১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন -এর পটভূমি হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, মুসলিম লীগের দাবি, বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্ভব, আইন পাস, আইনের বিভিন্ন দিক, আইনের সমালোচনা হিসেবে অনধিকার, দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার অভাব, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুরুত্বহীনতা, বড়োলাটের চূড়ান্ত ক্ষমতা, কংগ্রেসের অসন্তোষ, সাম্প্রদায়িক নির্বাচন, আইনের গুরুত্ব হিসেবে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, স্বায়ত্তশাসনের সোপান ও আইনের শাসনের ভিত্তি সম্পর্কে জানবো।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন

ঐতিহাসিক ঘটনা১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন
প্রবর্তন কাল১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ
প্রধান উদ্যোক্তাজন মর্লে ও লর্ড মিন্টো
অন্য নামকাউন্সিল আইন, ১৯০৯
উদ্দেশ্যভারতের আন্দোলনকে দুর্বল করা
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন

ভূমিকা:- ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে ভারত -এর কেন্দ্রীয় আইনসভায় মাত্র তিনজন মনোনীত সদস্যকে গ্রহণ করা হয়। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে সরকারের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে বেসরকারি সদস্য হিসেবে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু এই লোক-দেখানো সংস্কারে ভারতীয়রা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মলে-মিন্টো শাসন সংস্কার নামে একটি নতুন আইন প্রবর্তন করে।

মর্লে-মিন্টো আইনের পটভূমি

১৯০৯ সালে ভারতে মলে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তনের কারণলি হল নিম্নরূপ –

(১) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ

আগেকার আইনগুলির মাধ্যমে আইন পরিষদে বেশি সংখ্যায় ভারতীয় সদস্যের প্রবেশের সুযোগ ছিল না। আইন পরিষদে বেশি সংখ্যায় নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ এবং তাদের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার দাবিতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সোচ্চার হয়।

(২) বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন তীব্রতা লাভ করলে সরকার বিপাকে পড়ে যায়। কংগ্রেসে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটলে সরকারের পক্ষে তাদের আন্দোলনের মোকাবিলা করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

(৩) মুসলিম লিগের দাবি

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলিম লিগ -এর নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে তাদের সদস্যদের পৃথক নির্বাচনের দাবি জানায়।

(৪) সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের উদ্ভব

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের একটি ধারা ক্রমে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে পরিণত হলে সরকার আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলন সরকারকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়।

মলে-মিন্টো আইন প্রণয়ন

এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার জন্য ভারত সচিব জন মর্লে এবং বড়োলাট লর্ড মিন্টো কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করার উদ্দেশ্যে একটি শাসনসংস্কারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত এই শাসনসংস্কার মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার বা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইন নামে পরিচিত।

মর্লে-মিন্টো আইনের বিভিন্ন দিক

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মলে-মিন্টো সংস্কার বা কাউন্সিল আইন প্রবর্তনের প্রধান দুটি দিক হল–

  • (ক) কার্যনির্বাহক পরিষদ এবং
  • (খ) আইন পরিষদ।

(ক) কার্যনির্বাহক পরিষদ

কেন্দ্রে ও বিভিন্ন প্রদেশে কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন–

(১) ভারতীয় সদস্য গ্রহণ

বড়োলাটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ এবং প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে বড়োলাটের কার্যনির্বাহ পরিষদে প্রথম সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ (লর্ড সিন্হা)।

(২) সদস্য গ্ৰহণ বাধ্যতামূলক নয়

প্রাদেশিক পরিষদে ভারতীয় সদস্য গ্রহণের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হলেও বাংলার কার্যনির্বাহক পরিষদে রাজা কিশোরী লাল গোস্বামীকে পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

(৩) সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি

বাংলা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশের গভর্নরের কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২ জন থেকে বাড়িয়ে ৪ জন করা হয়।

(খ) আইন পরিষদ

মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের গঠন ও ক্ষমতার বিষয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ গৃহীত হয়।যেমন –

(১) কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা

কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬০ জন করা হয়। এঁদের মধ্যে ২৮ জন সদস্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতেন, ২৭ জন সদস্য জমিদার শ্রেণি, মুসলিম সম্প্রদায়, বোম্বাই ও কলকাতার বণিকসভা এবং প্রাদেশিক আইনসভাগুলির দ্বারা নির্বাচিত হতেন। বাকি ৫ জন সদস্যকে ভাইসরয় বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করতেন।

(২) আইন পরিষদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা

এর ফলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সরকারি ও মনোনীত সদস্যরা মিলে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে (অর্থাৎ ২৮+৫ = ৩৩ জন) পরিণত হন।

(৩) বাজেট পরিকল্পনা

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলি বাজেট তৈরি, বাজেট পাস বাজেট সম্পর্কে আলোচনা ও ভোটদানের অধিকার পায়।

(৪) সুপারিশ করার ক্ষমতা

আইন পরিষদ, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায়।

(৫) মুসলিম সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচন

মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।

(৬) প্রাদেশিক আইন পরিষদ

প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির সদস্যসংখ্যা ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে রাখা এবং নির্বাচিত সদস্যসংখ্যার তুলনায় মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা সর্বদা বেশি থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

(৭) সদস্যদের অপসারণ

গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাদের অপছন্দের যে-কোনো সদস্যকে আইন পরিষদ থেকে অপসারণের অধিকার পান।

মর্লে-মিন্টো আইনের সমালোচনা

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো আইন বা কাউন্সিল আইনের সমালোচনা করা হয়। যেমন—

(১) অনধিকার

দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বৈদেশিক নীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনো প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার ছিল না।

(২) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার অভাব

এই আইনের দ্বারা ভারতবর্ষে কোনো দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।

(৩) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুরুত্বহীনতা

জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোনো ক্ষমতা বা তাদের মতামতের আদৌ কোনো গুরুত্ব ছিল না।

(৪) বড়োলাটের চূড়ান্ত ক্ষমতা

মর্লে-মিন্টো আইনের মাধ্যমে বড়োলাট আইনসভার যে-কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সংশোধন বা বাতিল করার অধিকারী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি নিজ পছন্দের বেসরকারি সদস্যদের মনোনীত করতেন, যাঁরা বড়োলাটের ইচ্ছানুসারে কাজ করতেন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে বড়োলাটের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।

(৫) কংগ্রেসের অসন্তোষ

এই আইনের দ্বারা কংগ্রেসের চরমপন্থী অংশকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্যদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের দাবিদাওয়াও এই আইনের দ্বারা পূরণ করা হয়নি। ফলে কংগ্রেসের নরমপন্থী এবং চরমপন্থী উভয় গোষ্ঠীই মর্লে-মিন্টো আইনে অসন্তুষ্ট হয়েছিল।

(৬) সাম্প্রদায়িক নির্বাচন

এই আইনের দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জোগায়।

মর্লে-মিন্টো আইন সম্পর্কে স্পিয়ারের অভিমত

ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনকে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রথম সরকারি উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

মর্লে-মিন্টো আইন সম্পর্কে বিপান চন্দ্রের অভিমত

ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র লিখেছেন, “মুসলিম স্বাতন্ত্রের দাবিকে প্রশ্রয় দিয়ে ব্রিটিশ সরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কঠিন পথকে আরও কঠিন করে।

মর্লে-মিন্টো আইনের গুরুত্ব

বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন —

(১) বেসরকারি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি

মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারাই ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে বেসরকারি সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। বড়োলাটের শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করে সরকারি প্রশাসনে ভারতীয়দের যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।

(২) স্বায়ত্ত শাসনের সোপান

এই আইনের দ্বারা ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ব্রিটেনের সাংসদ হেনরি কটন এই আইনকে ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি ধীর পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন।

(৩) আইনের শাসনের ভিত্তি

মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা মোগল যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশরাজের সাংবিধানিক রীতিনীতি ও আইনের শাসনের ধারণা যুক্ত হয়।

উপসংহার:- ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন, “ভারতে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্ন ছিল।

(FAQ) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. ১৯০৯ সালের শাসন সংস্কার আইন কাদের নাম অনুসারে পাস করা হয়?

ভারত সচিব জন মর্লে ও ভারতের বড়োলাট লর্ড মিন্টো।

২. বাংলার কার্যনির্বাহক পরিষদে সদস্য হিসেবে কোন ভারতীয়কে গ্ৰহণ করা হয়?

রাজা কিশোরী লাল গোস্বামীকে।

৩. কোন আইনে পৃথক নির্বাচনের কথা প্রথম বলা হয়?

মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন।

৪. কোন আইনকে ভারতে স্বায়ত্তশাসনের সোপান বলা হয়?

মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইন।

Leave a Comment