একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিবিদ হলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৪–১৮৯৯)। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং সমাজে নারীদের শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর প্রজ্ঞা, উদার মানসিকতা এবং সমাজসেবার জন্য তিনি আজও স্মরণীয়।
মনীষী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
জন্ম | ২৬ জানুয়ারি১৮৪৪ খ্রি |
পেশা | শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজসংস্কারক, রাজনীতিবিদ |
পরিচিতি ক্ষেত্র | সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা প্রচার, আইন ও রাজনীতি |
প্রধান অবদান | বিধবা বিবাহ প্রচলনে সমর্থন, নারী শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ |
প্রভাব | বাঙালি সমাজে আধুনিকতার প্রচার |
উপাধি | স্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য |
মৃত্যু | ২ ডিসেম্বর, ১৯১৮ খ্রি |
ভূমিকা :- বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে বাংলাভাষার চর্চা প্রসার ও উন্নতিকল্পে অক্লান্তকর্মা মনীষী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীয় চরিত্রমাধুর্য ও কর্মকৃতিত্বগুণে স্বদেশবাসীর অন্তরে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের তিনিই প্রথম ভারতীয় ভাইস চ্যান্সেলর।
মনীষী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম
১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী কলকাতার নারকেলডাঙায় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। দরিদ্র হলেও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হিসেবে তাঁর পিতা রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁর মাতা সোনামণি দেবী নিষ্ঠাবতী ধর্মপ্রাণ মহিলা ছিলেন।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাল্যকাল
- (১) মাত্র তিন বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে অসহায় জননীর স্নেহচ্ছায়ায় ও তত্ত্বাবধানে তিনি বড় হতে থাকেন। সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও সোনামণি পুত্রের লেখাপড়া ও চরিত্র গঠনের বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। একমাত্র পুত্রের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য যথাসাধ্য তিনি চেষ্টা ও উপদেশ দিতেন।
- (২) মায়ের কঠোর স্নেহ-শাসনের বেষ্টনের মধ্যেই সুশীলস্বভাব গুরুদাসের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল। যখন তখন বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, তাই অনেক সময় স্নেহশীলা জননীই হতেন তাঁর খেলার সাথী। কখনো প্রতিবেশী বালকরা তাঁর সঙ্গে বাড়িতে খেলা করত।
- (৩) সোনামণি নিজের ছেলের সঙ্গে অন্যান্য বালকদের ওপরও দৃষ্টি রাখতেন। বালকদের মধ্যে কখনও কোনও বেয়াড়াপনা বা উশৃঙ্খলতা লক্ষ্য করলে তিনি তাদের স্নেহের সঙ্গে শাসন করতেন। এভাবেই বাল্য বয়স থেকে মায়ের আজ্ঞার অনুবর্তী হয়ে চলার শিক্ষা লাভ করেছিলেন গুরুদাস।
- (৪) বাস্তবতঃ মায়ের শাসন ও শিক্ষাগুণেই সন্তানের চরিত্র গঠিত হয়ে থাকে। সেকারণেই দেখা যায়, যাঁরাই উত্তর জীবনে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, মায়ের প্রভাব ছিল তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক। মহাপুরুষদের জীবন পর্যালোচনা করলেই এ সত্য অনুধাবন করা যায়।
- (৫) গুরুদাসের কর্মময় জীবনও এ ভাবেই সার্থকতা লাভ করেছিল। পরিণত বয়সেও তিনি ছিলেন সর্বতোভাবেই মাতৃ আজ্ঞানুবর্তী। সোনামণির স্নেহকোমল স্বভাব ও পুত্র প্রতিপালনের নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় তাঁকে প্রতিবেশীদের কাছেও আদরনীয় করে তুলেছিল।
- (৬) কোমলমতি বালক-বালিকাদের প্রতি কঠোর ব্যবহার তিনি পছন্দ করতেন না। মারধর করারও পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর স্নেহ মমতা ও মিষ্ট ব্যবহারে পাড়ার দুরন্ত ছেলেমেয়েরাও শান্ত হয়ে যেত। স্নেহশীলা মায়ের সস্নেহ শাসন ও উপদেশের মধ্যে বড় হয়ে গুরুদাস যে সঠিক জীবনপথের অনুবর্তী হবেন এ আর বেশি কথা কি?
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষা
- (১) দারিদ্র্য দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সোনামণি পুত্রকে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য জেনারেল অ্যাসেম্বলি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেই সময় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলকে লোকে বলত গৌরমোহন আঢ্যের স্কুল। প্রতিভাবান শিক্ষকরা এখানে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন।
- (২) জেনারেল অ্যাসেম্বলি ছেড়ে এই শিক্ষায়তনে এসে গুরুদাস বিশেষ করে সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষক রিচার্ডসন সহেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। এই প্রতিভাশালী শিক্ষকের স্নেহ-সান্নিধ্যে তিনি ইংরাজি ভাষা উত্তমরূপে শিক্ষার সুযোগ পান।
- (৩) এরপর গুরুদাস ভর্তি হন কলুটোলা ব্রাঞ্চস্কুলে (হেয়ার স্কুল) এবং এখান থেকেই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। প্রতিবৎসর স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম স্থানটি গুরুদাসের ছিল বাঁধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা হয়।
- (৪) হেয়ার স্কুলে গুরুদাস যেমন সুপ্রসিদ্ধ প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ প্রতিভাশালী শিক্ষকদের স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন তেমনি বেশ কয়েকজন প্রতিভাশালী চরিত্রবান সহপাঠীও লাভ করেছিলেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে স্বনামখ্যাত হয়েছিলেন।
- (৫) নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন কাশ্মীরের রাজস্বসচীব। কলকাতার প্রসিদ্ধ আইনজীবী কালীনাথ মিত্র, মাননীয় বিচারপতি বসন্তকুমার মল্লিক প্রমুখ ছিলেন গুরুদাসের সহপাঠী। সর্ববিষয়ে মাতৃআজ্ঞাধীন গুরুদাসের ছাত্রজীবন ছিল অনন্য গৌরবের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময়।
- (৬) প্রেসিডেন্সি কলেজ-এর ছাত্র হিসেবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এম.এ পাশ করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে আইন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানটিও ছিল তাঁরই। পরের বছর তিনি ল অনার্স পাশ করেন। স্কুল ও কলেজে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য বিদ্যার্থী হিসেবে সমস্ত রকম বৃত্তি ও পুরস্কার গুরুদাস লাভ করেছিলেন।
অধ্যাপক গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
এম. এ. পাশ করার পর গুরুদাস প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। এখানে গণিতের অধ্যাপক রূপে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সকল প্রতিভাবান সুশিক্ষকের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছিলেন, শিক্ষক জীবনে তাঁদের সকলের গুণাবলী তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে দেখা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি স্বনামখ্যাত রমেশচন্দ্র দত্ত, নবীনচন্দ্র সেন এবং বিহারীলাল গুপ্তকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব প্রতিভাবলে স্বদেশের ও স্বজাতির গৌরববৃদ্ধি করেছিলেন। ছাত্রদের প্রতি গুরুদাস ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ফলে তাঁর নির্দেশ উপদেশ ছাত্ররা যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন এবং মেনে চলার চেষ্টা করতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কর্মরত অবস্থাতেই গুরুদাস বহরমপুর কলেজে মাসিক তিনশত টাকা বেতনে অধ্যাপকের চাকরি পান।
আইন ব্যবসায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বহরমপুরে থাকার সময়েই তিনি মায়ের অনুমতি নিয়ে ওকালতি ব্যবসায় আরম্ভ করেন। মাতা সোনামণির আদেশ ছিল স্বাধীন আইন ব্যবসায়ে মাসিক একশত টাকা উপার্জন যখন হবে তখন তাঁকে কলকাতায় আসতে হবে। মায়ের এই আদেশ শিরোধার্য করে তিনি নিষ্ঠা সহকারে আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। এই সময়েই গুরুদাস মুর্শিদাবাদ-এর নবাবের আইন উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হন। আইন ব্যবসায়ে নিযুক্ত হয়েও গুরুদাস কখনো তাঁর ধর্মবুদ্ধিকে ত্যাগ করেন নি। সত্য ও ধর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি প্রতিটি মামলা গ্রহণ করতেন ও যথাযথ ভাবে পরিচালনা করতেন।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যনিষ্ঠার পরিচয়
- (১) এই সময়ের একটি ঘটনা বললেই তাঁর সত্যনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে গুরুদাস বহরমপুর ত্যাগ করে কলকাতায় এসে হাইকোর্ট-এ আইন ব্যবসায় আরম্ভ করেন। কিছুদিন পরেই দৈনিক পঞ্চাশ টাকা ফি-তে একটি মামলা তিনি গ্রহণ করেন।
- (২) এই মামলার শুনানির আগের দিন বহরমপুরের একটি মামলার পরিচালনার আহ্বান আসে। তাতে তাঁর ফি পাবার কথা দেড় হাজার টাকা। খুবই সামান্য মামলা-বিশেষ বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন এতে ছিল না। কিন্তু কলকাতার মামলার জন্য যিনি তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন তিনি গুরুদাসকে ছাড়তে চাইলেন না।
- (৩) গুরুদাসের পক্ষে বহরমপুরের দেড়হাজার টাকার মামলা আর গ্রহণ করা সম্ভব হল না। তিনি সানন্দেই দৈনিক পঞ্চাশ টাকা ফি-এর মামলা নিয়ে সন্তুষ্ট রইলেন। এই সত্যনিষ্ঠার পুরস্কারও গুরুদাস পেয়েছিলেন হাতে হাতেই।
- (৪) বহরমপুরের মামলা যখন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, ঠিক সেই সময়েই কলকাতা নারকেলডাঙ্গায় বাড়ির জন্য একখণ্ড জমি কিনেছিলেন গুরুদাস। যেই দালালের মাধ্যমে জমি কেনা হচ্ছিল, জমির আড়াই হাজার মূল্যের ওপরে তিনি দালালিবাবদ আরও তিনশত টাকা ধার্য করেছিলেন।
- (৫) কিন্তু দালাল ভদ্রলোক যখন শুনলেন যে গুরুদাস সত্যের খাতিরে দেড় হাজার টাকার মামলা ছেড়ে পঞ্চাশ টাকার মামলা নিয়ে কলকাতায় রয়ে গেলেন, তখন তিনি তাঁর লাভের অংশ সানন্দে পরিত্যাগ করলেন।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে গুরুদাস ডি-এল. উপাধি পান এবং পরের বছর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির পদ লাভ করেন। ষোল বছর তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। বিচারক হিসেবে গুরুদাসের কর্তব্যনিষ্ঠা প্রবাদের রূপ লাভ করেছিল। দীর্ঘ ষোল বছরের মধ্যে কদাচিৎ তাঁকে আদালতে অনুপস্থিত হতে দেখা গেছে। তাঁর পুত্র যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে পুত্রকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় দেখেও তিনি যথারীতি অবিচলিত মনে ধীর স্থির ভাবে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি গুরুদাস পুত্রের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার কথা জানতে পেরে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। গৃহে পৌঁছবার মিনিট কয়েকের মধ্যেই তাঁর পুত্র দেহত্যাগ করে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
পরবর্তী জীবনে গুরুদাস অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কমিশনার এবং বাঙলার ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হয়েছিলেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য ও আইন পরীক্ষক হন। তিনি তিন বছর সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে পরীক্ষা পরিচালনা ও পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন গুরুদাস। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এই পদ লাভ করেছিলেন। সেইকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কোনো বেতন পেতেন না। দুই বছর পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে হন ল ফ্যাকাল্টির ডিন।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্মী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম উৎসাহী কর্মী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে তাঁর প্রভূত অবদান ছিল। প্রতিষ্ঠার কাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন আমৃত্যু।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনকল্যাণমূলক কাজ
বিভিন্ন সামাজিক জনকল্যাণমূলক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গেও তাঁর সংযোগ ছিল নিবিড়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ও ভারতীয় বিজ্ঞান উৎকর্ষিণী সভার সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে গুরুদাস সরকার কর্তৃক স্যার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত হন।
শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
দেশীয় ভাষার চর্চায় গুরুদাসের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার চর্চা আবশ্যিক করার কাজে তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। বাংলা ভাষার মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টায় তাঁর প্রভূত অবদান ছিল। জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিকল্পনার তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী পুরুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে কায়িক শ্রমের কাজেও তিনি ছিলেন উৎসাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় সরকারী হস্তক্ষেপের নিন্দা করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। সক্রিয়ভাবে বাধাদান করেছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষার বিষয়েও তিনি ছিলেন সমান আগ্রহী।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন-এর সময় পরোক্ষভাবে তিনি রাজনীতিকদের সাহায্য করেছিলেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সভায় তিনি ছিলেন প্রধান বক্তা। এই সভায় সভাপতি ছিলেন আনন্দমোহন বসু। গুরুদাসের জাতীয় চেতনা ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সভার বক্তৃতা রাজনৈতিক নেতাদের উৎসাহ বৃদ্ধি করেছিল।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
আচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল জ্ঞান ও কর্ম, শিক্ষা, A few twoughts on Education এবং The Education Problem in India প্রভৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর আইন অধ্যাপক রূপে তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতা Hindu Law of Marriage and Stridhan পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে এটিই একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ।
মনীষী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু
২ ডিসেম্বর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এই মহান কর্মবীর চিরবিশ্রাম লাভ করেন।
উপসংহার :- গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন অগ্রগামী চিন্তাবিদ, যিনি বাঙালি সমাজের উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য হিসেবেই নয়, সমাজসংস্কারক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবেও স্মরণীয়। তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও উদ্যোগ নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ এবং সামাজিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। তিনি একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব, যিনি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে উচ্চ আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ ও আদর্শ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
(FAQ) গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিবিদ, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য এবং নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের প্রবক্তা।
তিনি শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, নারী অধিকার এবং ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বিধবা বিবাহ প্রচলনে সমর্থন, নারীদের শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ, এবং বাঙালি সমাজে আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রসার।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুকালীন বয়স ছিল ৫৫ বছর।
তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।