ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল

১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল প্রসঙ্গে অনাবশ্যক যুদ্ধ হিসেবে স্থায়ী মীমাংসা হয় নি, তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতি অবহেলা, বৃহৎ শক্তিগুলির উদাসীনতা, অনাবশ্যক যুদ্ধ নয় হিসেবে বিশেষ স্থান দখল, অনাকাঙ্খিত ফলের দ্বারা গৌরবান্বিত, টেলরের অভিমত, প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে রুশ প্রভাব খর্ব, তুরস্কের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ, তৃতীয় নেপোলিয়নের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি, পরোক্ষ ফল হিসেবে জলবিভাজিকা, জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ, জার বিরোধী আন্দোলনের সূচনা, রাশিয়ায় সংস্কারের সূচনা, ইতালির ঐক্য আন্দোলন, জার্মানির ঐক্য সহজতর, প্রকৃত বিজেতা, ঋণগ্রস্ত ইংল্যান্ড ও ইউরোপে মিত্রহীন ইংল্যান্ড সম্পর্কে জানবো।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল

ঐতিহাসিক ঘটনাক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল
সময়কাল১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দ
বিবাদমান পক্ষরাশিয়া বনাম ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, প্রাশিয়া
ফলাফলরাশিয়ার পরাজয়
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল

ভূমিকা:- ক্রিমিয়ার যুদ্ধ-এর গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ফরাসি ঐতিহাসিক ও মন্ত্রী থিয়ার্স-এর মতে, এটি হল “কবরের চাবিকাঠি নিয়ে হীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন যাজকদের মধ্যে অনুপ্রসূত যুদ্ধ।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব

এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন। যেমন –

(ক) অনাবশ্যক যুদ্ধ

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি অনাবশ্যক যুদ্ধ। কারণ, 

(১) স্থায়ী মীমাংসা হয় নি

স্যার রবার্ট মোরিয়ার-এর মতে, এই যুদ্ধ ছিল “আধুনিক কালের সর্বাপেক্ষা অনাবশ্যক ও অযৌক্তিক যুদ্ধ।” বলা বাহুল্য, এই মতামতকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এই যুদ্ধের দ্বারা পূর্বাঞ্চল সমস্যা, রুশ-তুর্কি বিরোধ বা বলকান অঞ্চলে বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তিগুলির স্বার্থদ্বন্দ্বের কোনও স্থায়ী মীমাংসা হয় নি।

(২) তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতি অবহেলা

এই যুদ্ধের দ্বারা তুর্কি সাম্রাজ্য-এ রুশ আগ্রাসন রোধ, তুরস্ক-এর অখণ্ডতা রক্ষা, তুরস্কের আধুনিকীকরণ বা বলকান জাতিগুলির জাতীয় রাষ্ট্রগঠন – কিছুই সম্ভব হয় নি। প্যারিসের চুক্তি-ও ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া প্যারিস চুক্তির কৃষ্ণসাগর-সম্পর্কিত শর্ত ভঙ্গ করে সেখানে রণতরী পাঠায়।

(৩) বৃহৎ শক্তিগুলির উদাসীনতা

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে স্যানস্টিফানো-র সন্ধি দ্বারা রাশিয়া বেসারাবিয়া দখল করে। পুনরায় রুশ-তুরস্ক যুদ্ধ শুরু হয়। প্যারিসের চুক্তিতে তুরস্কের আধুনিকীকরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয় নি। এর ফলে বৃহৎ শক্তিগুলি তুরস্ক সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। তাই অনেকের কাছেই এই যুদ্ধ ছিল অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয়।

(খ) অনাবশ্যক যুদ্ধ নয়

ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে অনেকেই অনাবশ্যক যুদ্ধ নয় বলেও ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন –

(১) বিশেষ স্থান দখল

ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি-র মতে, “উনিশ শতকের ইউরোপ-এর ইতিহাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

(২) অনাকাঙ্খিত ফলের দ্বারা গৌরবান্বিত

অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল উদ্দেশ্যহীন, সম্ভবত অপ্রয়োজনীয়, অনেকাংশে বিফল এবং অবশ্যই ব্যয়বহুল ও অবিবেচনাপ্রসূত। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত ফলের দ্বারা গৌরবান্বিত।

(৩) টেলরের অভিমত

অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর-এর মতে, “পরস্পরের আক্রমণ থেকে নয়, পরস্পরের সন্দেহ থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত, তথাপি এটি সম্পূর্ণভাবে অনাবশ্যক যুদ্ধ ছিল না।”

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল

এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের ফলাফলই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন –

(ক) ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল

প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বলা যায় যে,

(১) রুশ প্রভাব খর্ব

এই যুদ্ধের দ্বারা বলকান অঞ্চল ও কৃষ্ণসাগরে তথা তুরস্কে রুশ অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ইতিপূর্বে তুরস্কের যে সব অঞ্চল রাশিয়া অধিকার করেছিল, তুরস্ক তা-ও ফিরে পায়। এর ফলে রাশিয়ার ক্ষমতা কিছুটা সঙ্কুচিত হয়।

(২) তুরস্কের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ

তুরস্ক ইউরোপীয় রাষ্ট্রমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আধুনিক সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্কের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আসে।

(৩) তৃতীয় নেপোলিয়নের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি

ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এর ফলে তৃতীয় নেপোলিয়ন ও ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

(খ) ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল

প্রত্যক্ষ ফল অপেক্ষা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –

(১) জলবিভাজিকা

লর্ড ক্রোমার ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে ‘ইউরোপীয় ইতিহাসের জলবিভাজিকা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জলবিভাজিকা বা ঝরনার জলধারা যেমন শতমুখে প্রবাহিত হয়ে পার্শ্ববর্তী বহু স্থানকে সুজলা-সুফলা ও উর্বরা করে তোলে, তেমনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত নানা প্রবণতা পরবর্তীকালের ইউরোপীয় ইতিহাসের গতি-প্রকৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

(২) জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ

ইউরোপে রুশ বিস্তার-নীতি প্রতিহত হওয়ায় রাশিয়া ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে বিস্তার নীতি অবলম্বন করে। এর ফলে ভারত -এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

(৩) জার বিরোধী আন্দোলনের সূচনা

বীতশ্রদ্ধ জনসাধারণ জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বস্তুত, এই সময় থেকে জার-বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়।

(৪) রাশিয়ায় সংস্কারের সূচনা

গণ-বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ায় বেশ কিছু উদারনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেন। এভাবেই ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ঘটে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক সংস্কারের যুগের সূচনা হয়।

(৫) ইতালির ঐক্য আন্দোলন

এই যুদ্ধ ইতালি ঐক্য আন্দোলন -এ সাহায্য করে। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে যোগদান করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভ করে। এর ফলে ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করে ইতালির ঐক্যসাধন সম্ভব হয়।

(৬) জার্মানির ঐক্য সহজতর হয়

এই যুদ্ধে রাশিয়ার মিত্র অস্ট্রিয়া রাশিয়াকে সাহায্য না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। এর ফলে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয় এবং পরবর্তীকালে জার্মানির ঐক্য আন্দোলন কালে প্রাশিয়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকে। এর ফলে জার্মানির ঐক্য সহজতর হয়।

(৭) প্রকৃত বিজেতা

ঐতিহাসিক টেলর বলেন যে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রকৃত বিজেতা ছিলেন ক্যাভুর ও বিসমার্ক – ফ্রান্স নয়।” ঐতিহাসিক কেটেলবি বলেন যে, “ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলেই ইতালি ও জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।” অধ্যাপক টেলর বলেন যে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ছাড়া ইতালি বা জার্মানির ঐক্য সম্ভব হত না।

(৮) ঋণগ্রস্ত ইংল্যান্ড

এই যুদ্ধের ফলে বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের ফল ইংল্যান্ডের পক্ষে সুখকর হয় নি। ব্রিটিশ সেনাদলও যুদ্ধে তেমন যোগ্যতা দেখাতে পারে নি এবং এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইংল্যান্ড প্রবলভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

(৯) ইউরোপে মিত্রহীন ইংল্যান্ড

প্রথম নেপোলিয়ন -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইংল্যান্ড যে মর্যাদা লাভ করেছিল, এই যুদ্ধে তা রক্ষিত হয় নি, বরং এই যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড ইউরোপে মিত্রহীন হয়ে পড়ে।

উপসংহার:- এই যুদ্ধের ফলে মেটারনিখের মৃদু প্রভাব, যা তখনও সামান্য হলেও প্রবহমান ছিল, পুরোপুরি মুছে যায় এবং ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সীম্যান বলেন যে, ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লব নয় – ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের চুক্তিই মেটারনিখ যুগের সমাপ্তি ঘটায়।

(FAQ) ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময়কাল কত?

১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ।

২. কাদের মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়?

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, প্রাশিয়া ও ইতালির সঙ্গে রাশিয়ার।

৩. কোন সন্ধি দ্বারা প্রেমিয়ার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে?

৩০ মার্চ, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি।

৪. ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগদানকারী ইতালির প্রধানমন্ত্রীর নাম কি ছিল?

কাউন্ট ক্যাভুর।

Leave a Comment