শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ব্রাহ্মসমাজের নেতা ও ঐতিহাসিক। তিনি বাংলা সমাজের কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি দূর করতে এবং নারী শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচিত বই “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের পাশাপাশি মানবতাবাদী মূল্যবোধের প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেন, যা তাঁকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
মনীষী শিবনাথ শাস্ত্রী
ঐতিহাসিক চরিত্র | শিবনাথ শাস্ত্রী |
জন্ম | ৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭, বসিরহাট, চব্বিশ পরগনা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ভারত |
প্রধান পরিচিতি | সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ব্রাহ্মসমাজের নেতা, ঐতিহাসিক |
প্রধান অবদান | কুসংস্কার দূরীকরণ, নারী শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা |
সাহিত্যকর্ম | “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ”, “ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজতত্ত্ব” |
সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব | রাজনারায়ণ বসু, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর |
ধর্মীয় আন্দোলন | ব্রাহ্ম সমাজ-এর সক্রিয় সদস্য ও প্রচারক |
দর্শন | মানবতাবাদ, সামাজিক সাম্য, ধর্মীয় উদারতা |
মৃত্যু | ১৯১৯, কলকাতা, ভারত |
ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলন প্রাণ লাভ করেছিল যে কজন মানবহিতৈষী মনীষীর প্রেরণা ও কর্মোদ্যোগে, শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অন্তরে গভীর ঈশ্বর বিশ্বাস ও মানব সেবার ব্রতকে আদর্শ করে দেশ ও সমাজের কাজে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্ম
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাঙ্গড়িপোতা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম হয়েছিল শিবনাথের। তাঁর পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ।
লেখক শিবনাথ শাস্ত্রীর শৈশব
গ্রাম্য পরিবেশে শিবনাথের শৈশব ছিল মুক্ত, আনন্দময়। মনের আনন্দে তিনি খোলা মাঠে ঝোপেঝাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। কীট-পতঙ্গ পশু-পাখীর জীবন পর্যবেক্ষণ করতে ভালবাসতেন। সুযোগ পেলেই খাঁচায় ভরে পাখি পুষতেন। দোয়েল, টুনটুনি, বুলবুলি এসব ছোট পাখি খুব ভালবাসতেন তিনি। পিঁপড়ে ফড়িং ইত্যাদি ধরেও পোষার চেষ্টা করেছেন। মুক্ত প্রকৃতির কোলে ললিত হয়ে শিবনাথের মনটিও হয়ে উঠেছিল উদার। ভবিষ্যতের সংস্কারমুক্ত মনন ও চিন্তার বীজ মুক্ত প্রকৃতিই যেন তাঁর মধ্যে এভাবে উপ্ত করে দিয়েছিল।
ঐতিহাসিক শিবনাথ শাস্ত্রীর বাল্যজীবন
বাল্যবয়সে মাতামহীর স্নেহ ছায়ায় লালিত হয়েছিলেন শিবনাথ। এই মাতামহী সম্পর্কে আত্মচরিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মাতামহীর ন্যায় ব্রাহ্মণকন্যা বিরল। বলিতে কি তাঁহাকে আমি যখন স্মরণ করি, আমার হৃদয় পবিত্র ও উন্নত হয় এবং একথা আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমাতে যা কিছু ভাল আছে তাহার অনেক অংশ তাঁহাকে দেখিয়া পাইয়াছি।’ শিবনাথের মাতা গোলকমণি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণা, নিষ্ঠাবর্তী ও ধর্মভাবাপন্ন। সেই যুগে মেয়েদের শিক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না। তাই বিবাহের পূর্বে তাঁর বিদ্যাশিক্ষা পিতৃগৃহে মায়ের কাছেই হয়েছিল।
লেখক শিবনাথ শাস্ত্রীর শিক্ষাজীবন
পাঁচ বছর বয়সে মজিলপুর গ্রামের পাঠশালায় শিবনাথের স্কুল জীবনের শুরু। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিদিনের সমস্ত পাঠ তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত।
শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রী
স্কুলের পাঠ শেষ হবার আগেই মাত্র নবছর বয়সেই ঘটনাচক্রে শিবনাথকে শিক্ষকতার কাজ শুরু করতে হয়েছিল। সে এক মজার ঘটনা। শিবনাথের ছাত্রীটি ছিলেন তাঁর পিতার সম্পর্কিত খুড়ি। বিধবা এই যুবতী তাঁর পাঁচগুণ বয়সে বড়। তাঁকে বর্ণপরিচয় পড়াতেন শিবনাথ। ভবিষ্যতের শিক্ষক জীবনের হাতেখড়ি তাঁর এভাবেই হয়েছিল বলা চলে। তাঁর যখন একুশ বছর বয়স, তখনও জুটেছিল এক ছাত্রী। বয়সে তাঁর দিগুণ এই ছাত্রীটি ছিলেন তাঁর বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র রায়ের ভাগ্নী। তাঁর নাম ছিল লক্ষ্মী। কথাবার্তা, আলোচনার ফাঁকে তাঁকে তিনি শেখাতেন বাংলা ও ইংরাজী
কলকাতায় শিবনাথ শাস্ত্রী
গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ করে শৈশবে কলকাতায় পড়তে এলেন শিবনাথ। মামার বাড়িতে থেকে ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজে। শহরের পরিবেশ ছিল কলুষমাখা। মামাবাড়িতে যাদের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হত, তাদের অনেকেরই নৈতিক চরিত্র বলে কিছু ছিল না। এদের সঙ্গে একত্র বসবাস করেও তিনি কখনো প্রভাবিত হন নি। তিনি তাঁর পড়াশুনা ও নিজের চিন্তা নিয়ে মগ্ন থাকতেন।
ছবির প্রতি শিবনাথ শাস্ত্রীর নেশা
- (১) এই বাড়ির এক ঘরে থাকতেন এক চিত্রকর। সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে শিল্পী তাঁর ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। শিল্পীর শিল্পকর্ম শিবনাথকে আকর্ষণ করত। স্কুল থেকে ফিরে এসেই তিনি চলে যেতেন চিত্রকরের ঘরে। বসে বসে নিবিষ্ট হয়ে দেখতেন শিল্পীর অঙ্কন কৌশল। কখনও বা তাঁর কোনো ছবি নিয়ে চিন্তায় ডুবে যেতেন।
- (২) আত্মচরিতে এই সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমার ছবি দেখার নেশা সেই অবধি অদ্য পর্যন্ত যায় নাই। আমাকে উৎকৃষ্ট ছবির মধ্যে রাখিয়া দিলে বোধ হয় আহার নিদ্রা ভুলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকিতে পারি।’ সেই শৈশবে শিল্প ও শিল্পীর প্রতি যে প্রগাঢ় ভালবাসার জন্ম হয়েছিল শিবনাথের অন্তরে তা অধিক বয়স পর্যন্ত চির জাগরুক ছিল।
- (৩) ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘটনা থেকে তাঁর এই মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত শিল্পী শশিকুমার হেস সেই সময় রাজা মাহারাজা ও মনীষীদের প্রতিকৃতি এঁকে দেশে বিদেশে খুবই সুনাম অর্জন করেছিলেন। একসময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এরও একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন।
আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী
- (১) ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শশিকুমার লন্ডনে বসবাসকালে আতালি ফ্লামা নামে জনৈকা ফরাসি বিদুষী মহিলার সঙ্গে বাগদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। কিন্তু দেশে ফিরে এসে এই বিবাহের ব্যাপারে পরিবার ও সমাজেব বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হল। ফলে এই বিবাহ ভেঙ্গ যায় এবং শিল্পী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে শশিকুমারের সহযোগিতার জন্য সমাজের গণমান্য অনেকের সঙ্গে এগিয়ে এলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।
- (২) তিনি শশিকুমারের ভাবী বধূ আতালি ফ্লামাকে নিজ গৃহে রেখে ব্রাহ্মসমাজের প্রথা অনুযায়ী বিবাহের বন্দোবস্ত করলেন। সেই বিবাহে সানন্দে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। শশিকুমার ও আতালির বিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল বেনেটোলা অঞ্চলের সিটি স্কুলে। বহু মান্যগণ্য ব্যক্তির সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজেরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন বিবাহ সভায়। আচার্য হিসাবে বিবাহের কাজ শিবনাথ সম্পন্ন করেছিলেন ইংরাজি ভাষায়।
- (৩) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন এক সংবাদপত্রে এই অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল, “An interesting ceremony of mar- riage was held last evening in the Hall of 45 Beniatolah Lane between Mr. S. K. Hesh, the celebrated painter …. and Made- moiselle Flamant, a French lady, who was come out to this country…. They made each other acquaintance some two years back at Paris and their attachment led to a formal engagement in London. Mademoiselle Flamant was a guest of Dr. J. C. Bose for several months. More than two months ago she was initiated into Bramoism by Pandit Sivanath Sastri who was now joined them in holy wedlock. The gests was filled with a large crowd of guests with a sprinkling of European visitors. The serrice and sermon were in English.”
সংস্কার আন্দোলনে শিবনাথ শাস্ত্রী
শিবনাথ যখন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হলেন, সেই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ। বঙ্গীয় সমাজে তখন সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ। শিবনাথ জন্মেছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে সেকালে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার ও অর্থহীন আচার-আচরণ বিষয়ে তাঁর মন ছিল বিরূপ। তাই কলকাতায় আসার পরে সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলন ও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে হতে হয়েছিল পিতার বিরাগভাজন। তবে মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের স্নেহ ও আদর থেকে তাঁকে কখনো বঞ্চিত হতে হয় নি।
পন্ডিত শিবনাথের শাস্ত্রী উপাধি লাভ
নানাভাবে পাঠ্যজীবন বাধাপ্রাপ্ত হলেও এবং নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও শিবনাথ পড়াশুনায় বরাবরই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন, বি.এ. ও এম.এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। সংস্কৃতে এম.এ পাস করে তিনি শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন।
পত্রিকা প্রকাশক শিবনাথ শাস্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হলে ১৮৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর মামা দ্বারকানাথের বিখ্যাত সোমপ্রকাশ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। স্বাস্থ্যের কারণে দ্বারকানাথ সেই সময় কাশীতে অবস্থান করছিলেন।
ব্রাহ্মদের সংস্পর্শে শিবনাথ শাস্ত্রী
এরপরে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন কেশব সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত আশ্রমের মহিলা বিদ্যালয়ে। মাইনে ছিল নামমাত্র-১০ টাকা। এখানে কাজ করার সময়েই তাঁর পরিচয় হয় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে। তিনিও তখন যুক্ত হয়েছেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে। এভাবে ক্রমেই ব্রাহ্মদের সংস্পর্শে এসে শিবনাথ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন।
হরিণাভি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রী
কিছুকাল পরে হরিণাভি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দিলেন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি তার সর্বাঙ্গীন উন্নতির কাজে মনোযোগী হলেন। ছাত্র ও শিক্ষকদের আদর্শ ও নীতিবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন শিবনাথ। তাই সর্বাগ্রে তিনি নজর দিলেন স্কুলের নৈতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে। স্কুলের এক মাষ্টারমশায় যাত্রা দলের সং সাজতেন। আদর্শের প্রতি অবিচল শিবনাথ এতে আপত্তি না জানিয়ে পারলেন না। ফল হল বিপরীত। প্রবল বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হল তাঁকে। অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়লেন মামলায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মামলায় তিনিই জয়ী হলেন। বিরোধীপক্ষকে আদর্শের কাছে মাথা নত করে হার স্বীকার করতে হল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন স্কুল ইন্সপেকটর রাধিকাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে শিবনাথ প্রধান শিক্ষকের চাকরি নিয়ে চলে এলেন ভবানীপুর সাউথ সুবার্বন স্কুলে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত পুরো দুই বছর তিনি এই স্কুলে কাজ করেন।
লেখক শিবনাথ শাস্ত্রীর বিবাহ
- (১) শিবনাথের বিবাহ সম্পর্কে এবারে কিছু বলা যাক। তৎকালীন হিন্দুসমাজ ও কুলপ্রথা অনুসারে ১২-১৩ বছর বয়সেই শিবনাথের বিবাহ হয়েছিল। তখন তিনি কলকাতায় মাতুলালয়ে থেকে পড়াশুনা করতেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রীর নাম ছিল প্রসন্নময়ী। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই বিয়ে পাঁচ বছর পরেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্রসন্নময়ী ও তাঁর পরিবারের প্রতি বিরূপ হওয়ায় শিবনাথের পিতৃদেব হরানন্দ তাঁকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
- (২) পরে তিনি পুত্রের দ্বিতীয়বার বিবাহ দেন বর্ধমান-এর অভয়চরণ চক্রবর্তীর জ্যেষ্ঠাকন্যা বিরাজমোহিনীর সঙ্গে। এই বিয়ে হয়েছিল ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। পিতার পীড়াপীড়িতে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মত হতে হয়েছিল শিবনাথকে। কিন্তু বিয়ের পর অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলেন তিনি।
- (৩) ইতিমধ্যে উভয় পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হওয়ায় প্রসন্নময়ী আবার শ্বশুরগৃহে ফিরে আসেন। দুই স্ত্রীকে নিয়ে একত্রে বাস করলেও বিরাজমোহিনীর জীবন ছিল স্বামীসুখ বঞ্চিত। শিবনাথ কোনদিনই তাঁর সঙ্গে পতিসুলভ ব্যবহার করেন নি। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান এবং নিষ্ঠাবর্তী যোগিনীর মতোই ছিল তাঁর জীবনযাত্রা।
- (৪) স্বামীসুখে বঞ্চিত হলেও এই হৃদয়বর্তী মহিলা সপত্নীর পুত্রকন্যাদের মাতৃস্নেহে লালন পালন করেছেন। প্রসন্নময়ীর মৃত্যু হলে তিনি স্বামীর সঙ্গেই নিষ্কামভাবে বসবাস করেন। বিরাজমোহিনী ছিলেন শিবনাথের আদর্শ সহধর্মিনী। তিনি তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজে উপাসনায়ও যোগ দিতেন। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথের প্রথম সন্তান হেমলতার জন্ম হয়।
শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রতি পিতার রাগ
- (১) একবার কলকাতায় এলে হরানন্দ শিবনাথকে ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করতে নিষেধ করেন। কিন্তু শিবনাথ পিতৃআজ্ঞা সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতে পারলেন না। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতাবাদের প্রতিও শিবনাথ বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তিনি পরিবারের বিগ্রহ পূজা করতেন না। এই সকল ব্যাপারে হরানন্দ পুত্রের প্রতি অত্যন্ত কুপিত হলেন।
- (২) শিবনাথ হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথাও মানতেন না। কিছুকাল পরে জাত্যাভিমানের চিহ্ন পৈতাও চিরতরে পরিত্যাগ করে প্রগতিশীল ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন। সেইকালে বঙ্গীয় ব্রাহ্মসমাজ দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রকে কেন্দ্র করে দুটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শিবনাথ কেশব সেনের নববিধান দলে যোগ দিলেন।
- (৩) পুত্রের স্বধর্মত্যাগের সংবাদ পেয়ে হরানন্দ পুত্রকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেন। কেবল এখানেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি পুত্র বাড়িতে এলে তাকে বাধা দেবার জন্য তিনি মাইনে দিয়ে গুন্ডা পুষেছিলেন। মাতৃঅন্তপ্রাণ শিবনাথ মাকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে লুকিয়ে মজিলপুরে যেতেন।
মেয়েদের বিয়ের বয়স সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী
- (১) কেশবচন্দ্র ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সভা স্থাপন করেছিলেন। এই সভার কাজে শিবনাথ ছিলেন তাঁর একান্ত সহযোগী। হিন্দু মেয়েদের বিবাহের বয়সের প্রশ্নে শিবনাথের ব্যক্তিগত জীবনেই তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করে তিনি এই বিষয়টির সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করলেন।
- (২) বস্তুতঃ জ্ঞান-বুদ্ধি বিকশিত হবার পূর্বেই সেইকালে কন্যাদের পাত্রস্থ করা হত। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ভাগ্য বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা হত তাদের চিরসঙ্গী। মেয়েদের বিবাহের বয়স নিরূপণের বিষয়টি ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশনের কর্মতালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হল। এই বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিপ্রায়ে কেশব সেন ভারতে মেয়েদের বিয়ের বয়স কী হওয়া উচিত তা জানার জন্য দেশের বিখ্যাত সকল ডাক্তারকেই চিঠি লেখেন।
- (৩) এ বিষয়ে তাঁদের অভিমত জানিয়ে স্বদেশী বিদেশী সকল ডাক্তারই লেখেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ থেকে ১৬ ধরা উচিত। ডাক্তারদের মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলন করে কেশব সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্রাহ্ম নেতা ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি আইন পাস করান। এই আইন বলে ১৪ বছরই মেয়েদের বিয়ের বয়স বলে ধার্য হয়।
হেয়ার স্কুলের শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রী
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুর সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে ইস্তফা দিয়ে শিবনাথ হেয়ার স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষকরূপে যোগ দেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের কাজের জন্য দুই বছর পরেই সরকারী চাকুরিতে ইস্তফা দেন।
শিবনাথ শাস্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বঙ্গ-মহিলা বিদ্যালয়
নারী-মুক্তি আন্দোলনে শিবনাথ কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। কিন্তু মহিলাদের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যখন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আন্দোলন শুরু করেন, কেশবচন্দ্র তার বিরোধিতা করেন। ফলে উভয়ের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত কেশবচন্দ্রকে অগ্রাহ্য করেই শিবনাথ হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় বা বঙ্গ-মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শিবনাথ শাস্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতি
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগী তরুণদের নিয়ে ঘনবিশিষ্ট নামে একটি বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেন। জাতীয়তা মূলক ও সমাজ-সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পরিকল্পনা এই সমিতির কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিবনাথের এই গুপ্ত সমিতিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু যোগ দিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী এই গুপ্ত সমিতির অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে ছিল, জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার, সরকারি চাকরি পরিত্যাগ ও সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। সমিতির সভ্যদের নিয়মিতভাবে অশ্বারোহন ও বন্দুকচালনাও শিক্ষা দেওয়া হত।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে শিবনাথ শাস্ত্রী
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহারের রাজপবিবারে কেশবচন্দ্রের অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ উপলক্ষে ব্রাহ্মসমাজে ভাঙ্গন ধরে। শিবনাথের নেতৃত্বে এই সময় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয় এবং এই সময় থেকে ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সমাজ সংস্কারের কাজেও সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান
শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে শিবনাথ আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একযোগে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছরে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান।
বিলাতি পত্রিকায় শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুবাদ প্রকাশ
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে শিবনাথ ছয় মাসের জন্য বিলাত গমন করেন। বিলাতে অবস্থান-কালে Journal of National Indian Association নামক স্থানীয় একটি পত্রিকায় শিবনাথের লিখিত মেজবউ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল বিলাতি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত বাংলা উপন্যাস।
শিবনাথ শাস্ত্রী কর্তৃক সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠা
বিলাত থেকে ফিরে শিবনাথ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্ম ও জনসমাজের সেবায় যথার্থ উৎসাহী, বৈরাগ্যভাবাপন্ন বিশ্বস্ত কর্মী গঠনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাধনাশ্রম।
লেখক শিবনাথ শাস্ত্রীর গ্রন্থ
তাঁর রচিত সাহিত্য বিপুল। ‘আত্মচরিত’ এবং ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ তথ্যমূলক অতিমূল্যবান গ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ নির্বাসিতের বিলাপ, বিধবার ছেলে, যুগান্তর, নয়নতারা, ধর্মজীবন, History of the Brahmo Samaj, Men I have seen প্রভৃতি।
শিবনাথ শাস্ত্রীর মৃত্যু
সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে শিবনাথকে। শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হতে লাগলেন। অবশেষে শয্যা নিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর লোকসেবক অক্লান্তকর্মা শিবনাথ পরলোক গমন করেন।
উপসংহার :- উপসংহারে বলা যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ, যিনি বাংলা রেনেসাঁর প্রগতিশীল ধারা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রচারক ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি ধর্মীয় উদারতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নারী শিক্ষার পক্ষে কাজ করেন। তাঁর রচিত “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” গ্রন্থ বাংলা সমাজের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনকে চিত্রিত করেছে এবং আজও গবেষণার মূল্যবান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবন ও আদর্শ বাংলার সমাজকে আরও মানবিক, যুক্তিবাদী এবং প্রগতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
(FAQ) শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
শিবনাথ শাস্ত্রী ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং ব্রাহ্মসমাজের নেতা ছিলেন। তিনি বাংলা রেনেসাঁর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রবর্তক ছিলেন।
তিনি সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ, নারী শিক্ষা প্রসার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য বিখ্যাত। তাঁর বই “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
তাঁর প্রধান সাহিত্যকর্ম হলো “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ”, যেখানে বাংলা রেনেসাঁ এবং সে সময়ের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ রয়েছে।
তিনি নারী শিক্ষা, ধর্মীয় উদারতা, কুসংস্কার দূরীকরণ এবং সামাজিক সাম্যের প্রচারের জন্য কাজ করেছেন। ব্রাহ্মসমাজের নেতা হিসেবে তিনি ধর্মীয় উদারতার প্রচার করেছেন।
তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলার সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর চিন্তাধারা ও সমাজসংস্কারমূলক কাজ পরবর্তী প্রজন্মের সমাজ সংস্কারকদের অনুপ্রাণিত করেছে।