দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রসঙ্গে মন্দির প্রতিষ্ঠা, ঐতিহাসিক দিক, মন্দির চত্বর, ও স্থাপত্য রীতি সম্পর্কে জানবো।

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি

নিদর্শনদক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি
প্রতিষ্ঠাকাল১৮৫৫ খ্রি:
প্রতিষ্ঠাতারানি রাসমণি
অবস্থানদক্ষিণেশ্বর
জেলাউত্তর চব্বিশ পরগনা
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
দেশভারত
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি

ভূমিকা :- কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালী মন্দির হল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তর্গত দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত।

দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা

  • (১) প্রসিদ্ধ মানব দরদি জমিদার রানি রাসমণি ১৮৫৫ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের দেবী কালীকে মা ভবতারিণী নামে পূজা করা হয়। কথিত আছে যে, রানি রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (২) মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস-এর দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। এই রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস ১৮৫৭-৫৮ সালে এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি এই মন্দিরকেই তার সাধনক্ষেত্র রূপে বেছে নেন।

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির ঐতিহাসিক দিক

  • (১) ১৮৪৭ সালে ধনী বিধবা জমিদার রানি রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণার পূজার জন্য কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেন। আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী ও রসদ নিয়ে তিনি রওনা হওয়ার জন্য আয়োজন করেন। কিংবদন্তি অনুসারে যাত্রার পূর্বরাত্রে রানি দেবী কালীর স্বপ্নদর্শন পান।
  • (২) দেবী তাকে বলেন, “কাশী যাওয়ার দরকার নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দির তৈরি করে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা কর। সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে আমি পূজা গ্রহণ করব।”
  • (৩) এই স্বপ্নের পর রানি অবিলম্বে গঙ্গাতীরে জমি ক্রয় করেন এবং মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৮৫৫ সালে শেষ হয়। আটবছরে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই মন্দির নির্মিত হয়।
  • (৪) মন্দিরের ২০ একরের প্লটটি জন হেস্টিংস নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে কেনা হয়। লোকমুখে জায়গাটি পরিচিত ছিল সাহেবান বাগিচা নামে। এর একটি অংশ ছিল মুসলমান গোরস্থান। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
  • (৫) ১৮৫৫ সালের ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পূর্বে মন্দিরের আরাধ্যাকে মাতা ভবতারিনি কালিকা নামে অভিহিত করা হয়েছিল। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রধান পুরোহিত পদে বৃত হন, তার ছোটো ভাই গদাধর বা গদাই তার সহযোগী হন।
  • (৬) পরে তার ভাগনে হৃদয়ও তাকে সহায়তা করতে থাকেন। পরের বছরই রামকুমার দেহরক্ষা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে অবস্থান করেন। তার অবস্থানের কারণে পরবর্তীকালে এই মন্দির পরিণত হয় একটি তীর্থক্ষেত্রে।
  • (৭) শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিনী সারদা দেবী মন্দির চত্বরের বাইরে নহবতখানায় অবস্থান করতে থাকেন। এই নহবতখানা এখন সারদা দেবীর মন্দির।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির মন্দির চত্বর

  • (১) দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির ও ধর্মস্থল অবস্থিত। মূল মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। টালিগঞ্জের বাবু রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরত্ন মন্দিরের আদর্শে এই মন্দির নির্মিত।
  • (২) মূল মন্দির ছাড়াও দ্বাদশ শিবমন্দির নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরের উত্তরে আছে শ্রীশ্রীরাধাকান্ত মন্দির নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির।
  • (৩) মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কিছু স্থান আছে, যা আজ পুণ্যার্থীদের কাছে ধর্মস্থানরূপে বিবেচিত হয়।

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের স্থাপত্য রীতি

  • (১) মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর বা গৌড়ীয় স্থাপত্যের নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। মূল মন্দিরটি তিন তলা। উপরের দুটি তলে এর নয়টি চূড়া বণ্টিত হয়েছে। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত ও ১০০ ফুট উঁচু দালানের উপর গর্ভগৃহটি স্থাপিত।
  • (২) গর্ভগৃহে শিবের বক্ষোপরে ভবতারিণী নামে পরিচিত এই কালীমূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত। এই মূর্তিদ্বয় একটি রুপোর সহস্রদল পদ্মের উপর স্থাপিত মূল মন্দিরের কাছে যে বারোটি একই প্রকার দেখতে পূর্বমুখী শিবমন্দির রয়েছে সেগুলি আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। গঙ্গার একটি ঘাটে দুই ধারে এই মন্দিরগুলি দণ্ডায়মান।
  • (৩) মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বে আছে রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরে একটি রুপোর সিংহাসনে ষোলো ইঞ্চির রাধা ও সাড়ে একুশ ইঞ্চির কৃষ্ণ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। রানি রাসমণির গৃহদেবতা রঘুুবীর, জনার্দন (কৃষ্ণ), নাড়ু গোপাল বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরে অধিষ্ঠান করছেন।

উপসংহার :- ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে কালীসাধনা করতেন।

(FAQ) দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কোন নদীর তীরে অবস্থিত?

হুগলি।

২. দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কে প্রতিষ্ঠা করান?

রানি রাসমণি।

৩. দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে।

৪. দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে কালী সাধনা করেছেন কোন বিশিষ্ট যোগী?

রামকৃষ্ণ।

Leave a Comment