ফ্রান্সের সংবিধান সভা, সংবিধান সভার গঠন, বৈশিষ্ট্য, সংবিধান প্রণয়ন, সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি, হ্যম্পসন ও রাইকারের মন্তব্য এবং ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ঘোষণা সম্পর্কে জানবো।
ইউরোপে ফ্রান্সের সংবিধান সভা
বিষয় | ফ্রান্সের সংবিধান সভা |
টেনিস কোর্টের শপথ | ২০ জুন, ১৭৮৯ |
সংবিধান সভা | ৯ জুলাই, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ |
সংবিধান রচনাকাল | ১৭৮৯-১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ |
রচয়িতাগণ | মুনিয়ের, মিরাবো, আবেসিয়েস, রোবসপিয়ার |
সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি | ৪ আগস্ট, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ |
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারে | ২৬ আগস্ট, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নিজেদের সভাকে ‘জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করেন। ২০শে জুন ‘টেনিস কোর্টের শপথ‘-এর মাধ্যমে এই সভা ফ্রান্স -এর জন্য একটি সংবিধান রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
সংবিধান সভার গঠন
২৭শে জুন থেকে তিনটি শ্রেণির যৌথ অধিবেশন বসে এবং ৯ই জুলাই থেকে ‘জাতীয় সভা’ ‘সংবিধান সভা’-য় রূপান্তরিত হয়। এই সংবিধান সভার কাজ হয় ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান তৈরি করা। এইভাবে ফরাসি বিপ্লব -এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
ইউরোপে ফ্রান্সের সংবিধান সভার বৈশিষ্ট্য
সংবিধান সভার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
- (১) এই সভার সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি – আইনজীবী, ব্যবসায়ী, পূর্বতন সরকারি কর্মচারীরাই ছিলেন এই সভার মূল চালিকা শক্তি। শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন সংখ্যালঘু।
- (২) অধ্যাপক কোবান প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সভায় আইনজীবীদের সংখ্যা ছিল ২০%, চাকুরিজীবী ৫%, বণিক ও শিল্পপতি ১৩% এবং কৃষক প্রতিনিধি ছিল ৭-৯%।
- (৩) এই সভায় ৫০ জন প্রগতিশীল সদস্য, ৪৪ জন বিশপ এবং ২০০ জন নিম্ন যাজক ছিলেন। বুর্জোয়া সম্প্রদায়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং তাদের স্বার্থেই এই সভার পরিচালিত হয়।
- (৪) সভার সদস্যরা যথেষ্ট শিক্ষিত ও দার্শনিকদের রচনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এই কারণে এই সভার কাজকর্মে দার্শনিক তত্ত্বের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
- (৫) সভার সদস্যরা ছিলেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। সভাপতির নির্দেশ পালন করে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করার শিক্ষা তাদের ছিল না। সদস্যদের পারস্পরিক বিবাদ, ঈর্ষা, দলগত দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই সংবিধান সভাকে একটি বিশৃঙ্খল জনসভায় পরিণত করে।
ফ্রান্সের সংবিধান সভা কর্তৃক সংবিধান প্রণয়ণ
- (১) মুনিয়ের, বারনেড, লাফায়েৎ, মিরাবো, ট্যালিরাণ্ড, অ্যাবে সিয়েস, রোবসপিয় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই সংবিধান রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
- (২) ১৭৮৯ থেকে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দপর্যন্ত দু’বছরের চেষ্টায় সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একট সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধান ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান নামে পরিচিত।
- (৩) এটি ছিল ফ্রান্সের প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানের মাধ্যমে ফ্রান্সে প্রচলিত মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়।
ইউরোপে ফ্রান্সের সংবিধান সভা কর্তৃক সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি
- (১) মূল সংবিধান রচনার আগে সংবিধান সভা দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এই সময় গ্রামাঞ্চলে প্রবল কৃষক বিদ্রোহ চলছিল। এই অবস্থায় ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা আগস্ট সংবিধান সভা এক ঘোষণা মারফত ফ্রান্সে সামন্তপ্রথা ও তার সমস্ত উপস্বত্ব বিলোপ করে।
- (২) এই ঘোষণায় সামন্তপ্রথা, ভূমিদাস প্রথা, সামন্তকর,’কর্ভি’ বা বেগার খাটা, ‘টাইদ’ বা ধর্মকর এবং সামন্ত শ্রেণির সমস্ত বিশেষ অধিকার ও মর্যাদা লোপ করা হয়। এই ঘোষণা মারফত সামন্ত প্রথা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত না হলেও তার অনেকটাই বিলুপ্ত হয়।
ফ্রান্সের সংবিধান সভা সম্পর্কে হ্যাম্পসন ও রাইকারের মন্তব্য
নর্মান হ্যাম্পসন (N. Hampson বলেন যে, জাতীয় সভা অনেকটাই এগিয়েছিল, কিন্তু যতদুর যাওয়া দরকার ছিল তাঁ যায় নি। এই ত্রুটিগুলি দূর করার জন্য ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ই নভেম্বর এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কয়েকটি আইনের মাধ্যমে সংবিধান সভা পুরাতনতন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলে। ঐতিহাসিক রাইকার এই ঘটনাকে ‘পুরাতনতন্ত্রের কবর রচনা বলে অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সের সংবিধান সভা কর্তৃক ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র
- (১) সংবিধান সভার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কাজ হল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে আগস্ট ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ঘোষণা’।
- (২) ইংল্যান্ড -এর ম্যাগনা কার্টা, বিল অফ রাইটস্, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (১৭৭৬ খ্রিঃ) এবং সাধারণভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানদীপ্ত দার্শনিক মতবাদের অনুকরণে রচিত এই ঘোষণাপত্রটিকে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের মুখবন্ধ বলা যায়।
- (৩) এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, আইনের চোখে সবাই সমান, বাক্-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা,ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের অধিকার প্রভৃতি হল মানুষের সর্বজনীন অধিকার এবং জনগণই হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
- (৪) কেবলমাত্র ফ্রান্স নয়, এই ঘোষণাপত্রে সমগ্র মানবজাতির অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এর আবেদন সর্বজনীন। ফ্রান্স ও ইউরোপ -এর নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ এর মধ্যে মুক্তির অধিকার খুঁজে পায় এবং এই ঘোষণাপত্র ফ্রান্স ও ইউরোপের সর্বত্র আশার সঞ্চার করে।
- (৫) লর্ড অ্যাক্টন (Lord Acton)-এর মতে, এই ঘোষণাপত্রটি ‘নেপোলিয়ন -এর সমগ্র বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী ছিল।’ ঐতিহাসিক ওলার (Aulard) বলেন যে, এই ঘোষণাপত্রটি ছিল ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু-পরোয়ানা।
- (৬) জর্জ রুদে-ও অনুরূপ মন্তব্য করে বলেন যে, “এটি হল পুরাতনতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক।” কোবান-এর মতে, এটি ছিল “বিশেষ সুবিধা ও পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা।”
উপসংহার :- ঐতিহাসিক কোবান -এর মতে, সংবিধান সভা কর্তৃক ব্যক্তি ও নাগরিকের ঘোষণাপত্র ইউরোপের সর্বত্র নব যুগের আগমনবার্তা ঘোষণা করে। ঐতিহাসিক লেফেভর বলেন যে, ফরাসি বিপ্লবের কালজয়ী আবেদনের সূচনা হয়েছিল এই ঘোষণাপত্রটির মাধ্যমে।
(FAQ) ফ্রান্সের সংবিধান সভা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৯ জুলাই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ।
মুনিয়ের, লাফায়েত, মিরাবো, আবেসিয়েস, রোবসপিয়ার।
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট।