ক্রিমিয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে যুদ্ধের কারণ হিসেবে গ্ৰিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব, রুশ সম্প্রসারণ, ইউরোপীয় শক্তিবর্গের স্বার্থ, ভিয়েনা নোট, রাশিয়ার পরাজয়, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ভূমিকা, প্যারিসের সন্ধি ও শর্ত, যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল হিসেবে অনাবশ্যক যুদ্ধ, অনাবশ্যক যুদ্ধ নয়, প্রত্যক্ষ ফল ও পরোক্ষ ফল সম্পর্কে জানবো।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময়কাল, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগদানকারী দেশ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সাথে ভিয়েনা নোট, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূচনা, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ভূমিকা, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়, প্যারিসের সন্ধি দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান, প্যারিসের সন্ধির শর্ত, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল।
ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ
ঘটনা | ক্রিমিয়ার যুদ্ধ |
সময়কাল | ১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | রাশিয়া বনাম ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, প্রাশিয়া |
ফলাফল | রাশিয়ার পরাজয় |
ভূমিকা:- ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পূর্বাঞ্চল সমস্যার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক অতি তুচ্ছ কারণকে উপলক্ষ্য করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি হল-
(ক) গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব
- (১) তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত খ্রিস্টের স্মৃতি-বিজড়িত পবিত্র জেরুজালেমের প্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন বা রোমান ও গ্রিক ধর্মযাজকদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ফ্রান্স ল্যাটিন ধর্মযাজকদের এবং রাশিয়া গ্রিক ধর্মযাজকদের সমর্থন করত।
- (২) ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সঙ্গে ক্যাপিচুলেসন সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স জেরুজালেমের পবিত্র স্থান ও ল্যাটিন বা রোমান ধর্মযাজকদের উপর অভিভাবকত্ব করার অধিকার পায়। আবার, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের কুসুক-কাইনাডর্জির সন্ধি দ্বারা রাশিয়া উক্ত স্থানগুলি ও গ্রিক ধর্মযাজকদের উপর কর্তৃত্বাধিকার পায়।
- (৩) ফরাসি বিপ্লব চলাকালে ফ্রান্স এই ব্যাপারে চিন্তার অবকাশ পায় নি। রাশিয়াও এই ব্যাপারে নীরব ছিল। বিপ্লব-অবসানে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন জেরুজালেম সম্পর্কে ফ্রান্সের পুরোনো অধিকার দাবি করলে তুরস্ক তা মেনে নেয়।
- (৪) এই অবস্থায় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াও তুরস্কের কাছে গ্রিক ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও প্রজাবর্গের উপর অধিকার দাবি করে বসে। তুরস্ক গ্রিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির উপর রুশ অধিকার স্বীকার করলেও গ্রিক ধর্মাধিষ্ঠান-ভুক্ত প্রজাদের উপর রুশ অধিকার মানতে রাজি ছিল না, কারণ এর ফলে কয়েক লক্ষ প্রজা রুশ শাসনাধীনে চলে যেত।
- (৫) রাশিয়ার দাবি অস্বীকৃত হলে রাশিয়া কোনও রকম যুদ্ধ ঘোষণা না করেই দানিয়ুব উপত্যকায় অবস্থিত তুর্কি সাম্রাজ্য -এর দুটি প্রদেশ মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল করে নেয়। এর ফলে তুর্কি সুলতান ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
- (৬) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। এই ধর্মীয় কারণই হল যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা তাৎক্ষণিক কারণ।
- (৭) ফরাসি রাজনীতিক থিয়ার্স বলেন যে, কয়েকজন হতভাগ্য সন্ন্যাসীকে গ্রোটোর চাবি হস্তান্তর করার জন্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধ বাধানো হয়।
(খ) রুশ সম্প্রসারণ
- (১) আসলে ধর্মীয় কারণ হল যুদ্ধের অজুহাত মাত্র। যুদ্ধের প্রকৃত কারণ হল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে রুশ সম্প্রসারণ এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ-প্রণোদিত আচরণ। রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণসাগরের উপর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানো।
- (২) ইতিপূর্বে রুশ জার প্রথম নিকোলাস তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ আখ্যা দিয়ে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পুনরায় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কাছে তুরস্ক বিভাজনের প্রস্তাব পাঠান। বলা হয় যে, দুর্বল তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিলেই পূর্বাঞ্চল সমস্যার সমাধান হবে এবং এতে তাঁরা নিজেরাও লাভবান হবেন।
- (৩) ইংল্যান্ড সরাসরি এই প্রস্তাব নাকচ না করে পরোক্ষভাবে আপত্তি জানায়। এর ফলে রাশিয়ার ধারণা হয় যে, তুরস্ক ব্যবচ্ছেদে ইংল্যান্ডের আপত্তি নেই। যাই হোক, রাশিয়া মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল করলে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এই ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
(গ) ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের স্বার্থ
এই ব্যাপারে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। যেমন –
- (১) ইংল্যান্ড তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষপাতী ছিল, কারণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি ঘটলে ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থ ও ভারতীয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
- (২) ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁর স্বৈরশাসনকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি জমকালো পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে চাইছিলেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুযোগ তৃতীয় নেপোলিয়ন -এর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাই ফ্রান্সের গৌরব বৃদ্ধি এবং নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া অভিযান -এর ব্যর্থতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি রুশ-বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন। জার নিকোলাস তাকে প্রায়ই ব্যঙ্গ করে বলতেন যে, তিনি বংশানুক্রমিক অধিকারের ভিত্তিতে সিংহাসনে বসেন নি। রাশিয়াকে পরাজিত করে তিনি এই ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে উদ্যোগী হন।
- (৩) অস্ট্রিয়া নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কারণে বলকান অঞ্চলে রুশ সম্প্রসারণের বিরোধী ছিল।
- (৪) পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া-র প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর আশা করেছিলেন যে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে ইতালির ঐক্যের ব্যাপারে তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। আসলে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের বিবিধমুখী স্বার্থই ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রকৃত কারণ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ প্রসঙ্গে ভিয়েনা নোট
- (১) রাশিয়া কর্তৃক মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া অধিকৃত হলে শঙ্কিত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ভিয়েনাতে মিলিত হয় এবং সম্মিলিতভাবে তুরস্ক ও রাশিয়ার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব ‘ভিয়েনা নোট’ নামে খ্যাত।
- (২) এই প্রস্তাবে রাশিয়ার কাছে মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। রাশিয়া এই দাবি অগ্রাহ্য করলে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগ দেয় ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়
১৮৫৪ (মার্চ) থেকে ১৮৫৬ (মার্চ) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’ বছর এই যুদ্ধ চলে। প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া পরাজিত হয়। সিনোপের নৌযুদ্ধে রাশিয়া তুরস্ককে পরাজিত করে। এরপর আলমা, বালাক্লাভা, ইনকারম্যান প্রভৃতি রণক্ষেত্রে রুশ বাহিনী পরাজিত হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের ভূমিকা
এই সময় ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল নামে জনৈকা ইংরেজ তরুণী স্বোচ্ছাসেবিকা দল গঠন করে দু’বছর ধরে এই যুদ্ধে আহতদের সেবা করেন। তিনি ‘প্রদীপবাহী মহিলা’ বা ‘The Lady with the Lamp’ নামে পরিচিত হন।
প্যারিসের সন্ধি দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সমাপ্তি
ইতিমধ্যে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ জার প্রথম নিকোলাসের মৃত্যু হলে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা হ্রাস পায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে মার্চ প্যারিসের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্যারিসের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্তানুসারে-
- (১) রাশিয়া তুরস্ককে মোলডাভিয়া, ওয়ালেশিয়া ও বেসারাবিয়া ফিরিয়ে দেয়।
- (২) বৃহৎ শক্তিবর্গ তুরস্ক সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
- (৩) তুরস্ককে ইউরোপীয় রাষ্ট্রমণ্ডল ও আন্তর্জাতিক আইনের এক্তিয়ারভুক্ত করা হয়।
- (৪) দার্দানালিস প্রণালীতে শান্তির সময় কোনও দেশের যুদ্ধজাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ হয়।
- (৫) কৃষ্ণসাগর নিরপেক্ষ অঞ্চল বলে চিহ্নিত হয় এবং সেখানে রুশ বা তুর্কি নৌ-ঘাঁটি স্থাপন নিষিদ্ধ হয়।
- (৬) রাশিয়া গ্রিক চার্চ ও খ্রিস্টান প্রজাদের উপর দাবি ত্যাগ করে।
- (৭) তুর্কি সুলতান তুরস্কের আধুনিকীকরণ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন।
- (৮) মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়াকে তুরস্কের অধীনে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। প্যারিসের সন্ধির কিছুদিন পরে তৃতীয় নেপোলিয়নের উদ্যোগে এই স্থান দুটিকে নিয়ে রুমানিয়া রাজ্য গঠিত হয়।
- (৯) তুরস্কের, সুলতান সার্বিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ফরাসি ঐতিহাসিক ও মন্ত্রী থিয়ার্স-এর মতে, এটি হল “কবরের চাবিকাঠি নিয়ে হীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন যাজকদের মধ্যে অনুপ্রসূত যুদ্ধ। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল গুলি হল –
(ক) অনাবশ্যক যুদ্ধ
- (১) স্যার রবার্ট মোরিয়ার-এর মতে, এই যুদ্ধ ছিল “আধুনিক কালের সর্বাপেক্ষা অনাবশ্যক ও অযৌক্তিক যুদ্ধ।” বলা বাহুল্য, এই মতামতকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এই যুদ্ধের দ্বারা পূর্বাঞ্চল সমস্যা, রুশ-তুর্কি বিরোধ বা বলকান অঞ্চলে বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তিগুলির স্বার্থদ্বন্দ্বের কোনও স্থায়ী মীমাংসা হয় নি।
- (২) এই যুদ্ধের দ্বারা তুর্কি সাম্রাজ্যে রুশ আগ্রাসন রোধ, তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষা, তুরস্কের আধুনিকীকরণ বা বলকান জাতিগুলির জাতীয় রাষ্ট্রগঠন – কিছুই সম্ভব হয় নি। প্যারিসের চুক্তি-ও ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া প্যারিস চুক্তির কৃষ্ণসাগর-সম্পর্কিত শর্ত ভঙ্গ করে সেখানে রণতরী পাঠায়।
- (৩) ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে স্যানস্টিফানো-র সন্ধি দ্বারা রাশিয়া বেসারাবিয়া দখল করে। পুনরায় রুশ-তুরস্ক যুদ্ধ শুরু হয়। প্যারিসের চুক্তিতে তুরস্কের আধুনিকীকরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয় নি। এর ফলে বৃহৎ শক্তিগুলি তুরস্ক সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। তাই অনেকের কাছেই এই যুদ্ধ ছিল অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয়।
(খ) অনাবশ্যক যুদ্ধ নয়
- (১) ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি-র মতে, “উনিশ শতকের ইউরোপ -এর ইতিহাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
- (২) অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল উদ্দেশ্যহীন, সম্ভবত অপ্রয়োজনীয়, অনেকাংশে বিফল এবং অবশ্যই ব্যয়বহুল ও অবিবেচনাপ্রসূত। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত ফলের দ্বারা গৌরবান্বিত।
- (৩) অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর-এর মতে, “পরস্পরের আক্রমণ থেকে নয়, পরস্পরের সন্দেহ থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত, তথাপি এটি সম্পূর্ণভাবে অনাবশ্যক যুদ্ধ ছিল না।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল
এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের ফলাফলই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বলা যায় যে,
- (১) এই যুদ্ধের দ্বারা বলকান অঞ্চল ও কৃষ্ণসাগরে তথা তুরস্কে রুশ অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ইতিপূর্বে তুরস্কের যে সব অঞ্চল রাশিয়া অধিকার করেছিল, তুরস্ক তা-ও ফিরে পায়। এর ফলে রাশিয়ার ক্ষমতা কিছুটা সঙ্কুচিত হয়।
- (২) তুরস্ক ইউরোপীয় রাষ্ট্রমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আধুনিক সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্কের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আসে।
- (৩) ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এর ফলে তৃতীয় নেপোলিয়ন ও ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল
প্রত্যক্ষ ফল অপেক্ষা এই যুদ্ধের পরোক্ষ ফল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- (১) লর্ড ক্রোমার ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে ‘ইউরোপীয় ইতিহাসের জলবিভাজিকা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জলবিভাজিকা বা ঝরনার জলধারা যেমন শতমুখে প্রবাহিত হয়ে পার্শ্ববর্তী বহু স্থানকে সুজলা-সুফলা ও উর্বরা করে তোলে, তেমনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত নানা প্রবণতা পরবর্তীকালের ইউরোপীয় ইতিহাসের গতি-প্রকৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
- (২) ইউরোপে রুশ বিস্তার-নীতি প্রতিহত হওয়ায় রাশিয়া ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে বিস্তার নীতি অবলম্বন করে। এর ফলে ভারত -এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
- (৩) বীতশ্রদ্ধ জনসাধারণ জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বস্তুত, এই সময় থেকে জার-বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়। গণ-বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ায় বেশ কিছু উদারনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেন। এভাবেই ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ঘটে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক সংস্কারের যুগের সূচনা হয়।
- (৪) এই যুদ্ধ ইতালি ও জার্মানির ঐক্য-বন্ধনে সাহায্য করে। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে যোগদান করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভ করে। এর ফলে ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করে ইতালির ঐক্যসাধন সম্ভব হয়।
- (৫) এই যুদ্ধে রাশিয়ার মিত্র অস্ট্রিয়া রাশিয়াকে সাহায্য না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। এর ফলে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয় এবং পরবর্তীকালে জার্মানির ঐক্যের প্রয়োজনে প্রাশিয়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকে। এর ফলে জার্মানির ঐক্য সহজতর হয়।
- (৬) ঐতিহাসিক টেলর বলেন যে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রকৃত বিজেতা ছিলেন ক্যাভুর ও বিসমার্ক – ফ্রান্স নয়।” ঐতিহাসিক কেটেলবি বলেন যে, “ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলেই ইতালি ও জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।” অধ্যাপক টেলর বলেন যে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ছাড়া ইতালি বা জার্মানির ঐক্য সম্ভব হত না।
- (৭) এই যুদ্ধের ফলে বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের ফল ইংল্যান্ডের পক্ষে সুখকর হয় নি। ব্রিটিশ সেনাদলও যুদ্ধে তেমন যোগ্যতা দেখাতে পারে নি এবং এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইংল্যান্ড প্রবলভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
- (৮) প্রথম নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইংল্যান্ড যে মর্যাদা লাভ করেছিল, এই যুদ্ধে তা রক্ষিত হয় নি, বরং এই যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড ইউরোপে মিত্রহীন হয়ে পড়ে।
উপসংহার:- এই যুদ্ধের ফলে মেটারনিখের মৃদু প্রভাব, যা তখনও সামান্য হলেও প্রবহমান ছিল, পুরোপুরি মুছে যায় এবং ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সীম্যান বলেন যে, ১৮৪৮-এর বিপ্লব নয় – ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের চুক্তিই মেটারনিখ যুগের সমাপ্তি ঘটায়।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ক্রিমিয়ার যুদ্ধ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, প্রাশিয়া ও ইতালির সঙ্গে রাশিয়ার।
৩০ মার্চ, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি।
কাউন্ট ক্যাভুর।