১৯১২ ও ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে সংঘটিত বলকান যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলকান জাতীয়তাবাদ ধ্বংস, দমনমূলক নীতি, মুসলিম উপনিবেশ, বলকান লিগ গঠন, শাসন সংস্কার প্রবর্তনের দাবি, প্রথম বলকান যুদ্ধ, লণ্ডন চুক্তি, চুক্তির শর্ত, দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ, সার্বিয়ার ম্যাসিডোনিয়া দখল, যুদ্ধের সূচনা, বুখারেস্টের সন্ধি, সন্ধির শর্ত, বলকান যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি, হস্তক্ষেপের সুযোগ, অস্ট্রিয়ার ক্ষোভ, জটিলতা সৃষ্টি ও যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবো।
বলকান যুদ্ধ
প্রথম বলকান যুদ্ধ | ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ |
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ | ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ |
লণ্ডন চুক্তি | ৩০ মে, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ |
বুখারেস্টের সন্ধি | ১০ আগস্ট ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা:- মূলত ‘তরুণ তুর্কি আন্দোলন‘ -এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ১৯১২ ও ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বলকান জাতীয়তাবাদ ধ্বংস
ক্ষমতা লাভের সূচনায় ‘তরুণ তুর্কি’-রা নানা উদারনীতি গ্রহণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু কালক্রমে তারা বলকান জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করে।
দমনমূলক নীতি
অ-তুর্কি জাতিবর্গের প্রতি ‘তুর্কিকরণ নীতি এবং অ-মুসলিমদের প্রতি নানা দমনমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়। গ্রিক গির্জার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। ক্রিটের প্রতি দুর্ব্যবহার চলতে থাকে।
মুসলিম উপনিবেশ
ম্যাসিডোনিয়াকে দমন করার উদ্দেশ্যে সেখানে মুসলিম উপনিবেশ গড়ে তোলা হয়। আলবেনিয়ার স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার তৎপরতা শুরু হয়।
বলকান লীগ গঠন
এমতাবস্থায় তুর্কি সুলতানের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং নিজেদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের মন্ত্রী ভেনিজোলাসের নেতৃত্বে (মতান্তরে বুলগেরিয়ার রাজা ফার্দিনান্দ ) সার্বিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও মন্টেনিগ্রো—এই ঘরটি রাজ্য একত্রিত হয়ে ‘বলকান লিগ’ (Balkan League) গঠন করে।
শাসন সংস্কার প্রবর্তনের দাবি
‘বলকান লিগ’ ম্যাসিডোনিয়ায় খ্রিস্টান প্রজাদের উপর অত্যাচার বন্ধ করে অবিলম্বে সেখানে শাসনসংস্কার প্রবর্তনের দাবি জানায়।
প্রথম বলকান যুদ্ধ
তুরস্ক লিগের দাবি অগ্রাহ্য করলে বলকান লিগ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ প্রথম বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিত।
লণ্ডন চুক্তি
তুর্কি বাহিনী এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির মধ্যস্থতায় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে মে তুরস্ক ‘বলকান লিগ’-এর সঙ্গে ‘লন্ডন চুক্তি’ স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
লণ্ডন চুক্তির শর্ত
এই চুক্তির দ্বারা
- (১) কনস্টান্টিনোপল এবং থ্রেস-এর একাংশ ব্যতীত সমগ্র বলকান অঞ্চল স্বাধীনতা লাভ করে।
- (২) ক্রিট গ্রিসের অধিকারে আসে।
- (৩) আলবেনিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবেপ্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ
প্রথম বলকান যুদ্ধের পর তুরস্কের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন অঞ্চলের বিলি-বন্দোবস্ত বা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বলকান লিগের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ (১৯১৩ খ্রিঃ) নামে পরিচিত। ম্যাসিডোনিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত।
সার্বিয়ার ম্যাসিডোনিয়া দখল
লন্ডন চুক্তি অনুসারে আলবেনিয়া সার্বিয়ার হস্তচ্যুত হয়। এই কারণে সার্বিয়া ম্যাসিডোনিয়া দখলে করে তার ক্ষতিপূরণ করতে চায়।
যুদ্ধের সূচনা
ম্যাসিডোনিয়ার অধিকাংশ অধিবাসী বুলগার হওয়ায় বুলগেরিয়া এই স্থানের দাবি করে। সার্বিয়া বুলগেরিয়ার দাবি প্রত্যাখান করলে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে বুলগেরিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করে। এইভাবে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সূচনা হয়।
বুখারেস্টের সন্ধি
মন্টেনিগ্রো, গ্রিস ও রুমানিয়া সার্বিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। এই সম্মিলিত আক্রমণের চাপে পরাজিত বুলগেরিয়া শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগস্ট বুখারেস্টের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
বুখারেস্টের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধি দ্বারা বুলগেরিয়া
- (১) ম্যাসিডোনিয়ার বৃহৎ অংশ গ্রিস, সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রোকে ছেড়ে দেয়।
- (২) রুমানিয়া দোব্রুজা লাভ করে।
- (৩) তুরস্ক আড্রিয়ানোপল ও থ্রেসের কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করে। এইভাবে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ফলাফল
ইউরোপের ইতিহাসে বলকান যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –
(১) তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি
বলকান যুদ্ধের ফলে ইউরোপে তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রায় বিলুপ্তি ঘটে এবং তা একটিএশীয় শক্তিতে পরিণত হয়।
(২) হস্তক্ষেপের সুযোগ
বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান রাজ্যগুলির রাজ্যসীমা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও পারস্পরিক সম্প্রীতি ছিল না। এর ফলে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়।
(৩) গ্ৰিস ও সার্বিয়া লাভবান
এই যুদ্ধের দ্বারা সবচেয়ে লাভবান হয় গ্রিস ও সার্বিয়া এবং সবচেয়ে কম লাভ হয় বুলগেরিয়ার। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ বুলগেরিয়া অস্ট্রিয়া জার্মান শিবিরে যোগ দেয়। তুরস্ক অনেক আগেই এই শিবিরে যোগ দিয়েছিল।
(৪) অস্ট্রিয়ার ক্ষোভ
সার্বিয়ার সাফল্যে অস্ট্রিয়া ক্ষুব্ধ হয়, কারণ বলকানে স্লাভ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত কিছু অঞ্চল অস্ট্রিয়ার অধীনে ছিল। তারা অস্ট্রিয়ার অধীনতাপাশ থেকে মুক্তি চাইত।
(৫) জটিলতা সৃষ্টি
সার্বিয়া নিজেকে সর্ব স্লাভ আন্দোলনের নেতা মনে করে অস্ট্রিয়ার অধীনে বসবাসকারী স্নাভদের নানাভাবে উস্কানি দিত। অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে।
(৫)যুদ্ধ পরিস্থিতি
বলকান অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। সার্বিয়া রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলায়। অস্ট্রিয়া-সার্বিয়া এবং অস্ট্রিয়া-রাশিয়া দ্বন্দ্ব ইউরোপকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
উপসংহার:- বলকান যুদ্ধের পরিস্থিতিতে বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভো শহরে জনৈক সার্বিয় গুপ্তঘাতকের হাতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রান্সিস জোসেফ নিহত হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
(FAQ) বলকান যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে।
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।