জেমস মিল

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল প্রসঙ্গে জন্ম, শিক্ষা, বেন্থামের দর্শনের প্রতি আকর্ষণ, ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা, ভারত সম্পর্কে জ্ঞান লাভে জেমস মিলের মন্তব্য, ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গি, ও তার বিভিন্ন গ্ৰন্থ সম্পর্কে জানবো।

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল

ঐতিহাসিক চরিত্রজেমস মিল
জন্ম৬ এপ্রিল ১৭৭৩ খ্রি
অধিবাসীস্কটল্যাণ্ড
পরিচিতিঐতিহাসিক, দার্শনিক
ধারাউপযোগবাদ
গ্ৰন্থ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’
মৃত্যু২৩ জুন ১৮৩৬ খ্রি
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল

ভূমিকা :- স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা জেমস মিল ছিলেন একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক।

জেমস মিলের জন্ম

৬ এপ্রিল ১৭৭৩ সালে স্কটল্যান্ডের অ্যাঙ্গাস অঞ্চলের নর্থওয়াটার ব্রীজ এলাকায় জেমস মিল জন্মগ্রহণ করেন

জেমস মিলের শিক্ষা

বাল্যশিক্ষা শেষ করার পর তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন এবং সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ভাগ্যান্বেষণে লন্ডন গমন করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

বেন্থামের দর্শনের প্রতি জেমস মিলের আকর্ষণ

লন্ডনে অবস্থানকালে জেমস মিলের সঙ্গে উপযোগবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা জেরেমি বেন্থামের পরিচয় ঘটলে তিনি বেন্থামের কাছ থেকে দর্শনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন।

ভারতবর্ষ সম্পর্কে জেমস মিলের গ্ৰন্থ রচনা

জেমস মিল কখনও ভারতবর্ষ-এ না এসেও বিভিন্ন তথ্য, মহাফেজখানার নথিপত্র প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ভারত সম্পর্কে জ্ঞান লাভে জেমস মিলের মন্তব্য

তাঁর মতে, একজন যোগ্য ব্যক্তি সারা জীবন ভারতে বসবাস করে ভারত সম্পর্কে যে জ্ঞানার্জন করতে পারবে, ইংল্যান্ড-এর একটি ছোটো ঘরে মাত্র এক বছর চর্চা করে ভারত সম্পর্কে আরও বেশি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হবে।

ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গি

ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে নীচে উল্লেখ করা হল –

(ক) সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টি

  • (১) জেমস মিল সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করেন। তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্ৰন্থটি ১৮১৭ (মতান্তরে ১৮১৮) খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় তিন খণ্ডে প্রকাশিত মিলের এই গ্রন্থটিকে লর্ড মেকলে একটি মহাগ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন।
  • (২) ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা তাত্ত্বিক ও জনপ্রিয়  – এই দুই ধরনের ইতিহাস রচনা করেছেন বলে ঐতিহাসিক এরিখ স্টোকস উল্লেখ করেছেন। জেমস মিলের লেখা ওই গ্ৰন্থটি ছিল তাত্ত্বিক ইতিহাস। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পশ্চাৎপদ ও নিকৃষ্ট হিসেবে দেখিয়ে এর তীব্র সমালোচনা করেছেন।
  • (৩) তিনি ভারতীয় সমস্যাকে তিনটি শাখায় বিভক্ত করেছেন। যথা – সরকারের রূপ, আইনের প্রকৃতি ও কর ব্যবস্থা। মিল বিশ্বাস করতেন যে, এই তিনটি বিভাগের সংস্কার করলে ভারতীয় সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে।

(খ) সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে যুগ বিভাজন

জেমস মিল ভারতের ইতিহাসের সময়কালকে মূলত তিনটি যুগে ভাগ করেছেন। এগুলি হল – হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ। এই তিনটি যুগের সভ্যতাকে তিনি যথাক্রমে হিন্দু সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতা ও ব্রিটিশ সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন। মিলের এই সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে ঐতিহাসিক স্যার হেনরি এলিয়ট সমর্থন করেছেন।

(গ) ভারতীয় সভ্যতাকে নিকৃষ্ট হিসেবে তুলে ধরা

  • (১) জেমস মিল পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। মিলের অভিমত ছিল, ভারতীয় সমাজ অত্যন্ত নিম্নমানের, এমনকি ইউরোপ-এর সামন্ততান্ত্রিক যুগের চেয়েও নিম্নমানের। জেমস মিল মনে করতেন যে, অষ্টাদশ শতকে ভারতীয়রা যে দূরবস্থার মধ্যে বসবাস করত তা তাদের অতীত অবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি।
  • (২) মিলের মতে, ব্রিটিশরা ভারতে আসার পূর্বে ভারতের সমাজ গতিহীন হয়ে পড়েছিল এবং সামাজিক অগ্রগতির পথ কার্যত রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন চরিত্র, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, আইনবিধি প্রভৃতি সবকিছুকেই নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন। এভাবে মিল ভারতীয়দের বর্তমান দুরবস্থার জন্য অতীতকে দায়ী করে ব্রিটিশ শাসনকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

(ঘ) ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যগ্রতা

  • (১) জেমস মিল ভারতের পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের পথনির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, দেশে ভালো আইন প্রণয়ন ভারতীয়দের উন্নতিবিধান করতে পারে। মিলের মতে, কোনো অধিকতর উন্নত জাতি অপেক্ষাকৃত কম উন্নত জাতির উন্নতি ঘটানোয় সহায়তা করতে পারে।
  • (২) তাই ব্রিটিশরা উন্নত সভ্যতার অধিকারী বলে তাদের শাসনাধীনে ভারতীয় সভ্যতারও উন্নতি ঘটবে। মিল মনে করতেন যে, ভারতীয় সভ্যতা ব্রিটিশদের চেয়ে উন্নততর হলে ব্রিটিশ জাতির ওপর ভারতীয়দের শাসনও যুক্তিসংগত হত। জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গী তার সমসাময়িক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল।

(ঙ) ব্রিটিশ শাসনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা

  • (১) জেমস মিলের মতে, ভারতীয় সমাজ নানা জাতি ও প্রথায় বিভক্ত। এরূপ সামাজিক পরিস্থিতিতে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রসার ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। ইউরোপীয় সমাজ ও সভ্যতার সংস্পর্শে ভারতীয়দের দ্রুত সার্বিক উন্নতি ঘটবে।
  • (২) তাঁর মতে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান, শিল্প, রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ভারতীয়দের মধ্যে প্রসারিত হলে অর্ধসভ্য’ ভারতীয়রা ‘সভ্য’ হয়ে উঠবে। ভারতের স্থানীয় শাসকদের চেয়ে ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে ভারতীয়রা অধিক সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করবে।
  • (৩) এজন্য বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চলেও ব্রিটিশদের বিজয় অভিযান চালাতে হবে। মিলের মতে ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের কর্তব্য হল ভারতীয়দের উন্নত আইন ও শাসনের অধীনে এনে তাদের সামগ্রিক উন্নতি ঘটানো। তাঁর মতে, ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা দানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ভারতে অনন্তকাল ধরে ব্রিটিশ শাসন টিকে থাকবে।

(চ) জোন্সের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা

  • (১) উপযোগবাদী জেমস মিল ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্সের অভিমতের বিরোধিতা করেন। স্যার জোন্স মনে করতেন যে, ভারতের পৌরাণিক কাহিনী থেকে এদেশের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন যে, প্রাচ্যদেশীয় গ্রন্থগুলি অনুবাদের দ্বারা ইউরোপীয় সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।
  • (২) কিন্তু মিল জোন্সের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছেন। তিনি জোন্সের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘রক্ষণশীল’ আখ্যা দিয়েছেন। মিল মনে করতেন যে, কোনো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে তার অতীতের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। তাই ভারতের অতীতেরও বর্তমানে কোনো গুরুত্ব নেই।

জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা

জেমস মিল ভারত সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করেন তা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সহ আধুনিক কালের অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্য হল –

(ক) জাতিবিদ্বেষী মনোভাব

মিল ছিলেন জাতিবিদ্বেষের সমর্থক। তিনি ব্রিটিশ সভ্যতাকে উন্নত হিসেবে বিচার করে ভারতীয় সভ্যতাকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন।

(খ) তথ্যে ভুল

মিলের গ্ৰন্থের বহু মতামত ভ্রান্ত। তা ছাড়া তথ্যেও প্রচুর ভুলভ্রান্তি আছে।

(গ) ভ্রান্ত যুগ বিভাজন

  • (১) ভারতীয় ইতিহাসের যুগ বিভাজনে মিলের দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত। কারণ, প্রাচীন যুগে ভারতে হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। তেমনি মধ্যযুগে ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মধ্যেও দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু এবং সেই সময় হিন্দুদের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজত্বের অস্তিত্বও ছিল।
  • (২) আধুনিক যুগে ভারতে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল হিন্দু ও মুসলিম। তাই অধিকাংশ ঐতিহাসিক ভারতের ইতিহাসকে প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগে বিভক্ত করার পক্ষপাতী।

(ঘ) শাসক ও শাসিতের বিভেদের বীজ রোপণ

মিলের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিভেদের বীজ রোপিত হয়েছে।

জেমস মিলের গ্ৰন্থ রচনা

উপযোগবাদের প্রবক্তা জেমস মিল রচিত গ্ৰন্থ গুলি হল –

  • (১) An Essay on the Impolicy of a Bounty on the Exportation of Grain (১৮০৪)
  • (২) Lord Lauderdale on Public Wealth (১৮০৪)
  • (৩) Commerce Defended (১৮০৮)
  • (৪) Thomas Smith on Money and Exchange (১৮০৮)
  • (৫) দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, তিন খণ্ড (১৮১৮)
  • (৬) Government (১৮২০)
  • (৭) Elements of Political Economy (১৮২১)
  • (৮) Liberty of the Press (১৮২৩)
  • (৯) Essays on Government, Jurisprudence, Liberty of the Press, Education, and Prisons and Prison Discipline (১৮২৩)
  • (১০) An Analysis of the Phenomena of the Human Mind (১৮২৯)
  • (১১) Analysis of the Phenomena of the Human Mind. (১৮৬৯)
  • (১২) Essay on the Ballot and Fragment on Mackintosh (১৮৩০)
  • (১৩) Whether Political Economy is Useful (১৮৩৬)
  • (১৪) The Principles of Toleration (১৮৩৭)

জেমস মিলের মৃত্যু

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন জেমস মিল মৃত্যু বরণ করেন।

উপসংহার :- ডেভিড রিকার্ডোর সাথে তাকেও ধ্রুপদী অর্থনীতির জনক বলা হয়। তিনি ধ্রুপদী উদারবাদের অন্যতম রূপকার জন স্টুয়ার্ট মিলের পিতা।

(FAQ) ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জেমস মিল কোন দেশের অধিবাসী ছিলেন?

স্কটল্যাণ্ড।

২. জেমস মিল কবে জন্মগ্ৰহণ করেন?

৬ এপ্রিল ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে।

৩. জেমস মিলের বিখ্যাত গ্ৰন্থের নাম কি?

‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’।

৪. জেমস মিল দর্শনের কোন ধারার প্রবক্তা ছিলেন?

হিতবাদী বা উপযোগবাদী।

Leave a Comment