হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও -র জন্ম, পিতামাতা, শিক্ষা, ধর্মতলা একাডেমির প্রভাব, কর্মজীবন, নব্যবঙ্গ দল গঠন, হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন, যুক্তিবাদী মন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা, পত্রিকা প্রকাশ, স্বদেশ প্রেম, তার পদচ্যুতি, প্রভাব, মৃত্যু ও তার সম্মাননা সম্পর্কে জানবো।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
জন্ম | ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ |
পেশা | শিক্ষক, কবি ও নৃত্যশিল্পী |
পরিচিতি | কবি, যুক্তিবাদী, চিন্তাবিদ, শিক্ষকও নব্যবঙ্গ দলের নেতা |
মৃত্যু | ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১ (বয়স ২২) |
ভূমিকা :- ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।
জন্ম
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে এক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের প্রায় সমসাময়িক ছিলেন।
পিতামাতা
তার পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও ছিলেন একজন খ্রিস্টান ইন্দো-পর্তুগিজ অফিস কর্মী।তার মাসোফিয়া জনসন ডিরোজিওছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। তার আসল পারিবারিক নাম ছিল ‘ডি রোজারিও’।
শিক্ষা
ডিরোজিও ডেভিড ড্রুমন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমি স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছিলেন।এখানে তিনি ছয় থেকে চোদ্দো বছর পর্যন্ত একজন ছাত্র ছিলেন।
ধর্মতলা অ্যাকাডেমির প্রভাব
তিনি ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে শিক্ষালাভ করেন।ড্রামন্ডের যুক্তিবাদও মানবতাবাদের দ্বারা ডিরোজিও যথেষ্ট প্রভাবিত হন।
কর্মজীবন
- (১) কাজ করার জন্য ডিরোজিওকে ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল।তিনি প্রথমে তার পিতার কলকাতা কার্যালয়ে যোগদান করেন।
- (২) পরবর্তীকালে তিনি তার কাকার ভাগলপুর নীল কারখানায় বদলি হয়েছিলেন।
- (৩) গঙ্গা নদী তীরের সুন্দর দৃশ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন।এগুলি তিনি ইন্ডিয়া গেজেট পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজ
এই সময় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যারা হিন্দু আদর্শকে মানলেও পৌত্তলিকতাকে অস্বীকার করেছিল।
নব্যবঙ্গ দল
ডিরোজিওর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গলদল। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে এবং মিল, বেন্থাম, টম পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের রচনা পাঠের ফলে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর তরুণ সদস্যদের মনে যুক্তিবাদ ও সামাজিক চেতনা জেগে ওঠে।
নব্যবঙ্গ আন্দোলন
ডিরোজিওর নেতৃত্বে এই তরুণরা সমাজের পুরোনো সব কিছুরই সমালোচনা করেন এবং প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের আন্দোলন ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’নামে পরিচিত। নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ডিরোজিও।
হিন্দু কলেজের অধ্যাপক
নিজ প্রতিভাবলে তিনি ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কবি, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
যুক্তিবাদী মন
- (১) জাতীয়তাবাদের মন্ত্রগুরু রাজা রামমোহন রায় ভারতে যে যুক্তিবাদের বীজ বপন করেন ডিরোজিও সেটিকে মহিরুহে পরিণত করার চেষ্টা করেন।
- (২) ডিরোজিও বিনা বিচারে কিছুই মানতেন না। ছাত্রদের প্রেরণা : তিনি ছাত্রদের অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী ও সত্যসন্ধানী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।
- (৩) শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে শিক্ষক ডিরোজিও সম্পর্কে লিখেছেন যে, “চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তেমনি তিনিও বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন।”
সংস্কার কর্মসূচি
ডিরোজিও ভারতীয় সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন এবং তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম ও যুক্তিবাদ সম্প্রসারিত করেন। তিনি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে বলেন এবং কোনো কিছুই বিনা বিচারে গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা
তিনি ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মানিকতলায় ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
ডিরোজিওর ছাত্রদের লক্ষ্য
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে ডিরোজিও-র ছাত্ররা প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করত। জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা, সতীদাহ ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম তাঁদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল।
পত্রিকা প্রকাশ
- (১) ডিরোজিও-র অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ছিল ‘এথেনিয়াম’। ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্ররা মিলে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘পার্থেনন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে স্ত্রীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
- (২) ডিরোজিও-র উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ পত্রিকা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এ ছাড়া তিনি ‘হেসপেরাস’ ও ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
স্বদেশ প্রেম
ডিরোজিও-র বিভিন্ন রচনায় ভারতের প্রতি তাঁর গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘ফকির অব জঙ্গিরা’ এবং ‘ভারতবর্ষ, আমার স্বদেশের প্রতি ‘ (To India My Native Land) তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি দেশপ্রেমমূলক কবিতা।
রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া
ডিরোজিও ও তার নব্যবঙ্গ দলের উগ্ৰ কার্যকলাপ রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুরা ভালো চোখে দেখে নি।
ডিরোজিও-র পদচ্যুতি
ডিরোজিও-র অনুগামীদের হিন্দুধর্ম-বিরোধী বিভিন্ন মতামত ও কার্যকলাপ হিন্দুসমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল হিন্দুদের চাপে হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ ডিরোজিও-কে চাকরি থেকে পদচ্যুত করেন।
মৃত্যু
চাকরি থেকে পদচ্যুত হওয়ার কিছুদিন পর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এই মহামানব ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রভাব
ডিরোজিওর ধারণা উনিশ শতকের প্রথমদিকের আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যাকে বলা হয়েছিল বাংলার নবজাগরণ।
সম্মাননা
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর ডিরোজিয়োর নামে একটা স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল।
উপসংহার :- নবাব সিরাজ উদ্দৌলার মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।এরপর ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনে চলে এলো বাঙালিরা, তখনকার ভারতবাসীরা।প্রায় সব ইংরেজই যখন কোনো না কোনোভাবে বাঙালিকে হাতিয়ে নিতে চায় তখন পশ্চিমা কিছু মানুষ ব্যতিক্রম ছিলেন, যারা বাঙালির উন্নতিই চেয়েছিল। এরই মধ্যে অন্যতম হলেন এই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।
(FAQ) হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে।
জুডেনিস।
ধর্মতলা একাডেমী।
নব্যবঙ্গ দল প্রতিষ্ঠা।