ইতালির ঐক্য আন্দোলন

ইতালির ঐক্য আন্দোলন -এ রিসর্জিমেন্টো, কার্বোনারি সমিতির ভূমিকা, ম্যাৎসিনির ইয়ং ইতালি প্রতিষ্ঠা, স্লোগান, কৃতিত্ব, কাউন্ট ক্যাভুরের জন্ম, প্রথম জীবন, সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ, মন্ত্রীসভায় যোগদান, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, প্লমবিয়ার্সের চুক্তি, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ভিল্লাফ্রাঙ্কার চুক্তি, জুরিখের চুক্তি, গ্যারিবল্ডীর অবদান ও রোম জয় সম্পর্কে জানবো।

ইতালির ঐক্য আন্দোলন

ঐতিহাসিক ঘটনা ইতালির ঐক্য আন্দোলন
প্রধান ব্যক্তিত্ব ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর, গ্যারিবল্ডী
কার্বোনারি সমিতি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ
ইয়ং ইতালি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ
ঐক্যবদ্ধ ইতালি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ
ইতালির ঐক্য আন্দোলন

ভূমিকা :- ফরাসি বিপ্লব -এর সময় ইতালি অসংখ্য ছোটো ছোটো রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালি দখল করে ইতালিবাসীর নারে জাতীয় চেতনার জাগরণ ঘটান।

ভিয়েনা সম্মেলন

ভিয়েনা সম্মেলনে ইতালিকে আবার একাধিক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে বিদেশি শাসকদের অধীনে স্থাপন করা হয়। আটটি ভাগে বিভক্ত ইতালি তখন একটি “ভৌগোলিক সংজ্ঞায়” পরিণত হয়।

ভৌগোলিক সংজ্ঞা

একমাত্র পিডমন্ট সার্ডিনিয়ার স্যাভয় রাজবংশ ছাড়া বাকি সাতটি রাজ্যের শাসকই ছিলেন বিদেশি। তাই মেটারনিখ ইতালিকে ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’ বলে অভিহিত করেছেন।

নবজাগরণ

জাতীয় জীবনের এই ক্লান্তিলগ্নে ইতালিবাসীর মনে জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয়, যা রিসর্জিমেন্টো বা পুনরুত্থান বা নবজাগরণ নামে খ্যাত।

রিসর্জিমেন্টো

এই সময় ইতালিতে ব্রোয়া, কান্ত, ক্যাপ্পোনি প্রমুখ ঐতিহাসিক এবং লিওপার্ড, আজেগলিও প্রমুখ ঔপন্যাসিক ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়। এঁরা ইতালিবাসীর ভাবজগতে আলোড়নের সৃষ্টি করেন, যা ‘রিসার্জিমেন্টো’ নামে খ্যাত।

বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির উত্থান

এই জাগরণের ফলে উনিশ শতকে ইতালিতে কার্বোনারি, ফেডারেটি প্রভৃতি গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চলতে থাকে।

কার্বোনারি সমিতি

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্বোনারি সমিতি। কার্বোনারি সমিতির পরিচালিত আন্দোলন কার্বোনারি আন্দোলন নামে পরিচিত।

(১) নামকরণ

‘কার্বোনারি শব্দের অর্থ জ্বলন্ত ‘অঙ্গারবাহী’। এই সমিতির সদস্যরা জ্বলন্ত অঙ্গার বহন করত বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

(২) প্রধান কেন্দ্র

কার্বোনারি আন্দোলনের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল নেপলস্।  

(৩) মূল লক্ষ্য

কার্বোনারি সমিতির মূল লক্ষ্য ছিল ইতালিকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করা ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা।

ম্যাৎসিনি

এরপর ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জোসেফ ম্যাৎসিনি (১৮০৫-৭২ খ্রি:)।

(১) ইয়ং ইতালি প্রতিষ্ঠা

ইতালিবাসীর মনে আত্মশক্তির বিকাশ ও জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্য যুবশক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে তিনি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ইয়াং ইতালি বা নব্য ইতালি দল গঠন করেন।

(২) স্লোগান

এই সময় ম্যাৎসিনির স্লোগান ছিল ‘ইতালিয়া ফারা দা সে’ বা ইতালি এককভাবে এগিয়ে চলবে।

(৩) স্বপ্ন

প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী ম্যাৎসিনি স্বাধীন, সার্বভৌম ও প্রজাতান্ত্রিক ইতালির স্বপ্ন দেখতেন।

(৪) প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

তাঁর নেতৃত্বে গণ আন্দোলনের ফলে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে রোম ও টাসকেনিতে ‘প্রজাতন্ত্র” প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও তা স্থায়ী হয়নি।

(৫) কৃতিত্ব

ইতালির ঐক্যের সপক্ষে জনগণের মানসিক প্রস্তুতি সৃষ্টি করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব।

কাউন্ট ক্যাভুর

ম্যাৎসিনির পর ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর (১৮১০-১৮৬১)। তাঁকে ইতালির ঐক আন্দোলনের মস্তিষ্ক বলে অভিহিত করা হয়।

(১) জন্ম

১৮১০ খ্রিস্টাব্দের পিডমন্টের এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম। কাউন্ট ক্যান্ডুর আজেগগুলি -এর মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

(২) প্রথম জীবন

প্রথম জীবনে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তিনি পিডমন্টের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।

(৩) সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ

১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসোসিয়েশন অ্যাগ্রারিয়া” নামে একটি সমিতি গঠন করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘রিসর্জিমেন্টো’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

(৪) মন্ত্রিসভায় যোগদান

১৮৫০ খ্রিস্টাকে তিনি তাঁর জন্মস্থান পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন এবং ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টর ইমান্যুরেল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ

রাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী কাউন্ট ক্যাভুর ‘বাস্তব রাজনীতি” বা ‘রিয়েল পলিটিক’ নীতির প্রবক্তা। তিনি ইতালির জাতীয় ঐক্যের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করা এবং বৈদেশিক সাহায্য লাভের আশায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির পক্ষে যোগ দেন।

প্লমবিয়ার্সের চুক্তি

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্লমবিয়ার্স নামক স্থানে ক্যাভুর ও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের মধ্যে প্লমবিয়ার্সের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির দ্বারা ফরাসি সম্রাট স্যাভয় ও নিস প্রাপ্তির বিনিময়ে ইতালির ঐক্যের জন্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পিডমন্ট সার্ডিনিয়াকে সামরিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন।

অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্সও যুদ্ধে যোগ দেয়। ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে জয়লাভ করে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ও ফরাসি বাহিনী অস্ট্রিয়ার কবল থেকে লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার করে।

ভিল্লাফ্রাঙ্কার চুক্তি

এই সময় ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ক্যাভুরের সাথে কোনো আলোচনা না করেই এককভাবে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভিপ্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং লোম্বার্ডি ও মিলান পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটি ছিল ইতালির ঐক্যের প্রথম ধাপ।

জুরিখের ও তুরিনের সন্ধি

এরপর ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ‘জুরিখের সন্ধি’ স্বাক্ষরিত হয়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ক্যাভুর ও তৃতীয় নেপোলিয়নের মধ্যে তুরিনের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি অনুসারে পিডমন্টের সঙ্গে পার্মা-টাস্কানি যুক্ত হয় এবং তৃতীয় নেপোলিয়ন স্যাভয় ও নিস লাভ করেন।

গ্যারিবল্ডি

  • (১) গ্যারিবল্ডি ছিলেন ইতালির একজন মহান দেশপ্রেমিক ও প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি ইয়ং ইতালি’ দলের সদস্য ছিলেন।
  • (২) তিনি ‘লালকোর্তা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জনগণের আহ্বানে নেপলস্ ও সিসিলি জয় করেন।
  • (৩) ইতালির জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তিনি রাজ্য দুটি পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের হাতে সমর্পণ করে স্বেচ্ছা-নির্বাসন বেছে নেন।
  • (৪) ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টর ইমান্যুয়েল ‘ইতালির রাজা’ ঘোষিত হন। এই সময় ভেনিসিয়া ও রোম ব্যতীত সমগ্র ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়।

ভেনিশিয়া জয়

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলে ভেনিশিয়া ইতালির অন্তর্ভুক্ত হয়।

রোম জয়

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হলে রোম ইতালির অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়।

উপসংহার :- এরপরও ইতালিতে ইতালিভাষী ক্ষুদ্র অঞ্চল ট্রেন্ট, ট্রিয়েস্ট ও টাইরল অস্ট্রিয়ার অধিকারে থেকে গিয়েছিল এই অঞ্চলটি ‘অমুক্ত ইতালি’ নামে পরিচিত ছিল।

(FAQ) ইতালির ঐক্য আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ক্যাভুর কে ছিলেন?

পিডমন্ট সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক ইতালির গঠনকর্তা।

২. ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক বলে পরিচিত কে?

কাউণ্ট ক্যাভুর।

৩. ইতালির ঐক্য আন্দোলনের জনক কে?

যোশেফ ম্যাৎসিনি।

৪. ইয়ং ইতালি প্রতিষ্ঠা করেন কে?

যোশেফ ম্যাৎসিনি।

Leave a Comment