কুমারী পূজা (Kumari Puja)

দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা (Kumari Puja) প্রসঙ্গে মহাঅষ্টমীতে কুমারী পূজা, কুমারী পূজার প্রচলন, কুমারী পূজার পদ্ধতি, কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যার নাম, কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব, কুমারী পূজা সম্পর্কে কোলাসুর বধের কাহিনি, ব্রহ্মা কর্তৃক কুমারী রূপে দেবীর পূজা, কুমারী পূজা সম্পর্কে রামকৃষ্ণের মন্তব্য, কুমারী পূজার বর্ণনা, কুমারী পূজা সম্পর্কে পুরাণের ব্যাখ্যা, মহাভারতে কুমারী পূজার উল্লেখ, দুর্গাপূজা ব্যতীত কুমারী পূজা, স্বামী বিবেকানন্দের কুমারী পূজার ইতিহাস, কুমারী পূজার দিব্যভাবের পূজক বিবেকানন্দ, বাংলাদেশে কুমারী পূজা এবং কুমারী পূজার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য।

মা দুর্গার পূজায় কুমারী পূজা (Kumari Puja in Maa Durga Puja)

উৎসবকুমারী পূজা
ধরণধর্মীয় উৎসব
সংঘটনবার্ষিক
পালনকারীহিন্দু সম্প্রদায়
সময়কালআশ্বিন মাস
তিথিঅষ্টমী ও নবমী
সম্পর্কিতমহালয়া, দুর্গাপূজা, অকালবোধন
মা দুর্গার পূজায় কুমারী পূজা (Kumari Puja in Maa Durga Puja)

ভূমিকা:- দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে কুমারী পূজা। তন্ত্রশাস্ত্র মতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা হল কুমারী পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক মন্দির, বারোয়ারি বা বাড়ির পুজোয় প্রথা মেনে আজও কুমারী পুজো হয়।

মহাঅষ্টমীতে কুমারী পূজা

প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোথাও কোথাও মহানবমীর দিনও কুমারী পূজা হয়।

কুমারী পূজার প্রচলন

শাস্ত্র অনুযায়ী কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত আছে, বানাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবতারা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে বানাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।

বাঙালির কুমারী পূজার পদ্ধতি

পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত আছে। কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত হলেও কোথাও বলা নেই যে ব্রাহ্মণকন্যাই কেবল পূজ্য। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়।

কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যার নাম

বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন –

  • (১) এক বছরের কন্যা – সন্ধ্যা
  • (২) দুই বছরের কন্যা – সরস্বতী
  • (৩) তিন বছরের কন্যা – ত্রিধামূর্তি
  • (৪) চার বছরের কন্যা – কালীকা
  • (৫) পাঁচ বছরের কন্যা – সুভগা
  • (৬) ছয় বছরের কন্যা – উমা
  • (৭) সাত বছরের কন্যা – মালিনী
  • (৮) আট বছরের কন্যা – কুব্জিকা
  • (৯) নয় বছরের কন্যা – কালসন্দর্ভা
  • (১০) দশ বছরের কন্যা – অপরাজিতা
  • (১১) এগারো বছরের কন্যা – রূদ্রাণী
  • (১২) বারো বছরের কন্যা – ভৈরবী
  • (১৩) তেরো বছরের কন্যা – মহালক্ষ্মী
  • (১৪) চৌদ্দ বছরের কন্যা – পীঠনায়িকা
  • (১৫) পনেরো বছরের কন্যা – ক্ষেত্রজ্ঞা
  • (১৬) ষোলো বছরের কন্যা – অন্নদা বা অম্বিকা

বাঙালির কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব

এই কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হল নারীর মধ্যে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত আছে যে, এই ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেছিলেন।

কুমারী পূজা সম্পর্কে কোলাসুর বধের কাহিনি

  • (১) শাস্ত্র ও পুরাণে কুমারী পুজোর উল্লেখ আছে। কুমারী পুজোর সূচনার নেপথ্যে বিভিন্ন কাহিনি শোনা যায়, যার মধ্যে অন্যতম কোলাসুর বধের কাহিনী। মনে করা হয়, একসময় কোলাসুর স্বর্গ ও মর্ত্য অধিকার করে নেওয়ায় বিপন্ন হয়ে পড়ে দেবকুল। সেই সময় দেবতারা মহাকালীর শরণাপন্ন হয়।
  • (২) দেবতাদের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। তারপর থেকেই মর্ত্যে শুরু হয় কুমারী পূজা। সনাতন ধর্মে, সম্মানের বিচারে নারীকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে শাস্ত্রকাররা নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতেই এই পূজার কথা বলেছেন।
  • (৩) হিন্দু শাস্ত্রে নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধার আসনে বসাতে এবং দেবীর কুমারী রূপের আরাধনা করতেই এই পুজোর বিধান দেওয়া হয়েছে। মনের অন্তরের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানানোই কুমারী পুজোর প্রধান ও মূল লক্ষ্য।

ব্রহ্মা কর্তৃক কুমারী রূপে দেবীর পূজা

  • (১) বৃহদ্ধর্মপুরাণে রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপুজোর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পুরাণ অনুযায়ী, সেই সময় ছিল শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ, দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বলেন, বেল গাছের নিচে দুর্গার বোধন করতে।
  • (২) দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, সেই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। এরপেরই বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করেন ব্রহ্মা। দেবী জাগরিত হয়ে বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারন করেন।

কুমারী পূজা সম্পর্কে রামকৃষ্ণের মন্তব্য

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, “দিব্যচক্ষু চাই। মন শুদ্ধ হলেই সেই চক্ষু হয়। দেখ না কুমারীপূজা। হাগা-মোতা-মেয়ে, তাকে ঠিক দেখলুম সাক্ষাৎ ভগবতী।” তিনি আরও বলেছেন, “সারদা মা কে কুমারীর ভিতর দেখতে পাই বলে কুমারীপূজা করি।”

হিন্দু উৎসব কুমারী পূজার বর্ণনা

যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্ত্রসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোনো কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়।

কুমারী পূজা সম্পর্কে পুরাণের ব্যাখ্যা

  • (১) পুরাণে আছে, ব্রহ্মার নির্দেশ অনুসারে শ্রীরামচন্দ্র দেবীপূজার আয়োজন করেন। ধ্যানমানসে উদ্ভাসিত হলেন দেবী এবং জানতে পারলেন যে, দেবী তখন কুমারীরূপে শায়িত আছেন বেল গাছের শাখায়। স্রষ্টা ব্রহ্মার নির্দেশ অনু্যায়ী শ্রীরামচন্দ্র শুক্লা ষষ্ঠীর সকালে কল্পারম্ভ এবং সন্ধ্যায় বেল গাছের নিচে শুরু করলেন দেবীর বোধন। ষষ্ঠীতে বোধিত হলেন দেবী।
  • (২) সপ্তমীতে ষোড়শোপচারে দেবীকে পূজা করেন শ্রীরামচন্দ্র। কিন্তু তখন পর্যন্ত দেবীর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন অষ্টমী তিথিতে সকল যোগিনীদের ডেকে আবার সমস্ত পূজা-অর্চনা করে আরাধনা করা হল দেবীকে। দেবী তখনও কোন সাড়া দিলেন না। আগত যোগিনীদের হৈ-চৈ-তে দেবী তখন কেবল একটু নড়ে চড়ে পাশ ফিরে শয়ন করলেন।
  • (৩) দেবী জাগ্রত হলেন না। তখন অষ্টমীর শেষ এবং নবমীর শুরুতে মহা সন্ধিক্ষণে করলেন দেবীর আবার বিশেষ পূজা। যাকে বলা হয় সন্ধিপূজা। অষ্টমীর ২৪ মিনিট এবং নবমীর ২৪ মিনিট নিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের পূজা হল সন্ধিপূজা। সন্ধিপূজা হল দেবী চামুন্ডার বিশেষ পূজা। শ্রীরামচন্দ্র তখন চামুন্ডা দেবীকে আবাহন করে বলেন যেভাবেই হোক দেবী দুর্গাকে জাগাতে হবে। চামুন্ডার সহযোগীতায় দেবী তখন জেগে উঠলেন নবমী তিথিতে।
  • (৪) শ্রীরামচন্দ্র দেবীকে যোগিনীদের সঙ্গে বিশেষ পূজা করেন এবং দেবীকে দর্শন করেন কুমারীরূপে। সেই থেকে কুমারীরূপী দেবীপূজা শুরু। শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে একসঙ্গে একশ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দিলেন এবং দেবী নবমীর দিন কুমারীরূপে পূজিতা হলেন।

মহাভারতে কুমারী পূজার উল্লেখ

ভারত-এর অন্যতম মহাকাব্য মহাভারত অনুযায়ী, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন কুমারী পূজা করেন। শ্বেতাম্বর উপনিষদেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থ থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।

দুর্গাপূজা ব্যতীত কুমারী পূজা

কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যা ও অন্যান্য শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন আছে।

স্বামী বিবেকানন্দের কুমারী পূজার ইতিহাস

  • (১) ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন তাঁর কাশ্মীর ভ্ৰমনকালে। তিনি যখন ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তখন তিনি এক মুসলমান মেয়েকে কুমারী পূজা করেছিলেন। শাস্ত্ররীতিতে ব্রাহ্মণ কন্যাকেই কুমারীপূজার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি সমস্ত রীতির উর্ধ্বে গিয়ে পূজা করেছেন মুসলমান কন্যাকে।
  • (২) তিনি জাতপাতের উর্ধ্বে দেবী দর্শন করেন। দেবীত্ব কেবল ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা দেবীত্ব ও মাতৃত্ব কারোর একচেটিয়া সম্পদ নয়। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজির ধ্যানে ও দর্শনে তা প্রমাণিত। তাই তিনি মুসলমান কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন।
  • (৩) ১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ, বেলুড় মঠ -এ দুর্গা পূজা ও কুমারী পূজা শুরু করেন। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম কুমারী পুজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয় জন কুমারী কে পূজা করেন।
  • (৪) এখন বেলুড় মঠে একজনকেই পূজা করা হয়ে থাকে। এটাই নাকি শাস্ত্রীয় রীতি। স্বামীজির দিব্যদৃষ্টিতে সকল কুমারীই দেবীর এক-একটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি পূজা করেছিলেন ৯ জন কুমারীকে। স্বামীজি প্রতিটি কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে।
  • (৫) এই নয়জন কন্যার মধ্যে একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা। যাঁর কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে তিনি বলেছিলেন- “ আঃ! দেবীর বোধ হয় তৃতীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।”
  • (৬) তাঁর দৃষ্টি ঠিকই। আমাদের দুটো চোখ থাকলেও, তৃতীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃতীয় নয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি যেমন ‘সেদিন দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’ পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজির স্নেহধন্যা ছিলেন এই কন্যা।
  • (৭) স্বামীজির কুমারীপূজায় যেন সত্যি সত্যিই ঠিক দুর্গামারূপে তিনি পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘দুর্গামা’ অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজির অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এই নয়জন কুমারীর মধ্যে দুর্গামা যেমন ছিলেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলালদাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানীও ছিলেন।
  • (৮) স্বামীজি এই পূজার দ্বারা যেন একটা নূতন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সমস্ত নীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নূতন রীতি। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিদর্শন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ইদানীং যে দুর্গাপূজার সময় জীবন্ত কন্যাকে কুমারীপূজা করার প্রচলন তা স্বামীজিরই আবিষ্কার বা তিনিই এর প্রচারক।

কুমারী পূজার দিব্যভাবের পূজক বিবেকানন্দ

  • (১) একটি ঘটনার মধ্যে আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে পাই দিব্যভাবের পূজক হিসাবে। তিনি তখন উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে। সেখানে এক প্রবাসী বাঙালির কুমারী মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল মণিকা। পরবর্তীকালে এই মণিকাদেবী হয়ে উঠেছিলেন যশস্বিনী সন্ন্যাসিনী।
  • (২) এ যেন স্বামীজির ঐ দিব্য বীজের বপন, যেন অনাঘ্রাত কুসুমকে দেবসেবায় উৎসর্গ করা। যথার্থ তাঁর দেবী দর্শন। কুমারীপূজায় উৎসর্গীকৃতা মণিকা যেন দেবীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা। এই মণিকাদেবী শেষজীবনে সন্ন্যাসিনী হয়ে যশোদা-মাঈ নামে পরিচিতা হয়েছিলেন জগতে। এও স্বামীজির এক অন্য আবিষ্কার।

বাংলাদেশে কুমারী পূজা

বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন কমে এসেছে। বাংলাদেশ -এ সূদূর অতীত থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় কুমারীপূজাপ্রয়োগ গ্রন্থ থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট, হবিগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন -এ কুমারী পূজার প্রচলন আছে।

কুমারী পুজোর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

দুর্গাপূজার সময় কন্যা পূজার জন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ত্রিদেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কালীকে অন্ন অর্পণ ও পূজা করলে ত্রিদেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কালীর পূজার ফল পাওয়া যায়। এতে তিন দেবী প্রসন্ন হয়ে বর দেন।

উপসংহার:- হিন্দু ধর্মে বলা হয় দেবী কুমারী প্রতীকে হিন্দুদের মাতৃরূপে অবস্থিত। সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা করার জন্য কুমারী পূজা করা হয়। আবার কুমারী পূজার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নিজেকেই শ্রদ্ধা জানায়।

(FAQ) কুমারী পূজা (Kumari Puja) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কুমারী পূজার অন্য নাম কি?

কন্যা পূজা।

২. দুর্গাপূজার কোন দিন কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়?

অষ্টমীর দিন। তবে নবমীর দিনও হয়।

৩. কুমারী পূজার প্রচলন করেন কে?

স্বামী বিবেকানন্দ।

৪. কোন বয়সের কন্যাদের নিয়ে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়?

অনধিক ১৬ বছরের কন্যা।

৫. বেলুড় মঠে কুমারী পূজার সূচনা হয় কখন?

১৯০১ সালে।

Leave a Comment