ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত -এর জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা, বিবাহ, সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনা, কবিগান সংগ্ৰহ, স্বদেশ প্রীতি, বাংলা সাহিত্যে অবদান, কবিতা রচনা, সাহিত্য কীর্তি ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পিতৃপরিচয়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বিবাহ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিক্ষাজীবন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কর্তৃক সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনা, যুগ সন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার বিশেষত্ব, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবি প্রতিভা, বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অবদান, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের স্বদেশপ্রীতি, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ও কবিতার বিষয়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্য কীর্তি ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু।

সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ঐতিহাসিক চরিত্রঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
জন্ম৬ মার্চ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯ (বয়স ৪৬)
পরিচিতিবাঙালি কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ভূমিকা :- কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্তের হাত ধরেই মধ্যযুগের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা কবিতা আধুনিকতার পথে নাগরিক রূপ পেয়েছিল। তিনি “গুপ্ত কবি” নামে সমধিক পরিচিত।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী (বর্তমানে কাঁচড়াপাড়া) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পিতৃ পরিচয়

তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম দাস ছিলেন নামকরা কবিরাজ এবং তার পিতা হরিনারায়ণ দাস ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তাঁর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর পারিবারিক পদবী দাস পরিবর্তন করে গুপ্ত করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মামার বাড়িতে আশ্রয়

তাঁর বয়স যখন দশ বছর তখন তার মা পরলোকগমন করেন। পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনি কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বিবাহ

মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তার বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিক্ষা জীবন

শৈশবকালে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগিতার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষ অগ্রসর না হলেও, অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির জোরে ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেন।

সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা -র সম্পাদনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। এটি ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। কিছু দিন বন্ধ থাকার পর পত্রিকাটি ১৮৩৬ সালে পুনরায় চালু হয়। তিনি এটিকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করেন ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অন্যান্য পত্রিকা সম্পাদনা

১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক পাষণ্ড পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক হিসাবে সংযুক্ত। পরবতী বৎসর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকার দায়িত্বভার পালন করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের দ্বারা কবিগান সংগ্ৰহ

তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী রচনা করেছেন।

রক্ষণশীল দলভুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ আন্দোলন -এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মনোভাবের পরিবর্তন

নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তার মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দু থিয়ফিলানথ্রফিক সভা এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি বক্তৃতাও করতেন।

বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -এর বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।

যুগ সন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত। কারণ, তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তার ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের খণ্ড কবিতার আদর্শ

মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার বিশেষত্ব

ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তার রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এই ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের স্বদেশ প্রীতি

স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তার বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তার বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।

রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গানের ব্যবহার

তাঁর ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটকের প্রস্তাবনায় নটীর গানের প্রথম দুটি কলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্ৰন্থে ব্যবহার করেন।

কবিয়ালদের জীবনী প্রকাশে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ভূমিকা

ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দ্বারা উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি

পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তার।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বাংলা সাহিত্যে ভূমিকা

ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি। তবুও এই কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তার গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গুরু পদে বরণ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকরা ঈশ্বর গুপ্তকে ‘গুরু’ পদে বরণ করেছিলেন। তাঁর ছদ্মনাম ‘ভ্রমণকারী বন্ধু’।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা রচনা

মধ্যযুগের দেবমাহাত্ম্য ব্যঞ্জক বিষয় থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করে তিনি অনায়াসে ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তোপসে মাছ‘ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে কবিতা লেখেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিতার বিষয়

তার কবিতায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ঘটনাবলির চিত্ররূপ তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে।

মার্জিত কবিতা রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

তৎকালীন কবিওয়ালাদের থেকে বাংলা কবিতাকে তিনি নাগরিক বৈদগ্ধ ও মার্জিত রুচির আলোয় নিয়ে আসেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্য কীর্তি

তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল রামপ্রসাদ সেন কৃত কালীকীর্তন (১৮৩৩), কবিবর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত (১৮৫৫), প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮), হিত প্রভাকর (১৮৬১), ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র (১৮৬৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসংগ্রহ, সত্যনারায়ণ পাঁচালী ইত্যাদি।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি যুগ সন্ধিক্ষণের কবি পরলোক গমন করেন।

উপসংহার :- সাহিত্য অঙ্গনে তার আবির্ভাব মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর পর্যায়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাকে “খাঁটি বাঙালি কবি” বলে অভিহিত করেছেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে  তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত পত্রিকার নাম কি?

সংবাদ প্রভাকর।

২. কাকে যুগ সন্ধির কবি বলা হয়?

ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত।

৩. ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের মাতৃবিয়োগ হয় কত খ্রিস্টাব্দে?

১০ বছর বয়স, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. ঈশ্বর গুপ্ত কে যুগসন্ধির কবি বলা হয় কেন?

ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত। কারণ, তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তার ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়।

Leave a Comment