একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসংস্কারক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। তিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সহ-সম্পাদক। তার লেখা যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করতে তিনি শিক্ষার প্রসার এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার উপর জোর দিয়েছিলেন।
সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত
ঐতিহাসিক চরিত্র | অক্ষয়কুমার দত্ত |
জন্ম | ১৫ জুলাই ১৮২০ খ্রি |
জন্মস্থান | চুপি গ্রাম, বর্ধমান, ভারত |
পেশা | লেখক, দার্শনিক, সমাজসংস্কারক |
পত্রিকা সম্পাদনা | তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা |
বিখ্যাত কাজ | ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সমাজ, বিজ্ঞান যুক্তিবাদ প্রচার |
আদর্শ | বিজ্ঞানমনষ্কতা, যুক্তিবাদ, সামাজিক সমতা |
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা | ব্রাহ্ম আন্দোলন-এ সক্রিয় ভূমিকা, সমাজ সংস্কার |
প্রভাব | বাংলা নবজাগরণ, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ প্রচার |
মৃত্যু | ১৮ মে ১৮৮৬ খ্রি |
অক্ষয়কুমার দত্ত
ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাবে বাংলার জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণ-এর সূচনা হয় অক্ষয়কুমার ছিলেন তার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর স্বাধীন ও যুক্তিবাদী চিন্তা বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে এক বিপুল পরিবর্তন এনেছিল।
অক্ষয়কুমার দত্তর জন্ম
১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই তৎকালীন নবদ্বীপের সন্নিহিত চুন্সী নামক গ্রামে অক্ষয়কুমারের জন্ম। তাঁর পিতার নাম পীতাম্বর দত্ত, মাতা দয়াময়ী দেবী। পীতাম্বর ছিলেন দয়ালু ও পরোপকারী ব্যক্তি। দয়াময়ী ছিলেন তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী। পিতার গুণাবলী উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন অক্ষয়কুমার।
মনীষী অক্ষয়কুমার দত্তর শিক্ষা
- (১) মাত্র সাত বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় বিদ্যারম্ভ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু বেশিদিন সেখানে পড়াশুনা করা হয় নি। আট-ন বছর বয়স হতেই পীতাম্বর ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। এখানে এক পাদ্রীর কাছে অক্ষয়কুমারের ইংরাজী শিক্ষা আরম্ভ হয়।
- (২) পাদ্রীর সংস্পর্শে ছেলেকে ক্রমেই খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হতে দেখে পিতা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। এখানে মাত্র দুই বছর পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। এই স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন হার্ডম্যান জেফ্রয় নামে এক সাহেব। এই সাহেবের কাছেই অক্ষয়কুমার গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু ও জার্মান ভাষা শিক্ষা করেন।
- (৩) বাল্যবয়স থেকেই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন তিনি। অধ্যবসায় ও জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁর বিদ্যার্জনের সহায়ক হয়েছিল। অধীত ভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্যাদি পাঠ করে তিনি তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতেন। সেই সময় খিদিরপুরে থাকতেন অক্ষয়কুমার। সেখান থেকে প্রতিদিন কলকাতার জোড়াসাঁকোয় যাতায়াত করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। সেকারণে তাঁকে নিয়ে আসা হল দর্জিপাড়ায় পিসতুতো দাদা রামধন বসুর বাড়িতে। এখানে থেকেই তিনি স্কুলে যাতায়াত করতেন।
অক্ষয়কুমার দত্তর গভীর জ্ঞান অর্জন
বিদেশী ভাষা সাহিত্যের পাশাপাশি গণিত, বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের প্রতিও গভীর আগ্রহ ছিল অক্ষয়কুমারের। স্বভাবতঃই প্রবল অধ্যবসায় ও নিষ্ঠাবলে কিশোর বয়সেই তিনি এ সকল বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। দেশীয় সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দুশাস্ত্রাদির প্রতিও স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল তাঁর এবং গভীর আগ্রহ সহকারে এই সকল বিষয়ে নিয়মিত চর্চা করতেন। ফলে একটি পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত মন কৈশোর থেকেই তাঁর মধ্যে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছিল।
সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তর বিবাহ
তৎকালীন রীতি অনুযায়ী মাত্র পনেরো বছর বয়সেই তাঁর বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের কিছুকাল পরেই অকস্মাৎ পিতৃবিয়োগ ঘটে। ফলে পড়াশুনা ত্যাগ করে পরিবারের ভরণপোষণের চেষ্টায় ব্যাপৃত হতে হয়। পিতার অনুপস্থিতিতে সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ল তাঁর ওপরে। এবার কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হল তাঁকে। শুরু হল দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম। অত কৃষ্ণতার মধ্যেও অক্ষয়কুমারের জ্ঞানস্পৃহা রইল সমান জাগরুক। বন্ধুবান্ধবের কাছে বইপত্র সংগ্রহ করে নিয়মিত তিনি জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করে গেছেন।
ঈশ্বর গুপ্তর সাথে অক্ষয়কুমার দত্তর সাক্ষাত
- (১) একবার একটি কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে ঘটনাক্রমে তাঁর পরিচয় হয় কবি ঈশ্বর গুপ্ত-এর সঙ্গে। সেই সময় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ কবি। প্রভাকর নামে একটি জনপ্রিয় সাহিত্যপত্রও তিনি সম্পাদনা করতেন। অক্ষয়কুমার গেলেন প্রভাকর কার্যালয়ে কবির সঙ্গে দেখা করতে।
- (২) সেদিন ঘটনাচক্রে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক অনুপস্থিত ছিলেন। প্রভাকর পত্রিকার জন্য The Englishman পত্রিকার কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ করার প্রয়োজন হয়েছিল। ঈশ্বর গুপ্ত অক্ষয়কুমারকে বললেন কাজটা করতে। ইতিপূর্বে গদ্যরচনায় বিশেষ অভ্যাস না থাকলেও অক্ষয়কুমার কবিতা রচনা করেছেন।
- (৩) মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই তিনি রচনা করেছিলেন অনঙ্গমোহন নামে কাব্যগ্রন্থ। স্বভাবতঃ ঈশ্বর গুপ্তর প্রস্তাবে অক্ষয়কুমার তাঁর অক্ষমতার কথা জানালেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিবরের উৎসাহে তিনি অনুবাদের কাজটুকু সমাধা করলেন। লেখা পড়ে সন্তুষ্ট হলেন ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি সানন্দে জানালেন যে, এত দিন এই কাজটি যিনি করে আসছেন অক্ষয়কুমারের অনুবাদ তাঁর চাইতেও উৎকৃষ্ট হয়েছে।
- (৪) এই ছোট্ট ঘটনাটিই অক্ষয়কুমারকে প্রবল অনুপ্রাণিত করল। তিনি গদ্য রচনা এবং সাংবাদিকতাব কাজে উৎসাহিত হলেন। এর পর থেকেই তিনি প্রায় নিয়মিত ভাবে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার জন্য ইংরাজি সংবাদপত্র থেকে প্রবন্ধাদির বঙ্গানুবাদ শুরু করেন। এভাবেই সূত্রপাত হয় অক্ষয়কুমারের গদ্যরচনার।
তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য অক্ষয়কুমার দত্ত
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য হন। বাংলার নবজাগরণের নবীন স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে অক্ষয়কুমারের জীবন এক নতুন গতিবেগ পেল। তিনি যেন এতদিন পরে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেলেন।
পাঠশালার শিক্ষক অক্ষয়কুমার দত্ত
- (১) ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বছরই অক্ষয়কুমার এই পাঠশালার শিক্ষক পদে নিযুক্ত হলেন। মাসিক বেতন ধার্য হল আট টাকা। পরে মাস কয়েকের মধ্যেই দুই ধাপে তাঁর বেতন বৃদ্ধি হয়ে হয়েছিল চোদ্দ টাকা। পাঠশালায় শিক্ষকতার কাজে থাকাকালীনই কিছুকাল তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
- (২) সেই কালে ইংরাজি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও প্রভাবের ফলে বাংলা ভাষার চর্চা পুরোপুরিই কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াতেই বাঙ্গালী গৌরবান্বিত বোধ করত। অবশ্য তার সঙ্গে জাগতিক বাস্তব লাভালাভের বিষয়টিই যে প্রবল ছিল তা বলাই বাহুল্য।
- (৩) মাতৃভাষার এই অবহেলা ও অনাদরের যুগে শুধুমাত্র বাংলা ভাষা শিক্ষা দেবার জন্যই তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই কালে খ্রিস্টান মিশনারিদের সুকৌশল প্ররোচনায় দেশের অল্পমতি বালক-বালিকারা পরধর্মের প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিল। হিন্দুধর্ম ও বাঙ্গালী জীবনের ইতিহাসে সে ছিল এক চরম বিপর্যয়ের কাল।
- (৪) এই পরিস্থিতিতে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসী ও পরবর্তী প্রজন্মকে মিশনারিদের প্রলোভন থেকে মুক্ত রাখা। দেবেন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসার পর জাতীয় চেতনার এই নতুন ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অক্ষয়কুমার প্রাণমন ঢেলে কাজ করতে লাগলেন।
- (৫) বাংলা ভাষা ছিল অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার। সেই কারণেই ছাত্রদের পাঠদানের উপযুক্ত পুস্তকাদিও রচিত হয়নি। পুস্তকের অভাবে পাঠশালার শিক্ষাদান কাজে খুবই অসুবিধা হতে লাগল। এই অসুবিধা অনুভব করে অল্পদিনের মধ্যেই অক্ষয়কুমার বাংলা ভাষায় একখানি ভূগোল পুস্তক রচনা করেন।
- (৬) ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে ভূগোল পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একখানি পদার্থবিদ্যার বইও রচনা করেন। এছাড়া রচনা করেন তিন ভাগে বিভক্ত চারুপাঠ। তাঁর রচিত চারুপাঠ প্রথম থেকে তৃতীয় ভাগ বহুকাল বাংলা স্কুলের পাঠ্যপুস্তক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
পত্রিকা সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত
- (১) ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে টাকির স্বনামধন্য প্রসন্নকুমার ঘোষের সহযোগিতায় অক্ষয়কুমার বিদ্যাদর্শন নামে একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। অবশ্য এই পত্রিকার মাত্র দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হতে পেরেছিল। পরের বছরেই আগস্ট মাসে তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্ররূপে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পেলেন অক্ষয়কুমার।
- (২) তাঁর উপযুক্ত সম্পাদনায় ও প্রসাদগুণসম্পন্ন রচনা সম্ভারে পত্রিকাটি অল্পকালের মধ্যেই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাময়িক পত্রে পরিণত হয়। পত্রিকাটির চর্চিত বিষয়াদি ছিল চমকপ্রদ। তত্ত্ববিদ্যা, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের মননশীল প্রবন্ধাদি পত্রিকাটির গৌরব বৃদ্ধি করেছিল।
- (৩) নানা বিষয়ের প্রবন্ধাদির সঙ্গে স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, হিন্দুবিধবাদের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও নানাবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লেখাও পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হত। প্রায়শই ছাপা হত সচিত্র প্রবন্ধ। অক্ষয়কুমার যুক্তিপূর্ণ তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধর্ম-সমাজ-সাহিত্য-বিজ্ঞান-পুরাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে চিন্তাশীল প্রবন্ধাদি নিয়মিত রচনা করতেন।
- (৪) এইভাবে তাঁর বলিষ্ঠ কলম চালনা ও মননশীলতার ফলে বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। তৎকালে বাংলার দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায় নীলকর সাহেব ও জমিদারদের পীড়ন ও অত্যাচারে চরম দুরবস্থায় কবলিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমার এই সকল অবিচারের বিরুদ্ধেই নির্ভীকভাবে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখনী চালনা করতেন।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিতে অক্ষয়কুমার দত্তর অবদান
সে যুগে বাংলাভাষায় গদ্যবচনার রীতি বিশেষ প্রচলিত ছিল না। বাংলা ভাষায় কোন বইও ছিল না। এমত অবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা লিখে অক্ষয়কুমার একদিকে যেমন বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করলেন, তেমনি তরুণ সমাজের দৃষ্টি ও মন আকৃষ্ট করলেন অবহেলিত বাংলা রচনার প্রতি। তাঁর সহযোগী লেখকদের মধ্যে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ দেশবরেণ্য মনীষীগণ।
মনীষী অক্ষয়কুমার দত্তর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা
- (১) ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর তিনি পরিচালনা সম্পাদনা দ্বারা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সমৃদ্ধি সাধন করেছিলেন। সম্পাদক জীবনের শুরুতেই ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ এবং অপর উনিশজন বন্ধুর সঙ্গে অক্ষয়কুমার রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম।
- (২) অক্ষয়কুমার ছিলেন যুক্তিবাদে বিশ্বাসী। ফলে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও বেদের অভ্রান্ততা তিনি স্বীকার করতেন না। অপরদিকে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবলরূপে ভাববাদী এবং বেদের অভ্রান্ততায় আস্থাশীল। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের কর্তা। তাঁর মতেই সমাজ পরিচালিত হত।
- (৩) অক্ষয়কুমার নিজের মত প্রতিষ্ঠার আন্তরিক প্রেরণায় অবিলম্বে আন্দোলন আরম্ভ করলেন এবং জ্ঞান ও যুক্তির সহযোগে ব্রাহ্ম সমাজ-এর ভ্রান্তি দূর করতে সচেষ্ট হলেন। বেদান্ত ধর্ম অনুসারী ব্রাহ্মসমাজের ধর্মাচার্যদের বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমার রীতিমতো শাস্ত্রীয় তর্কে অবতীর্ণ হলেন এবং শেষাবধি নিজমত প্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য হন।
- (৪) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ বহু অনুসন্ধান ও আলোচনা-চিন্তাদির পরে অক্ষয়কুমারের মতই যুক্তিসিদ্ধ বলে মেনে নিলেন এবং বেদ-এর অভ্রান্ততায় বিশ্বাস বর্জন করেন। ব্রাহ্মসমাজে তৎকালে ঈশ্বরোপাসনা হত সংস্কৃত ভাষায়। সংস্কৃত ভাষার বদলে বাংলা ভাষার প্রবর্তন হয় অক্ষয়কুমারের উদ্যোগে। অবশ্য পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না।
আত্মীয়সভার সভাপতি অক্ষয়কুমার দত্ত
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকোয় দেবেন্দ্রনাথ স্বীয়ভবনে আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা করেন। সামাজিক সমস্যাদির বিষয়ে আলোচনা ও সমাধানের জন্যই এই সভার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সভার সভাপতি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ এবং অক্ষয়কুমার ছিলেন সম্পাদক।
নর্মালস্কুলের শিক্ষক অক্ষয়কুমার দত্ত
কলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয় নর্মালস্কুল স্থাপন করেন ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা ও রচনাদির সূত্রে তাঁর সঙ্গে অক্ষয়কুমারের পূর্বেই পরিচয় হয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের উচ্চ ধারণা ছিল। তাই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে ওই বছরেই বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমারকে তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত করলেন। মাসিক বেতন ধার্য হয় একশত পঞ্চাশ টাকা। অবশ্য অক্ষয়কুমার বেশিদিন এই স্কুলে শিক্ষকতা করতে পারেন নি। দুরারোগ্য শিরোরোগের দরুন তিন বছর পরে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকতার কাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
গঙ্গাতীরে অক্ষয়কুমার দত্তর বাড়ি ও বাগান
- (১) এই সময় তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে তাঁকে মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তি দেবার ব্যবস্থা হয়। পরে তাঁর লিখিত বইয়ের আয় বৃদ্ধি পেলে তিনি এই বৃত্তি নেওয়া বন্ধ করেন। শিরোরোগের উপশমের আশায় প্রথমে কিছুদিন অক্ষয়কুমার বাংলার বাইরে ভ্রমণ করেন। কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। শেষ পর্যন্ত হাওড়ার বালী অঞ্চলে গঙ্গার তীরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য একখানি বাড়ি নির্মাণ করলেন।
- (২) বাড়ির সঙ্গেই নিজহাতে তিনি একটি বাগান তৈরি করেছিলেন। দেশি বিদেশি অনেক গাছ এখানে রোপন করেছিলেন এবং যত্নের সঙ্গে তাদের লালনপালন ও সংরক্ষণ করতেন। এই বাগানের তিনি নাম দিয়েছিলেন শোভনোদ্যান।
- (৩) মাথার যন্ত্রণায় সময়ে সময়ে খুবই কাতর হয়ে পড়তেন অক্ষয়কুমার। সেই সময় এই বাগানে এসে পায়চারী করে তিনি অনেকটা আরামবোধ করতেন। তাঁর বিখ্যাত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড এই বাগানে বসেই তিনি রচনা করেন।
- (৪) এই গ্রন্থের সুদীর্ঘ উপক্রমণিকা অংশে তিনি আর্যভাষা ও সাহিত্যের প্রধান তিন শাখা-ইন্দো-ইউরোপীয়, ইন্দো-ইরানীয় এবং বৈদিক ও সংস্কৃত বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেন। ভারতে ভাষা বিজ্ঞান সম্বন্ধে সেটিই প্রথম আলোচনা। তাঁর আগে এ বিষয়ে আর কেউ আলোকপাত করেননি।
শিরোরোগে আক্রান্ত অক্ষয়কুমার দত্ত
শেষজীবনে শিরোরোগে অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন অক্ষয়কুমার। শেষ দিকে সামান্য শব্দও সহ্য করতে পারতেন না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল বিষয়ে শিক্ষাদানের যে পরিকল্পনা অক্ষয়কুমার করেছিলেন দুরারোগ্য শিরোরোগের জন্য তা তিনি রূপায়িত করতে পারেন নি।
ব্যক্তিজীবনে অক্ষয়কুমার দত্ত
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠোর নীতিপরায়ণ, বিনয়ী ও ধার্মিক। পরদুঃখকাতরতা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। অভাবে পড়ে কেউ তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলে তার অভাব দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত কর্তৃক প্রার্থনার প্রয়োজন স্বীকার
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবে তিনি ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী হন। প্রার্থনার প্রয়োজন তিনি স্বীকার করতেন না। কিন্তু রোগযন্ত্রণার তীব্রতায় শেষ দিকে তাঁর এই মনোভাব স্থির রাখতে পারেন নি। একবার শিরোরোগে অত্যধিক কাতর অবস্থায় বাড়ির নিত্যপূজা নারায়ণের আসনে প্রণাম করেন। রোগ উপশমের প্রার্থনা জানান।
মনীষী অক্ষয়কুমার দত্তর মৃত্যু
অবশেষে রোগযাতনা নিয়েই অক্ষয়কুমার ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে মে বালীর বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলার নবজাগরণের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি তার চিন্তা, কর্ম, এবং লেখনীর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রগতি ও মানবতাবাদ প্রচার করেছেন। তিনি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ব্রাহ্ম সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষার প্রসার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার জীবন ও কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি প্রেরণার উৎস। যুক্তি, মানবিকতা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার যে দৃষ্টিভঙ্গি তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা আজও সমাজে প্রাসঙ্গিক। অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন শুধুমাত্র একজন সমাজসংস্কারক নন, বরং তিনি ছিলেন এমন এক চিন্তাবিদ, যিনি বাংলার নবজাগরণের মঞ্চে অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন।
(FAQ) অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন বাংলা নবজাগরণের অগ্রদূত, একজন দার্শনিক, লেখক এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন এবং বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনা ও যুক্তিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজের যুক্তিবাদী শাখাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর করতে এবং বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রসারে তার লেখা ও কার্যক্রম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তার বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে “ভারতবর্ষীয় উপাসক সমাজ” এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো উল্লেখযোগ্য।
অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্ম সমাজের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন।
তার দর্শন ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সমতার প্রচার করেছিলেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল।