১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সংঘটিত। এই আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধীজির ভূমিকা আলোচনা করা হল।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন
ঐতিহাসিক ঘটনা | অসহযোগ আন্দোলন |
সময়কাল | ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
লক্ষ্য | স্বরাজ লাভ |
পন্থা | অহিংস অসহযোগ |
নেতা | মহাত্মা গান্ধী |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা:- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই বছরে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
যুগান্তকারী ঘটনা
দীর্ঘ ৩৫ বছরের ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’ বা আবেদন-নিবেদনের পথ ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-এর আহ্বান জানানো ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
গণ আন্দোলন
বস্তুত, এই আন্দোলন ছিল এক সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলন এবং এর লক্ষ্য ছিল ‘স্বরাজ’ অর্জন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ -এর পর এত ব্যাপক গণ-আন্দোলন আর দেখা যায় নি।
নবযুগের সূচনা
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কংগ্রেস নেতা আচার্য জে.বি. কৃপালনী বলেন যে, অসহযোগ আন্দোলন কংগ্রেস ও জাতীয় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। এই সময় ‘আবেদন-নিবেদন ও প্রতিবাদের’ দিন শেষ হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
জনসাধারণ বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক ও ভয়হীন চিত্তে সমবেতভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।
অসহযোগ আন্দোলনের কারণ
জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে এই অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –
(১) স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রবল আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভারতবাসী তাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সফল করার জন্য গান্ধীজির আহ্বানে ভারতীয়রা দলে দলে এই যুদ্ধে যোগদান করে এবং যুদ্ধ-তহবিলে প্রচুর অর্থ দান করে। ভারতবাসী আশা করেছিল যে, যুদ্ধান্তে তাদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে, কিন্তু যুদ্ধের অবসানে দেওয়া হল মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার যা ভারতীয়দের কাছে ছিল “তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক”। তাই দাবি আদায়ের জন্য ভারতীয়রা অন্য পথ গ্রহণে বাধ্য হয়।
(২) আর্থিক সংকট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেশবাসীকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ফাটকাবাজি ও বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করে। কাপড়, ওষুধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট চিনি প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ে। মন্দা ও শ্রমিক ছাঁটাই শ্রমিকদের সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়। এই সব নানা কারণে ভারতবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশিষ্ট মার্কসবাদী পণ্ডিত রজনী পাম দত্ত বলেন যে, দেশের অভ্যন্তরে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ফলে কংগ্রেসের পক্ষে আর সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই গান্ধীজি গণ-অসন্তোষকে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের পথে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
(৩) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও অসহযোগ আন্দোলনের কারণ বা পটভূমি তৈরি করে। রুশ বিপ্লব, আয়ারল্যাণ্ডের ‘সিনফিন’ আন্দোলন ও মাইকেল কলিন্সের নেতৃত্বে আইরিশ গেরিলাদের দুর্বার ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম ভারতীয়দের নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে। ভারতীয়রা উপলব্ধি করে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারাও জয়যুক্ত হতে পারে।
(৪) রাওলাট আইন
ভারতীয় বিপ্লববাদ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার রাওলাট আইন পাশ করতে উদ্যোগী হয়। এই আইনে স্থির হয় যে, সরকার-বিরোধী যে-কোনো প্রচার দণ্ডনীয় বলে বিবেচিত হবে, সন্দেহভাজন যে-কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে, বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল তাদের বন্দি করে রাখা বা নির্বাসন দেওয়া যাবে, বিনা সাক্ষ্য-প্রমাণে বিশেষ আদালতে তাদের বিচার হবে এবং এই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাবে না। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ এই আইনটি পাশ হয়। ভারতবাসী ক্ষোভে-রোষে ফেটে পড়ে। গান্ধীজি এই আইনের বিরুদ্ধে রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনকে ‘অসহযোগ আন্দোলনের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
(৫) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার চরম পরিণতি দেখা দেয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড -এ। জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র জনসমাবেশের ওপর গুলি চালনা, নারী, বৃদ্ধ ও শিশুসহ নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদের হত্যাকরে।এই ঘটনা সারা দেশে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করে। ব্রিটিশ রাজনীতিজ্ঞ চার্চিল এই ঘটনাকে ‘অতি অস্বাভাবিক, অতিপাশবিক’ বলে অভিহিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘৃণাভরে সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। গান্ধীজি বলেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে”।
(৬) খিলাফৎ সমস্যা
‘খিলাফৎ’ সমস্যাও অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। ভারতীয় মুসলিমরা তুরস্কের সুলতানকে ‘খলিফা’ বা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু বলে মনে করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগদান করে। যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে সুলতানের ক্ষমতা যথেষ্ট খর্ব করে। এর ফলে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ‘খলিফা’-কে তাঁর হৃাতমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলিমরা খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে। গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সুযোগ দেখতে পান।
অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা
এই সব কারণে গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান এবং এই দাবির সমর্থনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন।
বিশেষ অধিবেশন
খিলাফৎ কমিটি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তখনও এই কর্মসূচি সমর্থন করে নি। তাই উপরিউক্ত সমস্যাগুলি আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৯২০ বিশেষ কলকাতা ১৯২০ খ্রিঃ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে লালা লাজপৎ রায় -এর সভাপতিত্বে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে।
গান্ধীজির প্রস্তাব পাস
গান্ধীজি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগের পরিকল্পনা পেশ করেন এবং ‘স্বরাজ’-কে ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য বলে মেনে নেবার প্রস্তাব দেন। তিনি ‘স্বরাজ’-এর কোনো অর্থ বলেন নি। চিত্তরঞ্জন দাশ, লালা লাজপৎ রায়, মহম্মদ আলি জিন্না, মদনমোহন মালব্য, শ্রীমতী বেশান্ত, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা সত্ত্বেও গান্ধীজির প্রস্তাব পাস হয়।
নাগপুর অধিবেশন
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে জিন্না, মদনমোহন মালব্য ও শ্রীমতী বেশান্ত-র বিরোধিতা সত্ত্বেও অহিংস অসহযোগের প্রস্তাব পুনরায় অনুমোদিত হয়। স্থির হয় যে, কংগ্রেসের এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল-
- (১) পাঞ্জাবের অন্যায়ের প্রতিকার,
- (২) খিলাফৎ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ও
- (৩) ‘স্বরাজ’ অর্জন।
অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য, পন্থা, নেতা
এরপর জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে স্থির হয়—’স্বরাজ’, পন্থা —অহিংস অসহযোগ এবং নেতা—গান্ধীজি।
এক বছরের মধ্যে ‘স্বরাজ’ লাভ
গান্ধীজি-র ‘এক বছরের মধ্যে স্বরাজের প্রতিশ্রুতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বা বাস্তবসম্মত ছিল না। যেমন –
- (১) বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর প্রতিশ্রুতির মধ্যে ‘ম্যাজিক’ দেখেছিলেন, কোনো ‘লজিক’ খুঁজে পান নি।
- (২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধরনের ‘সংক্রামক বিশ্বাস প্রবণতায়’ শিউরে ওঠেন। তিনি ‘একটা বিশেষ বিশেষ তারিখে স্বরাজ লাভের প্রতিশ্রুতিকে সন্ন্যাসীর মন্ত্রশক্তিতে সোনা ফলাবার আশ্বাস বলে সমালোচনা করেছেন।
- (৩) সুভাষচন্দ্র বসু এই প্রতিশ্রুতিকে শিশুসুলভ কল্পনামাত্র বলে মন্তব্য করেছেন। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন তাঁর ‘মেরী জীবনযাত্রা’ গ্রন্থে লিখছেন যে, “এক বৎসরে স্বরাজের কথায় বিশ্বাস করা – যাদুমন্ত্রে বিশ্বাসী গ্রাম্য জনতার কাছে কঠিন ছিল না, কিন্তু আমার অবাক লাগত সেই সব শিক্ষিতদের বুদ্ধিতে, যাঁদের মধ্যে জেলে পড়ে থাকা অনেকেই ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯২১-এর মধ্যরাত্রে স্বরাজ সরকার দ্বারা জেলের ফটক খুলে যাবার প্রতীক্ষা করছিলেন।
অসহযোগ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
এই অসহযোগ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হল–
- (১) এই আন্দোলনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডী ভেঙ্গে গ্রামের কোটি কোটি নিরক্ষর মানুষের মধ্যে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। ‘স্বরাজ’ বলতে গান্ধীজি কেবলমাত্র ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি বোঝেন নি দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং রোগের হাত থেকেও মুক্তি বুঝেছিলেন।
- (২) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তো বটেই— জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়।
- (৩) কৃষক, শ্রমিক, চা-বাগানের কুলি এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ, প্রতাপগড় ও রায়বেরিলী জেলা, মাদ্রাজ এবং অন্ধ্রের গুন্টুর জেলা, পাঞ্জাবে অকালি শিখ ও জাঠ কৃষকরা আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়।
- (৪) গুজরাটের বারদৌলী তালুকে কৃষকদের খাজনা বন্ধ আন্দোলন চলতে থাকে। আসামের চা-বাগানের প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক ধর্মঘট করে। মেদিনীপুরে গ্রামবাসীরা চৌকিদারি ট্যাক্স না দেওয়া ও ইউনিয়ন বোর্ড বর্জনের আন্দোলন শুরু করে। এই সময় ভারতে মোট ৪০০টি শ্রমিক ধর্মঘট হয় এবং তাতে প্রায় ৫ লক্ষের বেশি শ্রমিক অংশগ্রহণ করে।
- (৫) নারী সমাজ দলে দলে পর্দা ছেড়ে বেরিয়ে এসে সভা, শোভাযাত্রা ও পিকেটিং-এ যোগদান করেন। তাঁরা সানন্দে কারাবরণ করতে থাকেন। ‘তিলক স্বরাজ তহবিল তাঁদের দানের অলংকারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাসন্তী দেবী, সরোজিনী নাইডু, জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায়, ঊর্মিলা দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার প্রমুখ বঙ্গনারী এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এইভাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রকৃত গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়।
- (৫) চরকা’ ও ‘খাদি’-র প্রসার এবং মদ্যপান নিবারণ, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, জাতীয় শিক্ষা ও সালিশি সংগঠন স্থাপন প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
- (৬) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গঠিত হয় এবং এই স্বেচ্ছাসেবীরা গ্রামে-গঞ্জে অসহযোগের বার্তা ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “সারা দেশ জুড়ে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়।
সরকারি দমননীতি
- (১) আন্দোলনের ব্যাপকতায় ভীত হয়ে নবনিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড রিডিং নিষ্ঠুর দমননীতির পথ ধরেন। কংগ্রেস ও খিলাফৎ স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলি বেআইনি বলে ঘোষিত হয়। সভা, সমিতি, মিছিল, সংবাদপত্র ও বাক্ স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
- (২) আন্দোলনের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলিতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১০৮ ও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বিভিন্ন জননেতার গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।
- (৩) চিত্তরঞ্জন দাশের ময়মনসিংহ যাত্রা, রাজেন্দ্র প্রসাদ -এর বিহারের আরা জেলায় প্রবেশ এবং লালা লাজপৎ রায়ের পেশোয়ার প্রবেশের ওপর নিয়েধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
- (৪) বহু স্থানে লাঠি ও গুলি চলে। জেলগুলি বন্দিদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে ওঠে। জেল সম্পর্কে মানুষের ভীতি দূর হয়ে যায় এবং কারাগার ‘পবিত্র তীর্থস্থানে’ পরিণত হয়। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হওয়ার পূর্বেই গান্ধীজি ব্যতীত প্রায় সকল নেতাই কারারুদ্ধ হন এবং এই সময় বন্দি কংগ্রেস কর্মীর সংখ্যাই ছিল চল্লিশ হাজার।
- (৫) এই সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মন্তব্য করেন–“সমস্ত ভারতই আজ এক বিশাল কারাগার। …… সুতরাং কি এসে যায়। যদি আমাকে জেলের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় বা আমি বাড়িতে থাকি।”
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা নামক স্থানে প্রায় তিন হাজার কৃষক জনতার এক শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। উত্তেজিত জনতা তাদের আক্রমণ করলে তারা থানায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এবার উত্তেজিত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে এবং তাতে ২২ জন পুলিশের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা চৌরিচৌরা ঘটনা নামে পরিচিত। এই ঘটনায় শান্তির পুজারি গান্ধীজি খুবই মর্মাহত হন এবং ১২ই ফেব্রুয়ারি বারদৌলিতে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির সভায় অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের প্রস্তাব দেন। ২৫ শে ফেব্রুয়ারি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
এই অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –
(১) গান্ধীজির একক নেতৃত্ব
এই আন্দোলন ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। গান্ধীজি ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা এবং সেটাই ছিল আন্দোলনের প্রধান ত্রুটি।
(২) খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্তি
খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে এর সংযুক্তি এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক পাশার অভ্যুত্থান এবং খলিফাতন্ত্রের বিলোপ সাধন খিলাফৎ আন্দোলনের মৃত্যু সুনিশ্চিত করে দেয়।
(৩) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থনহীনতা
বি. এন. পাণ্ডে বলেন যে, সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পূর্ণ সমর্থন না পাওয়ার ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। প্রাথমিক সাফল্যের পর বয়কট আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
(৪) বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ
বিশাল ভারত জুড়ে বিভিন্ন মানসিকতার লোক নিয়ে সম্পূর্ণ অহিংস পথে গণমুখী আন্দোলন পরিচালনা করা সত্যই অসাধ্য ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে অহিংসার কোনো গুরুত্বই ছিল না এবং তারা সত্যাগ্রহ, মাদক বর্জন, চরকা প্রভৃতির তাৎপর্য বুঝতে রাজি ছিল না।
(৫) সরকারি দমননীতি
বড়লাট লর্ড রিডিং-অনুসৃত দমননীতি এবং অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের ফলে জনসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। রিডিং-অনুসৃত কূটনীতি আন্দোলনকে যথেষ্ট দুর্বল করে দেয়।
(৬) বিভিন্ন স্বার্থ
বহু শ্রেণীতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। শ্রমিক, কৃষকদের আসল অভিযোগ ছিল জমিদার, মহাজন ও মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে — ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নয়। বণিক শ্রেণীর লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন— ‘স্বরাজ’ লাভ নয়।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব
আপাতদৃষ্টিতে অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এই আন্দোলন তার ঘোষিত লক্ষ্য পূরণে সফল হয় নি। আপাত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব গুলি হল –
(১) গণ-আন্দোলন
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটাই হল প্রথম সুসংবদ্ধ গণ-আন্দোলন। শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ—সর্বস্তরের মানুষের যোগদানে প্রথম এই আন্দোলন যথার্থ গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
(২) সর্বভারতীয় আন্দোলন
প্রকৃত অর্থে অসহযোগ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী প্রথম সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলন। ব্যাপকতার দিক থেকে দেখতে গেলে এই আন্দোলন ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকেও অতিক্রম করে যায়। অসহযোগ আন্দোলন ভারতের প্রতিটি প্রান্তে বিস্তার লাভ করে।
(৩) জাতীয় জাগরণ, আত্মবিশ্বাস ওভয়হীনতা
এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ অশিক্ষিত দরিদ্রতম গ্রামবাসী পর্যন্ত সকলেই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা আত্মশক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
(৪) জাতির নেতা গান্ধীজি
জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে গান্ধীজি সর্বভারতীয় জাতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশবাসী তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয়। গান্ধীজির আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—’তুমি সর্বাশ্রয়, এ কি শূন্যকথা’। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন “নগরের পথে রোল ওঠে শোন ‘গান্ধীজি’ গান্ধীজি’! ‘গান্ধীজি’!”
(৫) জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা বৃদ্ধি
এই আন্দোলনের ফলে একটি সুসংঘবদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত সাংবিধানিক ভাষ্যকার কৃপল্যাণ্ড বলেন যে, “বাল-গঙ্গাধর তিলক যা করতে পারেন নি, গান্ধীজি তা করতে পেরেছেন।
(৬) আন্দোলনের নতুন পদ্ধতি
গান্ধীজি এক নতুন ও অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করেন। কোনো গোপন হিংসাত্মক আন্দোলন নয়, শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ গণ-আন্দোলন শুরু হয়।
(৭) জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি
অসহযোগ আন্দোলন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে নানা ভাবে সাহায্য করে। আন্দোলনের সময় দেশজুড়ে যে সব জাতীয় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু টিকে থাকে, যা জাতীয় ভাবধারা বিকাশের সহায়ক হয়। দারিদ্র, অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি গুলি সম্পর্কে জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে এবং খাদি ও কুটির শিল্পের বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ফিরে আসে।
উপসংহার:- জওহরলাল নেহরু বলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তিই ছিল প্রজাপুঞ্জের মনে সর্বব্যাপী ভীতির সঞ্চার। গান্ধীজি জনমানস থেকে সেই ভীতি দূর করে দেন। নজরুল ইসলাম-এর কবিতায় আছে “এই শিকল পরে শিকল তোদের করব রে বিকল”।
(FAQ) অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
খিলাফৎ সমস্যার সমাধান, পাঞ্জাবের অন্যায়ের প্রতিকার ও স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যে অহিংস আন্দোলন শুরু করে তা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত।
অসহযোগ আন্দোলন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে ফেব্রুয়ারী প্রত্যাহার করা হয়।
অসহযোগ আন্দোলন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুম্বাইয়ে শুরু হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের জনক মহাত্মা গান্ধী।
অসহযোগ আন্দোলনের নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
মহাত্মা গান্ধী, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে।
নাগপুর অধিবেশন, ডিসেম্বর, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ।
স্বরাজ অর্জন।
অহিংস অসহযোগ।
চৌরিচৌরা ঘটনা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ।