ব্রাহ্ম সমাজ

রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সভার ব্রাহ্ম সমাজে রূপান্তর, লক্ষ্য, বিভাজন, আদি ব্রাহ্ম সমাজ, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ, হিন্দুধর্মে বাল্যবিবাহ বিরোধী ব্রাহ্ম আন্দোলন ও অন্যান্য অবদান।

রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজ

বিষয়ব্রাহ্ম সমাজ
প্রতিষ্ঠাকাল১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ
প্রতিষ্ঠাতারাজা রামমোহন রায়
উল্লেখযোগ্য নেতাদেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী
উদ্দেশ্যসমাজ সংস্কার
ব্রাহ্ম সমাজ

ভূমিকা :- ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের তেজোদ্দীপ্ত সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ভারতীয় সমাজ, ধর্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। ভারত -এর বিভিন্ন মনীষী ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের গ্লানিগুলি দূর করতে প্রয়াসী হন। তাদের মধ্যে অন্যতম রামমোহন ও তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ।

আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা

বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র পাঠের ফলে রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠাকরেন এবং একেশ্বরবাদের পক্ষে জোর প্রচার চালান।

ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা

১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্মসভা’-র নাম হয় ‘ব্রাহ্ম সমাজ’।

ব্রাহ্ম সমাজের লক্ষ্য

কেবলমাত্র ধর্মসংস্কারই নয়, রামমোহন-প্রবর্তিত ব্রাহ্ম আন্দোলন-এর লক্ষ্য ছিল মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি।তাই ধর্মসংস্কারের পাশাপাশি ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা-সংক্রান্ত আন্দোলনেও অবতীর্ণ হয়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ

  • (১) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্ম সমাজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁর সুহৃদ দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিলে ব্রাহ্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়।
  • (২) রামমোহন রায় তাঁর ধর্মমতকে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়রূপে গড়ে তুলতে চান নি। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী যে কোনও মানুষ ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এ আসতে পারতেন।
  • (৩) দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি বিশেষ ধর্মমত এবং ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-কে একটি বিশেষ সম্প্রদায় রূপে গড়ে তোলেন।
  • (৪) নানা নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন আচার-আচরণ ও দীক্ষাদান রীতির প্রবর্তন করে তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি সংগঠিত ধর্মীয় রূপ দেন এবং প্রথম ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন।
  • (৫) তিনি ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান-পদ্ধতি’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বেদকে অপৌরুষেয় বলে মনে করতেন।
  • (৬) খ্রিস্টান পাদরি ও উগ্র-পাশ্চাত্য পন্থীদের হিন্দুধর্মের ওপর অযৌক্তিক আক্রমণের তিনি তীব্র সমালোচনা করেন।
  • (৭) তাঁর উদ্যোগে স্থাপিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা” (১৮৩৯ খ্রিঃ) এবং ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা‘ (১৮৪৩ খ্রিঃ) বাংলার শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে।
  • (৮) ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ছিল দলমত নির্বিশেষে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মিলনকেন্দ্র। বিদ্যাসাগরঅক্ষয়কুমার দত্ত -এর মতো বুদ্ধিজীবীরা এখানে সমবেত হতেন।
  • (৯) তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় সমকালীন কুসংস্কার-বিরোধী মতামত প্রকাশিত হত।
  • (১০) ব্রাহ্ম সমাজ’-এর আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যুবকদের শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিযুক্ত হন।
  • (১১) তাঁর আমলে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ শিক্ষাবিস্তার ও বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণ ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কার দূর করার কর্মসূচি গ্রহণ করে।
  • (১২) সামাজিক কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমাজ উন্নতি-বিধায়নী সুহৃদ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (১৩) সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন‘ -এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন।

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ

  • (১) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তরুণ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন নব বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
  • (২) তাঁর নিষ্ঠা, ধর্মোন্মাদনা, বাগ্মিতা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে বহু শিক্ষিত যুবক দলে দলে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করে। তিনি অচিরেই তরুণ ব্রাহ্মদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।
  • (৩) তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ।
  • (৪) তাঁর সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক ও আচার্য পদে বরণ করেন।
  • (৫) তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে এবং নারীশিক্ষার প্রসার, নারী স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ ও শ্রমিক কল্যাণের পক্ষে দেশে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
  • (৬) তাঁর উদ্যোগে ‘ব্রাহ্মবন্ধু সভা’ (১৮৬০ খ্রিঃ), ‘সঙ্গত সভা’ (১৮৬০ খ্রিঃ) ও ‘ক্যালকাটা কলেজ’ (১৮৬২ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ (১৮৬১ খ্রিঃ) পত্রিকার প্রকাশ তাঁর অন্যতম কীর্তি।
  • (৭) নারী কল্যাণের জন্য তিনি ‘বামাবোধিনী সভা’ (১৮৬৩ খ্রিঃ) ও ‘ব্রাহ্মিকা সমাজ’ (১৮৬৫ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই উদ্দেশ্যে ‘পরিচারিকা’ ও ‘বামাবোধিনী পত্রিকা‘ (১৮৬৩ খ্রিঃ) প্রকাশিত হয়।
  • (৮) তিনি ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৬৪ খ্রিঃ) ও সুলভ সমচার পত্রিকা প্রকাশ করেন। কেবল বাংলার অভ্যন্তরেই নয়, বোম্বাই (১৮৬৪ খ্রিঃ), মাদ্রাজ (১৮৬৪ খ্রিঃ), উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশের একাংশ) প্রভৃতি অঞ্চলেও তিনি ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আদর্শ বিস্তৃত করেন।
  • (৯) ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার -এর মতে, কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনই হল “প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন’ (“… this was the first all – India movement.”)।
  • (১০) ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন মাত্র ৫০০ জন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তা দাঁড়ায় ২০০০-এ। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৫০টি, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ২টি, পাঞ্জাবে ১টি ও মাদ্রাজে ১টি।অর্থাৎ সারা ভারতে ব্রাহ্ম সমাজের মোট ৫৪ টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেশবচন্দ্র সেনের বহিষ্কার

অচিরেই কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন তরুণ ব্রাহ্মদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিরোধ বাধে। অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ, ব্রাহ্ম আচার্যদের উপবীত গ্রহণ ও সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ প্রভৃতি প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথের রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ করায় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ থেকে বহিষ্কৃত হন।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ

কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন

আদি ব্রাহ্ম সমাজ

  • (১) দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম সমাজ ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ” নামে পরিচিতি লাভ করে। একেশ্বরবাদী হলেও দেবেন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্মই, হিন্দুদের জন্যই এই ধর্ম এবং তা হল হিন্দুধর্মের বিশুদ্ধ রূপ।
  • (২) তিনি মূর্তিপূজা ব্যতীত হিন্দু সমাজ ও ধর্মের জাতিভেদ বা অপর কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে ব্রাহ্মধর্ম হল ধর্মীয় আন্দোলন- তিনি সমাজ সংস্কারকে এই আন্দোলনের অঙ্গীভূত করতে রাজি ছিলেন না।

কেশবচন্দ্র সেন ও তার ব্রাহ্ম ধর্ম

কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীদের কাছে ব্রাহ্মধর্ম হল সমন্বয়ী ও সার্বজনীন। কেবলমাত্র পৌত্তলিকতাই নয়, তাঁরা সমভাবেই জাতিভেদ ও অপরাপর সামাজিক কুপ্রথার বিরোধী ছিলেন এবং তাঁদের কাছে ব্রাহ্মধর্ম নিছক একটি ধর্মীয় আন্দোলন নয়- সমাজ সংস্কারও তাঁর অঙ্গীভূত।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের কার্যাবলী

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ বিধবা বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, অসবর্ণ বিবাহ, সুলভ সাহিত্য প্রচার, নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাবিস্তার, পতিতা মেয়েদের উদ্ধার ও নানা জনহিতকর কার্যাবলীর পক্ষে এবং বাল্যবিবাহ, মদ্যপান ও পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।

ভারতীয় ব্রাহ্ম সমাজের পত্রিকা প্রকাশ

সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ প্রচারের জন্য এক পয়সা দামের পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’, শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য ‘ভারত শ্রমজীবী, শ্রমিকদের মধ্যে মদ্যপান নিবারণের জন্য এক পয়সা দামের পত্রিকা ‘মদ না গরল’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

তিন আইন পাশ

মূলত ব্ৰাহ্ম সমাজের আন্দোলনের ফলেই ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার বিখ্যাত তিন আইন’ পাশ করে এবং তার দ্বারা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য

কেশবচন্দ্রকে যে সব তরুণ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— শিবনাথ শাস্ত্রী, রামকুমার বিদ্যারত্ন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্ৰনাথ বসু প্রমুখ।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরে বিতর্ক

ইতিমধ্যে কয়েকটি নীতিগত প্রশ্নে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের’ অভ্যন্তরে প্রবল বিতণ্ডার সূচনা হয়। কেশবচন্দ্রের খ্রিস্ট-প্রীতি, ইংরেজ-প্রীতি, শ্রীচৈতন্য-প্রীতি, গুরুবাদ ও ভক্তিবাদে আকর্ষণ এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব -এর সান্নিধ্যে এসে হিন্দু দেবদেবী ও অনুষ্ঠানের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ব্রাহ্ম সমাজে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

কেশবচন্দ্র সেনের কীর্তিকলাপ

  • (১) ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ অনুযায়ী স্ত্রীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে এবং বাল্যবিবাহের বিপক্ষে প্রচার চালানো সত্ত্বেও তিনি পর্দাপ্রথা সম্পূর্ণভাবে উঠিয়ে দেওয়া, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নারীদের উচ্চতর শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন।
  • (২) নীতিগতভাবে বাল্যবিবাহ ও হিন্দুবিবাহ পদ্ধতির বিরোধী হয়েও তিনি হিন্দুমতে নিজ চতুর্দশবর্ষীয়া নাবালিকা কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কুচবিহারের নাবালক হিন্দু রাজপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দেন।
  • (৩) ‘নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে পাত্রের বয়স ১৮ এবং পাত্রীর বয়স ১৬ হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী উভয়েই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন।

সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ

বিভিন্ন কারণে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্ম বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তাঁরা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই মে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শে কেশবচন্দ্র তাঁর নববিধান ঘোষণা করেন এবং তাঁর ব্রাহ্ম সমাজ ‘নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য

এই নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ ও কেশবচন্দ্র সেনের সহযোগী ছিলেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, অঘোরনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের পতন

কালক্রমে কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত ‘নববিধান’ তার প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে এবং ‘সাধারণ ব্রাহ্মা সমাজ’-এর নেতৃত্বেই ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের কাজ চলতে থাকে।

ব্রাহ্ম সমাজের অবদান

ভারতীয় জনজীবনে ব্রাহ্ম সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। যেমন –

  • (১) কুসংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বুকে ব্রাহ্ম সমাজই প্রথম আঘাত হানে। নারী স্বাধীনতা ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, অসবর্ণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন, শিক্ষাবিস্তার, হরিজন উন্নয়ন, অস্পৃশ্যতা নিবারণ, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ, মদ্যপান নিবারণ, পর্দাপ্রথা রদ প্রভৃতি বিষয়ে ব্রাহ্মা সমাজের ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ।
  • (২) মূলত ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবেই বিখ্যাত ‘তিন আইন’ পাশ করে বাল্যবিবাহ ও পুরুষের বহুবিবাহ রদ এবং বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ করা হয়। তাঁদের আন্দোলনের ফলেই ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজের কুসংস্কারগুলি বিলুপ্ত হতে থাকে।
  • (৩) সাধারণ মানুষ ও শ্রমজীবীদের দুর্দশা লাঘবেও ব্রাহ্ম সমাজ সচেষ্ট ছিল।এই বিষয়ে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রামকুমার বিদ্যারত্ন, শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী ও কৃষ্ণকুমার মিত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।
  • (৪) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ‘সঙ্গত সভা’ প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়িত মানুষের জন্য জনসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (৫) ব্যক্তিস্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য, মানুষের মর্যাদা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির গণতন্ত্রীকরণের কথা বলে ব্রাহ্ম সমাজ জনমনে এক নতুন চেতনার সঞ্চার করে। ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, “ব্রাহ্ম সমাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।”
  • (৬) জাতীয় জাগরণে ব্রাহ্ম সমাজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম এবং এই প্রতিষ্ঠান ভারতকে বহু উল্লেখযোগ্য নেতা উপহার দিয়েছিল।

উপসংহার :- ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ইলিয়ট ব্রাহ্ম আন্দোলনকে ‘আগ্নেয়গিরি‘-র সঙ্গে তুলনা করে মন্তব্য করেন যে, এই আন্দোলন যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা আমাদের (ব্রিটিশদের) ভারতীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

(FAQ) ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্রের নাম কি?

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।

২. আদি ব্রাহ্মসমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?

রাজা রামমোহন রায়।

৩. ব্রাহ্মসমাজ কি?

উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ছিল ব্রাহ্ম সমাজ।

৪. নববিধান কে প্রতিষ্ঠা করেন?

কেশবচন্দ্র সেন।

৫. ব্রাহ্ম সমাজ কবে গড়ে ওঠে?

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে।

৬. আদি ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে কে ছিলেন?

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৭. ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ কখন কাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ও তার অনুগামীরা।

৮. নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে কে ছিলেন?

কেশবচন্দ্র সেন।

Leave a Comment