেন। ষোড়শ লুই ক্যালোনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বিশিষ্ট অভিজাতদের সভা ডাকার নির্দেশ দেন ।

কিন্তু তাঁরা সুবিধাভোগী থাকায় এ প্রস্তাব মানতে রাজি হয় নি। নিরুপায় রাজা ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী ক্যালোনকে পদচ্যুত করেন। ক্যালোনের পরে অর্থমন্ত্রী করা হয় ব্রিঁয়াকে।

পরিস্থিতির চাপে তিনি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ব্রিঁয়া রাজার নির্দেশ অনুসারে আর্থিক সংস্কারের প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে পেশ করেন। কিন্তু এ প্রস্তাবও পার্লামেন্ট (ভারতীয় সংসদ নামে ভারতবর্ষে পরিচিত) নাকচ করে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে অভিজাত শ্রেণী তাঁদের স্বার্থ বহির্ভূত কর প্রস্তাব একের পর এক প্রত্যাখান করতে থাকে। কিন্তু সেই সময় ফ্রান্সের অর্থনীতি এতটাই করুণ অবস্থায় ছিল যে সকল শ্রেণীর উপর কর আরোপ ছাড়া কোনো পথ ছিল না। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকেন।

ফরাসি বিপ্লব কালে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন

সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর (১৬১৪-১৭৮৯ খ্রিঃ) পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ ই মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এই জাতীয় সভার আহ্বান এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ঐ দিন থেকেই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল বলা যেতে পারে।

এই সভায় যাজকদের সংখ্যা ছিল ৩০৮ জন, অভিজাতদের সংখ্যা ছিল ২৮৫ জন ও তৃতীয় শ্রেণীর সংখ্যা ছিল ৬২১ জন। কিন্তু সকল সদস্যদের একটি করে ভোট ছিল না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোনো লাভ হত না। কারণ অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর বিরোধিতার জন্য রাজা তৃতীয় শ্রেণীর দাবি-দাওয়া মানতে রাজি হতেন না।

টেনিস কোর্টের শপথ

কয়েকদিন অপেক্ষার পরেও রাজার কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না আসায় ১৭ জুন স্টেটস জেনারেলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ নিজেদেরকে জাতীয় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘোষণা করেন।

তাঁরা নিজেদের সভাকে জাতীয় পরিষদ নাম দেন এবং ঘোষণা করে যে, কর ধার্যের অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। এমতাবস্থায় অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর চাপের মুখে রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদেরকে দমন করতে উদ্যত হন। তিনি স্টেটস জেনারেলের সভাকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন।

তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ সভাকক্ষের তালা বন্ধ দেখে ক্ষুব্ধ হয়। তারা বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হন। সেখানেই তারা ঐতিহাসিক শপথ (২০ জুন ১৭৮৯ খ্রিঃ) নিয়ে বলেন যে, যতদিন তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে না পারবেন ততদিন পর্যান্ত তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন। এই শপথ টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত।

এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই ২৩ জুন স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডেকে জাতীয় সভার কর্মকাণ্ডকে বেআইনী বলে ঘোষণা করেন এবং প্রতিনিধি সভার তিনটি শ্রেণীকে পৃথক পৃথক কক্ষে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন। রাজার এ ঘোষণার ফলে সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

রাজার বক্তৃতা শেষ হলে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা কক্ষ ত্যাগ করেন নি। সভাগৃহে রাজার পরিচালক তাঁদেরকে সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বললে জননায়ক মিরাবো (Mirabeau) দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দেন,

“আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বল প্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছুতেই সম্ভব নয়।”

পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা শেষ পর্যন্ত তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিগণকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন। রাজা কতৃক জনসাধারণের দাবি মেনে নেওয়ার ফলে তাঁদের প্রাথমিক সাফল্য লাভ হয়। এভাবে প্যারিস নগরী বিপ্লবের মঞ্চে পরিণত হল।

এসময় ফ্রান্সের অন্যত্র কৃষির অবনতি ও প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ কাজ ও খাদ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। বুভুক্ষু নরনারী প্যারিসে রুটির দোকান ও কারখানাগুলোকে বিধ্বস্ত করতে থাকে। ইতিপূর্বে শহরে সশস্ত্র ডাকাত দলের আবির্ভাব ঘটে ও যত্রতত্র লুটতরাজ করতে থাকে।

রাজা ষোড়শ লুই প্যারিস নগরীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়। ভীতসন্ত্রস্ত রাজা আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিচলিত হয়ে ভার্সাই নগরীর নিকট সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। শুরু হয় জনতার সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ। শীঘ্রই প্যারিসের নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের হাতে চলে যায়।

বাস্তিল দুর্গের পতন

বাস্তিল দুর্গ ছিল ফ্রান্সের বুরবোঁ বংশীয় রাজাদের স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক। লেতর দ্য ক্যাশে আইনে বন্দী ফরাসিদের এখানে রাখা হত। উন্মত্ত জনতা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেয়।

তারা কারাগারের অধিকর্তা দ্যলুনেকে হত্যা করে বন্দিদের মুক্ত করে দেয়। বাস্তিল দুর্গের পতনের সাথে সাথে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমাধি প্রতিষ্ঠা হয়।

এরপর বিপ্লবীরা প্যারিসের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তারা ‘প্যারি কমিউন’ নামে অস্থায়ী পৌর পরিষদ গঠন করে। প্যারিস নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিপ্লবীরা ন্যাশনাল গার্ড নামে এক জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করে। প্যারিসের ন্যায় ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরণের কামিউন গঠিত হয়।

বাস্তিল দুর্গের পতন

যাজক ও অভিজাতদের পূর্বতন সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহার

বাস্তিল দুর্গের পতন -এর সাথে সাথে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এসময় গুজব রটে, শহর থেকে অভিজাতদের ভাড়াটিয়া লুটেরা শ্রেণী গ্রামগুলোর শস্যক্ষেত পুড়িয়ে দিচ্ছে।

ফলে কৃষকরা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয় ও তাদের সামন্ত প্রভুদের হত্যা করতে থাকে। কৃষকদের এই অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থানে যজক ও অভিজাত শ্রেণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশন বসে এবং ১১ আগস্ট একাধিক আইন পাশ করে ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী তাদের পূর্বতন সকল সুবিধা প্রত্যাহার করেন। এর ফলে পূর্বতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ও ফ্রান্সের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা হয় ।

ফরাসি-বিপ্লবে নারী

ফরাসি সমাজ ও পরিবারে পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার থাকলেও ফরাসি বিপ্লবে নারীসমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বিপ্লবের শুরু থেকে শেষ অবধি নারীরা ছিল পুরুষদের সঙ্গী, বন্ধু ও বিপ্লবী কাজকর্মের অংশীদার।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশন আহ্বানের মধ্য দিয়ে যে মহান ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তাতে পুরুষদের সঙ্গে মহিলারাও যুক্ত হয়ে পড়ে।

ঐতিহাসিক কার্লাইল (Carlyle) তাঁর  ‘The French Revolution’ গ্রন্থে  বিপ্লবে মহিলাদের অংশগ্রহণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

আবার ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই যখন জনতা বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে তখন বহু সাহসিনী মহিলা তাদের দুর্গ ভেঙে ফেলার জন্য উৎসাহ দিয়েছিল এবং নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছিল।

রুটির দাবিতে ৫-৬ অক্টোবর যে বিশাল জনতা মিছিল করে রাজা-রানিকে প্যারিসে ফেরাতে ভার্সাই গিয়েছিল, সেই মিছিলে কমপক্ষে ১০ হাজার মহিলা যোগদান করেছিল এবং সেই কাজে তারা সফলও হয়েছিল, এমনকি মহিলারা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনেও সক্রিয় ভূমিকা নেয়।

১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট টুইলারিস প্রাসাদ অবরোধের ক্ষেত্রে এবং ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সম্মেলনের অধিবেশনে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদের পক্ষেও মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

ফরাসি বিপ্লবকালে সংবিধানসভা বা বিপ্লবী আইনসভা ক্রীতদাসদের মুক্তিতে সচেষ্ট হলেও নারীর সামাজিক বা রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

ফলে নারীরা পুরুষের সমানাধিকার দাবি করে।। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের নারীসমাজের অধিকার ও প্রজাতন্ত্রের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য প্যরিসে ক্লেয়ার ল্যাকম্ব ও পাওলিন লেয় বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রী নারী’ সমিতি গঠন করেছিলেন।

বিপ্লবকালে বিপ্লবী নেতারা নারীদের রাজনৈতিক অধিকার ও যোগ্যতার প্রশ্নে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারলেও এ সময়ে নারীমুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

ফরাসি বিপ্লব কালে রাজতন্ত্রের শবযাত্রা

বিপ্লবের গতিধারা ক্রমশ অনমনীয় হয়ে ওঠে । বিপ্লবের ফলে প্যারিসের খাদ্য সংকট (Food Crisis) তীব্র আকার ধারণ করে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় খাদ্যাভাব চরমে পৌঁছলে ৫ অক্টোবর প্যারিসের কয়েক হাজার স্ত্রীলোক খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই নগরীর দিকে রওনা হয়।

এদের সঙ্গে লাফায়েতের নেতৃত্বে ২০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড ভার্সাইয়ে হাজির হয়। এই সময় লাফায়েৎ ২০ হাজার জাতীয় রক্ষীদের সাহায্যে উন্মত্ত জনতার কবল থেকে রাজপ্রাসাদ রক্ষা করেন। ষোড়শ লুই বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে জাতীয় পরিষদের সব আইনগুলিতে সম্মতি দেন।

অতঃপর নারী জোট ও লাফায়েতের নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষী বাহিনী রাজা, রাণী ও তাঁদের বালক পুত্রকে নিয়ে মিছিল করতে করতে প্যারিস নগরে আসে। এই ঘটনা ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা’ বলে পরিচিত।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন

সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামে জাতীয় সভার অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে ফ্রান্সের রাজকোষের অর্থাভাব ধরা পড়ে। এ দিক দিয়ে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের রাজা, মন্ত্রী ও অভিজাতদের দূর্বল দিক ফাঁস হয়ে যায়।

ফরাসি বিপ্লব কালে ফ্রান্সের জাতীয় তথা সংবিধান সভা

অতঃপর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাজার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা বিজিত হয়। কারণ ২৭ জুন ষোড়শ লুই তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন।

এ সময় হতেই জাতীয় সভা ফ্রান্সের জন্য নতুন সংবিধান রচনার কাজে ব্রতী হয়। ফলে জাতীয় সভা সংবিধান সভায় পরিণত হয়। সংবিধান সভা প্রাথমিক ভাবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে-

  • (১) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪-১১ আগস্ট সংবিধান সভা কতকগুলো বিধিবিধান সংযোজন করে সামন্ত প্রথা বিলুপ্ত করে।
  • (২) সংবিধান সভার দ্বিতীয় অবদান মানবাধিকার সনদ ঘোষণা । মূলত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও দার্শনিকদের রচনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এ সনদ রচনা করা হয়।

ফরাসি বিপ্লবের পরে রাজার ক্ষমতা

নতুন সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্স শাসন করার ক্ষমতা রাজা ও আইনসভার মধ্যে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। রাজাকে দেওয়া হয় মন্ত্রী নিয়োগের অধিকার। তবে আইনসভার কোনো সদস্যের মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আর থাকল না। এভাবে আইনসভা থেকে শাসন বিভাগকে আলাদা করা হয়।

নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাজা শুধু “ভেটো” (Suspensive Power) ব্যবহার করে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য কোনো আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখার ক্ষমতা লাভ করেন। প্রকৃতপক্ষে এই সংবিধানে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ করা হয় ।

ফরাসি বিপ্লবের পরে গঠিত আইনসভা

৭৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠন করা হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, যার মেয়াদ ধরা হয় ২ বছর। আইন প্রণয়নের পূর্ণ অধিকার লাভ করে আইনসভা।

ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী ফ্রান্সের শাসন বিভাগ

শাসনকার্যের সুষ্ঠু অধিকারের ভিত্তিতে পুরাতন প্রদেশ বাতিল করে ফ্রান্সকে ৮৩ টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক বিভাগ ও কয়েকটি জেলাকে ক্যান্টন ও কমিউনে বিভক্ত করা হয়। এভাবে সমগ্র ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস শুরু হয়।

ফরাসি বিপ্লবের পরে গীর্জার পুনর্গঠন

গীর্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও সংবিধান-সভা ফ্রান্সে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় সমাধানের জন্য ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে যাজকদের নাগরিক সংবিধান পাশ করে গীর্জার সকল স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করা হয়। গীর্জার ওপর থেকে পোপের সমস্ত কর্তৃত্বের অবসান ঘটান হয়।

ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন

সংবিধান সভা বন্ধের পর প্রথম সমস্যা নাগরিক সংবিধানের প্রতি যেসব যাজক অসম্মতি প্রদান করবে, তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভাতা, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বিদ্রোহী ধর্মযাজকদের উপর থেকে নাকচ করে নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।

দ্বিতীয় সমস্যা এমিগ্রি অর্থাৎ বহিরাগত অভিজাতদের বিদ্রোহ। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারীর মধ্যে তাদের ফিরে আসতে বলা হয়। যারা এই আদেশ অমান্য করবে তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

এই দুটি সিদ্ধান্ত রাজার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে তিনি ভেটো ক্ষমতাবলে নাকচ করে দেন। রাজার এই নিষেধাজ্ঞায় জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন গোষ্ঠী ক্রুদ্ধ হয়। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কর্ডেলিয়ান ক্লাবের লোকেরা ছিল উগ্রপন্থী। তাদের উস্কানীতে ফ্রান্সের উন্মত্ত জনতা ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করে।

এই আক্রমণের ফলে রাজা স্ব-নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হন। অস্ট্রিয়ার রাজা লিউপোল্ড তাঁর ভগ্নী ও ভগ্নীপতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন।

রাজা ষোড়শ লুই, রাণী মারি আঁতোয়ানেত ও তাঁদের বালকপুত্র ছদ্মবেশ ধরে পালিয়ে যান। কিন্তু সীমান্তের কাছে ভ্যারোন্নে গ্রামে রাজা সপরিবারে ধরা পড়ে। তীব্র ধিক্কার ও অপমানের মধ্য দিয়ে রাজা ষোড়শ লুই সপরিবারে প্যারিসে ফিরে আসেন।

এই সময় ব্রান্সউইক ঘোষণার দ্বারা অস্ট্রিয়ার সেনাপতি সতর্ক করে দেন, ফ্রান্সের রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি হলে তিনি বিপ্লবীদের কঠিন শাস্তি দেবেন। উগ্রপন্থীদের অভিযোগ করে যে রাজা দুটি শত্রু দেশ অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।

তাছাড়া পলাতক রাষ্ট্রদ্রোহী এমিগ্রি ও বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে রাজার গোপন যোগাযোগের গুজব ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রিয়ার সম্রাট, রাণী মারি আঁতোয়ানেতের ভ্রাতা লিওপোল্ড ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট পিলনিৎসের ঘোষণাপত্র দ্বারা বলেন যে যদি ইউরোপের সকল রাজশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ষোড়শ লুইকে রক্ষা এবং তাঁর হৃত ক্ষমতা পুনঃস্থাপনের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করবে।

এই ঘোষণার দ্বারা উগ্রপন্থী বিপ্লবীরা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তাঁরা রাজাকে বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করে ও রাজতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য মারমুখী হয়।

জিরন্ডিস্টদের চাপে বিধানসভা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেকরে। সভায় জিরন্ডিস্টরা “পিতৃভূমি বিপন্ন” এই ধ্বনি তুলে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে সদস্যদের ভোট পেয়ে যায়। ফলে রাজধানী প্যারিস বিপন্ন হয়ে পড়ে।

১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের বিপ্লবী কমিউনের নেতৃত্বে টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করা হয় এবং রাজার সুইস দেহরক্ষী দলকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। রাজা-রাণী প্রাণভয়ে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে আইনসভায় আশ্রয় নেন।

ক্ষিপ্ত জনতা আইনসভা ঘেরাও করে রাজতন্ত্র বাতিলের দাবি জানায়। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্র রদ করা হলে সকল রাজভক্ত পদত্যাগ করে। রাজতন্ত্রের এই উচ্ছেদকে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব আখ্যা দেন ।

ফরাসি বিপ্লবে রাজা ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ড

জাতীয় সম্মেলনের সামনে প্রধান কাজ ছিল সকল রাজতন্ত্রী ও ক্যাথলিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের দমন করা। বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের যে সংবিধান রচিত হয়েছিল তা বাতিল করা হয়।

ফলে আবার নতুন সংবিধান রচনা করা হয়। এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুইকে পদচ্যুত করা হয়। জনসাধারণ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাঁর প্রাণদণ্ডের পক্ষপাতী না হলেও জ্যাকোবিন দলের রোষের মুখে পড়ে ষোড়শ লুইকে গিলোটিন যন্ত্রে শিরোশ্ছেদ করা হয় (২১ জানুয়ারি ১৭৯৩ খ্রিঃ)।

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্স তথা সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রুশ বিপ্লব ছাড়া, সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের মতো এত ব্যাপক, গভীর ও সুদূরপ্রসারী বিপ্লব আর ঘটেনি।

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেন “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পূর্বে ফরাসি বিপ্লবকেই আধুনিক ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে অভিহিত করা যায়।

বিপ্লবের মূল আদর্শ ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী (Liberty, Equality and Fraternity) ফরাসি জনগণের মনে এই আদর্শ এমনই বদ্ধমূল হয়ে ছিল যে, তারা পরবর্তী সকল কর্মে এই আদর্শকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও আন্দোলনের বিস্তার হতে থাকে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, প্রাশিয়া, সাইলেসিয়া, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতালি, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, গ্রিস, বলকান প্রভৃতি অঞলে শুরু হয় জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ফরাসি বিপ্লব” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ)ফরাসি বিপ্লব হতে জিজ্ঞাস্য?

১. ফরাসি বিপ্লব কবে হয়েছিল ?

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ।

২. ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা কে ছিলেন?

বুরবোঁ বংশীয় রাজা ষোড়োশ লুই ।

৩. কবে রাজা ষোড়শ লুই এর প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়?

২১ শে জানুয়ারী, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ।

৪. ফরাসি বিপ্লবের জননী কে?

প্যারিস শহরকে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment