১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন -এর পটভূমি হিসেবে গণ-আন্দোলন, বিপ্লবী কার্যকলাপ, জাতীয়তাবাদের আতঙ্ক, সাইমন কমিশনের রিপোর্ট, গোলটেবিল বৈঠক, শ্বেতপত্র, আইন পাস, আইনের বৈশিষ্ট্য, আইনের বিভিন্ন দিক হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার, প্রাদেশিক সরকার, আইনের ত্রুটি, নেতৃবৃন্দের মতামত ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন

ঐতিহাসিক ঘটনা১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন
প্রবর্তকব্রিটিশ পার্লামেন্ট
প্রবর্তন কাল১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ
কার্যকর১ এপ্রিল, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ
কারণভারতব্যাপী গণ-আন্দোলন
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন

ভূমিকা:- ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন প্রণয়নের পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতিতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন ভারত শাসন আইন পাস করে। সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে এই আইন কার্যকরী হবে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পটভূমি

ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন প্রণয়নের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –

(১) গণ-আন্দোলন

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্ট-ফোর্ড আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা ভারত -এ প্রবল গণ-আন্দোলন শুরু হয়।

(২) বিপ্লবী কার্যকলাপ

এই সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীদের অতিসক্রিয়তায় সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

(৩) জাতীয়তাবাদের আতঙ্ক

ভারতে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধি ব্রিটিশ সরকারকে খুবই ভাবিয়ে তোলে। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার চিন্তা করতে শুরু করে।

(৪) সাইমন কমিশনের রিপোর্ট

ভারতীয়রা স্বায়ত্তশাসন লাভের উপযুক্ত কি না তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সাইমন কমিশন ভারতে আসে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কমিশন তার যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর সুপারিশ করে।

(৫) গোলটেবিল বৈঠক

সাইমন কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করে। প্রথম গোলটেবিল বৈঠক (১৯৩০ খ্রি.), দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক (১৯৩১ খ্রি.) ও তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক -এর (১৯৩২খ্রি.) আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার নতুন সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হয়।

(৬) শ্বেতপত্র

সাইমন কমিশনের রিপোর্ট ও গোলটেবিল বৈঠকগুলির আলোচনা ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘শ্বেতপত্র‘ প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবসমূহ’।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস

সরকারের প্রস্তাব এবং যৌথ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত শাসন আইন’ (Govt. of India Act, 1935) পাস করে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্য

ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

  • (১) ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষে এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছাধীন ছিল।
  • (২) কেন্দ্রে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও প্রদেশে তা বিলুপ্ত করা হয়।
  • (৩) প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়।
  • (৪) সাম্প্রদায়িক ও অপরাপর গোষ্ঠীগুলির জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলিম সভ্যদের জন্য সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন এবং তফসিলি সভ্যদের জন্য ‘পুণা চুক্তি‘ অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
  • (৫) সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল ও প্রদেশগুলিতে গভর্নরের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিভিন্ন দিক

ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দিকগুলিকে দুই ভাবে আলোচনা করা যায়। যেমন –

(ক) কেন্দ্রীয় সরকার

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রে এক ধরনের ‘দ্বৈতশাসন’ (Dyarchy) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইনের সাহায্যে গৃহীত শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপগুলি হল –

(১) ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন

ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশীয় রাজ্যগুলি ইচ্ছা করলে এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবে বলে জানানো হয়।

(২) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা

কেন্দ্রে পাঁচ বছর মেয়াদির দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর নিম্নকক্ষ ফেডারেল অ্যাসেম্বলির সদস্য সংখ্যা স্থির হয় ৩৭৫ জন এবং উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেটস-এর সদস্যসংখ্যা স্থির হয় ২৬০ জন। নিম্নকক্ষের ৩৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ২৫০ জন ব্রিটিশ ভারতের এবং ১২৫ জন দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধি থাকবেন বলে জানানো হয়। উচ্চকক্ষের ২৬০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫৬ জন ব্রিটিশ ভারতের এবং ১০৪ জন দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধি থাকবেন বলে জানানো হয়।

(৩) সাম্প্রদায়িক নির্বাচন

মুসলিম সদস্যদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং তপশিল সদস্যদের ‘পুনা চুক্তি’ (১৯৩২ খ্রি.)-র ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। শিখ, খ্রিস্টান, ইঙ্গ-ভারতীয়, ইউরোপীয় প্রভৃতি প্রতিনিধিদেরও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আইনসভায় গ্রহণ করা হয়।

(৪) মন্ত্রীপরিষদের দায়িত্ব

গভর্নর জেনারেলের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হয়। আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে গভর্নর-জেনারেল তাঁর মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নিয়োগ করেন। মন্ত্রীরা তাঁদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন বলে জানানো হয়।

(৫) সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত বিষয়

কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন ক্ষমতাকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। দেশের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, রিজার্ভ ব্যাংক, মুদ্রা, শান্তি শৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি ‘সংরক্ষিত’ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। ‘সংরক্ষিত’ বিষয়ে গভর্নর-জেনারেল ও তাঁর তিনজন উপদেষ্টার হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ‘হস্তান্তরিত’ (Transferred) বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। “হস্তান্তরিত’ বিষয়গুলি গভর্নর জেনারেল তাঁর মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে পরিচালনার দায়িত্ব পান। অবশ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ গ্রহণ করা গভর্নরের পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিল না।

(৬) গভর্নর-জেনারেলের চূড়ান্ত ক্ষমতা

গভর্নর জেনারেল শাসন পরিচালনার বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেন। কোনো আইন রচনার আগে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে গভর্নর-জেনারেলের অনুমতি নিতে হত। তিনি আইনসভা ও মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ উপেক্ষা করার এবং তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার পান। এ ছাড়া তিনি কিছু ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা’ ও ‘স্ববিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা’ ভোগ করতেন।

(৭) কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতার তালিকা

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের উদ্দেশ্যে তিনটি পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়। এগুলি হল—

  • [i] কেন্দ্রীয় তালিকা: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সামরিক বিভাগ, বিদেশনীতি, রেল, ডাক, মুদ্রা প্রভৃতি,
  • [ii] প্রাদেশিক তালিকা: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল শান্তি শৃঙ্খলা, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পুলিশ প্রভৃতি ও
  • [iii] যুগ্ম তালিকা: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সংবাদপত্র, মুদ্রণ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি।
(৮) গভর্নর-জেনারেলের দায়বদ্ধতা

গভর্নর-জেনারেল তাঁর কাজের জন্য সরাসরি ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।

(খ) প্রাদেশিক সরকার

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন দিকগুলি হল —

(১) স্বায়ত্তশাসন

প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়।

(২) প্রাদেশিক আইনসভা গঠন

প্রাদেশিক আইনসভা এককক্ষ এবং দ্বিকক্ষ উভয়ই হতে পারত। বাংলা-সহ ছয়টি প্রদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অবশিষ্ট পাঁচটি প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রাখা হয়।

(৩) মন্ত্রীসভা গঠন

প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনয়নের মাধ্যমে প্রতিটি প্রদেশে গভর্নরের অধীনে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। মন্ত্রীরা তাঁদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকতেন।

(৪) গভর্নরের দায়িত্ব

কেন্দ্রের অনুকরণে প্রদেশের শাসনকাঠামো তৈরি হয়। প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় গভর্নরের হাতে।

(৫) গভর্নরের বিশেষ ক্ষমতা

প্রদেশের গভর্নর আইন প্রণয়ন ও নাকচ করার অধিকারী ছিলেন। তিনি আইনসভার যে-কোনো প্রস্তাব বাতিল করতে, অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করতে, আইনসভা ও মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে নিজের হাতে প্রদেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করতে পারতেন।

(৬) সাম্প্রদায়িক নির্বাচন

সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মুসলিম সদস্যদের জন্য পৃথক নির্বাচন এবং ‘পুনা চুক্তি’ (১৯৩২ খ্রি.) অনুসারে তপশিল সম্প্রদায়ের সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ত্রুটি

ব্রিটিশ ভারতে প্রবর্তিত ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এই আইনের বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল। যেমন—

(১) সংকুচিত ভোটাধিকার

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে ভোটাধিকারের প্রসার ঘটানো হয়নি। ব্রিটিশ ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ ভোটদানের অধিকার পেয়েছিল।

(২) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা

গভর্নর-জেনারেলের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকার ফলে আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

(৩) যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান স্বেচ্ছাধীন হওয়া

প্রস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজন্যবর্গের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত তাঁর ‘ইন্ডিয়া টুডে’ গ্রন্থে বলেছেন, “প্রস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ছিল একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ড নামকরণ।” তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হলে মুসলিমরা কেন্দ্রে সংখ্যলঘু হয়ে যাবে বলে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র গঠনের বিরোধী ছিলেন।

(৪) স্বায়তশাসনের নামে প্রতারণা

এই আইনের দ্বারা ভারতবাসীকে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রে গভর্নর-জেনারেল ও প্রদেশে গভর্নরের অসীম ক্ষমতা স্বায়ত্তশাসনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল।

(৫) সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্ন

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এরুপ বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ এই আইনের সমালোচনা করে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের মতামত

  • (১) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতের কোন রাজনৈতিক দলকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নি। হিন্দু মহাসভা এই বিলকে “গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথে প্রতিক্রিয়াশীল ও বাধাদানকারী সাংবিধানিক ব্যবস্থা” বলে বর্ণনা করে।
  • (২) মুসলিম লীগ এই আইনকে “গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা ধ্বংসকারী” বলে অভিহিত করে বলে যে, এই আইন দ্বারা মুসলিম সমাজ অন্যান্য ভারতীয় জনগণের মতই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহম্মদ আলি জিন্না-র মতে “এই আইনটি ছিল সম্পূর্ণ পচনশীল, মূলত মন্দ এবং সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য”।
  • (৩) সুভাষচন্দ্র বসু -র মতে, স্বায়ত্তশাসন নয়—ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং ব্রিটিশ অনুগামী সংগঠনগুলির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়িত্বদানের জন্যই এই আইন পাশ করা হয়।
  • (৪) জওহরলাল নেহরু একে “দাসত্বের এক নতুন দলিল” (“a new charter of slavery”) বলে অভিহিত করেন। ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশন’ তীব্র ভাষায় এই আইনের সমালোচনা করে। এই দলের সি. ওয়াই চিন্তামণি-র মতে এই আইন “ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান”।
  • (৫) নরমপন্থী নেতা মদনমোহন মালব্য বলেন যে,” বাইরে থেকে দেখলে আইনটি গণতান্ত্রিক বলে মনে হয়, কিন্তু ভেতরে তা হল চরম শূন্য”। খালসা দরবারের প্রতিনিধি শিখ নেতা সর্দার মঙ্গল সিং এই আইনকে “অনিচ্ছুক ও অসহায় জনগণের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া সংবিধান” বলে আখ্যায়িত করেন।
  • (৬) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর মতে এই আইনটি ছিল ‘সম্পূর্ণ হতাশাব্যঞ্জক’ (totally disappointing)। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি এক প্রস্তাবে এই আইনকে “দামি মুখোশের আড়ালে দেশবাসীর ওপর বৈদেশিক শাসন ও শোষণ কায়েম করার অপচেষ্টা” বলে অভিহিত করে। 
  • (৭) ইংল্যান্ড -এর শ্রমিক দলের নেতা এটলী-র মতে “এই বিলের মূল কথাই হল অবিশ্বাস”। তাঁর মতে, “কংগ্রেসকে শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার জন্যই এই আইন রচিত হয়েছে।” তিনি বলেন যে, “এই বিলে একটি বস্তু নেই, তা হল ভারতীয় জনগণ।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব

বিভিন্ন ত্রুটি সত্ত্বেও ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কিছু গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। যেমন –

(১) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের ভিত্তি রচনা

এই আইন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।

(২) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন

এর মাধ্যমে ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৩) স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ভিত্তি হয়ে ওঠা

স্বাধীন ভারতের সংবিধানের কাঠামোটি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে।

(৪) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবর্তন

এই আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলি যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেয়েছিল, জিন্না ও মুসলিম লিগ তার প্রশংসা করে।

উপসংহার:- ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দেশবাসীকে ক্ষমতা প্রদান করা অপেক্ষা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আধিক্যই পরিলক্ষিত হয়। তাই জওহরলাল নেহরু একে একটি মেশিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার ইঞ্জিন নেই কিন্তু ব্রেক খুবই শক্তিশালী (“a machine with strong breaks and no engine”)।

(FAQ) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন আইনের মাধ্যমে প্রদেশ গুলিতে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটে?

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন।

২. ভারত শাসন আইন কবে পাস হয়?

১৯৩৫ সালে।

৩. কোন আইন অনুসারে কেন্দ্রে দ্বৈত শাসন প্রবর্তিত হয়?

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন।

Leave a Comment