উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি নাট্যকার ও সাহিত্যিক হলেন দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০–১৮৭৩)। তিনি নীলদর্পণ নাটকের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, যা ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছিল। তাঁর রচনায় সামাজিক অবিচার, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের সুর প্রতিফলিত হয়। দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাটকের অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয়।
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র
ঐতিহাসিক চরিত্র | দীনবন্ধু মিত্র |
জন্ম | ১০ এপ্রিল, ১৮৩০ খ্রি |
জন্মস্থান | ২৪ পরগণা, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | নাট্যকার, সাহিত্যিক, সরকারী কর্মচারী |
কর্মজীবন | টেলিগ্রাফ বিভাগে কর্মরত |
বিখ্যাত রচনা | নীলদর্পণ |
অবদান | সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রচারক |
মৃত্যু | ১ নভেম্বর, ১৮৭৩ খ্রি |
ভূমিকা :- পরাধীন ভারতে জাতীয় চেতনায় নবশক্তির উদ্বোধন যদি করে থাকে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র-এর আনন্দমঠ গ্রন্থ ও বন্দেমাতরম মাতৃমন্ত্র তাহলে এক্ষেত্রে পুরোধা বলতে হবে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটককে। নবজাগরণ যুগের অন্যতম প্রধান পুরুষরূপে জাতীয় চেতনার আবাহন রচনা করেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র তাঁর এই ঐতিহাসিক নাটকের মাধ্যমে।
দীনবন্ধু মিত্রর জন্ম
স্বল্পায়ু দীনবন্ধুর পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে। এখানেই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা কালাচাঁদ মিত্র কায়ক্লেশে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন। ফলে অস্বচ্ছলতা ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই শৈশবকাল অতিবাহিত হয় তাঁর।
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর শিক্ষা
- (১) বিদ্যাশিক্ষার জন্য গ্রাম্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল দীনবন্ধুকে। কিন্তু বেশিদিন এখানে পড়াশুনা করার সুযোগ পেলেন না। পুত্রের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন কালাচাঁদ। তাই স্কুল ছাড়িয়ে মাসিক আট টাকা মাইনেতে জমিদারি সেরেস্তায় কাজে ঢুকিয়ে দিলেন পুত্রকে।
- (২) পড়াশুনায় আগ্রহ ও উৎসাহ কোনওটাই কম ছিল না দীনবন্ধুর। উচ্চশিক্ষা লাভের আকাঙক্ষা তাঁকে তাই অবিলম্বে ঘরছাড়া করল। দীনবন্ধু পালিয়ে কলকাতা চলে এলেন। এখানে পিতৃব্যের গৃহে থেকে অতি দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে পড়াশুনা শুরু করলেন। পড়াশুনা চালাবার জন্য এই সময় বাসন মাজার কাজ পর্যন্ত তাঁকে করতে হয়েছে।
- (৩) দীনবন্ধু ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে লঙ সাহেবের অবৈতনিক স্কুলে শিক্ষা শুরু করেন। পরে হেয়ার সাহেবের কলুটোলা ব্রাঞ্চস্কুলে ভর্তি হন। হেয়ার সাহেবের স্কুল থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু শেষ পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে পাশ করেন এবং ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। কলেজের পরীক্ষাতেও কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি। সব পরীক্ষাতেই বৃত্তি লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল তাঁর বাঁধা।
নাম পরিবর্তন করে দীনবন্ধু মিত্র
দীনবন্ধু নামে যিনি দেশকাল বিশ্রুত তাঁর পিতৃদত্ত নামটি অনেকেরই অজানা। সেই জমকালো নামটি বালক দীনবন্ধুকে এতই বিব্রত বিরক্ত করত যে শেষ পর্যন্ত নিজের উদ্যোগেই নামটি পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। কলকাতায় স্কুলে ভর্তি হবার সময়েই পিতৃদত্ত গন্ধর্বনারায়ণ নাম পাল্টে দীনবন্ধু রাখেন তিনি। ওই নাম নিয়ে সহপাঠীদের কাছে খুবই হেনস্থা হতে হতো তাঁকে গ্রামের স্কুলে। গন্ধর্বনারায়ণকে ছেলেরা সংক্ষিপ্ত করে ‘গন্ধ’ করে নিয়েছিল। ওয়াক থুঃ থুঃ গন্ধ, এই বলে সকলেই তাঁকে নিয়ে তামাসা করত। এই নিয়ে খুবই অশান্তি ভোগ করতে হয়েছে বালক দীনবন্ধুকে। পাছে কলকাতার স্কুলেও ‘গন্ধ’ সংক্রান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, তাই আগেভাগেই নিজের পছন্দ করা নাম স্কুলের খাতায় লিখিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, সেই নামেই তিনি পরবর্তীকালে দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
পোস্টমাস্টার দীনবন্ধু মিত্র
- (১) কলেজের সব পরীক্ষায় বরাবর ভাল ফল করেও শেষ পরীক্ষা কিন্তু তাঁর দেওয়া হল না। সংসারের প্রয়োজনে চাকরি নিতে হল। একশত পঞ্চাশ টাকা বেতনে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে পার্টনায় পোস্টমাস্টার-এর কাজে যোগ দেন। কাজ অতি সামান্য হলেও সেই কাজই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন তিনি। ফলে যোগ্যতার সঙ্গে মাত্র দেড় বছর চাকরি করার পরেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েন এবং পোস্টাল ইনসপেক্টর পদে উন্নীত হন।
- (২) এই কাজটি তাঁকে সম্পন্ন করতে হত ওই অঞ্চলে সব কটি ডাক ঘরে ঘুরে ঘুরে। কাজকর্মের তদারকি করাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। চোদ্দ বছর এই দায়িত্ব তিনি সুষ্ঠুভাবে করে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ফলে নতুন পদে উন্নীত হলেন তিনি। এই পদে তাঁর কাজ ছিল পোস্টমাস্টার জেনারেলকে সাহায্য করা। দায়িত্বপূর্ণ নতুন পদেও তিনি অসাধারণ যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
- (৩) আসাম অঞ্চলে লুসাই যুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় ডাকব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। বিপর্যস্ত ডাকবাবস্থার কাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব দিয়ে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধুকে পাঠানো হয়। যথেষ্ট বিপদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দীনবন্ধু কাছাড়ে গিয়ে অসাধারণ কর্মনিপুণতার সহায়তায় বিশৃঙ্খল ডাক ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। তাঁর এই দক্ষতার জন্য ইংরাজ সরকার ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধুকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন।
- (৪) এরপর থেকে দেশব্যাপী ছড়ানো ডাকব্যবস্থার কোথাও কোনও রূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেখানেই দীনবন্ধুকে পাঠানো হত। ফলে বছর ভর তাঁকে দেশের দূর দূর অঞ্চলে যাতায়াত করতে হত। নদীয়া, বীরভূম, দার্জিলিং, ওড়িশা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে ডাক বিভাগের উন্নতি বিধানে দীনবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
- (৫) বিভাগীয় কাজে অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সরকারের কাছ থেকে রায়বাহাদুর খেতাব লাভ করেছিলেন দীনবন্ধু। কিন্তু ডাক বিভাগে তাঁর যথোচিত পদোন্নতি হয় নি পরাধীন দেশের হতভাগ্য নাগরিক বলে। অধিকতর দুঃখের বিষয় যে কর্মকর্তাদের অন্তর্কলহের ফলে দীনবন্ধুকে বদলি হতে হয় পরিদর্শকের কাজ থেকে পূর্বের নিম্নতর পদে।
পত্রিকায় দীনবন্ধু মিত্রর কবিতা
কলেজ জীবনে দীনবন্ধু কবি ঈশ্বর গুপ্ত-এর সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর প্রেরণায় তিনি সংবাদ প্রভাকর এবং সাধুরঞ্জন প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন।
গুপ্ত কবি দীনবন্ধু মিত্র
তখনকার দিনে অনেক কবি সাহিত্যিকই গুপ্ত কবির পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দীনবন্ধুও গুপ্তকবির অনুপ্রেরণায় সেই সময় কাব্য রচনা করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন।
লোকচরিত্র সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র
কর্মজীবনে সরকারি কাজে তাঁকে নানা স্থানে পরিভ্রমণ করতে হয়। সেই সুবাদে নানা শ্রেণীর লোকের সংস্পর্শে তাঁকে আসতে হয় এবং বহু লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। এইভাবে লোকচরিত্র সম্পর্কে তিনি যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্য জীবনে চরিত্র সৃষ্টির কাজে প্রভূত সহায়ক হয়েছিল। মানবচরিত্র বিশ্লেষণ ও রূপায়নে দীনবন্ধুর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। সকলই ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ফল। এই সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, “দীনবন্ধু রচিত অনেক নাটক প্রকৃত ঘটনা ভিত্তিক এবং অনেক চরিত্র তৎকালীন জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে রচিত।”
রামতনু লাহিড়ী সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র
সুবিখ্যাত রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের সান্নিধ্য দীনবন্ধু লাভ করেছিলেন কৃষ্ণনগরে থাকাকালে। তাঁর সাধুচরিত্র তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি এই মহৎ মানুষটি সম্পর্কে লিখেছিলেন –
পরম ধার্মিকবর এক মহাশয়,
সত্য-বিমন্ডিত তাঁর কোমল হৃদয়।
সারল্যের পুত্তলিকা, পরহিতে রত,
সুখ দুঃখ সমজ্ঞান ঋষিদের মত।
জিতেন্দ্রিয় বিজ্ঞতম, বিশুদ্ধ বিশেষ,
রসনায় বিরাজিত ধৰ্ম্ম উপদেশ।
একদিন তাঁর কাছে করিলে যাপন,
দশদিন থাকে ভাল দুর্বিনীত মন।
বিদ্যাবিতরণে তিনি সদাহরষিত,
তাঁর নাম রামতনু সকলে বিদিত।
রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের চরিত্রের মহৎ গুণাবলী যে দীনবন্ধুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তাতে সন্দেহ নেই।
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর চরিত্র
চরিত্রের যে সব গুণাবলী অর্জিত হলে অতিসাধারণ স্তর থেকে নিজেকে সাফল্যের উচ্চতম শিখরে উন্নীত করা যায়, দীনবন্ধু নিঃসন্দেহে সে সকলের অধিকারী হয়েছিলেন এবং বাঙ্গালী চাকুরিজীবীদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই অতি উচ্চপদের অধিকারী হয়েছিলেন। দীনবন্ধুর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, অসাধারণ পরিশ্রম, নিষ্ঠা, উচ্চাশা, সাধুতা এবং পরদুঃখকাতরতা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কৌতুকপ্রিয়তা। চরিত্রের এই সকল গুণাবলী দীনবন্ধুর কর্মক্ষেত্র ও জীবনপথের পাথেয় স্বরূপ ছিল।
দীনবন্ধু মিত্রর ইতিহাস খ্যাত নাটক নিলদর্পণ
- (১) নাট্যকার দীনবন্ধুর ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিখ্যাত নাটক নীলদর্পণ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে শেষ দিকে ঢাকা থেকে। নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচারে লাঞ্ছিত দেশীয় নীলকর চাষীদের দুরবস্থার প্রকৃত চিত্র তিনি এই নাটকে যথাযথ রূপদান করেছিলেন। বাংলা তথা ভারতবর্ষ-এর ইতিহাস ও সামাজিক দিক থেকে নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
- (২) সেই সময়ে দেশের সাধারণ কৃষক সম্প্রদায় ইংরাজ নীলকরদের বীভৎস অত্যাচারের ফলে সর্বস্বান্ত হচ্ছিল। নানান অপকৌশলে ও অত্যাচারে চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করা হত। এজন্য গৃহে অগ্নিসংযোগ, মেয়েদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি কোনো কাজেই বর্বর ইংরাজ নীলকরগণ পরাম্মুখ হত না।
- (৩) কর্মসূত্রে ঢাকায় অবস্থান কালে দীনবন্ধু নীল-প্রপীড়িত বহুস্থানে ভ্রমণ করেছিলেন এবং অসহায় চাষীদের অমানুষিক লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্বদেশবাসী চাষীসম্প্রদায়ের দুঃখের জ্বালা তাঁর বুকেও তীব্র হয়ে বেজেছিল। সেই হৃদয়যন্ত্রণা নিয়েই তিনি নীলদর্পণ নাটক রচনা করেছিলেন।
- (৪) এই নাটক যে কেবল জাতীয় চেতনার উদ্বোধক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল তা নয়। বহুভাবে দীনবন্ধুর নীলদর্পণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এই নাটককে কেন্দ্র করে সেইকালে দেশব্যাপী অলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কাগজে কাগজে ব্যাপক প্রচারের ফলে নাটকটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে নীলচাষ বিরোধী এক প্রবল আন্দোলনের সূচনা হয়।
- (৫) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় নীলদর্পণ। লেখকের নাম ছিল এরকম – কদাচিৎ পথিকস্য। সেই সময়ে দীনবন্ধু ডাক বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট। তাই তাঁর নিজের নামে নাটকটি প্রকাশে অসুবিধা ছিল। পাদরি রেভারেন্ড লং সাহেব নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারকে অবহিত করার জন্য এবং রাজকর্মচারীদের সচেতন করার জন্য নীলদর্পণ-এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
- (৬) নাটকটির ইংরাজী অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন। এটিই প্রথম ইংরাজী ভাষায় অনুবাদিত নাটক। ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে, নীলকরদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার ঢেউ ইংল্যান্ড-এ গিয়েও পৌঁছায়। ফলে সেখানেও ওঠে প্রতিবাদের ঝড়।
- (৭) দেশে বিদেশে সমালোচিত হবার ফলে নীরকর সাহেবরা ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। পাদরি লং সাহেবই হন তাদের আক্রোশের শিকার। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই আদালতের রায়ে লং সাহেবের একমাসের কারাদন্ড এবং একহাজার টাকা জরিমানা হয়।
- (৮) মামলার রায় শোনার জন্য সেদিন আদালতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিও উপস্থিত হয়েছিলেন। দীনবন্ধু সেদিন নিজেই লং সাহেবের বদলে জেলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলেন। জরিমানার টাকা আদালতেই মিটিয়ে দিলেন মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ। কিন্তু শেষ অবধি কারাবাস এড়াতে পারলেন না লং সাহেব। ওই বছরের ২৪শে জুলাই একমাসের মেয়াদে তাঁকে কারাগারে যেতে হল।
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর বিভিন্ন নাটক
দীনবন্ধু কিন্তু নিরস্ত হলেন না। দ্বিধাহীন হৃদয়ে তিনি সামাজিক সংস্কারমুখী সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। মূলতঃ সামাজিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই তাঁর লেখনী অগ্রসর হতে লাগল। এই উদ্দেশ্যে তিনি ব্যঙ্গ ও কৌতুক রসের আশ্রয় নিলেন। নীলদর্পণ-এর পরে প্রকাশিত হল নবীন তপস্বী। তারপর বিয়ে পাগলা বুড়ো ও সধবার একাদশী নামে দুটি প্রহসন। আগাগোড়া কৌতুকরসের মোড়ক দিয়ে সমাজের নানা কুপ্রথা আচার- আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত হেনেছেন তিনি। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় লীলাবতী নাটক ও পরে জামাই বারিক। লীলাবতী নাটকের মতোই জামাই বারিক কৌতুক নাটিকাও সেকালে কলকাতার সমাজে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। সেকালের কলকাতার ধনী পরিবারগুলোতে ঘরজামাই রাখা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরালয়ের বাইরে বড় বড় ব্যারাক তৈরি হত জামাইদের জন্য। সেখানে যে পরিবেশে জামাইদের থাকতে হত তারই জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছিলেন দীনবন্ধু।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় দীনবন্ধু মিত্রর নাটক
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ-এর জীবনস্মৃতি গ্রন্থেও জামাই বারিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময় তাঁর বালক বয়স। বড়দের জন্য লিখিত বই পড়ার অধিকার ছিল না বাড়ির বালকদের। কিন্তু বইটি পড়ার তীব্র আগ্রহে রবীন্দ্রনাথ এক আত্মীয়ার আঁচল থেকে চাবি চুরি করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, “চাবি চুরি গেল এবং চোর ধরা পড়িল না। বই পড়া হইল। তাহার পরে চাবি এবং বই স্বত্বাধিকারীর হাতে ফিরাইয়া দিয়া চৌর্য্যাপরাধের আইনের অধিকার হইতে আপনাকে রক্ষা করিলাম। আমার আত্মীয়া ভর্ৎসনা করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু তাহা যথোচিত কঠোর হইল না। তিনি মনে মনে হাসিতেছিলেন-আমারও সেই দশা।” এই সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক বিষয়ে নাটক প্রহসনাদি রচনাতেও দীনবন্ধুর কী অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
রচনারীতিতে দীনবন্ধু মিত্রর স্বাতন্ত্র্য
নাট্যকার হিসাবে দীনবন্ধুর আবির্ভাবের পূর্বেই মধুসূদন নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। তাঁর প্রধান নাটকগুলি যখন সবই প্রায় প্রকাশিত হয়ে গেছে, সেই সময় দীনবন্ধুর প্রথম নাটক প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে দীনবন্ধুর রচনায় মধুসূদন দত্তর কোনও প্রভাব ছিল না। রচনারীতি এবং বিষয়নির্বাচনেও দীনবন্ধুর স্বাতন্ত্র্য ছিল স্পষ্ট।
দীনবন্ধু মিত্রর নাটকে মানুষ
বিপথগামী যুবকসম্প্রদায়, বিকৃত স্বভাব উচ্চবিত্ত শ্রেণী, দরিদ্র কৃষক ও নিম্ন শ্রেণীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের চরিত্র রূপায়নের মাধ্যমে তিনি সমাজের বিকৃতি, কুসংস্কার, রীতি-নিয়ম ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। ব্যঙ্গ কৌতুক ও রঙ্গরস ছিল তাঁর হাতিয়ার। সঙ্গতভাবেই রঙ্গরস প্রধান নাটক ও প্রহসনগুলি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তখনকার বাংলা থিয়েটারগুলিতেও এইসকল নাটক প্রাধান্য লাভ করেছিল।
অভিনয়-সংস্কৃতির চর্চার সূত্রপাত
সেই কালে ধনীক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ করে ধনীদের গৃহেই অভিনয়-সংস্কৃতির চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল। বিলিতি থিয়েটারের অনুকরণে বিভিন্ন পরিবারে কয়েকটি নাট্যশালাও গড়ে উঠেছিল। প্রচুর ব্যয়ে ও মাত্রাতিরিক্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সেই সকল মঞ্চে সাধারণতঃ পৌরাণিক নাটকের অভিনয় হত। বিশেষ বিশেষ পরিবারেব লোকজনই কুশীলবের ভূমিকায় অভিনয় করত। এই নাটকাভিনয়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন যোগাযোগ থাকত না। নব্যযুবক শ্রেণীও ধনীদের শখের থিয়েটারে ছিল অপাঙ্কতেয়।
নাট্যকার দীনবন্ধুর নাটক নিয়েই প্রথম থিয়েটার তৈরি
দীনবন্ধুর লীলাবতী, সধবার একাদশী প্রভৃতি সামাজিক নাটক প্রকাশিত হবার পর নব্যযুবক শ্রেণী নাটক অভিনয়ে বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। এইকালে নাটক অভিনয়ের জন্য বিশেষ খরচপত্রের বালাই ছিল না। ফলে নাটক মঞ্চস্থ হবার প্রাথমিক বাধা আর রইল না। দীনবন্ধুর নাটক নিয়েই অচিরেই একটি যুবগোষ্ঠী সঙ্ঘবদ্ধ হল বাগবাজারে এবং দীনবন্ধুর নাটক নিয়েই তারা প্রথম থিয়েটার তৈরি করল। এই ভাবেই বঙ্গদেশে থিয়েটার ও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সূচনা হয়। নাটক অভিনয় আর নিছক প্রমোদ বা ধনীক শ্রেণীর খেয়ালখুশিতে আবদ্ধ থাকল না। সর্বশ্রেণীর দর্শকের জন্যই টিকিট কেটে নাটকের অভিনয় দেখার সুযোগ হয়ে গেল।
দীনবন্ধুর নীলদর্পণ নাটক দিয়েই প্রথম অভিনয় শুরু
এই সাধারণ রঙ্গালয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ৭ই ডিসেম্বর দীনবন্ধুর নীলদর্পণ নাটক দিয়েই প্রথম অভিনয় আরম্ভ হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই নাটককে আঙ্কল টমস কেবিন- এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “টম কাকার কুটীর আমেরিকার কাফ্রিদিগের দাসত্ব ঘুচাইয়াছে, নীলদর্পণ নীল দাসদিগের দাসত্ব মোচনের অনেকটা কাজ করিয়াছে।”
ইতিহাসে স্মরণীয় দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণ নাটক
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বন্দেমাতরম সঙ্গীত রচনা করেছিলেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে। আর দীনবন্ধু মিত্র বিদেশী ইংরাজদের অত্যাচারে লাঞ্ছিত দেশীয় নীল চাষীদের দুরবস্থার প্রকৃত ঘটনা অবলম্বনে নীলদর্পণ নাটক রচনা করেছিলেন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। বিদেশী শোষণ ও শাসনযন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাঁর এই নাটক। নীলদর্পণ নাটকের অভিনয়ের ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে আছে আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণে। এই নাটকের অভিনয় দেখতে এসে বিদ্যাসাগর মহাশয় মঞ্চে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। অভিনয়ের সাফল্যের সার্থকতম পুরস্কার হিসাবে সেদিন ভাগ্যবান অভিনেতা আনন্দে গর্বে মাথায় স্থাপন করেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহাজনের পাদুকা।
জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের পুরোধা পুরুষ দীনবন্ধু মিত্র
দীনবন্ধু নীলদর্পণ নাটক রচনার মাধ্যমে যেমন জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের পুরোধা পুরুষ হয়ে আছেন, তেমনি, বঙ্গীয় রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের গৌরব অর্জন করেছেন। অভিনেতা-কবি-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাষায়, “বঙ্গে রঙ্গালয় স্থাপনের জন্য মহাশয় কর্মক্ষেত্রে আসিয়াছিলেন….।”
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর মৃত্যু
মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দীনবন্ধু মিত্রর কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটে। তিনি পুস্তকাকারে কমলে কামিনী নাটকটি দেখে যেতে পারেন নি। নাটকটি যখন ছাপা হচ্ছে তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।
উপসংহার :- নীলদর্পণ, বিয়ে পাগলা বুড়ো, জামাই বারিক, লীলাবতী, সধবার একাদশী ছাড়াও দীনবন্ধু নবীন তপস্বিনী, কমলে কামিনী প্রভৃতি নাটক রচনা করে যশ লাভ করেছিলেন। দীনবন্ধু নীলদর্পণ নাটক রচনার মাধ্যমে যেমন জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের পুরোধা পুরুষ হয়ে আছেন, তেমনি, বঙ্গীয় রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের গৌরব অর্জন করেছেন। অভিনেতা-কবি-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাষায়, “বঙ্গে রঙ্গালয় স্থাপনের জন্য মহাশয় কর্মক্ষেত্রে আসিয়াছিলেন….।”
(FAQ) দীনবন্ধু মিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকের জন্য বিখ্যাত। এটি ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচার এবং বাংলার কৃষকদের দুঃখ-কষ্টকে তুলে ধরেছিল।
নীলদর্পণ ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়।
তিনি সরকারি টেলিগ্রাফ বিভাগে কাজ করতেন।
তাঁর লেখায় সামাজিক সমস্যা, মানবিকতা এবং ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা প্রাধান্য পায়।
তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে জমিদার দর্পণ ও বিধবা বিবাহ উল্লেখযোগ্য।
তিনি ১ নভেম্বর ১৮৭৩ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।