মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন

মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন পাস, আইনের পটভূমি হিসেবে মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারের অসারতা, যুদ্ধান্তে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের আশা, ভারতে বিপ্লবী কর্মকান্ড, নরমপন্থী চরমপন্থী মিলন, লক্ষ্মৌ চুক্তি, হোমরুল আন্দোলন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সরকারের পরিবর্তিত নীতি, আইন পাস, আইনের শর্তাবলি, আইনের ত্রুটি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত ও আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন (১৯১৯ খ্রিঃ)

ঐতিহাসিক ঘটনামন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন
প্রবর্তন কাল১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ
প্রধান উদ্যোক্তামন্টেগু ও চেমসফোর্ড
পূর্ববর্তী আইনমর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার ১৯০৯
পরবর্তী আইনভারত শাসন আইন ১৯৩৫
মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন আইন (১৯১৯ খ্রিঃ)

ভূমিকা:- ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন শাসন সংস্কার আইন প্রবর্তিত হয়। এই আইন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন বা ‘মন্ট-ফোর্ড আইন’ নামে পরিচিত।

নামকরণ

মূলত ভারত সচিব মন্টেগু এবং বড়লাট চেমসফোর্ডের উদ্যোগেই এই আইনটি পাশ হয়। তাই এই আইনটি ‘মন্ট-ফোর্ড শাসন সংস্কার’ বা ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার’ নামেপরিচিত।

আইনের পটভূমি

মন্ট-ফোর্ড শাসন সংস্কারের পশ্চাতে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –

(১) মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারের অসারতা

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার দ্বারা ভারতবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। এই আইন দ্বারা ভারতে কোনো দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নি বা নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের হাতেও কোনো ক্ষমতা আসে নি। এই শাসন সংস্কার নরমপন্থী বা চরমপন্থী কাউকেই খুশি করতে পারে নি। এই আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল নরমপন্থী ও মুসলিম জনসাধারণকে হাত করে ভারতে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের আধিপত্য সুনিশ্চিত করা। স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ভারতবাসী দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য উদগ্রীব ছিল।

(২) যুদ্ধান্তে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের আশা

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মাদ্রাজ অধিবেশনে সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। সৈন্য ও অর্থ দিয়ে ভারতবাসী নানা ভাবে সরকারের যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় সামিল হয়। বহু ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করে। এ ছাড়া, যুদ্ধজনিত করভার, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অপরাপর অর্থনৈতিকদুর্দশা ভারতবাসী বিনা বাক্যে মেনে নেয়। ভারতবাসী আশা করত যে, এই সাহায্য ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধান্তে ভারতকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেবে।

(৩) ভারতে বিপ্লবী কার্যকলাপ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ভারত ও ভারতের বাইরে ভারতীয় বিপ্লবীরা সক্রিয়হয়ে ওঠেন। ইংল্যাণ্ড -এর শত্রু জার্মানির সাহায্য নিয়ে তাঁরা ভারতব্যাপী এক বিপ্লব সংঘটিত করতে উদ্যোগী হন। দেশময় একবৈপ্লবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

(৪) নরমপন্থী-চরমপন্থী মিলন

এই সময় ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসন দণ্ড ভোগের পর চরমপন্থী বাল গঙ্গাধর তিলক দেশে ফিরে আসেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কোন কার্যকরী আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়। তাই তিনি নরমপন্থী পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেসে প্রবেশের চেষ্টা চালান। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে মতাদর্শগত বিভেদ ভুলে নরমপন্থী ও চরমপন্থীরা মিলিত হয় এবং জাতীয় কংগ্রেস এক ঐক্যবদ্ধ রূপ ধারণ করে।

(৫) লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন

জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐক্যও এই যুগের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বঙ্গভঙ্গ রদ, তুরস্কের ওপর ইতালির আক্রমণ, বল্কান যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধযাত্রা ভারতীয় মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই সময়েই মুসলিম লীগ -এর নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটে। তরুণ নেতৃত্ব আলিগড়ের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে বিসর্জন দিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে।

(৬) লক্ষ্ণৌ চুক্তি

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে জাতীয় কংগ্রেস মুসলিম লীগের পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়। অপরদিকে মুসলিম লীগও জাতীয় কংগ্রেসের ‘স্বরাজ’ এর আদর্শ মেনে নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে জাতীয় আন্দোলনে অবতীর্ণ হতে সম্মত হয়।

(৭) হোমরুল আন্দোলন

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল তিলক এবং ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমতী অ্যানি বেশান্ত পৃথক পৃথক ভাবে দু’টি ‘হোমরুল লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে এই দুই লীগের কার্যকলাপ বিস্তৃত হয়, যা হোমরুল আন্দোলন নামে পরিচিত। সরকার দমননীতির পথ ধরলে গণ-অসন্তোষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।

(৮) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী ভাব ধারার স্ফুরণ এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লব -এর সাফল্য সরকারকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এই অবস্থায় যুদ্ধে বিশ্ববাসীর সহযোগিতা লাভের আশায় ব্রিটেন, আমেরিকা ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ যুদ্ধাবসানে উপনিবেশগুলিতে গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সরকারের পরিবর্তিত নীতি

  • (১) ভারত সচিব চেম্বারলেন এবং বড়লাট হার্ডিঞ্জ উভয়েই শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অধিকতর ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন। এই পটভূমিকায় ভারত সচিব চেম্বারলেনের নির্দেশক্রমে বড়লাট হার্ডিঞ্জ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ভারতে শাসন সংস্কারের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন।
  • (২) পরবর্তী বড়লাট চেমসফোর্ড (Chelmsford) ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে নভেম্বর এক প্রতিবেদনে বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের সহযোগিতার পুরস্কার-স্বরূপ প্রশাসনে ভারতীয়দের অধিকতর অংশগ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
  • (৩) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মন্টেগু ভারত সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হোমরুল আন্দোলনে ভারত তখন উত্তাল। এই অবস্থায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে আগস্ট মন্টেগু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ভারতীয় প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দান এবং ভারতে ক্রমশ ‘দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা’র প্রবর্তনই হল ব্রিটিশ সরকারের নীতি। এই ঘোষণা ‘১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট ঘোষণা” নামে পরিচিত।
  • (৪) এক অর্থে এই ঘোষণাকে ‘বৈপ্লবিক’ বলা যায়, কারণ মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারে (১৯০৯ খ্রিঃ) ‘দায়িত্বশীল সরকার গঠনের কোনো সম্ভাবনা স্বীকার করা না হলেও, এই ঘোষণায় তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে ভারতে ‘দায়িত্বশীল সরকার গঠনই ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য।
  • (৫) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মন্টেগু ভারতে এসে বড়লাট চেমসফোর্ড, পদস্থ রাজকর্মচারী এবং বিশিষ্ট ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শাসন সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যা ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট নামে পরিচিত।

আইন পাস

মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের ভিত্তিতেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন’ (Government of India. Act, 1919) বা ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার’ (Mont-Ford Reform) রচিত ও পাস হয়।

আইনের শর্তাবলী

এই আইনের বিভিন্ন দিকগুলি হল –

(ক) ক্ষমতা ও দায়িত্ব বণ্টন

  • (১) এই শাসন সংস্কার দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর দেশরক্ষা, রেলপথ, মুদ্রা, পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, শুল্ক, ডাকব্যবস্থা প্রভৃতি সর্বভারতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
  • (২) প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, রাজস্ব, যোগাযোগ, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভূমি রাজস্ব থাকে প্রদেশের হাতে এবং আয়কর থাকে কেন্দ্রের হাতে।।
  • (৩) কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হলেও কেবল কেন্দ্রীয় আইনসভাই সারা ভারতের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারত। আইনসভার সভ্যরা প্রশ্ন উত্থাপন, বিতর্ক, ছাঁটাই ও সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করতে পারতেন।তবে বৈদেশিক নীতি, সামরিক বিভাগ, জাতীয় ঋণ, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা বা প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বে বড়লাটের অনুমতি নেওয়া অপরিহার্য ছিল। বড়লাট ‘অর্ডিনান্সের’ বলে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।

(খ) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ

৭ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহক পরিষদ বা বড়লাটের শাসন পরিষদ (Executive Council) গঠিত হয়। ৭ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৩ জন সদস্যকে ভারতীয় হতে হত। শাসন পরিষদের সাহায্যে বড়লাট নিজ দায়িত্বে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ভারত সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন — ভারতীয় আইনসভার কাছে নয়।

(গ) কেন্দ্রীয় আইন সভা

  • (১) কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। নিম্নকক্ষের নাম হয় ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা(Legislative Assembly) এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় ‘রাষ্ট্রীয় পরিষদ’ (Council of States)।
  • (২) উচ্চকক্ষের ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ২৬ জন বড়লাট কর্তৃক মনোনীত এবং বাকি ৩৪ জন সদস্যকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়।
  • (৩) নিম্নকক্ষের ১৪০ জন (পরে ১৪৫ জন) সদস্যের মধ্যে ৪০ জন মনোনীত এবং ১০০ জনকে (পরে ১০৫ জন) নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয় কক্ষেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

(ঘ) প্রদেশে দ্বৈত শাসন

  • (১) প্রদেশগুলিতে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন নির্বাচিত এবং ৩০ জন গভর্নর কর্তৃক মনোনীত করার ব্যবস্থা করা হয়।
  • (২) প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সংরক্ষিত বিষয়ও হস্তান্তরিত বিষয়। আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, প্রশাসন, অর্থ, বিচার, শ্রম প্রভৃতি বিষয়গুলি ছিল ‘সংরক্ষিত বিষয় এবং এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক গভর্নর ও তাঁর কার্যনির্বাহক সভার ওপর।
  • (৩) অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি ছিল ‘হস্তান্তরিত বিষয়’ এবং এগুলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে। এই মন্ত্রীরা তাঁদের কাজকর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়ী থাকতেন।
  • (৪) হস্তান্তরিত বিষয়ে প্রাদেশিক আইনসভা কোনো আইন প্রবর্তন করলে গভর্নর বা গভর্নর জেনারেল তা নাকচ করে দিতে পারতেন। এইভাবে এই আইন প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে ‘দ্বৈত শাসনব্যবস্থা‘ (Dyarchy) প্রবর্তন করে।

(ঙ) ভারত সচিবের কাউন্সিল

  • (১) স্থির হয় যে, ভারত সচিবের কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ১২-র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সদস্যদের অন্তত অর্ধেক ব্যক্তি যেন এমন হন, যাঁরা দীর্ঘদিন (অন্তত ১০ বছর) ভারতে বসবাস বা চাকরি করেছেন।
  • (২) এই সদস্যরা পাঁচ বছরের জন্য নিযুক্ত হতেন এবং প্রয়োজনে তাঁদের পুনর্বার নিয়োগ করা যাবে। পূর্বে ভারতের রাজস্ব থেকে এই সব সদস্যদের বেতন ও ভাতা দেওয়া হত।
  • (৩) নতুন আইনে ব্রিটিশ সরকারের ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়। বলা বাহুল্য, এর ফলে ভারত শাসন বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

আইনের ত্রুটি

এই আইন দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খা পরিতৃপ্ত করতে পারে নি। এই আইনে বহু ত্রুটি ছিল। যেমন –

(ক) কেন্দ্রে বড়লাট সর্বেসর্বা

  • (১) এই আইন দ্বারা ভারতীয় শাসনব্যবস্থায়কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয় নি বা ভারতে কোনো দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয় নি। কেন্দ্রে কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভার ব্যবস্থা না থাকায় বড়লাট ও তাঁর কার্যনির্বাহক সভার হাতেই সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।
  • (২) এই কার্যনির্বাহক সভায় তিনজন ভারতীয় ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন না। তাঁরা বড়লাট কর্তৃক মনোনীত হতেন। বড়লাট আইনসভার যে কোন প্রস্তাব নাকচ করতে পারতেন।
  • (৩) তিনি তাঁর কাজের জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন না—তাকে জবাবদিহি করতে হত ইংল্যাণ্ডে ভারত সচিবের কাছে। সুতরাং ভারতে পূর্বের কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনই বহাল রইল।

(খ) প্রাদেশিক শাসন

  • (১) প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসনের দ্বারা আপাতদৃষ্টিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও তা ব্যর্থ হয়। প্রদেশে গভর্নর ছিলেন সর্বেসর্বা এবং প্রশাসনের সকল মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ছিল তাঁর অধীনে।
  • (২) এই সব বিষয়ে আইনসভার কোনো এক্তিয়ার ছিল না। হস্তান্তরিত বিষয়গুলি মন্ত্রীদের হাতে ন্যস্ত থাকলেও গভর্নর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নাকচ করতে পারতেন। ভারতের ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রও ভারতবাসীর এই সামান্য ক্ষমতালাভে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • (৩) যুক্তপ্রদেশের গভর্নর হারকোর্ট বাটলার এক পত্রে চেম্বারলেনকে জানান যে, “মন্ট-ফোর্ড শাসন সংস্কার খুব কম লোককেই সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। বাস্তবে সকল প্রাদেশিক সরকারই এই সংস্কার আইনের নিন্দা করেছে।…….আমরা মনে করি দ্বৈত শাসন ব্যর্থ হতে বাধ্য।”

(গ) ভোটাধিকার

এই আইনে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় নি। ভোটাধিকার মুষ্টিমেয় বিত্তবান ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নিম্নকক্ষে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ছিল মাত্র ৯,০৯,৮৭৪ জন এবং উচ্চকক্ষে ১৭,৩৬৪ জন। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% এই ভোটাধিকার পায়–এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন অশিক্ষিত। মহিলাদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য শতকরা এক ভাগেরও কম।

(ঘ) পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি

  • (১) এই আইনের আরেকটি ত্রুটি হল পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচন পদ্ধতি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কারে যে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন পদ্ধতির সূচনা হয়, এই আইনের দ্বারা তা আরও সম্প্রসারিত হয়।
  • (২) কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ই নয়—অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা প্রযুক্ত হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল গোষ্ঠী এই ব্যবস্থাতেও খুশি হয় নি —তাদের দাবি ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ আসন। বলা বাহুল্য, এই ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িক সংহতি ও জাতীয় ঐক্যের পক্ষে শুভ হয়নি।

(ঙ) আমলাতন্ত্রের বিরোধিতা

এই আইনে যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল ইংরেজ আমলাতন্ত্র সেটুকু দিতেও রাজি ছিলেন না। মন্টেগুর পদত্যাগের পর এই আইন অর্থহীন হয়ে পড়ে। সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কেন্দ্রে তেজবাহাদুর সপ্রু এবং যুক্তপ্রদেশে চিন্তামণি ও পণ্ডিত জগৎ নারায়ণমোল্লা পদত্যাগ করেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত

এই শাসন সংস্কার ভারতবাসীকে খুশি করতে পারে নি।যেমন –

  • (১) তিলক এই শাসন সংস্কারকে ‘সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য’ (‘entirely unacceptable’) বলে অভিহিতকরেন।
  • (২) শ্রীমতী বেশান্ত একে ‘দাসত্বের নামান্তর’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে “এই পরিকল্পনা ইংল্যাণ্ডের পক্ষে প্রবর্তন করা এবং ভারতের পক্ষে গ্রহণ করা অসম্মানজনক।” (…the scheme is unworthy of England to offer and unworthy of India to accept.”)
  • (৩) হাসান ইমামের সভাপতিত্বে বোম্বাইয়ে জাতীয় কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের প্রস্তাবগুলিকে “নগণ্য, নৈরাশ্যকর ও অসন্তোষজনক” (“inadequate, disappointing and unsatisfactory”) বলে অভিহিত করা হয়।
  • (৪)কংগ্রেস এই মর্মে ‘আইনগত প্ৰতিশ্ৰুতি’ (‘statutory guarantee) দাবি করে যে, ভারতকে ‘অনধিক ১৫ বছরের মধ্যে পূর্ণ দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা’ দেওয়া হবে।দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি মদনমোহন মালব্য লক্ষ্ণৌ চুক্তি অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান।
  • (৫) সুরেন্দ্রনাথ, দীনশা ওয়াচা, তেজ বাহাদুর সপ্রু, চিন্তামণি, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী প্রমুখের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী অংশ এই শাসন সংস্কারকে স্বাগত জানায়। তাঁদের মতে এই সংস্কার “ভারতে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের পক্ষে একটি সঠিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ”।তাঁরা জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে সুরেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশন” নামে একটি দল গঠন করে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে থাকেন।
  • (৬) তুরস্ক সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন নিয়ে মুসলিম সমাজ তখন এতই বিপর্যস্ত ছিল যে এই সংস্কার নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তা-ভাবনা করে নি। তবে মুসলিম সমাজের উগ্র ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী স্বতন্ত্র নির্বাচনের পরিধিকে আরও সম্প্রসারিত করে আইনসভায় ৫০% আসন দাবি করে। এক কথায় বলা যায় যে, এই শাসন সংস্কার ভারতীয় মানসকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি।

আইনের গুরুত্ব

বিভিন্ন ত্রুটি থাকলেও এই আইনের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –

(১) প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সূত্রপাত

মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের দ্বারা ভারতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সূচনা হয় এবং ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ ঘটে।

(২) দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার সূচনা

এই আইনের দ্বারা মন্ত্রীসভাকে তার কাজের জন্য আইনসভার কাছে দারী রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে।

(৩) রাজনৈতিক শিক্ষালাড

এই আইনের দ্বারা ভারতীয় প্রতিনিধিরা আইনসভায় প্রবেশের সুযোগ পেলে তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষালাভের সুযোগ ঘটে।

(৪) মন্ত্রীসভার ভারতীয়াকরণ

ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাট এই আইনের প্রশংসা করে বলেন যে, প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ভারতীয়নের স্থান দিয়ে ব্রিটিশ সরকার শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়করণের পথ প্রস্তুত করে।

উপসংহার:- মূলত শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ব্যবধানের জন্যই এই শাসন সংস্কার বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করতে পারে নি। কুপল্যাণ্ড বলেন যে,“Dyarchy failed in its primary purpose which its authors intended to serve. It did not provide a real training in responsible government.”

(FAQ) মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন আইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন কবে পাস হয়?

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।

২. মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন প্রণয়নের সময় ভারতের বড়লাট কে ছিলেন?

চেমসফোর্ড।

৩. মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনকে দাসত্বের নামান্তর বলেন কে?

শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত।

Leave a Comment