ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে দেশীয় রাজ্য

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে দেশীয় রাজ্য প্রসঙ্গে তাদের বৈশিষ্ট্য, ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্ক, দেশীয় রাজ্যগুলির প্রাপ্তি, ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে দেশীয় রাজ্যগুলির সক্রিয়তা, দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও ব্যর্থতা এবং দেশীয় রাজ্য ও ব্রিটিশ শক্তির সম্পর্কের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানবো।

ভারতে দেশীয় রাজ্য প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত মৌখিকভাবে সার্বভৌম রাজ্য, ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির বৈশিষ্ট্য, ব্রিটিশদের সাথে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির সম্পর্ক, ভারতের রাজনীতিতে দেশীয় রাজ্যগুলির সক্রিয়তা ও ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানব।

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে দেশীয় রাজ্য

ঐতিহাসিক বিষয়দেশীয় রাজ্য
বৃহৎ দেশীয় রাজ্যহায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিলর্ড ওয়েলেসলি
স্বত্ববিলোপ নীতিলর্ড ডালহৌসি
প্রিন্স অব চেম্বার১৯১৯ খ্রি
নেহরু রিপোর্টমতিলাল নেহরু
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে দেশীয় রাজ্য

ভূমিকা :- ব্রিটিশকে কর দানের বিনিময়ে দেশীয় রাজা বা শাসকরা এসব রাজ্য শাসন করতেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময় সরকারিভাবে ভারতে অন্তত ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।

ভারতে দুই ধরনের রাজ্যের অস্তিত্ব

ভারতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় ভারতে দুই ধরনের রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। যেমন –

(১) ব্রিটিশ ভারত

সমগ্র ভারতের অন্তত ৬০ শতাংশ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অংশ সাধারণভাবে ‘ব্রিটিশ ভারত’ নামে পরিচিত ছিল।

(২) দেশীয় রাজ্য

প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনের বাইরে অন্তত ৪০ শতাংশ ভূখণ্ডে বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এই সব রাজ্য সাধারণভাবে ‘দেশীয় রাজ্য’ বা ‘Princely States’ নামে পরিচিত ছিল।

দেশীয় রাজ্যগুলির বৈশিষ্ট্য

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল –

(১) আয়তন

দেশীয় রাজ্যগুলির আয়তন বিভিন্ন ধরনের ছিল। বড়ো আয়তনের রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, বরোদা, মহীশূর প্রভৃতি। আবার দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে এমন অনেক রাজ্য ছিল যাদের আয়তন এবং জনসংখ্যা ছিল খুবই কম।

(২) স্বৈরশাসন

দেশীয় রাজ্যের শাসকরা নিজ নিজ রাজ্যে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করতেন। সর্বোচ্চ শাসক বা তাঁর নিকট আত্মীয়দের হাতে দেশীয় রাজ্যগুলির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হত। এইসব স্বৈরাচারী দেশীয় শাসকরা ওয়াদিয়ার (মহীশূরের শাসক), ছত্রপতি (মহারাষ্ট্রে ভোঁসলে সম্প্রদায়ের শাসক), নিজাম (হায়দ্রাবাদের শাসক), বাদশা, মহারাজা, রাজা, নবাব, ঠাকুর, ওয়ালি, ইনামদার প্রভৃতি মর্যাদাসূচক বিভিন্ন ধরনের উপাধি গ্রহণ করতেন। তবে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন স্তরের দেশীয় শাসকদের সাধারণভাবে ‘রাজা’ বা ‘প্রিন্স’ বলে অভিহিত করত।

(৩) প্রজাদের অবস্থা

ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ প্রজাদের তুলনায় দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের ওপর করের বোঝা সাধারণভাবে বেশি ছিল। ব্রিটিশ ভারতের চেয়ে এসব রাজ্যের নাগরিকরা নাগরিক অধিকার বা আইনের শাসনের সুবিধাও কম ভোগ করত। ফলে প্রজাদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না।

(৪) পশ্চাদগামিতা

বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্য ছিল বিভিন্ন দিক থেকে পশ্চাদগামী। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, শিক্ষাগত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব রাজ্যগুলি পিছিয়ে ছিল।

(৫) তোপধ্বনি

বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। কোনো দেশীয় রাজ্যের শাসক ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে এলে তোপধ্বনি বা ‘গান স্যালুট’-এর মাধ্যমে তাঁকে সম্মান দেখানো হত। বিভিন্ন দেশীয় শাসকের জন্য ৩ থেকে ২১ বার পর্যন্ত তোপধ্বনির ব্যবস্থা ছিল। রাজকোশের সমৃদ্ধি, বংশ কৌলীন্য, ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি বিচার করে দেশীয় শাসকদের জন্য তোপধ্বনি বরাদ্দ করা হত। যে শাসকের যত বেশি মর্যাদা, তার জন্য তত বেশি তোপধ্বনি নির্দিষ্ট ছিল।

(৬) অধীনতামূলক নীতির প্রয়োগ

বহু দেশীয় রাজ্য বাধ্য হয়ে ওয়েলেসলির অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য জানায়। এভাবে নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়ে দেশীয় রাজারা তাদের শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হন।

(৭) স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ

পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশ শাসক লর্ড ডালহৌসী স্বত্ববিলোপ নীতির পরিবর্তন করে দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক নির্ধারণ করেন।

দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক

বিংশ শতকের সূচনা থেকে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করলে ইংরেজদের দেশীয় রাজ্যগুলি সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন –

(১) হস্তক্ষেপের নীতি

লর্ড কার্জন বারংবার দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করতেন। এই বিষয়টি ব্রিটিশ সরকার ও দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যেকার সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে।

(২) বিচ্ছিন্নতার নীতি

কার্জনের পরবর্তী শাসক লর্ড মিন্টো দেশীয় রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ-ভারতে ঘটে চলা রাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে আলাদা রেখে উদীয়মান জাতীয়তাবাদের প্রভাব থেকে সেখানকার মানুষদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন।

(৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশের নীতি

মিন্টো দেশীয় রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার নীতি গ্রহণ করেন, তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় পালটাতে থাকে। যুদ্ধের সময় দেশীয় রাজ্যগুলির কাছ থেকে সহায়তা লাভের স্বার্থেই সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করে। ফলে দেশীয় রাজ্যগুলিও সরকারের যুদ্ধ তহবিলে মুক্তহস্তে দান ক’রে এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে তাদের খুশি করার চেষ্টা করে।

দেশীয় রাজ্যগুলির প্রাপ্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করার বিনিময়ে যুদ্ধশেষে দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার আশা করেছিল।

(১) দাবিদাওয়া

যুদ্ধের পর দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে রাজ্যে তাদের রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ জারি না করার নিশ্চয়তা, ব্রিটিশ ভারতে উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেশি করে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রভৃতি দাবি করে। এ ছাড়া তারা পরামর্শদাতা সভা হিসেবে ‘চেম্বার অফ প্রিন্সেস’ গঠন এবং ভারত সরকারের শাসন কাঠামোয় সরাসরি অংশগ্রহণের দাবি জানায়।

(২) বিভিন্ন দাবি পূরণ

সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির বিভিন্ন দাবি পুরণের উদ্যোগ নেয়। ১৯১৯ খ্রি মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন-এর মাধ্যমে ১২০ জন সদস্যবিশিষ্ট ‘চেম্বার অব প্রিন্সেস’ গঠন করা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়া এবং উভয়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করা এই চেম্বারের উদ্দেশ্য ছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির লালকেল্লায় এই চেম্বারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।

ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে দেশীয় রাজ্যগুলির সক্রিয়তা

দেশীয় রাজ্যের শাসকরা কখনো কখনো ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় উৎসাহ দেখাতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, বিশ শতকের শুরুতে ভরতপুর ও আলওয়ারের শাসকরা ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে, আর্য সমাজ-এর কাজকর্মকে এবং উর্দুর পরিবর্তে হিন্দির প্রসারকে তীব্র সমর্থন করেছিলেন। আলওয়ারের শাসক জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি দস্তানা না পরে খালি হাতে কখনও ইউরোপীয়দের সঙ্গে হাত মেলাতেন না।

দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন ভারতে আসার পর থেকে ব্রিটিশ ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার বিভিন্ন ধাপগুলি হল –

(১) নেহরু রিপোর্ট দাখিল

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল নেহরু তাঁর ‘নেহরু রিপোর্ট’-এ যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণা দেন তাতে দেশীয় রাজ্যগুলি উপলব্ধি করে যে, প্রস্তাবিত এই যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হয়ে তারা যেমন নিজ নিজ রাজ্যের অভ্যন্তরীণ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারবে, তেমনি তাদের ওপর সরকারের আধিপত্যের অবসানও ঘটবে।

(২) প্রথম গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠক-এ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়। দেশীয় রাজ্যগুলির সমন্বয়ে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন ছিল গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু। কিন্তু এই আলোচনা বিশেষ ফলপ্রসূ হয় নি।

(৩) দিল্লি চুক্তি

শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘চেম্বার অব প্রিন্সেস’-এর সদস্যরা ‘দিল্লি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু এই দাবির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন দাবিও জানায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, চেম্বার অব প্রিন্সেস তাদের সকল সদস্যের জন্য আইনসভার উচ্চকক্ষে আসন এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার চেয়েছিল। তাদের অধিকাংশ দাবি ব্রিটিশ সরকার ও জাতীয়তাবাদীরা খারিজ করে দিলে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা আবার ভেস্তে যায়।

(৪) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এ বলা হয় যে, যদি দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তত ৫০ শতাংশ ইন্সট্রুমেন্টস অব অ্যাক্সেশন -এ সাক্ষর করে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিস্তরীয় কেন্দ্রীয় আইনসভার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আসন দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়।

দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার ব্যর্থতা

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেই পরিকল্পনাটি শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এর বিভিন্ন কারণ হল –

(১) আধিপত্যের আশঙ্কা

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হলেও সর্বশক্তিমান শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের যে-কোনো দেশীয় রাজ্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করার বা প্রয়োজন হলে কোনো রাজপুরুষের শাসনক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা থেকেই যেত। তাই দেশীয় রাজ্যগুলি এই বিষয়ে আপত্তি করে এজন্যই দেশীয় রাজ্যগুলি প্রস্তাবিত এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে রাজি হয় নি।

(২) গণতান্ত্রিকতার আশঙ্কা

দেশীয় রাজ্যগুলি এই আশঙ্কাও করে যে, তারা গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিলে ব্রিটিশ ভারতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দেশীয় রাজ্যগুলির স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরোধিতা করে সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মদত দিতে পারে।

(৩) ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির আশঙ্কা

ক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্যগুলি আশঙ্কা করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় তাদের রাজ্যের প্রতিনিধির সংখ্যা কম হবে। ফলে তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব করা হবে।

(৪) কংগ্রেসের আশঙ্কা

এই পরিকল্পনায় স্বৈরাচারী দেশীয় রাজ্যগুলির শাসকদের খেয়ালখুশির সঙ্গে গণতান্ত্রিক ভারতের ভাগ্যকে জুড়ে দেওয়া হয়। তাই কংগ্রেস আশঙ্কা করে যে, এর ফলে তারা কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাধিক্য আসন লাভে ব্যর্থ হবে।

দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে লেবার পার্টির মন্তব্য

লন্ডনের লেবার পার্টি মন্তব্য করেছিল যে, “১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতে রাজভক্তদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এদেশে ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর লর্ড লিনলিথগো দেশীয় রাজপুরুষদের কাছে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের প্রস্তাব দিলে (জানুয়ারি, ১৯৩৯ খ্রি.) তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ইউরোপ-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুর হলে দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ঠান্ডা ঘরে চলে যায়।

দেশীয় রাজ্য ও ব্রিটিশ শক্তির সম্পর্কের মূল্যায়ন

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি, স্বত্ববিলোপ নীতি ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতের দেশীয় স্বাধীন রাজ্যগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থির করে। এই সম্পর্কের মূল কাঠামোটি ছিল প্রভু ভৃত্যের সম্পর্কের মতো। দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের পশ্চাদ্‌গামিতা ও দুর্বলতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ শাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলি নানাভাবে ব্রিটিশ সরকারকে তোষণ করে ভারতে নিজেদের শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার বিভিন্ন দিকগুলি হল –

(১) মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশকে সহায়তা

মহাবিদ্রোহ-এর সময় কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ইংরেজদের পক্ষে থেকে বিদ্রোহ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। পাঞ্জাবের সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে সরকারকে দুর্দিনে সুবিধা করে দেয়।

(২) আনুগত্য

অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এক অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করত। প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারত-দর্শনকে (১৯২২ খ্রি.) জাতীয় কংগ্রেস বয়কট করলেও দেশীয় রাজ্যগুলি তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। সরকার এধরনের দেশীয় রাজ্যগুলিকে তার রক্ষাপ্রাচীরের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এই আনুগত্য অটুট রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংস্কারের কোনো তাগিদ দেখায় নি।

(৩) জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রতিরোধে ব্রিটিশকে সহায়তা

ভারতে ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যেমন – বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির সময় দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতেন। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “…. জাতীয়তাবাদী চ্যালেঞ্জ যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন এইসব ব্রিটিশভক্ত রাজপুরুষেরাই ব্রিটিশের সবচাইতে বিশ্বস্ত মিত্র ছিলেন।”

(৪) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশকে সহায়তা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশ যুদ্ধ তহবিলে ২৫ লক্ষ পাউন্ড দান করেন। গোয়ালিয়রের রাজাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু পদাতিক সৈন্য ও একটি হাসপাতাল-জাহাজ দিয়ে ব্রিটিশদের সহায়তা করেন। ব্রিটিশরা যখন তুর্কিদের কাছ থেকে হাইফা বন্দর দখল করে, তখন যোধপুরের অশ্বারোহী সেনারা ইংরেজদের যথেষ্ট সহায়তা করে।

(৫) ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস বিভিন্ন প্রদেশে বিপুল সাফল্য পেলে দেশীয় রাজ্যগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

(৬) কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশন

এরপর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে দেশীয় রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ না করার নীতি বাতিল হয়। ফলে অল ইন্ডিয়া স্টেটস পিপলস কনফারেন্স-এর নেতৃত্বে দেশীয় রাজ্যগুলিতে শীঘ্রই শুরু হওয়া গণ-আন্দোলনে কংগ্রেস সক্রিয় সমর্থন জানায়। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশীয় রাজ্যগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। অবশ্য বৃহৎ দেশীয় রাজ্যগুলি দৃঢ়তার সঙ্গে আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নেয় এবং ব্রিটিশ সরকার তাতে সহায়তা করে।

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশকে সহায়তা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জয়পুরের মহারাজা ইংরেজদের পক্ষে জয়পুর ইনফ্যান্টির নেতৃত্ব দেন। বার্মার যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে বুন্দির মহারাজা ইংরেজদের কাছ থেকে মিলিটারি ক্রস পদক লাভ করেন।

উপসংহার :- প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময় দেশীয় রাজ্যগুলিকে স্বাধীন থাকার অথবা ভারত বা পাকিস্তান-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতের এবং কিছু পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে শুধু নেপালভুটান, ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই যুক্ত না হয়ে স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছে।

(FAQ) দেশীয় রাজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দেশীয় রাজ্য কাকে বলে?

প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনের বাইরে অন্তত ৪০ শতাংশ ভূখণ্ডে বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এই সব রাজ্য সাধারণভাবে ‘দেশীয় রাজ্য’ বা ‘Princely States’ নামে পরিচিত ছিল।

২. দুটি বৃহৎ দেশীয় রাজ্যের নাম লেখ?

হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর

৩. দেশীয় রাজ্যগুলিতে ব্রিটিশ সরকার কোন কোন নীতি প্রয়োগ করে?

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ও স্বত্ববিলোপ নীতি

৪. দেশীয় রাজ্য হায়দ্রাবাদের শাসককে কি বলা হয়?

নিজাম

৫. চেম্বার অব প্রিন্সেস গঠন করা হয় কখন?

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে

Leave a Comment