মহাকাব্যের যুগ প্রসঙ্গে নামকরণ সঠিক নয়, প্রাচীনত্ব, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, রাজতন্ত্র ও গণরাজ্য, রাজার ক্ষমতা, শাসন ব্যবস্থা, জাতিভেদ প্রথা, নারীদের অবস্থা ও ধর্মজীবন সম্পর্কে জানবো।
মহাকাব্যের যুগ প্রসঙ্গে মহাকাব্যের যুগ নামকরণ সঠিক না হওয়ার কারণ, মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের প্রাচীনত্ব, মহাকাব্যের যুগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, মহাকাব্যের যুগে গণরাজ্য ও রাজতন্ত্র, মহাকাব্যের যুগে রাজার ক্ষমতা, মহাকাব্যের যুগে শাসন ব্যবস্থা, মহাকাব্যের যুগে যুদ্ধনীতি ও বীরধর্ম, মহাকাব্যের যুগে জাতিভেদ প্রথা, মহাকাব্যের যুগে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা, মহাকাব্যের যুগে নারীর অবস্থা, মহাকাব্যের যুগে রাজস্ব ও শুল্ক, মহাকাব্যের যুগে ধর্মজীবন।
রামায়ণ ও মহাভারত নির্ভর মহাকাব্যের যুগ
ঐতিহাসিক যুগ | মহাকাব্যের যুগ |
মহাকাব্য | রামায়ণ ও মহাভারত |
রামায়ণ | মহর্ষি বাল্মীকি |
মহাভারত | বেদব্যাস |
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ | মহাভারত |
ভূমিকা :- পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে মহাকাব্যের যুগ বলা হয়। বৈদিক যুগের পরে আর্য সভ্যতার বিকাশ জানতে হলে আমাদের প্রধানত দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং সূত্র সাহিত্যগুলির ওপর নির্ভর করতে হয়। এজন্য অনেকে এই যুগকে ‘মহাকাব্যের যুগ’ বলেন।
মহাকাব্যের যুগ নামকরণ সঠিক না হওয়ার কারণ
রামায়ণ ও মহাভারত নির্ভর ‘মহাকাব্যের যুগ’ এই নামকরণ সঠিক নয় বলে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন। কারণ,
- (১) সমগ্র মহাভারত অর্থাৎ এই মহাকাব্যের সকল পর্বগুলি কোনো একটি বিশেষ যুগে রচিত হয় নি। কিংবদন্তি অনুসারে জানা যায় যে, ঋষি বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেন। কিন্তু পণ্ডিতেরা বিচার করে দেখেছেন যে, কোনো একজন লোক সমগ্ৰ মহাভারত রচনা করেছেন এমন কথা বলা যায় না। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন লোকের রচনা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
- (২) মহাভারতের প্রথম অংশ সূত্র যুগে অথবা পরবর্তী বৈদিক যুগে রচিত হয়। মহাভারতের পরের অংশগুলি আরও অনেক পরে রচিত হয়। মহাভারতে কোনো বিশেষ যুগের কথা বলা হয়েছে একথা বলা চলে না। এই সকল কারণে ডঃ আর. ডি. ব্যানার্জী প্রমুখ গবেষক বলেন যে, ‘মহাকাব্যের যুগ’ এই নামকরণ ঠিক নয়।
- (৩) সম্প্রতি হস্তিনাপুর খননকার্যের ফলে মহাভারতের দেওয়া তথ্য সম্পর্কে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে মহাভারতের মূল কাহিনীর কিছু সত্যতা আছে বলে এখন মনে করা হয়।
মহাকাব্যের যুগ অর্থাৎ রামায়ণ ও মহাভারতের প্রাচীনত্ব
- (১) রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে পণ্ডিতেরা মহাভারতকেই প্রাচীনতর বলে মনে করেন। কারণ বৈদিক সূত্র সাহিত্যের সঙ্গে মহাভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। রামায়ণে এরূপ সম্পর্ক দেখা যায় না। তাছাড়া মহাভারতের সংস্কৃত ভাষা রামায়ণের মত মার্জিত ও উন্নত নয়। মহাভারতের ভাষায় অনেকটা আদিমতার ছাপ আছে।
- (২) ডঃ সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেন যে, “রামায়ণের কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।” পাণিনির রচনায় মহাভারতের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাণিনি নিঃসন্দেহে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগের রচনাকার। পাণিনিতে রামায়ণের উল্লেখ না থাকায় অনেকে মনে করেন যে, রামায়ণ পাণিনির পরের যুগের রচনা।
- (৩) মহাভারতে রাজা পরীক্ষিত ও জনমেজয়ের নাম পাওয়া যায়। এই রাজারা পরবর্তী বৈদিক যুগে অথবা সূত্র যুগে রাজত্ব করতেন বলে জানা যায়। এই কারণে মহাভারতকেই দুই মহাকাব্যের মধ্যে প্রাচীনতর বলা হয়।
মহাকাব্যের যুগে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ
মহাভারতে কিছু কিছু বিষয় প্রক্ষিপ্ত থাকলেও মূল কাহিনী যথা কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের কাহিনী বেশ প্রাচীন ঘটনা। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সম্ভবত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বে ঘটেছিল। তবে এই যুদ্ধের কাল গণনা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
মহাকাব্যের যুগে রাজতন্ত্র ও গণরাজ্য
বৈদিক সভ্যতার পর সূত্র ও মহাকাব্যের যুগের রাষ্ট্র ছিল প্রধানত রাজতান্ত্রিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা জানা যায়। প্রজাতন্ত্রকে ‘গণ’ বলা হত। মহাভারতের শান্তিপর্বে ‘গণ’ রাজ্যের উল্লেখ আছে। ব্যাকরণ সূত্রের রচয়িতা পাণিনি ‘সঙ্ঘের’ কথা উল্লেখ করেছেন। যথা – ক্ষুদ্রক, মালব, যৌধেয় প্রভৃতি সঙ্ঘ। সাধারণভাবে কয়েকটি ‘গণ’ বা প্রজাতন্ত্রের সমষ্টিকে সঙ্ঘ বলা হত। গণ রাজ্যগুলির শাসনের দায়িত্ব ছিল জ্যেষ্ঠ বা মুখ্য ব্যক্তিদের হাতে। এঁরা ছিলেন দেশের মান্যগণ্য লোক।
মহাকাব্যের যুগে রাজার ক্ষমতা
- (১) রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলি অবশ্যই রাজার দ্বারা শাসিত হত। মহাকাব্যের যুগে রাষ্ট্রগুলির আয়তন বেশ বড় ছিল। এই যুগে যুদ্ধ-বিগ্রহের দ্বারা রাষ্ট্রের সীমা বাড়াবার নিরন্তর চেষ্টা চলত। সূত্রযুগে রাজা একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতেন না। তাঁর ক্ষমতার অনেকটা নানা কর্মচারীর মধ্যে ভাগ হয়ে যেত।
- (২) রাজাকে প্রজার মঙ্গলের কথা ভাবতে হত। মহাভারতে ধর্মরূপী বক যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম সম্পর্কে যে জ্ঞান দেন তাতে দেখা যায় প্রজা কল্যাণ ছিল রাজার অবশ্য কর্তব্য। রাজসভায় বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও রাজকুলের লোকেদের কথা রাজাকে মান্য করতে হত। রাজা দুর্যোধন তা মান্য না করায় নিন্দিত হন।
- (৩) মহাকাব্যের যুগে রাজার ক্ষমতার ওপর নানা প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছিল। জনপদগুলি স্থানীয় প্রথা দ্বারা শাসিত হত। রাজাকে তা মেনে চলতে হত। মন্ত্রিপরিষদ ও সভার পরামর্শ রাজা মেনে চলতেন। সামরিক বিষয়ে সভা পরামর্শ দিত। মন্ত্রিপরিষদে ৪ জন ব্রাহ্মণ, ৮ জন ক্ষত্রিয়, ২১ জন বৈশ্য ও কয়েকজন শূদ্র মন্ত্রী থাকতেন। মহাভারতে এই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়।
রামায়ণ ও মহাভারত নির্ভর মহাকাব্যের যুগের শাসনব্যবস্থা
- (১) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছিল মহাকাব্যের যুগের প্রথা। গ্রামণী গ্রামের শাসন করত ও রাজস্ব আদায় করত। তাছাড়া গ্রামণী গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করত। গ্রামণীর ওপরে ছিল ২০টি গ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী বা বিশেষ কর্মচারী। এর ওপরে ছিল অধিপতি। এই কর্মচারী এক হাজার গ্রামে শাসন করত।
- (২) পাণিনির সূত্রে দেখা যায় যে, গ্রামের ওপরের শাসন বিভাগকে নগর বলা হত। নগরের ওপরের শাসন বিভাগের নাম ছিল বিষয়। সবার ওপরে ছিল জনপদ। সম্ভবত জনপদকেই মহাভারতে ১০০০ গ্রাম নিয়ে গঠিত শাসনকেন্দ্র বা অধিপতির শাসন শাসনকেন্দ্র বলা হয়েছে।
মহাকাব্যের যুগের যুদ্ধনীতি ও বীরধর্ম
- (১) মহাকাব্য ও সূত্র যুগে ক্ষত্রিয়শ্রেণী সমাজে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই শ্রেণীই রাজ্য শাসন করত, যুদ্ধ করত এবং অধিকাংশ ক্ষমতা ভোগ করত। মহাকাব্যে ক্ষাত্রধর্মের গুণগান করা হয়েছে।
- (২) ক্ষত্রিয় শ্রেণীর বীরধর্ম, আত্মমর্যাদা, যুদ্ধক্ষেত্রে অসহায় শত্রুকে হত্যা না করে কৃপা করা প্রভৃতি নানা গুণের কথা মহাকাব্যে বলা হয়েছে। শত্রুকে অজ্ঞাতসারে লুকিয়ে আক্রমণ করাকে কপটতা ও অন্যায় বলে মনে করা হত। ভীম গদাযুদ্ধে আইন ভেঙে দুর্যোধনের উরু ভেঙে দেন এজন্য তিনি নিন্দিত হয়েছেন।
- (৩) কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় এক ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের প্রচলন ছিল দেখা যায়। রাত্রিকালে একপক্ষ অন্যপক্ষের শিবির আক্রমণ করত না। এমন কি রাত্রিকালে তারা পরস্পরের শিবিরে এসে আলাপ করত। দিনের বেলা তারা যুদ্ধ করত। যুদ্ধের সময় কৃষকের ক্ষেতের ফসল ও ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা হত না।
- (৪) যুদ্ধ হত ক্ষত্রিয় বনাম ক্ষত্রিয়ের মধ্যে। নারী ও নপুংশকে হত্যা করা হত না। মহাবীর ভীষ্ম নপুংশক শিখণ্ডীকে সামনে দেখে অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন। ব্রাহ্মণরাও যুদ্ধ-বিগ্রহ করতেন। কুরু ও পাণ্ডবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ও তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা ছিলেন ব্রাহ্মণ। এঁরা যুদ্ধে সেনাপতির কাজও করেন।
মহাকাব্যের যুগে জাতিভেদ প্রথা
- (১) সমাজে চারটি বর্ণ যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বেশ স্পষ্টভাবে ভাগ হয়েছিল। লোকে বিশ্বাস করত যে, কর্মফলের প্রভাবে লোক উচ্চ ও নীচ বংশে জন্মায়। সমাজে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য থাকলেও, ক্ষত্রিয় শ্রেণী প্রায় সকল ক্ষমতা ভোগ করত।
- (২) জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা ছিল না। মহাভারতে অসবর্ণ বিবাহের নজীর দেখা যায়। সত্যবতীর উপাখ্যান এই প্রসঙ্গে মন্তব্য। ব্রাহ্মণ দ্রোণ ছিলেন কুরু ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু এবং যুদ্ধে সেনাপতি। অপর দিকে রামায়ণে গুহক চণ্ডালের উপাখ্যান, শূদ্রের বেদ পাঠে নিষেধাজ্ঞা জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা ও ব্রাহ্মণদের গোঁড়ামির পরিচয় দেয়।
রামায়ণ ও মহাভারত নির্ভর মহাকাব্যের যুগে দক্ষিণ ভারতের আর্য সভ্যতা
- (১) মহাকাব্য ও সূত্র যুগে সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা উত্তর ভারতে আর্যদের বসতি বিস্তার ভালভাবে হয়েছিল বলা যায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে, যে সকল রাজা যোগ দেয় তারা অনেকেই ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে এসেছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভারত ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনুপস্থিত।
- (২) পাণিনির ব্যাকরণ সূত্রে যে সকল স্থানের নাম আছে তা সকলই বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরের। বিন্ধ্যের দক্ষিণের নাম প্রায় নেই বলা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, সূত্র ও মহাভারতের যুগে আর্য সভ্যতা উত্তর ভারতেই প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল।
- (৩) রামায়ণের রামচন্দ্রের লঙ্কা (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) বিজয়ের কাহিনীকে অনেকে দক্ষিণের দ্রাবিড় সভ্যতার বিরুদ্ধে আর্য সভ্যতার বিজয় বলেন। রামায়ণের কাহিনী অবশ্য মহাভারত অপেক্ষা অনেক পরে লেখা বলে মনে হয়। সুতরাং রামায়ণের যুগে দক্ষিণে আর্য সভ্যতা বিস্তৃত হতে পারে।
মহাকাব্যের যুগে রামায়ণের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা
- (১) রোমিলা থাপার বামায়ণের কাহিনীর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা গোড়ার দিকে পড়েছি যে, মানুষ আদিতে খাদ্য উৎপাদন করতে জানত না, খাদ্য সংগ্রহ করত (Food Gathering man)। বনের ফলমূল কুড়িয়ে ও পশু শিকার করে তারা ক্ষুধার নিবৃত্তি করত। পরে এক উচ্চতর সভ্যতা আসে, যখন মানুষ কৃষি দ্বারা ইচ্ছামত খাদ্য উৎপাদন করত।
- (২) রোমিলা থাপার বলেন যে, গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষি সভ্যতা বা আর্য সভ্যতার সঙ্গে, বিন্ধ্য অঞ্চলের খাদ্য সংগ্রহকারী, শিকারী, অরণ্যাচারী জাতির সংঘাত হল রামায়ণের আসল উপজীব্য। এই সংঘাতে রাম ছিলেন কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকারী উন্নত সভ্যতার প্রতীক, আর রাবণ ছিলেন খাদ্য সংগ্রহকারী, অরণ্যচারী সভ্যতার প্রতীক। এতে অবশ্যই কৃষি সভ্যতার ধ্বজাধারী রামের জয় হয়।
- (৩) পরের যুগের কোনো উর্বর মস্তিষ্ক কবি এই ঘটনাকে অবলম্বন করে তার কাব্য রচনা করেন। তিনি বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে এই সংঘাতের স্থান না দেখিয়ে কল্পনাবশত সিংহলে রাবণের স্বর্ণলঙ্কাকে নির্দেশ করেন।
- (৪) প্রত্নতত্ববিদ ডি. ডি. সাংখালিয়া এই কারণে দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে স্বর্ণলঙ্কার অবস্থান আছে অনুমান করে খননকার্য চালাচ্ছেন। যদি এই খননকার্যের ফলে বিন্ধ্য অঞ্চলে লঙ্কার অবস্থিতি সম্পর্কে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় তবে এই মত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মহাকাব্যের যুগে নারীদের অবস্থা
- (১) মহাকাব্যের যুগে নারীদের মর্যাদা বৈদিক যুগ অপেক্ষা অনেক কম ছিল। পুরুষেরা বহু পত্নী গ্রহণ করত। পাণ্ডু রাজার একাধিক পত্নী ছিল। ঋষিদেরও একাধিক পত্নী থাকত। এছাড়া অসংখ্য দাসী থাকত। নারীরা কদাচিৎ বহু স্বামী গ্রহণ করত। মহাভারতে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী ছিল। তবে এটা অনার্য প্রভাবে ঘটেছিল বলে অনেকে বলেন।
- (২) তারা, মন্দোদরী প্রভৃতি অনার্য নারীরা স্বামীর মৃত্যু হলে দেবরকে পতি হিসেবে গ্রহণ করেন। নারীরা জাতীয় উৎসব বা শোকের সময় অন্তঃপুর ছেড়ে বাইরে আসতেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে মৃত কৌরব বীরদের মাতা ও ভার্যারা তাদের শ্রাদ্ধ ও সৎকার উপলক্ষে বাইরে আসেন ও শোক প্রকাশ করেন।
রামায়ণ ও মহাভারত নির্ভর মহাকাব্যের যুগে রাজস্ব ও শুল্ক
- (১) মহাকাব্যের যুগে ভূমিকরের হার ছিল ফসলের ১/৬ থেকে ১/১০ অংশ। কৃষিকে সম্মানজনক জীবিকা বলে মনে করা হত। বাণিজ্য স্থলপথে ও নদীপথে চলত। বাণিজ্য দ্রব্যের ওপর শুল্ক আদায় হত শতকরা ৫%। সোনা ও রূপার খনি এবং এই দুই ধাতুর বিক্রয়ের ওপর শতকরা ২% কর ধার্য করা হত। লোকে সুদে টাকা খাটাতে ভালবাসত। ব্রাহ্মণদের পক্ষে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।
- (২) মধ্যযুগের ইউরোপ -এ ভূমিদাসদের জমির মালিককে যেরূপ বেগার বা শ্রম কর (Corvee) দিতে হত, মহাকাব্যের যুগে কারিগরদের সেরূপ মাসে একদিন বেগার খাটতে হত। এটাই ছিল তার কর। শূদ্ররা সম্ভবত জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হত না। তবে জমির ওপর মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হত। এর বিনিময়ে প্রভুকে কর ও বেগার দিতে হত।
মহাকাব্যের যুগে ধর্মজীবন
- (১) মহাকাব্যের যুগে অধিকাংশ বৈদিক দেবতা তাদের মর্যাদা হারান। এই যুগের শ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন বিষ্ণু। তিনি ছিলেন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের অধিকারী। বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের উল্লেখ দেখা গেলেও তিনি বিষ্ণুর কাছে ম্লান হয়ে গেছেন দেখা যায়। বিষ্ণুর জন্য স্বর্গে বিশেষ স্থান বিষ্ণুলোক নির্দিষ্ট হয়েছিল।
- (২) রামায়ণের রামচন্দ্রকে মনুষ্যরূপে বিষ্ণুর অবতার বলে কল্পনা করা হয়। মহাভারতের কৃষ্ণ, যদুবংশের গোষ্ঠীপতি মানব হলেও তাকে নররূপী বিষ্ণু বলে মনে করা হত। তিনি নিখিল-বিশ্বপ্রকৃতির রক্ষক। তাঁর মধ্য থেকেই পরবর্তী ত্রিমূর্তি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের উদ্ভবের সূত্র পাওয়া যায়।
- (৩) তখনও বৈদিক যুগের বিরাট আকারের যজ্ঞের প্রচলন ছিল। যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে রাজসূয় যজ্ঞ করেন ও বহু দানধ্যান করেন বলে জানা যায়। পরিণত বয়সে পঞ্চপাণ্ডব রাজ্য ত্যাগ করে মহাপ্রস্থান করেন।
- (৪) উপনিষদের যুগে চতুরাশ্রমের শেষ আশ্রম ছিল সন্ন্যাস। পঞ্চপাণ্ডবও রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে চলে যান। মহাকাব্যের যুগে ভক্তিধর্মের উদ্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্র অব্দে এই ধর্ম প্রসার লাভ করে।
উপসংহার :- প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বিশেষ মর্যাদার স্থান অধিকার করে আছে। বৈদিক সূত্র সাহিত্যকে যদি ‘ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য’ বলে অভিহিত করা হয় তাহলে মহাকাব্য দুটিকে নিঃসন্দেহে ‘ক্ষত্রিয়দের সাহিত্য’ বলা চলে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “মহাকাব্যের যুগ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) মহাকাব্যের যুগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রামায়ণ ও মহাভারত।
মহর্ষি বাল্মীকি।
বেদব্যাস।
অষ্টাধ্যায়ী।