রামকৃষ্ণ দেব (Ramakrishna Dev)

যুগাবতার শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (Sri Ramakrishna Paramahamsa Dev) – র জীবনী প্রসঙ্গে জন্ম পরিচয়, পিতা-মাতা, গদাধর নামকরণ, শৈশব, শিক্ষা জীবন, আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা, কলকাতা আগমন, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণ নামকরণ, মা কালীর নিকট নিজেকে সমর্পণ, বিবাহ, সাধনা, রামকৃষ্ণ দেবের প্রভাব, তার শেষ জীবন ও মহাপ্রয়াণ।

বঙ্গীয় নবজাগরণের পুরোধা পুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রসঙ্গে তার ঈশ্বরের অবতার রামকৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ দেবের জন্ম পরিচয়, জন্মস্থান, পিতা মাতার নাম, শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির, গদাধর নামকরণের কারণ, রামকৃষ্ণ দেবের শৈশব জীবন, শিক্ষাজীবন, আধ্যাত্মিক ভাব তন্ময়তা, পিতৃবিয়োগ, কলকাতা আগমন, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত রামকৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ নামকরণ, দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দেখার আকুলতা, মায়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ, রামকৃষ্ণ দেবের বিবাহ, সাধনা, রামকৃষ্ণ দেবের গুরু ভৈরবী ব্রাহ্মণী, রামকৃষ্ণের বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধনা, গুরু তোতাপুরি, বৈদান্তিক সাধনা, খ্রিস্টমতে সাধনা, রামকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী সারদা দেবী, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ঘণিষ্ঠতা, রামকৃষ্ণ ও কেশবচন্দ্র, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামকৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ দেবের শিষ্য, রামকৃষ্ণ দেবের শেষ জীবন, রামকৃষ্ণ দেবের মহাপ্রয়ান, রামকৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর কারণ, রামকৃষ্ণের উপদেশ, রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতামত।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবন কাহিনী (Life story of Ramakrishna Paramahansadeva in Bengali)

মনীষীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব
জন্ম১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬, কামারপুকুর, হুগলি
প্রকৃত নামগদাধর চট্টোপাধ্যায়
দর্শনঅদ্বৈত বেদান্ত, ভক্তি, তন্ত্র
আখ্যাপরমহংস
বিশিষ্ট শিষ্যস্বামী বিবেকানন্দ
মৃত্যু১৬ আগস্ট, ১৮৮৬ (বয়স ৫০)
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী

ভূমিকা :- রামকৃষ্ণ পরমহংস ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু।

বঙ্গীয় নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ  

স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ পরমহংস উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণ -এর এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব।

ঈশ্বরের অবতার রামকৃষ্ণ পরমহংস

তার শিষ্যসমাজে, এমনকি তার আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম পরিচয়

পশ্চিমবঙ্গ -এর হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের পিতা ও মাতা

তিনি ছিলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান।

শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির

কামারপুকুর গ্রামের একটি ছোটো কুটিরে রামকৃষ্ণ পরমহংস বাস করতেন। বামদিকে পারিবারিক ঠাকুরঘর আর ডানদিকে তাঁর জন্মস্থল যার উপর বর্তমানে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরটি স্থাপিত।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মস্থান কামারপুকুর

কামারপুকুর শহরের চাকচিক্য দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল না এবং এখানে ধানের ক্ষেত, লম্বা-লম্বা তাল গাছ, রাজকীয় বটগাছ, কয়েকটি হ্রদ এবং দুটি শ্মশান ছিল।  

রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম নিয়ন্ত্রণ কিংবদন্তি

একটি কিংবদন্তিতে আছে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জন্মের পূর্বে তাঁর পিতামাতার সম্মুখে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণি দেবী দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গদাধর নামকরণের কারণ

রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর।

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শৈশব জীবন  

শৈশবে গদাই নামে পরিচিত গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তাঁর ছিল সহজাত দক্ষতা।

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিক্ষাজীবন

  • (১) প্রথাগত শিক্ষায় রামকৃষ্ণ পরমহংসের আদৌ মনোযোগ ছিল না। সেযুগে ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন।
  • (২) পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তার ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তার আগ্রহের অন্ত ছিল না। গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি অনায়াসে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
  • (৩) তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন গদাধর।
  • (৪) মাতৃভাষা বাংলায় তার অক্ষরজ্ঞান ছিল। কিন্তু সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।
  • (৫) পুরীর পথে কামারপুকুরে বিশ্রামরত সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্মীয় বিতর্ক মন দিয়ে শুনতেন গদাধর।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা দেখা দিত।

  • (১) একবার ধানক্ষেতের পথে চলতে চলতে আকাশে কালো মেঘের পটে সাদা বলাকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি বাহ্যজ্ঞানরহিত হন। পরবর্তীকালে তার সেই অবস্থাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এক অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতারূপে।
  • (২) বাল্যকালে আরও কয়েকবার তার অনুরূপ ভাবতন্ময়তা দেখা দিয়েছিল – একবার দেবী বিশালাক্ষীর পূজার সময়, আরেকবার শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রায় শিবের চরিত্রাভিনয়কালে। দশ-বারো বছর বয়স থেকে এই ভাবতন্ময়তা তার নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

পিতৃবিয়োগ ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপর প্রভাব

১৮৪৩ সালে পিতৃবিয়োগের পর পরিবারের ভার গ্রহণ করেন তার দাদা রামকুমার। এই ঘটনা গদাধরের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

  • (১) ধর্মীয় জীবনযাপনের ইচ্ছা তার মনে দৃঢ় হয়। পিতার অভাব তাকে মায়ের খুব কাছে নিয়ে আসে।
  • (২) ঘরের কাজ ও গৃহদেবতার পূজাপাঠে তিনি অধিকতর সময় ব্যয় করতে থাকেন। আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন ধর্মীয় মহাকাব্য পাঠে।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের কলকাতা আগমন

পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে রামকুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন।

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে রামকৃষ্ণের আগমন

  • (১) ১৮৫৫ সালে কলকাতার মাহিষ্য সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন।
  • (২) তখনকার ব্রাহ্মণ সমাজে নিম্নবর্ণীয়া গণ্য এক নারীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির হওয়া সত্ত্বেও সামান্য অনুরোধেই গদাধর সেই মন্দিরে চলে আসেন।
  • (৩) রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার ভাগনে হৃদয়রাম রামকুমারের সহকারী হিসাবে প্রতিমার সাজসজ্জার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রধান পুরোহিত রামকৃষ্ণ পরমহংস

১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তার স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তার অবশিষ্ট জীবন।

রামকৃষ্ণ নামকরণ

অনুমান করা হয় যে, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে পরিচিত, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন। অন্য মতে, এই নামটি তার অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।

দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দেখার জন্য রামকৃষ্ণের আকুলতা

রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। কালীকে তিনি মা ও বিশ্বজননীভাবে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেন।

  • (১) এই সময় দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। তার বিশ্বাস পাষাণ প্রতিমা জীবন্ত হয়ে অন্নগ্রহণ করতে শুরু করে।
  • (২) পূজা করতে করতে দেবীর দর্শন না পেয়ে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠতে থাকেন।
  • (৩) রাত্রিকালে নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে বস্ত্র ও উপবীত ত্যাগ করে নির্জনে ধ্যান করতেও শুরু করেন।
  • (৪) কেউ কেউ বলতে থাকে যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেন তিনি ঈশ্বরের প্রেমে আকুল হয়েছেন।
  • (৫) একদিন অস্থিরতার বশে তিনি সংকল্প করেন দেবীর দর্শন না পেলে জীবন বিসর্জন দেবেন। দেওয়াল থেকে খড়্গ তুলে নিয়ে তিনি গলায় কোপ বসাবেন, এমন সময় অকস্মাৎ সমগ্র কক্ষ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রথম কালীদর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিম্নরূপ-

“সহসা মার অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম! তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন্ দিক দিয়া সেদিন ও তৎপরদিন যে গিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই! অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূত জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম!… ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল – কোথাও যেন আর কিছুই নাই! আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্র! – যেদিকে যতদূর দেখি, চারিদিক হইতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে! দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল! হাঁপাইয়া হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম।”

মা কালীর নিকট রামকৃষ্ণের নিজেকে সমর্পণ

মায়ের দর্শন লাভের পর শ্রীরামকৃষ্ণ মা কালীর নিকট সম্পূর্ণত নিজেকে সমর্পণ করেন।

  • (১) কি সাধারণ, কি দার্শনিক – সকল ক্ষেত্রেই বালকসুলভ আনুগত্য নিয়ে তিনি দেবীর নিকট প্রার্থনা নিবেদন করতে শুরু করেন।
  • (২) রাণী রাসমণি ও তার জামাতা মথুরবাবু যদিও পরম স্নেহবশত তাকে তার ইচ্ছামতো পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও তারা মনে করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘ ব্রহ্মচর্যজনিত কোনও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
  • (৩) মথুরবাবু তার জন্য বারবণিতার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু তাকে প্রলুব্ধ করার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। তিনি সেই দেহোপজীবিনীর মধ্যেও দিব্য মাতৃমূর্তি দর্শন করেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিবাহ

  • (১) কামারপুকুরে গুজব রটে যায়, দক্ষিণেশ্বর -এ অতিরিক্ত সাধনার শ্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ পাগল হয়ে গেছেন।
  • (২) মা ও মেজদাদা রামেশ্বর তার বিবাহদানের চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তারা ভেবেছিলেন বিবাহের পর সাংসারিক দায়-দায়িত্বের ভার কাঁধে চাপলে আধ্যাত্ম সাধনার মোহ তার কেটে যাবে। তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসবেন।
  • (৩) শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস বিবাহে আপত্তি করলেন না। তিনি বলে দিলেন কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে জয়রামবাটী গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গৃহে কন্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।
  • (৪) ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তার শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বয়সের এই পার্থক্য উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজে কোনও অপ্রচলিত দৃষ্টান্ত ছিল না।
  • (৫) ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের মে মাসের আগে তাদের আর সাক্ষাৎ হয়নি।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধনা

বিবাহের পর শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় মন্দিরের কাজ গ্রহণ করেন। তবে ভাবতন্ময়তা কাটার পরিবর্তে তার অধ্যাত্ম-পিপাসা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

  • (১) ব্রাহ্মণের জাত্যভিমান দূর করার জন্য তিনি নিম্নবর্ণীয়দের হাতে খাদ্যগ্রহণ, অন্ত্যজ পারিয়াদের (চাকর ও ঝাড়ুদার) সেবা করতে থাকেন।
  • (২) স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাকে মাটির ঢেলার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন “টাকা মাটি, মাটি টাকা”। রামকৃষ্ণ অর্থকে লোষ্ট্রজ্ঞানে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। লোকে মনে করতে থাকেন, সত্যিই তিনি পাগল হয়ে গেছেন।
  • (৩) কথিত আছে, এই অবস্থায় তিনি এতটাই সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিলেন যে, ঘুমন্ত অবস্থাতে কেউ মুদ্রা স্পর্শ করালে তার দেহ সংকুচিত হয়ে আসত।
  • (৪) উত্তেজনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসের শরীরে তীব্র দাহ উপস্থিত হল। তিনি নিদ্রারহিত হলেন। ফলে মন্দিরের কাজকর্ম তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।
  • (৫) চিকিৎসকদের ডাকা হল। কিন্তু তাদের একজন বলেন যে, রোগীর এই অবস্থার কারণ আধ্যাত্মিক উত্তেজনা। কোনও ঔষধ একে সুস্থ করতে সক্ষম নয়।

ভৈরবী ব্রাহ্মণীর নিকট রামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনা

১৮৬১ সালে ভৈরবী ব্রাহ্মণী নামে গৈরিক বস্ত্র পরিহিতা এক যোগিনী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। তার প্রকৃত নাম ছিল যোগেশ্বরী এবং বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞা ও তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধনে সিদ্ধা।

রামকৃষ্ণ ও ভৈরবী ব্রাহ্মণী

শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীর কাছে তার ভাবতন্ময়তা ও দৈহিক পীড়ার বর্ণনা দেন।

  • (১) ভৈরবী তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি পাগল হয়ে যাননি, বরং আধ্যাত্মিক ‘মহাভাব’ তাকে আশ্রয় করেছে। এই মহাভাবের বশেই তিনি দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন।
  • (২) বিভিন্ন ভক্তিশাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখালেন রাধা ও চৈতন্য মহাপ্রভুরও একই ভাব উপস্থিত হয়েছিল। ভৈরবী তার দৈহিক পীড়া অবসানের নিদানও দিলেন।
  • (৩) ভৈরবীর পথনির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করলেন। এই সাধনায় তার সমস্ত শারীরিক ও মানসিক পীড়ার উপশম হয়।
  • (৪) ভৈরবীর সহায়তায় তিনি তন্ত্রে উল্লেখিত ৬৪ প্রকার প্রধান সাধন অভ্যাস করলেন। জপ ও পুরশ্চরণের মতো মন্ত্রসাধনায় চিত্ত শুদ্ধ করে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন।
  • (৫) ভৈরবী শ্রীরামকৃষ্ণকে কুমারী পূজা শিক্ষা দেন। এই পূজায় কোনও কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। এছাড়াও ভৈরবীর নির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ কুণ্ডলিনী যোগেও সিদ্ধ হন। ১৮৬৩ সাল নাগাদ তার তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হয়।
  • (৬) শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীকে মাতৃভাবে দেখতেন। অন্যদিকে ভৈরবী তাকে মনে করতেন ঈশ্বরের অবতার। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধনা

বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদনে পাঁচটি ভাবের উল্লেখ রয়েছে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাবগুলির কয়েকটি অভ্যাস করেন।

  • (১) কালীদর্শন ও বিবাহে মধ্যবর্তী সময়ে কিছুকালের জন্য তিনি দাস্যভাবে সাধনা করেছিলেন। এই সময় তিনি হনুমানভাবে ভাবিত হয়ে রামচন্দ্রের আরাধনা করেন।
  • (২) এইসময় তার হাবভাব সকলই হনুমানের মতো হয়েছিল। তিনি কদলীভক্ষণ করতেন, অধিকাংশ সময় বৃক্ষশাখায় কাটাতেন, এমনকি বানরের মতো অস্থির চোখের দৃষ্টিও লাভ করেছিলেন।
  • (৩) শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তার মেরুদণ্ডের নিচে সামান্য অংশও এই সময় লেজের মতো প্রসারিত হয়েছিল।
  • (৪) দাস্যভাবে সাধনার সময় তিনি রামের পত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান এবং সীতার সেই মূর্তি তার নিজদেহে অন্তর্হিত হতে দেখেন।
  • (৫) ১৮৬৪ সালে দেবীপ্রতিমায় মাতৃভাব আরোপ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বাৎসল্যভাবের সাধনা করেন। এই সময় তিনি ‘রামলালা’ অর্থাৎ বালক রামচন্দ্রের একটি ধাতুমূর্তি পূজা করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন যে, এই সময় তিনি ধাতুমূর্তিতেই জীবন্ত বালক রামচন্দ্রকে চাক্ষুষ করতেন।
  • (৬) পরবর্তীকালে গোপিনী রাধার ভাব আরোপ করে কৃষ্ণের প্রেমিকারূপে মধুর ভাব সাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এই প্রেম উপলব্ধি করার জন্য তিনি দীর্ঘকাল নারীর বেশে নিজেকে বৃন্দাবনের গোপিনী কল্পনা করেছিলেন। এই সাধনার অন্তে তার সবিকল্প সমাধি হয় – তিনি কৃষ্ণের সাথে আধ্যাত্মিক মিলনে মিলিত হন।
  • (৭) নদিয়ায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্য ও নিত্যানন্দের জন্মস্থান ভ্রমণকালে তিনি ভাবচক্ষুতে দুই নৃত্যরত বালককে তার দেহে অন্তর্লীন হতে দেখেছিলেন।
  • (৮) কালীদর্শনের পর তার শান্ত ভাব অর্জিত হয়েছিল বলেও জানা যায়।

তোতাপুরীর নিকট রামকৃষ্ণদেবের বৈদান্তিক সাধনা

১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী তোতাপুরী ছিলেন জটাজুটধারী এক বিশালবপু উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসী।

  • (১) তোতাপুরী প্রথমে সকল জাগতিক বন্ধন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে সন্ন্যাস প্রদান করেন। তোতাপুরীর সহায়তায় শ্রীরামকৃষ্ণ অধ্যাত্মজীবনের চরম অবস্থা নির্বিকল্প সমাধিতে নিমগ্ন হন।
  • (২) অদ্বৈত বেদান্তের নানা তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোতা এগারো মাস দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট থেকে যান। তিনি বিদায় নিলে আরও ছয় মাস শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তার জগতে অবস্থান করেন।
  • (৩) শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী, এরপর তিনি দেবী কালীর নিকট থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন – “তুই ভাবমুখে থাক” (অর্থাৎ, সমাধি ও সাধারণ অবস্থার মুখে অবস্থান করে লোকশিক্ষা দান কর।)।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের খ্রিস্টমতে সাধনা

১৮৭৩ সালের শেষভাগ নাগাদ শম্ভুচরণ মল্লিক তাকে বাইবেল পাঠ করে শোনালে তিনি খ্রিস্টীয় মতে সাধনা শুরু করেন।

  • (১) শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এই সময় তার চিত্ত খ্রিস্টীয় ভাবে পূর্ণ হয়েছিল এবং তিনি কালীঘরে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন।
  • (২) একদিন মেরিমাতার কোলে যিশু খ্রিস্টের চিত্রে তিনি জীবন্ত যিশুর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। তার ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে পিতরকে ত্রাণরত যিশুর একটি চিত্র ছিল, সেটিতে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্ত্রী সারদা দেবী

সেকালের প্রথা অনুযায়ী সতেরো-আঠারো বছর বয়স হলে সারদা দেবী স্বামীগৃহে যাত্রা করেন। স্বামী পাগল হয়ে গেছেন – এই গুজব শুনে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলেন। আবার এও শুনেছিলেন, তার স্বামী একজন বিশিষ্ট সাধকে পরিণত হয়েছেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংস ও সারদা দেবী

  • (১) শ্রীরামকৃষ্ণ এই সময় ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। এই পূজায় তিনি সারদা দেবীকে দিব্য মাতৃকাজ্ঞানে পূজা নিবেদন করেছিলেন। তাকে দেবী কালীর পীঠে বসিয়ে পুষ্প ও ধূপদানে তার পূজা সম্পাদন করেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
  • (২) শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, তিনি যে নারীমাত্রেই জগজ্জননীর রূপ দর্শন করেন, তার নিজের স্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকি তিনি বারবণিতাদেরও মাতৃসম্বোধন করতেন। দাম্পত্যজীবনে সারদা দেবীর মধ্যে মাতৃজ্ঞান করায় তাদের বিবাহ অসাধারণত্বে উন্নীত হয়।
  • (৩) সারদা দেবীর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও দিন তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করেননি। কখনও রূঢ়বাক্য প্রয়োগ বা তিরস্কারও করেননি।
  • (৪) সারদা দেবীকেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অনুগামী মনে করা হয়। তার শিষ্য ও ভক্তসমাজে সারদা দেবী ‘শ্রীমা’ বা ‘মাতাঠাকুরানী’ নামে পরিচিতা হন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোভাবের পর তিনিই রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্বরূপা হয়েছিলেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংস ও কেশবচন্দ্র সেন

১৮৭৫ সালে প্রভাবশালী ব্রাহ্ম সমাজ -এর নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সাথে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়। কেশব চন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্মসমন্বয়, ঈশ্বরে মাতৃভাব আরোপ এবং ব্রাহ্ম ও বহুদেববাদের সম্মিলনের আদর্শে “নববিধান” প্রতিষ্ঠা করেন।

বিজয়কৃষ্ণ ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি

  • (১) কেশবচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো অন্যান্য ব্রাহ্মগণও শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত শুরু করেন, ও তার মতের অনুগামী হয়ে পড়েন।
  • (২) প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী ও ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল প্রমুখ কলকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিময়িত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
  • (৩) প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রথম ইংরেজিতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য ব্রাহ্মদের বক্তৃতা ও নিবন্ধ থেকেও বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী দয়ানন্দ -এর সঙ্গেও ধর্মবিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের বাক্যালাপ হয়েছিল।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রভাব

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব কলকাতার শিক্ষিত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

  • (১) তার জীবদ্দশাতেই পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন মহলের গণ্ডী টপকে তার ধর্মীয় চিন্তাধারণা ও উপদেশের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল বাংলার বাউল ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমনকি বাংলার বাইরেও। অবশ্য মৃত্যুর পূর্বে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কাজ বিশেষ কিছুই সাধিত হয়নি।
  • (২) ব্রাহ্মসমাজ ও নবোত্থিত হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে বাংলার নবজাগরণ -এ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব অবিস্মরণীয়।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য

তার প্রধান শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন –

(১) গৃহস্থ শিষ্য

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখ।

(২) ত্যাগী বা সন্ন্যাসী শিষ্য

নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রাখালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (স্বামী শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (স্বামী সারদানন্দ) প্রমুখ।

(৩) নারী ভক্ত

নারী ভক্তদের একটি ছোটো অংশও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। এঁদের মধ্যে গৌরী মা ও যোগীন মা উল্লেখযোগ্য। ধতবে তপস্যার বদলে শহরে অবস্থান করে নারীসমাজের সেবাতেই তাদের উৎসাহিত করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শেষ জীবন

  • (১) ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংসের গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ হয়। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’।
  • (২) প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাকে দেখেন ২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ এবং পরের মাস থেকে নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তারই সিদ্ধান্ত, রোগটা ক্যানসার, কবিরাজি ভাষায় রোহিণী রোগ।
  • (৩) কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে তাকে নিয়ে আসা হয়। অবস্থা সংকটজনক হলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর তাকে স্থানান্তরিত করা হয় কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে।
  • (৪) ২৫ মার্চ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে এম কোটস এসেছিলেন তাকে দেখতে। বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত আসেনন ৬ এপ্রিল ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে।
  • (৫) চিকিৎসকগণ তাকে কথা না বলার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে তিনি অভ্যাগতদের সঙ্গে ধর্মালাপ চালিয়ে যান।
  • (৬) কথিত আছে যে, মৃত্যুর পূর্বে বিবেকানন্দকে তিনি বলেছিলেন, “আজ তোকে যথাসর্বস্ব দিয়ে ফকির হয়েছি। এই শক্তির সাহায্যে তুই জগতের অশেষ কল্যাণ করতে পারবি। কাজ শেষ হলে আবার স্বস্থানে ফিরে যাবি।”
  • (৭) বিবেকানন্দ তার অবতারত্ব সম্পর্কে সন্ধিহান হলে তিনি বলে ওঠেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ…”। তার শেষের দিনগুলিতে তিনি বিবেকানন্দকে ত্যাগী শিষ্যদের দেখাশোনার ভার অর্পণ করে যান।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাপ্রয়াণ

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অগস্ট সকালবেলায় ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার কাশীপুরে আসেন। অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডা. সরকার ‘‘বেলা দশ ঘটিকায় এসে নাড়ি দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।’’

রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রারম্ভ

তার প্রয়াণের পর বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে বরাহনগরে একটি পোড়ো বাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থসাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশন-এর যাত্রা।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশ

লোকশিক্ষক হিসাবে রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। গ্রাম্য বাংলায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে দেয় তার উপদেশাবলি জনমানসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

  • (১) ঈশ্বর-উপলব্ধিই তিনি মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে মনে করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, কাম ও অর্থই মানুষকে ঈশ্বরের পথ হতে বিচ্যুত করে। তাই “কাম-কাঞ্চন” বা “কামিনী-কাঞ্চন” ত্যাগের পথই তার কাছে ছিল ঈশ্বরের পথ।
  • (২) জগতকে তিনি ‘মায়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে জগতের অন্ধকার শক্তি ‘অবিদ্যা মায়া’ (অর্থাৎ, কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি) মানুষকে চেতনার সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনে। এই মায়া মানুষকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
  • (৩) অন্যদিকে সৃষ্টির আলোকময় শক্তি ‘বিদ্যা মায়া’ (অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক গুণাবলি, জ্ঞান, দয়া, শুদ্ধতা, প্রেম ও ভক্তি) মানুষকে চৈতন্যের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়।
  • (৪) শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মমত অভ্যাস করেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন সকল মতই একই ঈশ্বরের পথে মানুষকে চালিত করে।
  • (৫) তিনি ঘোষণা করেন “যত্র জীব তত্র শিব” অর্থাৎ, যেখানেই জীবন, সেখানেই শিবের অধিষ্ঠান। “জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা” – তার এই উপদেশ স্বামী বিবেকানন্দের কর্মের পাথেয় হয়েছিল।
  • (৬) ‘শ্রীম’ অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রণীত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে তার ধর্মভাবনার মূল কথাগুলি লিপিবদ্ধ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এটিই।

রামকৃষ্ণ পরমহংস ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রামকৃষ্ণ পরমহংস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার “পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের প্রতি” কবিতাটি লিখেছিলেন,

বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা,

ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা;

তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে

নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;

দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি

সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।।

বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মত

আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল – এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে – একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি – হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, – কিন্তু বস্তু এক। মত-পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, – ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।

উপসংহার :- অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে।

(FAQ) রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রামকৃষ্ণ নামের অর্থ কি?

সফল বা বিজয়ী।

২. রামকৃষ্ণের আরাধ্য দেবী কে?

মা কালী।

৩. রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মৃত্যুর কারণ কি?

গলায় ক্যান্সার।

৪. রামকৃষ্ণের শিষ্য কে ছিলেন?

স্বামী বিবেকানন্দ।

Leave a Comment